উইকিঅভিধান আলোচনা:অ্যাকাউন্টের জন্য অনুরোধ
দারুল মা্আ’রিফলামী রিসার্চ সেন্টার কান্দিগ্রাম
সম্পাদনাকোরআন সুন্নাহর আলোকে বিশুদ্ধ আক্বীদামাওলানা আব্দুল হাই জেহাদী
কোরআন সুন্নাহর আলোকে বিশুদ্ধ আক্বীদা
ইনসাফের মানদন্ডে মাওলানা মওদুদী
সূচীপত্র
প্রারম্ভিকতা লেখকের কথা/ভুমিকা সম্পাদকের কথা প্রকাশকের কথা প্রথম (১) অধ্যায় ঈমান আমল ইসলাম কুফর শিরক আক্বীদা: সংজ্ঞা গুরুত্ব, তাৎপর্য ও বিষয়বস্তু আক্বীদার আভিধানিক সংজ্ঞা পরিভাষা গত অর্থে আক্বীদা ইলমুল আক্বায়ীদ এর গুরুত্ব আল-ফিক্বহ: বিশুদ্ধ আক্বীদা বিশ্বাস আক্বীদা: বিশ্বাস ও তাওহীদের নাম ঈমান: আল কুরআনে ঈমান বা বিশ্বাসের গুরুত্ব - পরিশুদ্ধ আক্বীদা বলতে যা বুঝায় আক্বীদার কয়েকটি পরিভাষা ইলমুল আক্বায়ীদ এর আলোচ্য বিষয় ও উদ্দেশ্য ঈমান আক্বীদার পারস্পরিক সম্পর্ক ঈমান আক্বীদার মৌলিক পার্থক্য ও সম্পর্ক আক্বীদাহ'র ব্যবহারগত প্রকারভেদ আক্বীদা বিশ্বাসের মৌলিক ভিত্তি ইসলামী আক্বীদার উৎস ইলমুল আক্বায়ীদের প্রসিদ্ধ ইমামদের পরিচিত ইমাম মাতুরিদীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ইমাম আশআরী ইমাম ত্বাহাবী আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের পরিচিতি নামকরণের কারণ আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের ধারাবাহিকতা নামকরণের উৎপত্তি ও উদ্দেশ্য সাহাবাগন আহলূস সুন্নাহ নাম ব্যবহার করতেন নাম করণের শরয়ী ভিত্তি আহলে সুন্নাহ জামায়াতের মূলনীতি আহলে সুন্নত জামায়াতের প্রসিদ্ধির কারণ- দ্বীনের বিষয়ে বিবাদ বিতর্ক বিদআত আহলে সুন্নত জামায়াতের নাম আশআরিয়া কেন আল্লামা মুরতাযা জাবেদী আহলে সুন্নাহ জামায়াতের নাম মাতুরিদিয়াকেন কার ফতোয়ায় কে কাফের কে গোমরাহ
দ্বিতীয় অধ্যায়
আক্বীদা: আল্লাহর অবস্থান আল্লাহ সম্পর্কে আক্বীদা আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে ৩টি মত আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে আল-কুরআন আল্লাহ তায়ালা আছেন আরশের উপরে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির তুলনা করা কুফরী হাদীস দ্বারা প্রমাণ আইম্মা মুজতাহিদীনদের অভিমত ওয়াহদাতুল উজুদ কি ওয়াহদাতুশ শুহুদ কি ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ বিষয়ে আল কুরআন ও আইম্মা ও ওলামায়ে কেরামের মতামত ওয়াহদাতুলউজূদ ও শুহুদ বিষয়ে আহলে হাদীস মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী রঃ ওয়াহদাতূল উজুদ : দেওবন্দী আক্বীদা ফতেহ মুহাম্মদ পানিপতি দেওবন্দী রঃ পরিচিত সকল সুফিই ওয়াহদাতুল উজুদের প্রবক্তা আয়িম্মা ও ওলামায়ে কেরামের মতামত দেওবন্দীরাও ওয়াহদাতুল উজুদের প্রবক্তা ওয়াহদাতুল উজুদ ও কাদিয়ানী দেওবন্দী
তৃতীয় অধ্যায় কিতাব,রেসালত,ফেরেশতা ও আখেরাত তক্বদীর
নবী-রাসুল,সম্পর্কে আক্বীদা নবুওতের পরিচয়,অহী ও উদ্দেশ্য মুহাম্মদ (সাঃ) সর্বশেষ নবী কাদিয়ানীরা কাফের আসমানী কিতাব সম্পর্কে আক্বীদা তক্বদীর সম্পর্কে আক্বীদা আখেরাত সম্পর্কে আক্বীদা কিয়ামত সম্পর্কে আক্বীদা হাওজে কাওসার সম্পর্কে আক্বীদা হাওজে কাওসার সম্পর্কে মাওলানা মওদুদী রঃ শাফায়াত সম্পর্কে আক্বীদা মীযান ও পুলসিরাত জান্নাত ও জাহান্নাম সম্পর্কে আক্বীদা
চতুর্থ অধ্যায় ঃ ইসমতে আম্বিয়া
সায়্যদ আবুল আলা মওদুদী'র (রঃ) উক্তি আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ: কোরআনের দলীলে নবীগন নিস্পাপ মুজতাহিদীনও ওলামায়ে কেরামের মতামত তওবার ফজিলত: তওবা একটি ইবাদত তওবাকারীদের শাস্তি স্পর্শ করবেনা তাক্বওয়া অবলম্বনকারীরা সতর্ক হয়ে যায় প্রত্যেকের জন্যই তওবা করা আবশ্যক হযরত আদম (আঃ) এর দোয়া হযরত নুহ (আঃ) এর দোয়া মুসা (আঃ) এর দোয়া দাউদ (আঃ) এর তওবাইউসুফ আঃ এর ঘটনা লুত (আঃ) এর ঘটনা শুয়াইব (আঃ) এর ঘটনা মুহাম্মদ সাঃ কে তওবার নির্দেশ সম্পর্কিত আয়াত জালালাইনের অনুবাদে মারাত্মক জালিয়াতি তওবা ইস্তেগফার সম্পর্কে মাওলানা মওদুদী (রঃ) মওদুদীর (রঃ) উপর আনিত ভিত্তিহীন অভিযোগ মাওলানা মওদুদী (রঃ) সুরা এ 'নাসর' এর তাফসীরে যেটা বুঝাতে চেয়েছেন কোরআনে বর্ণিত আম্বিয়া এ কেরামের কিছু ঘটনাবলী আদম হাওয়ার (আঃ) নিষিদ্ধ গাছের ফল বক্ষন মওদুদী কে অপবাদ দিতে ইমাম আবু হানিফার (রঃ) ফতোয়া কাটছাট বিবেকের আদালতে ইনসাফের মানদন্ডে বিচার। কোন মুমিনকে কাফির বলা কি জায়েজ। মাওলানা মওদুদী ও জামায়াতিদের মুসলমানিত নিয়ে¡ গর্হিত প্রশ্ন? সাহাবা সমালোচনার ভিত্তিহীন অভিযোগ
পঞ্চম অধ্যায় আক্বীদাঃ মুজেযা কারামত ইস্তেদরাজ
মুজেযা কি ইস্তেদরাজ কি ফেরাসত তিন প্রকার অবস্থা ভেদে মুজেমা ও কারামতি প্রদান করা হয় মুহাম্মদ সাঃ এর প্রধান মুজেযা কুরআন জাদুর সংজ্ঞামুজিযা ও যাদঙর মুজিযা ও জাদুর পার্থক্য
ষষ্ট অধ্যায় অধ্যায় খেলাফত ও মলুকিয়ত:
জাষ্টিস আল্লামা তক্বী উসমানির জবাবে জাষ্টিস আল্লামা গোলাম আলী (র:) আলী রাঃ হেদায়ত প্রাপ্ত চার খলিফার অন্যতম রাজতন্ত্র ও খেলাফতের পার্থক্য। আদম আঃ এর নিষিদ্ধ ফল বক্ষণ: কোরআনিক পর্যালোচনা ইউসুফ আঃ এর নিস্পাপত্বঃ মওদুদীর বক্তব্য আদম আঃ এর সমালোচনার অভিযোগ পর্যালোচনা ফেরাকে বাতিলা ফতোয়া নিজেই বাতিল পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম হিন্দু? রাজতন্ত্র ও ইমাম হোসাইন ( রাঃ) নবীগনের সমালোচনা: কার দায় কার ঘাড়ে? মাওলানা মওদুদী ঃ নবীদের ’ গোনাহ’ নয় ’ভুল ত্রæটি বলেছেন, চরমোনাইর আক্বীদা আমাদের কথা আবুল আলা ঃ ’আলা’ আল্লাহর নাম নয় আবুল আলা নাম শিরক হলে মাওলানা শিরক নয় কেন? তানক্বিদ কি: ওসিলা: সংজ্ঞা ও পরিভাষা ওসিলা: সহী ও ভ্রান্ত আক্বীদা
প্রথম অধ্যায়
ঈমান ঃ সঃজ্ঞা,ভিত্তি ও বিষয়বস্তু
আভিধানিক সংজ্ঞা ঃ
ঈমানের সংজ্ঞা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে- فالإيمان لغة: التصديق، واصطلاحًا: قول باللسان، وتصديق بالجنان (القلب) وعمل بالأركان (الجوارح)، قال الإمام أحمد بن حنبل: الإيمان قول وعمل، يزيد وينقص. وقال الإمام البغوي: اتفقت الصحابة، والتابعون، فمن بعدهم من علماء السنة على أن الأعمال من الإيمان... وقالوا: إن الإيمان قول، وعمل، وعقيدة. اهـ من
ঈমানের আভিধানিক অর্থ সত্যায়ন করা বিশ্বাস করা । পরিভাষিক অর্থে মুখে স্বীকার করা অন্তরে বিশ্বাস স্থাপন করা এবং বিশ্বাস ও স্বীকৃতিকে কাজে রূপান্তর করা। ইমান আহমদ ইবনে হাম্বল (রঃ) বলেছেন ঈমান বৃদ্ধি ও ক্ষয় হয়। ইমাম বগভী (রঃ) বলেছেন সাহাবায়ে কেরাম তাবেয়ীন তবে তাবেয়ীন যা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত নামে পরিচিত তাদের ঐক্যমত্য হলো আমল হচ্ছে ঈমানের বহিপ্রকাশ। আর তারা এও বলেছেন যে ঈমান হলো মুখের স্বীকৃতি কাজে বাস্তবায়ন করা এবং আক্বীদা। এর ই কথাগুলোর ই সুবিন্যস্থ সাব্যস্থ পরিভাষা হলো যা বিভিন্ন শব্দে ও বাক্যে সংজ্ঞায়িত হয়ে তাকে। যেমন বলা হয়েছে যে- وهذا لفظ مسلم، والحديث دليل على إدخال الطاعات في الإيمان، سواء كانت قولية، أم قلبية، أم عملية، قال الإمام ابن القيم في كتاب الصلاة: الإيمان أصل له شعب متعددة، وكل شعبة تسمى إيمانا، فالصلاة من الإيمان، وكذلك الزكاة، والحج، والصوم، والأعمال الباطنة، كالحياء، والتوكل... যার সার কথা হলো এটা একটা বিধিত শব্দ যার পক্ষে হাদীসে দলীল রয়েছে যে ঈমানের সম্পর্ক ক্বলবের সাথে আর তার বহিপ্রকাশ ঘটে আমলের মাধ্যমে। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ) কিতাবুস সালাত এ বলেছেন ঈমান একটি মৌলিক বিষয় যার প্রতিটি শাখায় তা বিকশিত হয়। আর প্রত্যেকটিই ঈমানের সাথে সম্পর্কিত ও বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন সালাত ঈমানের ই আরেক নাম, রোজা হজ্ব ও জাকাত সহ বাতেনি আমলও ঈমানের ই আরেক নাম। যেমন লজ্জা ও তাওয়াক্কুল এটাও ঈমানেরই আরেক রূপ।
মর্ম ঃ ইমান إِيمَان আরবি শব্দ। আরবী ‘আমনুন’ শব্দ থেকে এর উৎপত্তি। এর শাব্দিক অর্থ বিশ্বাস,স্বীকৃতি দেয়া,স্বীকার করা, অনুগত হওয়া, দৃঢ় বিশ্বাস করা। এর বিপরিত শব্দ কুফর বা অস্বীকার করা বা অবাধ্যতার করা হৃদয়ের স্থিতি। এ ছাড়া আনুগত্য করা, শান্তি, নিরাপত্তা,অবনত হওয়া, এবং আস্থা অর্থেও ইমান শব্দটি ব্যবহৃত হয়। (আরবী অভিধান)
পরিভাষিক সংজ্ঞা ঃ প্রচলিত বা ইসলামী পরিভাষায়,ধর্মবিশ্বাস বোঝাতে পবিত্র কোরআন হাদীসে ঈমান শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আর বিশ্বাসী বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে মুমিন শব্দটি। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস,মুখে স্বীকৃতি এবং বিশ্বাস ও স্বীকৃতির আলোকে কাজের মাধ্যমে তা প্রকাশ করার নাম ঈমান।
মাওলানা সায়িদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ও ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ) এর মতামত সমর্থন করে বলেছেন ইমানের বাজ্যিক রূপ হলো ইসলাম যার বিকশিত রূপ হলো দ্বীন । এর একটি আরেকটির সম্পুরক হলেও ঈমানের পরিমাপ পাওয়া যায় আমলের মাধ্যম। তিনি ইহসান কেও ঈমানের অন্তর্ভূক্ত বলেছেন। (রাসায়িল ও মাসায়িল। ঈমানের হাকিকত,তাফহীমুল কোরআন,তাফহীমাত,তাসাউফ)
হাদীসের ভাষায় ঈমান ও ইসলামের পরিচিতিঃ
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর খেদমতে জিবরাঈল (আঃ) এসে ঈমান ও ইসলামের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করেন এবং আল্লাহে রাসুল (সাঃ) এর জবাব দেন। এতেই ঈমান ও ইসলামের মূল বিষয় গুলো প্রকাশ পায়। এই দীর্ঘ হাদীসটিকে হাদীসে জিবরীলও বলা হয়। যার শেষাংশে বলা হয়েছেÑفقال رسول الله صلى الله عليه وسلم " الاسلام ان تشهد ان لا اله الا الله وان محمدا رسول الله وتقيم الصلاة وتوتي الزكاة وتصوم رمضان وتحج البيت ان استطعت اليه سبيلا . قال صدقت অর্থাৎ- রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন- ইসলাম বলতে বুঝায় যে, তুমি সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল এবং তুমি সালাত কায়েম করবে, যাকাত দেবে, রমজানের রোজা রাখবে এবং কাবা গৃহে হজ সম্পাদন করবে যদি আপনি খরচ বহন করার ক্ষমতা রাখেন। তিনি (জিজ্ঞাসাকারী) বললেনঃ তুমি সত্য বলেছ। (মুসলিম, ঈমান অধ্যায় ১)
মুজতাহিদীনে কেরামের ব্যাখ্যামতে ঈমানের সংজ্ঞা ঃ ইমাম আবু হানিফা (রঃ) বলেছেন,‘আন্তরিক বিশ্বাস ও মৌখিক স্বীকৃতিই হলো ঈমান’। ইমাম শাফেয়ী (রঃ) ইমাম মালেক (রঃ)ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রঃ) এর-মতে, অন্তরের বিশ্বাস,মৌখিক স্বীকৃতি এবং আরকানসমূহ (ইসলামের বিধি-বিধান) কাজে পরিণত করার নাম ঈমান। ইমাম গাজালী (রঃ) বলেছেন-‘রাসুল (সাঃ) এর আনীত সকল বিধি-বিধানসহ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাই হচ্ছে ঈমান’। সমকালীন বিশ্বের ইসলামী স্কলারদের ব্যাখ্যামতে আল্লাহ তা‘য়ালার পক্ষ থেকে নবী (সাঃ) যত বিধি-বিধান নিয়ে এসেছেন এবং তা যথাযত দলীলে সত্যপ্রমাণিত হয়েছে তার কোন একটি বাদ না দিয়ে সব গুলোকে ’তাসদিক বিল জেনান’ বা মনে প্রাণে বদ্ধমূল বিশ্বাস করে এর রুকন সমূহ পালন বা ’আমল বিল আরকান’ এর নাম ঈমান। আল্লাহ তা‘য়ালার আদেশ-নিষেধ সঠিক এবং পূর্ণভাবে আমল করার সমন্বিত নাম ঈমান ই কামিল বা পরিপূর্ণ ঈমান। (মাওলানা সায়িদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ)
ঈমানের মূল ভিত্তি ঃ
ঈমানের মূল ভিত্তি হলো দুটি এর পক্ষে কোরআন হাদীসে বিস্তর দলীল রয়েছে। এই দুটি হলো যথা- (ক) তাওহীদ বা অদ্বিতীয়বাদ ঃ এর মূল বাক্য কলিমার প্রথমাংশ-লা ইলাহা ইল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন ঈলাহ নেই এই বাক্যে তাওহীদের মন্ত্র আছে। এই ইলাহ শব্দের মধ্যে গোটা সৃষ্টিজগতের প্রভুত্ব মালিক এবং সমূহ মাখলুকাতের পরিচালক ও অধিকর্তা একমাত্র অদ্বিতীয় আল্লাহ এটাই বুঝায় যা একটি বাক্যে প্রকাশ হয় তওহীদ শব্দের মধ্যে। তাই এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করায়ে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই,কোনো উপাস্য নেই। তিনি একক,অদ্বিতীয়। তিনি সব পারেন,সব করেন। সব ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব একমাত্র তারই অধীন। তিনি সব ধরণের দুর্বলতা,ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ও পবিত্র। সামান্য থেকে সামান্যতম বিষয়েও সবাই তার মুখাপেক্ষী, কিন্তু তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন-এমন বিশ্বাস লালন করা।
(খ) রেসালত ঃ বা আল্লাহর প্রতিনিধিত্বকারী ব্যাক্তি যার কাছে আল্লাহর বার্তা আসে। যেটা কালেমার দ্বিতীয় অংশ বলা হয়েছে‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’বলে। অর্থাৎ হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসুল এবং তিনি সর্বশেষ নবী,তাঁর পরে আর কোন নবী আসবেন না। এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা এবং মেনে নিয়ে তাঁর সুন্নাহ বা আদর্শ অনুস্মরণ করে জীবন যাপন করা। এই ঈমান ই হলো মানব জীবনের মহামূল্যবান সম্পদ বা নেয়ামত। ঈমানের বিপরীত হলো কুফর, ঈমান হলো সত্য, কুফর হলো মিথ্যা,ঈমান হচ্ছে আলো,কুফর হলো অন্ধকার।
তাওহীদ ঃ গুরুত্ব তাৎপর্য্য ও প্রকারভেদ। আল্লাহর একত্ব বা অদ্বিতীয়বাদ কে ইসলামী পরিভাষায় তাওহীদ বলে। তাওহিদ হল ইসলামের মূল বিশ্বাস। একজন মুসলমানের সম্পূর্ণ ধর্মীয়আনুগত্য নির্ভর করে তাওহীদ বিশ্বাসের উপর। তাওহীদের মৌলনীতি ও দাবী হচ্ছে একত্ববাদ বা অদ্বিত্বীয়বাদ। আরো সহজ বাক্যে আল্লাহর কোন শরীক নেই এটা কথা ও কাজে বিশ্বাস রাখা। তাই ইবাদতের একমাত্র উপযুক্ত একমাত্র আল্লাহ এই বিশ্বাস রাখা ও আমলে প্রতিফলিত করা। সেই সাথে আল্লাহ প্রেরিত সকল নবী রাসুলগণই সত্য এবং সত্যের বাহক হিসাবে এসেছিলেন এবং তারা সকলেই তাওহীদ ও আখেরাতের দাওয়াত দিয়েছিলেন এই বিশ্বাস রেখে নবী-রাসুলগণের মধ্যে কারো প্রতি কোন রকমের বৈশিষ্ট্যতার পার্থ্যক্য না করা। এর পক্ষে কোরআন হাদীসে দলীল রয়েছে।
তাওহীদ গোটা মানব জাতির মুল বিষয় ঃ তাওহীদ বনী আদমের মূল বিষয়। পরে তাদের মধ্যে শিরক প্রবেশ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً فَبَعَثَ اللَّهُ النَّبِيِّينَ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ وَأَنْزَلَ مَعَهُمُ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِيَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ فِيمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ ‘‘প্রথমে সব মানুষ একই পথের অনুসারী ছিল। তাদের মধ্যে যখন মতভেদ শুরু হলো তখন আল্লাহ নবীদেরকে পাঠালেন। তারা ছিলেন সঠিক পথের অনুসারীদের জন্য সুসংবাদদাতা এবং বেঠিক পথ অবলন্বনের পরিণতির ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শনকারী। আর তাদের সাথে সত্য কিতাব পাঠান,যাতে সত্য সম্পর্কে তাদের মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছিল তার মীমাংসা করা যায়’’। (বাকারা: ২১৩) আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, আদম (আঃ) থেকে শুরু করে নূহ (আঃ) এর জাতি পর্যন্ত একহাজার বছরের ব্যবধান ছিল। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সকল মানুষই তাওহীদের উপর ছিল। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেন, উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় এ কথাটি সঠিক। ইমাম ইবনে কাছীরও এ কথাকে সহীহ বলেছেন। অতঃপর নূহ (আঃ) এর জাতির মধ্যে সর্বপ্রথম শিরকের আবির্ভাব হয়। কতিপয় সৎ লোককে নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণেই তাদের মধ্যে শিরক প্রবেশ করে।
পৃথিবী তাওহীদ মুক্ত না হলে ক্বিয়ামত হবেনা যখন পৃথিবী তাওহীদ মুক্ত হবে, তখনই কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে। নবী করীম (সাঃ) বলেছেনلَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى لَا يُقَالَ فِي الْأَرْضِ اللَّهُ اللَّهُ ‘‘পৃথিবীতে যতদিন আল্লাহ আল্লাহ বলা হবে ততোদিন কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে না’’ (মুসলিম,কিতাবুল ঈমান।) কোরআনে করীমে তাওহীদের সংজ্ঞা গুরুত্ব ও তাৎপর্য্য সম্পর্কে বিশদ আলোচনা রয়েছে আমরা এখানে এর কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরছি। তার আগে তাওহীদের প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা করলে তওহীদ সম্পর্কে বুঝতে সুবিধা হবে। বিশ্বাসের দিক থেকে তাওহীদ বা অদ্বিতীয়বাদ তিন প্রকার। এ গুলো হচ্ছে-
তাওহীদুল আছমা ওয়াস্ সিফাত : আল্লাহ্র নাম ও গুণাবলী সমূহ যা ক্বোরআন ও ছুন্নাহতে বর্ণিত রয়েছে, সেগুলোর কোনরূপ পরির্বতন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং সৃষ্ট কোন বস্তুর সাথে সেগুলোর কোন প্রকার তুলনা, উপমা, সদৃশ কিংবা আকার-আকৃতি, উৎপ্রেক্ষা নির্ধারণ না করে ক্বোরআন ও ছুন্নাহ্তে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, বাহ্যিক অর্থসহ হুবহু সেগুলোর প্রতি দৃঢ়ভাবে ঈমান পোষণ করা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন:- لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ. অর্থাৎ- কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। ( সুরা শুরা ১১) তাই আল্লাহ তায়ালা নিজে তাঁর যে সকল নাম ও গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, রাছূল (সাঃ) থেকে আল্লাহ্র যে সব নাম ও গুণাবলি বর্ণিত হয়েছে এবং যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, বাহ্যিক অর্থসহ হুবহু সেগুলোর প্রতি দৃঢ় ঈমান পোষণ করার নাই ঈমান বিত্তাওহীদ।তাতে শব্দগত কিংবা অর্থগত কোনরূপ পরিবর্তন,পরিবর্ধন, বিবর্তন, সংযোজন-বিয়োজন না করা এবং নিজের পক্ষ থেকে আল্লাহ্র কোন নাম বা গুণ সাব্যস্থ না করা। যারা আল্লাহ্র নাম ও গুণাবলির ক্ষেত্রে এরকম কিছু করে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ ফরমান-وَلِلّهِ الأَسْمَاء الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُواْ الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَآئِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُواْ يَعْمَلُونَ. অর্থাৎ-আর আল্লাহ্র জন্য রয়েছে উত্তম নামসমূহ। কাজেই সেসব নাম ধরেই তাঁকে ডাকো। আর তাদেরকে বর্জন করো, যারা তাঁর নামের ব্যাপারে বাঁকা পথে চলে। তারা নিজেদের কৃতকর্মের ফল শীঘ্রই পাবে। (সুরা আল আ‘রাফ ১৮০) এরশাদ হচ্ছে- ہُوَ اللّٰہُ الۡخَالِقُ الۡبَارِئُ الۡمُصَوِّرُ لَہُ الۡاَسۡمَآءُ الۡحُسۡنٰی ؕ یُسَبِّحُ لَہٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَالۡاَرۡضِ ۚ وَہُوَالۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ অর্থাৎ তিনিই আল্লাহ, যিনি সৃষ্টিকর্তা, অস্তিত্বদাতা, রূপদাতা,সর্বাপেক্ষা সুন্দর নামসমূহ তাঁরই, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা-কিছু আছে তা তাঁর তাসবীহ পাঠ করে এবং তিনিই ক্ষমতাময়,হেকমতের মালিক।” আল্লাহ্র নাম ও গুণাবলির কোন কিছুকে অস্বীকার করা সুস্পষ্ট কুফ্রী আর এর সমকক্ষ কাউকে মনে করা শিরকী। আল্লাহ তায়ালা বলেছেনÑ كَذَلِكَ أَرْسَلْنَاكَ فِي أُمَّةٍ قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِهَا أُمَمٌ لِّتَتْلُوَ عَلَيْهِمُ الَّذِيَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَهُمْ يَكْفُرُونَ بِالرَّحْمَـنِ قُلْ هُوَ رَبِّي لا إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ مَتَابِ. অর্থাৎ- এমনিভাবে আমি আপনাকে একটি উম্মাতের মধ্যে প্রেরণ করেছি। তাদের পূর্বে অনেক উম্মাত অতিক্রান্ত হয়েছে। যাতে আপনি তাদেরকে ঐ নির্দেশ পড়ে শুনান,যা আমি আপনার কাছে প্রেরণ করেছি,তথাপি তারা দয়াময়কে অস্বীকার করে। বলুন! তিনিই আমার পালনকর্তা। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আমি তাঁর উপরই ভরসা করেছি এবং তাঁর দিকেই আমার প্রত্যাবর্তন। (সুরা আর রা‘দ- ৩০) “আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত,আল্লাহ্ তায়ালার ঐ সকল পরিপূর্ণ গুণাবলিই নির্ধারণ করেন, যা আল্লাহ তায়ালা নিজের জন্য নির্ধারণ করেছেন এবং ঐসকল গুণাবলি প্রত্যাখ্যান করেন,যা আল্লাহ তায়ালা নিজের জন্য পছন্দ করেননি। আল্লাহ্র নাম ও গুণাবলী নির্ধারণ ও প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে সম্পূর্ণরূপে ক্বোরআন ও সুন্নাহ্র উপর নির্ভর করেন। ইমাম মালিক (রঃ) বলেছেন,আল্লাহ্র সকল সুন্দর নামরাজি ও মহান গুণাবলির ক্ষেত্রে এটাই হলো আহলে ছুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মূলনীতি যে এ গুলোর কোন তুলনা বা সমকক্ষতা হয়না। আর এ নীতিকে অনুসরণ করাই সকল মুসলমানের অপরিহার্য কর্তব্য।
উলুহিয়্যাত ঃ তাওহীদ ই উলুহিয়্যাত বা ইলাহ এর অদ্বিতীয়বাদ ঃ এর মর্ম হলো প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল কথা ও কাজ তথা সকল প্রকার এবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কোন বস্তুর বা জন্তুর ব্যক্তির এবাদতকে অস্বীকার করার নাম তাওহীদে উলূহিয়্যাহ। গোটা মাখলুকাতে ইলাহ বা মাবুদ হবার হুকুম বাা আইন-কানুন দেবার, ইবাদত পাবার উপযুক্ত অধিকারী একমাত্র আল্লাহ। যেমন আল্লাহ্ তা’য়ালা বলেন- وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُوا إِلاَّ إِيَّاهُ ‘‘আপনার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া তোমরা অন্য কারো এবাদত করবে না’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ২৩) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ-وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلاَ تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا ”তোমরা আল্লাহর এবাদত কর এবং তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করো না’’। (সূরা নিসাঃ ৩৬) আল্লাহ আরো বলেনঃ-إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمْ الصَّلاَةَ لِذِكْرِي ‘‘আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া সত্য কোন মা’বুদ নেই। অতএব, আমার এবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে নামায কায়েম কর’’।(সূরা তোহাঃ ১৪) এটিই (لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ) এর সরল ও সঠিক ব্যাখ্যা। সুরা বাক্বারার ১৬৩ নম্বার আয়াতে এ প্রসঙ্গে এরশাদ হচ্ছেÑ وَاِلٰـہُکُمۡ اِلٰہٌ وَّاحِدٌ ۚ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ الرَّحۡمٰنُ الرَّحِیۡمُ অর্থাৎঃ তোমাদের ইলাহ/মাবুদ একই আল্লাহ, তিনি ছাড়া অন্য কোনও ইলাহ বা মাবুদ নেই। তিনিই দয়াবান সকলের প্রতি পরম দয়ালু। এরশাদ হচ্ছে- وَمَا مِنۡ اِلٰہٍ اِلَّا اللّٰہُ ؕ وَاِنَّ اللّٰہَ لَہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ অর্থাাৎঃ আল্লাহ ছাড়া কোনও ইলাহ নেই এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়। (সুরা ইমরান ৬২) এরশাদ হচ্ছেÑ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ ۚ خَالِقُ کُلِّ شَیۡءٍ فَاعۡبُدُوۡہُ ۚ وَہُوَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ وَّکِیۡلٌ অর্থাৎঃ (তিনিই আল্লাহ) তিনি ছাড়া কোনও ইলাহ বা মাবুদ নেই। তিনি যাবতীয় বস্তুর স্রষ্টা। সুতরাং তাঁরই ইবাদত কর। তিনি সব কিছুর অভিভাবক।( সুরা আনআম ১০২) সুরা নাহল এর ২২ নম্বার আয়াতে এরশাদ হচ্ছেÑ اِلٰـہُکُمۡ اِلٰہٌ وَّاحِدٌ ۚ فَالَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡاٰخِرَۃِ قُلُوۡبُہُمۡ مُّنۡکِرَۃٌ وَّہُمۡ مُّسۡتَکۡبِرُوۡنَ এক ইলাহ ই তোমাদের আল্লাহ। কিন্তু যারা আখেরাতে ঈমান রাখে না তাদের অন্তরে অবিশ্বাস/অস্বীকৃতি/ কুফরী বদ্ধমূল হয়ে গেছে এবং তারা অহমিকায় লিপ্ত। এরশাদ হচ্ছে- وَاِلٰـہُنَا وَاِلٰـہُکُمۡ وَاحِدٌ وَّنَحۡنُ لَہٗ مُسۡلِمُوۡنَ আমাদের ইলাহ/মাবুদ ও তোমাদের মাবুদ একই,আমরা মুসলিম/ তাঁরই আনুগত্যকারী। (সুরা আনকাবুত ৪৬)
এ ভাবে আরো অনেক আয়াতে দলীল আছে যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। ইলাহ শব্দের অর্থ কেবল মাবুদ বা উপসনার উপযুক্ত বললে এর মর্ম পুর্ণতা হবে। কোরআনে কেন তিনি ইলাহ এরও ব্যাখ্যা আছে তাই ইলাহ অর্থ,সৃষ্টিকর্তা,পালনকার্তা আইন-বিধান দাতা,হায়াত-মউত ও রিজিক দাতা বুঝায়। আর এ জন্যই কেবল তারই ইবাদত করতে হয়। তিনিই একমাত্র ইবাদতের উপযুক্ত হক্বদার। বিধার তার আইন ও বিধান মেনে চলার নাম ই উলুহিয়াতে বিশ্বাস। এর কোনটি অস্বীকার করে কোনটি অস্বীকার করলে ঈমান পুর্ণঅতা পাবেনা। কোরআনে তাই এটাও বলা আছে যে আর কারো ইবাদত করোনা কেবল আল্লাহর ই ইবাদত কর। কেবল নামাজ রোজাই নয় বরং আল্লাহর আইন বিধান মেনে চলা, হায়াত মউত রিজেক রুটি ভালো মন্দ সব কিছুই তার হাতে এই বিশ্বাসে আমল করাও ইবাদতের অন্তর্ভূক্ত। ( কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা)
তাওহীদে রুবুবিয়্যাত ঃ ইসলামের প্রথম ও শেষ বিষয় ই হলো তাওহীদ। এর প্রথমটাহলো তাওহীদে জাতী ও সিফাতি বা আসমা ও সিফাতঃ উলুহিয়্যত বা আল্লাহর সু উচ্চ মর্য্যাদা ও একমাত্র ইবাদতের হক্বদার হওয়া বুঝায়। এর পর হলো রবুবিয়্যত বা আল্লাহ তায়ালাকে প্রতিপালক হিসাবে বিশ্বাস করা। রবুবিয়্যতের মর্ম হলো, আল্লাহ তা‘য়ালাই প্রত্যেক জিনিসের একমাত্র রব/ প্রভু /প্রতিপালক এই বিশ্বাস অন্তরে রেখে সেই আলোকে কথা ও কাজের বাস্তবায়ন করা। এ স্বীকারোক্তি প্রদান করা যে, আল্লাহ তা‘য়ালাই সবকিছুর স্রষ্টা। সৃষ্টিজগতের একাধিক স্রষ্টা নেই, যারা গুণাবলী ও কর্মসমূহে পরস্পর সমপর্যায়ের হতে পারে। এতে কোন প্রকার সন্দেহ করা যাবে না করলে ঈমানের পূর্ণতা পায়না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন-لَوْ كَانَ فِيهِمَا آَلِهَةٌ إِلَّا اللَّهُ لَفَسَدَتَا فَسُبْحَانَ اللَّهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُونَ ‘‘যদি নভোমন্ডলওভূমন্ডলে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যান্য উপাস্য থাকতো,তবে আসমান-যমীন বিধ্বস্ত হয়ে যেতো। অতএব তারা যা বলে,তা থেকে আরশের অধিপতি আল্লাহ্ পবিত্র’’। (সূরা আম্বীয়া ২১:২২) আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁর রসূলদের সম্পর্কে বলেন,- قَالَتْ رُسُلُهُمْ أَفِي اللَّهِ شَكٌّ فَاطِرِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ‘‘তাদের রসূলগণ বলেছেন, আল্লাহর ব্যাপারে কোনো সন্দেহ আছে কি, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা?’’ (সূরা ইবরাহীম ১০) আল্লাহ তায়ালা অস্তিত্ব যারা বিশ্বাস করত না তাদের কাতারে শীর্ষ ছিল ফেরাউন। কারণ সে নিজেকেই বড় রব দাবী করে বসে। স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে যারা অজ্ঞ ছিল এবং যারা প্রকাশ্যে তা অস্বীকার করেছিল,তাদের মধ্যে ফেরাউনের নাম সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। কিন্তু গোপনে সেও স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতো। যেমন মুসা (আঃ) ফেরাউনকে বলেছিলেন, لَقَدْ عَلِمْتَ مَا أَنزَلَ هَٰؤُلَاءِ إِلَّا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ بَصَائِرَ وَإِنِّي لَأَظُنُّكَ يَا فِرْعَوْنُ مَثْبُورًا ‘‘তুমি অবশ্যই জানো এ প্রজ্ঞাময় নিদর্শনগুলো আকাশ ও পৃথিবীর রব ছাড়া আর কেউ নাযিল করেননি। হে ফেরাউন! আমার মনে হয় তুমি নিশ্চয় একজন হতভাগ্য ব্যক্তি’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ১০২) আল্লাহ তা‘আলা ফেরআউন এবং তার সম্পর্কে আরো বলেন, وَجَحَدُوا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَا أَنفُسُهُمْ ظُلْمًا وَعُلُوًّا ۚ فَانظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُفْسِدِينَ ‘‘তারা একেবারেই অন্যায়ভাবে এবং অহংকারের সাথে নিদর্শনগুলো অস্বীকার করলো অথচ তাদের এ মগজ সেগুলোর সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল। বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কী হয়েছিল,তা দেখে নাও’’। (সূরা আন নামাল ২৭:১৪) এ জন্যই ফেরাউন যখন স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে জেনেও না জানার ভান করে অস্বীকারের সুরে বলেছিল, وما رب العالمين؟ ‘‘কে সেই সৃষ্টিজগতের প্রতিপালক?’’ তবে সে গোপনে আল্লাহর রবুবীয়াতের প্রতি ঈমান রাখতো। যেমন মুসা আলাইহিস সালাম ফেরাউনকে বলেছিল, قَالَ رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا إِن كُنتُم مُّوقِنِينَ قَالَ لِمَنْ حَوْلَهُ أَلَا تَسْتَمِعُونَ قَالَ رَبُّكُمْ وَرَبُّ آبَائِكُمُ الْأَوَّلِينَ قَالَ إِنَّ رَسُولَكُمُ الَّذِي أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ لَمَجْنُونٌ قَالَ رَبُّ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَمَا بَيْنَهُمَا إِن كُنتُمْ تَعْقِلُونَ ‘‘মূসা জবাব দিল, তিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর রব এবং আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে যা কিছু আছে সেগুলোর রব, যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাস স্থাপনকারী হও। ফেরাউন তার আশপাশের লোকদের বললো, তোমরা শুনছো তো? মূসা বললো, তোমাদেরও রব এবং তোমাদের ঐসব বাপ-দাদারও রব, যারা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ফেরাউন বললো, তোমাদের কাছে প্রেরিত রসূল তো দেখছি একেবারেই পাগল। মূসা বললো, পূর্ব ও পশ্চিম এবং যা কিছু তার মাঝখানে আছে তিনি সবার রব, যদি তোমরা কিছু বুদ্ধি-জ্ঞানের অধিকারী হতে’’। (সূরা আশ শূরা ২৪-২৮) এই বিশ্বাস করাও তাওহীদে রবুবিয়্যাতের অন্তর্ভুক্ত যে, আসমান ও যমীনের স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ তা‘য়ালা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ ‘‘এবং তুমি যদি তাদেরকে প্রশ্ন করো কে সৃষ্টি করেছে আসমান ও যমীন? তবে অবশ্যই তারা বলবে, আল্লাহ্। (লুকমান: ২৫) আল্লাহ তা‘য়ালা আরো বলেন-قُل لِّمَنِ الْأَرْضُ وَمَن فِيهَا إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ ‘‘তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, যদি তোমরা জানো তাহলে বলো এ পৃথিবী এবং এর মধ্যে যা বাস করে তা কার? তারা নিশ্চয়ই বলবে, আল্লাহর। বলো, তাহলে তোমরা ভয় করছো না কেন?’’ (সূরা মুমিনুন: ৮৪-৮৫) আল্লাহ তা‘য়ালা বলেছেন-وَقَالُوا لَا تَذَرُنَّ آلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا‘‘তারা বলেছে- তোমরা তোমাদের উপাস্যদেরকে পরিত্যাগ করো না এবং পরিত্যাগ করো না ওয়াদ,সুয়া, ইয়াগুছ,ইয়াউক ও নসরকে’’(নূহ: ২৩)।
ঈমানের বিষয়বস্তু ঈমানের বিষয়বস্তু মূলত ছয়টি বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত যা এই তাওহীদের কলিমার দুই অংশের মধ্যেই নিহিত। কোরআনে এর অনুকুলে বহু আয়াত আছে। যেমন- اٰمَنَ الرَّسُوۡلُ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡہِ مِنۡ رَّبِّہٖ وَالۡمُؤۡمِنُوۡنَ ؕ کُلٌّ اٰمَنَ بِاللّٰہِ وَمَلٰٓئِکَتِہٖ وَکُتُبِہٖ وَرُسُلِہٖ ۟ لَا نُفَرِّقُ بَیۡنَ اَحَدٍ مِّنۡ رُّسُلِہٖ ۟ وَقَالُوۡا سَمِعۡنَا وَاَطَعۡنَا ٭۫ غُفۡرَانَکَ رَبَّنَا وَاِلَیۡکَ الۡمَصِیۡرُ অর্থাৎঃ রাসূল (হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাতে ঈমান এনেছে,যা তাঁর উপর তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ হতে নাযিল করা হয়েছে এবং (তাঁর সাথে) মুমিনগণও। তাঁরা সকলে আল্লাহর প্রতি,তাঁর ফিরিশতাদের প্রতি,তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি এবং তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান এনেছে। (তারা বলে,) আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কোনও পার্থক্য করি না (যে,কারও প্রতি ঈমান আনব এবং কারও প্রতি আনব না)। এবং তাঁরা বলে, আমরা (আল্লাহ ও রাসূলের বিধানসমূহ মনোযোগ সহকারে) শুনেছি এবং তা (খুশীমনে) পালন করছি। হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনার মাগফিরাতের ভিখারী,আর আপনারই কাছে আমাদের প্রত্যাবর্তন। (সুরা বাকারা ২৮৫) এই আয়াত ও হাদীসের আলোকে ঈমানের বিষয় গুলো হচ্ছে- ১. আল্লাহ। ২.ফেরেশতা। ৩.আসমানী কিতাব। ৪.নবী-রাসুল। ৫.শেষ দিবস ও পুনরুত্থান এবং ৬.ভাগ্যের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস স্থাপণ করা। এ জন্য কলিমার এক অংশে বিশ্বাস করলে আরেক অংশে বিশ্বাস না করলে বা এই দুই অংশের মধ্যে নিহিত ছয়টি বিশ্বাসের কোন একটির উপর বিশ্বাস না করলে বা আংশিক বিশ্বাস আংশিক অবিশ্বাস করলে ঈমান পুর্ণতা পাবেনা। কারণ ঈমানের প্রথম ও প্রধান দাবী হলো, আল্লাহর নাম ও গুণাবলিতে কাউকে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য শরিক করা থেকে বিরত থাকা এবং একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর ইবাদত করা। তাই আল্লাহ তায়ালা বার বার বলেছেন লা তুশরিক বিল্লাহ ’সাবধান- আল্লাহর সাথে কোন কিছুকেই শরীক কর না।
আল কুরআনে ঈমান বা বিশ্বাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য্য ঃ ঈমানের পূর্ব শর্ত তাগুত অস্বীকার করাঃ এরশাদ হচ্ছেÑفَمَن يَكْفُرْ بِٱلطَّٰغُوتِ وَيُؤْمِنۢ بِٱللَّهِ فَقَدِ ٱسْتَمْسَكَ بِٱلْعُرْوَةِ ٱلْوُثْقَىٰ لَا ٱنفِصَامَ لَهَا ۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ সুতরাং যে ব্যাক্তি তাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে,সে এমন এক মজবুত রশ্যি আঁকড়ে ধরল যা কখনো ছিড়বে না। (সুরা বাক্বারা ২৫৬)
ঈমানের মূল শেকড় কলিমা এ তাওহীদ ঃ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-يُثَبِّتُ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِٱلْقَوْلِ ٱلثَّابِتِ فِى ٱلْحَيَوٰةِ ٱلدُّنْيَا وَفِى ٱلْءَاخِرَةِ ۖ وَيُضِلُّ ٱللَّهُ ٱلظَّٰلِمِينَ ۚ وَيَفْعَلُ ٱللَّهُ مَا يَشَآءُ অর্থাৎ যারা শ্বাশ্বত বানীর প্রতি ঈমান এনেছে তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে সু প্রতিষ্ঠিত করে রাখবেন,এবং জালিমদের বিভ্রান্তিতে রাখবেন। আর আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন। (সুরা ইবরাহীম ২৭) আয়াতে শ্বাশ্বতবানী বলতে قوله تعالى : يثبت الله الذين آمنوا بالقول الثابت قال ابن عباس: هو لا إله إلا الله ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর বর্ণনায় এই বানী হচ্ছে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।
আল্লাহর আইন ও রাসুলের আদর্শ প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক চেষ্টাই নাজাতের গ্যারান্টিঃ অনুরূপ সুরা সাফ এর ১০-১১ নম্বার আয়াতে পরকালের ব্যবসাকে মূল পুজি আখ্যায়িত করে বলা হয়েছেÑ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَىٰ تِجَٰرَةٍ تُنجِيكُم مِّنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ অর্থাৎ- হে ঈমানদারগণ আমি কি তোমাদের এমন বাণিজ্যের সন্ধান দেব যা তোমাদেরকে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি থেকে রক্ষা করবে। আর তাহলো تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ আল্লাহর প্রতি ও রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে,এবং আল্লাহর দেয়া জান মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জনতে। ”আয়াতে আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ঈমানের সাথে দুটি আমলের কথা বলা হয়েছে যা আখেরাতের জীবনের মুক্তির পুঁজি। আর তা হলো আল্লাহর আইন ও রাসুলের আদর্শ প্রতিষ্ঠার তরে জান মাল দিয়ে সর্বাত্মক জেহাদ করা মানে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
ঈমান ও তাক্বওয়ার অনুপস্থিতি আল্লাহর আজাবের কারণ ঃ এরশাদ হচ্ছে- وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ ٱلْقُرَىٰٓ ءَامَنُوا۟ وَٱتَّقَوْا۟ لَفَتَحْنَا عَلَيْهِم بَرَكَٰتٍ مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلْأَرْضِ وَلَٰكِن كَذَّبُوا۟ فَأَخَذْنَٰهُم بِمَا كَانُوا۟ يَكْسِبُونَ অর্থাৎ যদি জনপদবাসী ঈমান আনত এবং তাক্বওয়া অবলম্বন কর, তবে আমি তাদের জন্য আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবী উন্মুক্ত করে দিতাম কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছিল,ফলে তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের জন্য পাকড়াও করেছি। (আরাফ ৯৬) এই আয়াত থেকে এটাই স্পষ্ট হয় যে ঈমানের সাথে তাক্বওয়া অপরিহার্য কারণ তাক্বওয়া অর্জিত হয় আল্লাহর রীতি নীতি বা শরীয়ত পালনের মাধ্যমে। বলাই বাহুল্য ইসলামী শরীয়ত কেবল ব্যাক্তি জীবনে কিছু আমল করার নাম নয় বরং নিজের পাশাপাশি নিজের পরিবার পরিজন কে এবং সমাজে দ্বীন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করার মাধ্যমে অর্জিত হয়। এর নাম ই দাওয়াত ও তাবলীগ,এর নাম ই ইক্বামতে দ্বীনের চেষ্টা করা বা জেহাদ ও আন্দোলন করা।
ঈমান ই মুক্তির পথ ঃ আল্লাহ তায়ালা বলেছেনÑ مَّا يَفْعَلُ ٱللَّهُ بِعَذَابِكُمْ إِن شَكَرْتُمْ وَءَامَنتُمْ ۚ وَكَانَ ٱللَّهُ شَاكِرًا عَلِيمًا অর্থাৎ তোমরা যদি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর এবং ঈমান সুদৃঢ় কর,তবে তোমাদের কে শাস্তি দেয়াতে আল্লাহর কি লাভ? আর আল্লাহ তো পুরস্কার দাতা ও সর্বজ্ঞ। (সুরা নিসা ১৪৭) এই আয়াতে মুলত মুনাফিকদের উদ্দেশ্য করা হয়েছে যারা নিজেদের ঈমানদার দাবী করেও কেবল ইসলাম আর মুসলমানদের ক্ষতি করার চিন্তায়ই থাকে। তাই আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে উদ্দেশ্য করেই বলেছেন যে তোমরা তোমাদের আচরণেই শাস্তি পাবে মুলত আল্লাহ তোমাদের শাস্তি দেয়ার কোন ইচ্ছা রাখেননা আর এতে আল্লাহর কোন লাভও নেই।তাই তোমাদের উচিত হলো ঈমান দৃঢ় করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা। তাফসীরের কিতাবে এটাই লেখা হয়েছে যে-قال أبو جعفر: يعني جل ثناؤه بقوله: " ما يفعل الله بعذابكم إن شكرتم وآمنتم সুতরাং ভেবে দেখা উচিৎ, যারা নিজেদের ঈমানদার দাবী করেও আল্লাহর জমীনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার কাজে,সমাজে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার কাজে ,দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে বাধা দেয়ার কাজ যারা করে এরা কি আসলেই প্রকৃত মোলমান না কি এরা মুনাফিক চরিত্রের ? তাই জেনে না জেনে বুঝে না বুঝে যারা মুনাফিক্বী চরিত্র নিয়ে সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি করে চলেছে তাদেরকে এই সর্বনাশা কাজ থেকে মুক্ত করে আনা সমাজকে বিপর্যয় থেকে মুক্ত করা ঈমানদারদের ঈমানের দাবী নয় কি? এ ভাবেই কোরআনে করীমে ঈমানের গুরুত্ব ও ও তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। যেমন সুরা শুরা এর ৫২ নম্বার আয়াতে আল্লাহর রাসুলের প্রতি অহী নাযেল এবং আল্লাহর রাসুলের আদর্শকেই একমাত্র সঠিক আদর্শ ও আক্বীদা বিশ্বাস বলা হয়েছে। সুরা আনফালের ২ নম্বার ও সুরা তওবার ১২৪ নম্বার আয়াতে কোরআন অনুস্মরণ ও তার তেলাওতে ঈমান বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। আর ঈমান বৃদ্ধির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে কঠিণ পরীক্ষার সময়ও আল্লাহর দ্বীনের উপর অবিচল থাকা কোন ভয় ভীতি লোভ মোহে পড়ে দ্বীন থেকে সরে না যাওয়া। কলিমা তায়্যিবার উদাহরণ দেয়া হয়েছে সুরা ইবরাহীম এর ২৪-২৫ নম্বার আয়াতে। সুরা হাদীদ এর ৭-৮ ও তাগাবুন এর ৮ এবং সুরা নিসার ১৩৬নম্বার আয়াতে ঈমান গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুরা আলে ইমরানের ৮৪ ও সুরা মায়েদার ১১১ নম্বার আয়াতে কোন কোন বিষয়ে ঈমান রাখতে হবে তার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুরা তাগাবুন এর ২ ও সুরা কাহফ এর ২৯ নম্বার আয়াতে নিজ উদ্যোগে বা নিজের ইচ্ছায় জেনে বুঝে ঈমান কবুল করার কথা বলা হয়েছে। আর সুরা ইউনুস এর ৯৯ নম্বার আয়াতে কাউকে জোর করে ঈমান গ্রহণ করাতে বারণ করা হয়েছে আর ১০০ নম্বার আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কেউ ঈমান গ্রহণ করতে পারবেনা। সুরা হুজরাতের ১৭ নম্বার আয়াতে ঈমান গ্রহণ করা কে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ বলা হয়েছে। সুরা আনআম এর ১৫৮ ও সুরা মুমিন এর ৮৪-৮৪নম্বার আয়াতে ঈমান গ্রহণ করতে বিলম্ব না করতে বলা হয়েছে তবে আল্লাহর আযাব ও গজব দেখে ঈমান আনলে তা গ্রহণযোগ্য হবেনা বলে সুরা ইউসুফের ৮৪-৮৫ নম্বার আয়াতে বলা হয়েছে। এ থেকেই অনুমিত হয় যে ঈমানের গুরুত্ব কতটুকু।
ঈমান গ্রহণের নির্দেশঃ
মহান রাব্বুল আলামীন গোটা মানব জাতীকেই ঈমান গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন এই বলে যে - اٰمِنُوۡا بِاللّٰہِ وَرَسُوۡلِہٖ وَاَنۡفِقُوۡا مِمَّا جَعَلَکُمۡ مُّسۡتَخۡلَفِیۡنَ فِیۡہِ ؕ فَالَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مِنۡکُمۡ وَاَنۡفَقُوۡا لَہُمۡ اَجۡرٌ کَبِیۡرٌ অর্থাৎ- আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান রাখ এবং আল্লাহ যে সম্পদে তোমাদেরকে প্রতিনিধি করেছেন,তা থেকে (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং (আল্লাহর পথে) ব্যয় করেছে, তাদের জন্য আছে মহা প্রতিদান।” وَمَا لَکُمۡ لَا تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ ۚ وَالرَّسُوۡلُ یَدۡعُوۡکُمۡ لِتُؤۡمِنُوۡا بِرَبِّکُمۡ وَقَدۡ اَخَذَ مِیۡثَاقَکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡৎ مُّؤۡمِنِیۡنَ অর্থাৎঃ তোমাদের এমন কী কারণ আছে, যদ্দরুন আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে না, অথচ রাসূল তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান রাখার জন্য আহ্বান করছেন এবং তোমাদের থেকে প্রতিশ্রæতি গ্রহণ করেছেন যদি বাস্তবিকই তোমরা মুমিন হও। (সুরা হাদীদ ৭-৮)
আরো এরশাদ হচ্ছে-فَاٰمِنُوۡا بِاللّٰہِ وَرَسُوۡلِہٖ وَالنُّوۡرِ الَّذِیۡۤ اَنۡزَلۡنَا ؕ وَاللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرٌ সুতরাং তোমরা ঈমান আন আল্লাহর প্রতি, তাঁর রাসূলের প্রতি এবং সেই আলোর প্রতি যা আমি নাযিল করেছি। তোমরা যা-কিছু করছ আল্লাহ সে সম্পর্কে পরিপূর্ণরূপে অবহিত। (সুরা তাগাবুন ৮) ঈমান গ্রহণের বাধ্যবাধকতা অনিবার্য়তা ও বৈশিষ্ট সম্পর্কেও কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে বলা হয়েছে যে আদি অন্ত যেমন এই আল্লাহর ই সমস্ত সৃষ্টি কুলের ¯্রষ্টাও তিনি তার উপরে ও তার সমকক্ষ আর কেই নেই। মানুষের জীবন মৃত্যু রিজেক রুটি কল্যাণ অকল্যাণ সবই তার হাতে هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ (মর্ম) তিনিই একক এমন এক সত্তা যার সমকক্ষ আর কেউ নেঈ এবং তিনি জাহির বাতিন সব কিছুই এমন কি অন্তরের খবরও জানেন। (সুরা হাদীদ ৩)
ঈমান গ্রহণ না করার পরিণতি ঃ ঈমান গ্রহণ না করার পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহর তায়ালা কোরআনের সুরা সুরা নিসার ১৩৬ নম্বার আয়াতে এরশাদ করেছেন- وَمَنۡ یَّکۡفُرۡ بِاللّٰہِ وَمَلٰٓئِکَتِہٖ وَکُتُبِہٖ وَرُسُلِہٖ وَالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلًۢا بَعِیۡدًا আর যে আল্লাহকে,তাঁর ফিরিশতাগণকে,তাঁর কিতাবসমূহকে, তাঁর রাসূলগণকে এবং পরকালকে অস্বীকার করে, সে বহু দূরের ভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। আরো এরশাদ হচ্ছে-یٰبَنِیۡۤ اٰدَمَ لَا یَفۡتِنَنَّکُمُ الشَّیۡطٰنُ کَمَاۤ اَخۡرَجَ اَبَوَیۡکُمۡ مِّنَ الۡجَنَّۃِ یَنۡزِعُ عَنۡہُمَا لِبَاسَہُمَا لِیُرِیَہُمَا سَوۡاٰتِہِمَا ؕ اِنَّہٗ یَرٰىکُمۡ ہُوَ وَقَبِیۡلُہٗ مِنۡ حَیۡثُ لَا تَرَوۡنَہُمۡ ؕ اِنَّا جَعَلۡنَا الشَّیٰطِیۡنَ اَوۡلِیَآءَ لِلَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ হে আদমের সন্তন-সন্ততিগণ! শয়তান যেন কিছুতেই তোমাদেরকে প্রতারিত করতে না পারে, যেমন সে তোমাদের পিতা-মাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল। সে তাদেরকে তাদের পরস্পরের লজ্জাস্থান দেখানোর উদ্দেশ্যে তাদের দেহ থেকে তাদের পোশাক অপসারণ করিয়েছিল। সে ও তার দল এমন স্থান থেকে তোমাদেরকে দেখে, যেখান থেকে তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। যারা ঈমান আনে না, আমি শয়তানকে তাদের বন্ধু বানিয়ে দিয়েছি। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন যে اِنَّا جَعَلۡنَا الشَّیٰطِیۡنَ اَوۡلِیَآءَ لِلَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ আমি শয়তানকে তাদের বন্ধু বানিয়ে দিয়েছি। শুধু তাই নয় তাদের আখেরাতের পরিণতি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে -اِنَّ الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِاٰیٰتِ اللّٰہِ ۙ لَا یَہۡدِیۡہِمُ اللّٰہُ وَلَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ যারা আল্লাহর আয়াতের উপর ঈমান রাখে না, আল্লাহ তাদেরকে হিদায়াত দান করেন না। তাদের জন্য আছে, যন্ত্রণাময় শাস্তি।
বিশ্বাসের (ঈমানের) দুই দিক ঃ বিশ্বাস অর্থে ঈমানের দুটি দিক আছে আর তা হলো ইতিবাচক ও নেতিবাচক। ইতিবাচক দিক হলো আল্লাহ-রাসুলে বিশ্বাস করে আল্লাহর আইন রাসুলের আদর্শ তথা শরীয়ত মেনে চলা যার মূল ভিত্তি গায়েব বা অদৃশ্য। এই অর্থে গায়েব মানে একমাত্র ও একক অদ্বিতীয় সত্বা ও সিফাত সহ আল্লাহ। এ জন্য মুমিনের/মুত্তাক্বির পরিচয় দিতে গিয়ে প্রথমেই বলা হয়েছে بِالۡغَیۡبِ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাসের নাম ইতিবাচক বিশ্বাস বা ঈমান। নেতিবাচক বিশ্বাসটিও আভিধানিক অর্থে ঈমান কিন্তু শরীয়তের পরিভাষায় এটা কুফরি। কারণ ইতিবাচক বিশ্বাসের নাম হেদায়ত যার শেষ প্রতিদান আল্লাহর জান্নাত। পক্ষান্তরে নেতিবাচক বিশ্বাস এর নাম হলো ضَلَّ ضَلٰلًۢا ’দ্বাল্লা দ্বালালা’বা চরম ভ্রষ্টতা যার শেষ পরিণতি জাহান্নাম। ইতিবাচক ও নেতি বাচক ঈমান বা বিশ্বাসের ব্যাপারে কোরআনের ভাষ্য হলোÑوَمِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّتَّخِذُ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اَنۡدَادًا یُّحِبُّوۡنَہُمۡ کَحُبِّ اللّٰہِ ؕ وَالَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَشَدُّ حُبًّا لِّلّٰہِ ؕ وَ لَوۡ یَرَی الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡۤا اِذیَرَوۡنَ الۡعَذَابَ ۙ اَنَّ الۡقُوَّۃَ لِلّٰہِ جَمِیۡعًا ۙ وَّاَنَّ اللّٰہَ شَدِیۡدُ الۡعَذَابِ অর্থাৎ ঃ এবং (এতদসত্ত্বেও) মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোকও আছে,যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে (তাঁর প্রভুত্বে) অংশীদার সাব্যস্থ করে,যাদেরকে তারা ভালোবাসে আল্লাহর ভালোবাসার মত। তবে যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহকেই সর্বাপেক্ষা বেশি ভালোবাসে। হায়! এ জালিমগণ (দুনিয়ায়) যখন কোনও শাস্তি—প্রত্যক্ষ করে, তখনই যদি বুঝত যে,সমস্ত শক্তি আল্লাহরই এবং (আখিরাতে) আল্লাহর আযাব হবে সু-কঠিন!”
ঈমান কবুলের শর্ত ঃ ঈমান আল্লাহ তায়ালার কাছে কবুল হওয়ার শর্ত হলো (১) এখলাসের সাথে বা কায়মনোবাক্যে তাওহীদের কলিমার স্বীকৃতি। (২) তাওহীদের কলিমার মর্ম জানা বুঝা ও আন্তরিকতার সাথে তার উপর আমল করা। (৩) তাওহীদের প্রতি বিশ্বাসীদের আল্লাহর জন্য মুহব্বত রাখা। (৪) কলিমার দাবী তাওহীদ ও রেসালত এর আনুগত্য নিষ্ঠার সাথে পালন করা। (৫) কলিমার দাবীর বিপরীত সমূহ বিষয় বর্জন করে চলা।
কুফ্র ঃ সংজ্ঞা,প্রকারভেদ ও পরিণতি
সঃজ্ঞা ঃ আরবী ‘কুফর’ الكُفْرُ শব্দটির অর্থ ‘আবৃত করা’ ঢেকে রাখা, অবিশ্বাস- অস্বীকার করা, প্রত্যাখ্যান করা,অকৃতজ্ঞ হওয়া ইত্যাদি। তাই আভিধানিক অর্থে কোন কিছু গোপন করাকে কুফরি বলা হয়। যেমন কৃষককে কাফির বলা হয় শষ্যদানা মাটির নিচে গোপন বা আবৃত্ত করার কারণে। পরিভাষাগত অর্থ ঃ ঈমান বা ইতিবাচক বিশ্বাসের বিপরীত নেতিবাচক বিশ্বাসকে ‘কুফর’ বলা হয়। আর এই অবিশ্বাস হলো প্রমাণিত বাস্তব সত্য আল্লাহ ও আল্লাহর আদেশকে অবিশ্বাস করা। আল্লাহর সৃষ্টি হয়ে সৃষ্টি নেয়ামত ভোগ করে ¯্রষ্টার অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও নিয়ামত অস্বীকার করা হয় ।
ইসলামী পরিভাষা ঃ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের উপর এবং ঈমানের রুকনগুলিতে বিশ্বাস না থাকাকেই ইসলামের পরিভাষায় ‘কুফর’ বলে গণ্য। অস্বীকার, সন্দেহ, দ্বিধা, হিংসা, অহঙ্কার, ইত্যাদি যে কোনো কারণে যদি কারো মধ্যে ‘ঈমান’ বা দৃঢ় প্রত্যয়ের বিশ্বাস অনুপস্থিত থাকে তবে তাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘কুফর’ বলে গণ্য করা হয়। অনুরূপভাবে মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে কোনো বিষয়ে তাঁর সমতুল্য বা সমকক্ষ বা তাঁর সাথে তুলনীয় বলে বিশ্বাস করার মাধ্যমে আল্লাহর একত্ব ও অতুলনীয়ত্ব অস্বীকার করাও কুফর। তবে এ পর্যায়ের কুফরকে ইসলামী পরিভাষায় শিরক বলা হয়। কুরআনে বিভিন্ন স্থানে মহান আল্লাহ পূর্ববর্তী বিভ্রান্ত সম্প্রদায় সমূহের বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাসের কারণ উল্লেখ করেছেন। কুরআন ও হাদীসের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাওহীদ, রিসালাত ও আরকানুল ঈমানের বিশুদ্ধ বিশ্বাস থেকেই অবিশ্বাস বা কুফর ও শিরক জন্ম নিয়েছে। ঈমান থেকেই কুফরী জন্মেছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঈমানের নামেই কুফরী প্রচারিত হয়েছে। ইহূদী, খৃস্টান ও আরবের অবিশ্বাসীগণ মূলত আসমানী কিতাব বা ওহী এবং আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলদের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তারা সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হন। কুরআন কারীমে এদের বিভ্রান্তির কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন জাতির অবিশ্বাসের কারণ কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীস শরীফে এ বিষয়ক অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে। আমরা এর ধরন, কারণ, প্রকরণ ও প্রকাশগুলির সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।
কুফরের প্রকারভেদ ঃ ‘অবিশ্বাস’ সামগ্রিক বা ব্যাপক হতে পারে এবং আংশিকও হতে পারে। আল্লাহর আদেশ নিষেধ পালনে বা আমলে ত্রুটি করলে ঈমান নাকেস বা দূর্বল হয়ে ঈমানের নূর-নষ্ট হয়ে যায়। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে এবং তওবা না করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমতাবস্থায় মৃত্যু হলে এই মৃত্যু কুফরির উপর মৃত্যু বলে গন্য হতে পারে কারণ তখন অতীত জীবনের সমূহ আমলে সালেহও নষ্ট হয়ে যায় । (না-আউযুবিল্লাহ) এই দৃষ্টিতে কুরআন ও হাদীসের আলোকে কুফরকে প্রধানতঃ দু ভাগে ভাগ করা হয়: (ক) কুফর আকবার ও (খ) কুফরে আসগর (১) কুফর আকবার বা বড় কুফর বলতে প্রকৃত অবিশ্বাস বঝানো হয় যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় এবং প্রকৃত অবিশ্বাসী বা কাফিরে পরিণত করে। এর পরিণতি চিরস্থায়ী জাহান্নামের শাস্তি ভোগ। কুফর আকবার বা ‘বৃহত্তর কুফর’-ই প্রকৃত কুফর বা অবিশ্বাস। আর এই কুফর মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। এ ক্ষেত্রে তাওহীদের মূল বিষয়ের কোন কটি অস্বীকার করলেই কুফরে আকবর হবে এবং এটা ইসলাম থেকে খারিজ করার জন্য যথেষ্ট হবে। (২) কুফরে আসগার বলতে বুঝানো হয় কঠিন পাপসমূহকে যা অবিশ্বাসেরই নামান্তর, এটাকে কুফরে মাজাযী বা রূপক কুফরও বলা হয়। এরূপ পাপে লিপ্ত মানুষদেরকে ইসলাম ত্যাগকারী বা প্রকৃত কাফির বলে গণ্য করা হয় না। তাদেরকে অনন্ত জাহান্নামবাসী বলেও বিশ্বাস করা হয় না। বরং তাদেরকে পাপী ও শাস্তিযোগ্য মুসলিম বলে গণ্য করা হয়।
আল কোরআনে কুফর ও কাফিরদের বিবরণ ঃ কুফর হলো জুলুম ঃ পবিত্র কোরআনে কুফর এ আকবর ও এর পরিণতি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা হয়েছে এবং কাফেরদের জালিম বলা হয়েছে । এরশাদ হচ্ছে- وَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّنِ ٱفۡتَرَىٰ عَلَى ٱللَّهِ كَذِبًا أَوۡ كَذَّبَ بِٱلۡحَقِّ لَمَّا جَآءَهُۥٓۚ أَلَيۡسَ فِي جَهَنَّمَ مَثۡوٗى لِّلۡكَٰفِرِينَ অর্থাৎ: যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা রচনা করে অথবা তাঁর নিকট হতে আগত সত্যকে অস্বীকার করে তার চেয়ে অধিক জালিম আর কে হতে পারে? জাহান্নামই কি কাফেরদের আবাস নয়? (সূরা আনকাবূত ৬৮) অহঙ্কার ঃ কুফরির দিকে ধাবিত করে সত্য বলে জানার পরও অহংকার বসতঃ অস্বীকার করাও কুফরি। আল্লাহ তায়ালা বলেন-وَإِذۡ قُلۡنَا لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ ٱسۡجُدُواْ لِأٓدَمَ فَسَجَدُوٓاْ إِلَّآ إِبۡلِيسَ أَبَىٰ وَٱسۡتَكۡبَرَ وَكَانَ مِنَ ٱلۡكَٰفِرِينَ অর্থাৎ:- এবং যখন আমি ফেরেশ্তাগণকে বলেছিলাম যে, তোমরা আদমকে সিজদা কর তখন ইবলিস ব্যতীত সকলেই সিজদা করে,সে অহঙ্কার করে অগ্রাহ্য করে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হল। (বাকারা ৩৪) এতে প্রমাণিত হয় কেবল জানলেই আর বড় জ্ঞানী হলেই চলবেনা বরং সত্য দ্বীন গ্রহণ করার মতো মেজাযও থাকতে হবে।
সত্যের উপর সন্দেহ কুফর ঃ সত্যের উপর সন্দেহও র কুফরির দিকে ধ্বাবিত করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-وَدَخَلَ جَنَّتَهُۥ وَهُوَ ظَالِمٞ لِّنَفۡسِهِۦ قَالَ مَآ أَظُنُّ أَن تَبِيدَ هَٰذِهِۦٓ أَبَدٗا ٣٥ وَمَآ أَظُنُّ ٱلسَّاعَةَ قَآئِمَةٗ وَلَئِن رُّدِدتُّ إِلَىٰ رَبِّي لَأَجِدَنَّ خَيۡرٗا مِّنۡهَا مُنقَلَبٗا ٣٦ قَالَ لَهُۥ صَاحِبُهُۥ وَهُوَ يُحَاوِرُهُۥٓ أَكَفَرۡتَ بِٱلَّذِي خَلَقَكَ مِن تُرَابٖ ثُمَّ مِن نُّطۡفَةٖ ثُمَّ سَوَّىٰكَ رَجُلٗا অর্থাৎ এ ভাবে নিজের প্রতি যুলুম করে সে তার উদ্যানে প্রবেশ করল। সে বলল: আমি মনে করি না যে এটা কখনো ধ্বংস হয়ে যাবে। এবং এটাও মনে করি না যে, কিয়ামত হবে, আর আমি যদি আমার প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবৃত্ত হই তবে অবশ্যই আমি ইহা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট স্থান পাব। তদুত্তরে তার বন্ধু তাকে বলল: তুমি কি তাকে অস্বীকার করছ? যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মৃত্তিকা ও পরে শুক্র হতে এবং তারপর পূর্ণাঙ্গ করেছেন মানুষ্য আকৃতিতে? (কাহফ ৩৫-৩৭) এ থেকে প্রমাণিত হয় দ্বীনে হক্ব এর প্রতি সন্দেহ পোষণ করাও কুফরি আর এটা হতে পারে কথা ও কাজে। ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে সেকেলে মনে করে ইনের উৎস হিসাবে মেনে না নেয়াও কুফরী। যারা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার আর যারা তাদের সমর্থনে সোচ্চার এবং যারা তাদের পক্ষে সহযোগিতা হয় এমন এমন কাজে লিপ্ত সেটাও সমান কুফরী।
সত্য অস্বীকার করার কুফর ঃ
প্রত্যাখ্যান করার কুফরি, এর দলীল হিসেবে আল্লাহ বলেন- وَٱلَّذِينَ كَفَرُواْ عَمَّآ أُنذِرُواْ مُعۡرِضُونَ অর্থাৎ: আর যারা কাফের তাদেরকে যা থেকে সতর্ক করা হয়েছে তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। (সূরা আহকাফ ৩) এরা হলো খাটি আদি ও আসল কাফের যেটাকে কুফরে আকবর বলা হয়। যাদের পরিচয় সুরা এ কাফেরুন এর মতো চোট্র একটি সুরায় দেয়া হয়েছে ’হে কাফেরগণ’ বলে। দুর্ভগ্যজনক হলেও সত্য অনেক মোসলামানও এখানে বুঝার বেলায় হোঁচট খেয়ে ফেলেন এটা ধর্ম নিরপেক্ষতার দলীল মেনে। মুলত এখানে ধর্ম নিরপেক্ষতা বা কুফর কে স্বীকৃতি দেয়া হয় নি তোমাদের ধর্ম বলে। বরং কাফের বলে তাদের ধৃষ্টতাকে ধিক্কার দেয়া হয়েছে।
তার চেয়েও বড় কথা হলো আজকালের আক্বীদার কিতাবগুলোতেও ছোট খাটোবিষয়ে মোসলমানদের মধ্যকার ইলমী এখতেলাফকে বড় করে দেখানো হলেও ইসলামের সাথে শিরক,ও নেফাকের কুফর মিশ্রনের বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যা খুবই কম। মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মমওদুদী (রঃ) এই বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার কারণেই এই মহলের চক্ষুসুল হয়ে পড়েছেন। পবিত্র কোরআনুল করীমে এরশাদ হচ্ছে-وَالَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَکَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَاۤ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۚ ہُمۡ فِیۡہَا خٰلِدُوۡنَ আর যারা কুফরীতে লিপ্ত হবে এবং আমার আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করবে, তারা জাহান্নামবাসী। তারা সেখানে সর্বদা থাকবে। সুতরাং কুফরি সে ছোট ই হোক তা থেকে অবশ্যই নিরাপদ দুরত্বে থাকতে হবে।
নেফাক একটি কুফর ঃ নেফাকী একটি কুফরি এবং এতোটাই জঘন্য কুফরি যে কাফের ও কুফরির পরিচয় দিতে কোরআনে যতটা বিবরণ এসেছে একটি দীর্ঘ সুরা সহ বহু আয়াতে মুনাফেকদের পরিচয় দিতে হয়েছে। এর কারণ হলো এরা নিজেদের মোসলমান দাবী করে বাহ্যিক বা লৌকিক কিছু আমলে মোসলমানদের সাথে মিশে থাকে বলে তাদের চেনা যায় না তাই। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ ءَامَنُواْ ثُمَّ كَفَرُواْ فَطُبِعَ عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ فَهُمۡ لَا يَفۡقَهُونَ অর্থাৎ: এটা এ জন্যে যে, তারা ঈমান আনার পর কুফরি করেছে ফলে তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেওয়া হয়েছে, পরিণামে তারা বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। (সূরা মুনাফিকূন ৩)
ছোট কুফরী,ইসলাম থেকে বের হওয়ার কারণ হয় না ঃ ছোট কুফরি’র দ্বারা কেউ ইসলাম থেকে বের হবে না,আর এটি হচ্ছে নেয়ামতের অস্বীকার এর কুফরী। এর দলীল হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার বানী-﴿ وَضَرَبَ ٱللَّهُ مَثَلٗا قَرۡيَةٗ كَانَتۡ ءَامِنَةٗ مُّطۡمَئِنَّةٗ يَأۡتِيهَا رِزۡقُهَا رَغَدٗا مِّن كُلِّ مَكَانٖ فَكَفَرَتۡ بِأَنۡعُمِ ٱللَّهِ فَأَذَٰقَهَا ٱللَّهُ لِبَاسَ ٱلۡجُوعِ وَٱلۡخَوۡفِ بِمَا كَانُواْ يَصۡنَعُونَ অর্থাৎ: আল্লাহ দৃষ্টান্ত দিয়েছেন এক জনপদের; যা ছিল নিরাপদ ও নিশ্চিত, যেখানে সর্বদিক থেকে প্রচুর জীবনোপকরণ আসতো; অতঃপর তারা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করল ফলে তারা যা করত তজ্জন্যে তাদেরকে আল্লাহ ক্ষুধা ও ভীতির আচ্ছাদনের স্বাদ গ্রহন করালেন। (সূরা নাহল ১১২) তিনি আরও বলেন: إِنَّ ٱلۡإِنسَٰنَ لَظَلُومٞ كَفَّارٞ নিশ্চয়ই মানুষ অতি মাত্রায় জালিম অকৃতজ্ঞ। (সূরা ইব্রাহীম ৩৪) কুফর আর কাফিরদের পরিণতি সম্পর্কে অন্যত্র আলোচনা হয়েছে যে এদের পরিণাম দুনিয়াতে লাঞ্চনা বঞ্চনা আর আখেরাতে অনন্ত জাহান্নামবাস। কুফর এর প্রকারভেদঃ এ ছাড়াও কুফরের আরো কয়েকটি প্রকারভেদ আছে যার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি আছে- যেমন - ১। কুফ্রে ইনকার : অন্তর এবং যবান উভয়ের মাধ্যমে দ্বীনি বিষয় বা বিষয়সমূহ অস্বীকার করা। যেমন: মক্কার কাফিরগণ। ২। কুফ্রে জুহুদ : অন্তরে বিশ্বাস রাখা কিন্তু মুখে অস্বীকার করা। যেমন: মদীনার ইয়াহুদগণ। ৩। কুফ্রে ‘ইনাদ : অন্তরে দ্বীনকে বিশ্বাস করে এবং মুখেও স্বীকার করে। কিন্তু ইসলামের হুকুম আহকাম কে মান্য করে না। অন্যান্য দ্বীন বাতিল হয়ে গিয়েছে তা বিশ্বাস করে না। যেমন: আদম শুমারীর অনেক নামধারী মুসলমান যারা কখনো সহীহ দ্বীনী পরিবেশে আসে না। উল্লেখিত ৩টির যে কোন একটি পাওয়া গেলে তার ঈমান চলে যাবে। ৪। কুফ্রে যানদাহকাহ : অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে দ্বীনের সব কিছু স্বীকার করে কোন বিষয়ে অস্বীকার করে না কিন্তু দ্বীনের কোন বিষয়ে এমন ব্যাখ্যা প্রদান করে যা- উম্মতের ইজমা পরিপন্থী যেমন- কাদিয়ানীগণ খতমে নবুওয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করে তাদের ভন্ড নবী কে প্রমাণ করে। তেমনিভাবে কেউ দ্বীনের অর্থ কেবল হুকুমতে ইসলামী মনে করে অথবা ইসলামী হুকুমত এর প্রচেষ্টাকে জরুরী (ফরজ) বিশ্বাস করেনা।
শিরক একটি বড় কুফর মুশরিকরা স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করতো এবং তারা কখনোই এ কথা বলতো না যে, সৃষ্টিজগতের দু’স্রষ্টা রয়েছে। কিন্তু তারা আল্লাহর মাঝে এবং তাদের নিজেদের মাঝে মধ্যস্থতাকারী নির্ধারণ করে নিয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন, এরশাদ হচ্ছে- أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ অর্থাৎ-‘‘যারা আল্লাহ্ ব্যতীত অপরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে তারা বলে, আমরা তাদের ইবাদত এ জন্যই করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়’’। (যুমার: ৩)
দেব-দেবী,সুর্য্য তারকা ফেরেশতা এবং মোসলমানদের ব্যক্তিপুজা তথা পীর পুজা গোর পুজা তথা দরগা পুজা ও দুর্গা পুজার মতো শিরক যা মানুষকে কুফরির মতো জঘন্য কাজের দিকে ধাবিত করে তা কেন করে এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা সুষ্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে তারা এ গুলো করে তাদেরকে আল্লাহ ভেবে নয় বরং আল্লাহ পর্যন্ত পৌছে দেয়ার মধ্যস্থতাকারী গন্য করেই করে। যা আল্লাহর তাওহীদে জাত ও ছিফাতের পরিপন্থি। শরীয়তের পরিভাষায় এটাকে শিরক বলে। এরশাদ হচ্ছে-وَيَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَٰؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِندَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُون এ লোকেরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের ইবাদত করছে তারা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে এরা আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী। হে মুহাম্মাদ! ওদেরকে বলে দাও, তোমরা কি আল্লাহকে এমন বিষয়ের খবর দিচ্ছো যার কথা তিনি আকাশেও জানেন না এবং যমীনেও না! তারা যে শির্ক করে তা থেকে তিনি পবিত্র এবং তার বহু উর্ধ্বে (ইউনুস: ১৮)।
রাসুলের (সাঃ) শেষ দিন গুলোতে মাজার কেন্দ্রীক শিরক বন্ধের নির্দেশ ছিলঃ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন-إن أُولَئِكَ قَوْمٌ إِذَا مَاتَ فِيهِمُ الْعَبْدُ الصَّالِحُ أَوِ الرَّجُلُ الصَّالِحُ بَنَوْا عَلَى قَبْرِهِ مَسْجِدًا وَصَوَّرُوا فِيهِ تِلْكَ الصُّوَرَ أُولَئِكَ شِرَارُ الْخَلْقِ عِنْدَ اللَّهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘‘তারা এমন লোক, তাদের মধ্যে যখন কোনো নেককার ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করতো, তখন তারা তার কবরের উপর মসজিদ তৈরী করতো এবং মসজিদে ঐগুলো স্থাপন করতো। এরাই হচ্ছে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সর্বাধিক নিকৃষ্ট লোক। (বুখারী ৪৩৪ متفق عليه) মৃত্যুর পাঁচদিন পূর্বে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,إِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوا يَتَّخِذُونَ قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ وَصَالِحِيهِمْ مَسَاجِدَ أَلاَ فَلاَ تَتَّخِذُوا الْقُبُورَ مَسَاجِدَ إِنِّى أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ ‘‘সাবধান, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো তাদের নাবীদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে। সাবধান! তোমরা কবরগুলোকে মসজিদে পরিণত করো না। আমি তোমাদেরকে এ কাজ করতে নিষেধ করছি’’। (মুসলিম ৫৩২) আবুল হাইয়াজ আল-আসাদী হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আলী (রাঃ) একদা আমাকে বললেন- أَلَا أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِي عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أمرني أن لا أدع صُورَةً إِلَّا طَمَسْتَهَا لَا تَدَعَنَّ قَبْرًا مُشْرِفًا إِلَّا سَوَّيْتَهُ ‘আমি কি তোমাকে এমন কাজে পাঠাবো না,যে কাজে স্বয়ং রসূল (সাঃ) আমাকে পাঠিয়েছিলেন? তিনি আমাকে আদেশ দিয়েছিলেন, কোন প্রাণীর ছবি দেখলেই তা বিলুপ্ত না করে ছাড়বে না। আর কোনো উচু কবরকে মাটির সমান না করে ছাড়বে না’’।(মুসলিম হা/৫৩১) আরো বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি মৃত্যু শয্যায় থাকা অবস্থায় বলেছেন- لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَগ্ধ يُحَذِّرُ مَا صَنَعُوا قالت عائشة لَوْلاَ ذَلِكَ لأُبْرِزَ قَبْرُهُ ولكن كره أَنْ يُتَّخَذَ مَسْجِدًا ‘‘ইহুদী-খৃষ্টানদের প্রতি আল্লাহর লা’নত। তারা তাদের নাবীদের কবরগুলোকে মসজিদে পরিণত করেছে। ইহুদী-নাসারাদের শির্কী কাজ থেকে মুমিনদেরকে সতর্ক করাই ছিল এ কথার উদ্দেশ্য। আয়েশা (রাঃ) বলেন, কবরকে ইবাদতখানায় পরিণত করার আশঙ্কা না থাকলে তার কবরকে উঁচু স্থানে উন্মুক্ত রাখা হতো। কিন্তু তার কবরকে মসজিদে পরিণত করা হবে, এটি তিনি অপছন্দ করেছেন’’ (বুখারী হা/৪৩৫)
জানা আবশ্যক যে পৃথিবীতে শিরক এর আগমন ঘটেছে নুহ প্রথমে আল্লাহর নেক বান্দাহদের প্রতি ব্যাক্তি কেন্দ্রীক অতিভক্তি এবং তাদের মৃত্যুর পর তাদের কবরে মসজিদ গম্বুজ, নির্মান,কবরে শিরনী মান্নত,প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্য্য নির্মাণের মধ্য দিয়ে ই। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) দুনিয়াতে আগমন পর্যন্ত এর বহু বিস্তার ঘটে যার মধ্যে আছে তারকা পুজা,ফেরেশতা পুজা,সুর্য্যপুজা অগ্নীপুজা,বৃক্ষপুজা, দেবদেবী তৈরী করে এর পুজা। পরবর্তিতে যুগী সন্যাসীরা এর বিস্তার ঘটায় এবং এর থেকেই ইসলামে অনু প্রবেশ ঘটে পীর ফকির অলী আউলিয়াদের মাজার করার প্রবণতা যা মোসলমানদের একটি ধর্মীয় রীতিতে ও অনুভুতিতে পর্যবসিত করে। ক্রমশঃ এর বিস্তার ঘটায় অনেকেই এটাকেও ইবাদতি এবং ইসলাম ও ইসলামের ইবাদতের পর্যায়ে গন্য করে। আর এটাও জেনে রাখা আবশ্যক যে কবর জিয়ারত আর কবরের মর্য্যাদা রক্ষা করা সম্মানী ব্যাক্তিদের সম্মান দেয়া আকাবীর ও আসলাফদের থেকে শিক্ষা নিয়ে পথ চলা ইবাদতের অন্তর্ভূক্ত এ গুলো পাপ নয়। বিধায় কবর জিয়ার আর পীর বুযুর্গদের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়া তাদের কাছ থেকে বরকত নেয়াকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়।
তারকা পূজা এবং তারকা সমূহের স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যমীনে সেগুলোর নামে মূর্তি তৈরী করা। বলা হয়ে থাকে, ইবরাহীম আলাইহিস সালামের গোত্রের শির্ক ছিল এ প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। এমনি ফেরেশতা ও জিনদেরকেও তারা আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করতো এবং তাদের নামে মূর্তি বানাতো।
শিরক ঃ সঃজ্ঞা ও প্রকারভেদ
সংজ্ঞা/ আভিধানিক অর্থ ঃ
আরবী شرك বা শির্কের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, কোন অংশীদার গ্রহণ করা। অর্থাৎ একজনকে অপরজনের অংশীদার বানানো। যেমন দুইজনের মাঝে যৌথভাবে করা হলে বলা হয়: أشرك بينهما কিংবা যখন কোন একটি বিষয়ে দুইজনকে অংশীদার করা হয় তখন বলা হয় أشرك في أمره غيره
পরিভাষাগত অর্থঃ (এক) শরীয়তের পরিভাষায় শির্ক হল আল্লাহ্র জাত ও সিফাতের সাথে কথা ও কাজে অন্য কোন অংশীদার شريك বা সমকক্ষ (ند) নির্ধারণ করা। আল্লাহ্র ওয়াহদানিয়ত বা একত্ববাদ বা তাওহীদ সে হোক রবুবিয়্যতের ক্ষেত্রে কিংবা উলূহিয়্যত বা ইবাদতের ক্ষেত্রে কিংবা তাঁর নাম ও গুণাবলীর বা আসমা ও ছিফাতের ক্ষেত্রে। আর ند হলো- সমকক্ষ ও সাদৃশ্যতা। এ কারণে আল্লাহ্ তায়ালা ند (সমকক্ষ) গ্রহণ করা থেকে নিষেধ করেছেন এবং যারা আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে অন্য কিছুকে তাঁর ند (সমকক্ষ) হিসেবে গ্রহণ করে কুরআনের অনেক আয়াতে তাদের নিন্দা করেছেন। যার সহজ কথা হলো আল্লাহর সাথে কোন অংশীদার স্থাপন করা বা একাধিক মা’বুদে বিশ্বাস করাকে শিরক বলা হয়। অথবা যে কোন ইবাদতকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে না করে অন্য কারো জন্য করা বা ইবাদতে কাউকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করাকে শিরক বলা হয়।
শিরক এর পরিণতিঃ শিরক এর পরিণতি হলো শিরক করার কারণে মুমিন ঈমান থেকে খারিজ হয়ে যায় এবং তার অতীতের সমস্ত আমলই বিনষ্ট হয়ে যায়। তাই ইসলামের পরিভাষায় শিরক হলো একটি মহা পাপ বা اَكْبَرُ الْكَبَائِرْ তথা কবীরা গুণাহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তায়ালা নিজেও বলেছেন- إِنَّ الشَّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ নিশ্চয়ই শিরক মহা পাপ। -(সূরা-লুকমান- ১৩)। আর আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বলেছেন যা বুখারী,মুসলিম শরীফের হাদীসে বর্ণিত আছে যে রাসূলে আকরাম (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করা হল-اَيُّ الذَّنْبِ اَعْظَمُ অর্থাৎ সবচেয়ে বড় পাপ কোনটি? উত্তরে তিনি বলেন- أَنْ تَجْعَلَ ِللّه ِندًّا وَهُوَ خَلَقَكَ অর্থাৎ আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক গ্রহণ করা অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেনÑ وَلَقَدْ أُوْحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ اَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ অর্থাৎ হে নবী! তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি এমর্মে ওহী পাঠানো হয়েছিল যে, যদি তুমি শিরক কর তবে তোমার সমস্ত আমলই বিনষ্ট হয়ে যাবে। এবং তুমি হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। -(সূরা-যুমার-৬৫)। মুশরিক অবস্থায় মারা গেলে জান্নাত তার জন্য চিরতরে হারম হয়ে যাবে; আর জাহান্নাম হবে তার স্থায়ী ঠিকানা। আল্লাহ তায়ালা বলেন : إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْحَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأ لارُ। অর্থাৎ নিশ্চই যে ব্যক্তি শিরক করবে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন এবং জাহান্নাম হবে তার স্থায়ী ঠিকানা। -(সূরা-আল-মায়িদাহ-৭২) এমন কি আল্লাহর রাসুল (সাঃ) সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلا مَا شَاءَ اللهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِي السُّوءُ অর্থ:- হে মুহাম্মদ তুমি বলে দাও, আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিত আমি নিজের ভাল-মন্দের, কল্যাণ-অকল্যাণের কোন অধিকার রাখিনা। যদি আমি গায়েব জানতাম তবে অনেক কল্যাণ অর্জন করে নিতাম আর কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করতে পারত না। -(সূরা-আ’রাফ-১৮৮) এর পরও কিছু মানুষ এমন কি আহলে ইলিমও ধারণা করেন যে পীর ফকির দরবেশ জ্বীন,পরি গায়েবের খবর জানেন তাই তারা জ্বিন পরী সাধনা করেন হাজির করেন। অনেকে পীর গায়েব জানেন,রাসুল (সাঃ) গায়েব জানে বলে ধারণা এমনকি প্রচারও করেন। এসব শিরক এবং শিরকে আকবর।
শিরক দু প্রকার ঃ কুফরির মতে শিরকের প্রকারভেদ আছেÑ যেমন (১) شِرْكْ أَكْبَرُ শিরকে আকবার বা বড় শিরক। (২)شِرْكَ أَصْغَرُ শিরকে আছগার বা ছোট শিরক। শিরকে আকবর এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ ১. আল্লাহর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা আছে এ জাতীয় আক্বিদা রাখা। ২. আল্লাহর জাত বা গুণের সাথে কাউকে শরীক বা সমকক্ষ মনে করা। ৩. মৃত ব্যক্তির নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা। ৪. মাজারে গমন এর উদ্দেশ্যে সফর করা ও মাজার বা অন্য কোন ব্যাক্তি বাব স্তুকে সিজদা করা। ৫. কারো সম্পর্কে এ বিশ্বাস রাখা যে,তিনি গায়েব জানেন,অথবা এ বিশ্বাস রাখা যে তিনি সর্বত্র হাজির নাজির বা তিনি আমাদের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন। ৬. গাইরুল্লাহ তথা মাজার, পীর, ফকির ইত্যাদির নামে জবেহ, কুরবানী বা মান্নত করা। ৭. বাইতুল্লাহর ন্যায় কারো কবর বা গৃহকে তাওয়াফ করা। ৮. কোন পীর বুজুর্গ বা ফকিরের নামের জিকির করা বা তাসবীহ আদায় করা। ৯. আল্লাহ ব্যতিত অন্য কাউকে লাভ-লোকসানের মালিক মনে করা।
শিরকে আছগর ঃ লোক দেখানো আমল শিরকের দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে শিরকে আছগর বা ছোট শিরক। শিরকে আছগরের কারণে মানুষ ঈমান হারা না হলেও অতি গোপণে তা মানুষের মাঝে ঢুকে পড়ে। মানুষ এটাকে কিছুই মনে করে না। ফলে অনেক সময় তা শিরকে আকবার পর্যন্ত পৌঁছিয়ে তাকে ঈমানহারা করার সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য ছোট শিরক থেকেও খুব সতর্ক থাকতে হবে। রাসূল (সাঃ) বলেন- انْ اَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشَّرْكُ الْأَصْغَرُ مُسْنَدُ أَحْمَدَ শিরকের ব্যাপারে তোমাদের উপর আমার বেশি ভয় হয়। ছোট শিরকের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন “রিয়া” বা লোক দেখানো আমল। (মুসনদে আহমাদ)। অন্য হাদীসে এসেছে- أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ اخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِى مِنَ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ قَالُوا بَلَى يَارَسُوْلَاللهِ قَالَ الشَّرْكُ الْحَفِيُّ يَقُوْمُ الرَّجُلُ فَيُصَلَّى فَيُزَيِّنُ صَلَاتَهُ لِمَا يُرَى مِنْ نَظْرِ رَجُلٍ. অথার্ৎ: রাসূলে করীম (সাঃ) বলেন, আমি কি তোমাদেরকে দাজ্জাল থেকে ভয়ানক বস্তুর সংবাদ দিব? সাহাবায়ে কিরাম আরজ করলেন অবশ্যই বলে দিন,ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন সূ² শিরক আর তা হল লোক দেখানোর জন্য নিজের নামাযকে সুন্দর ভাবে আদায় করা। وَالْحَلَفُ بِغَيْرِ الله وَقَوْلُ مَا شَاءَ الله وَشَنْتَ وَلَوْلَا اللَّهُ وَأَنْتَ وَهَذَا مِنْ اللَّهِ وَمِنْكَ وَأَشْبَاهُ ذَالِكَ وَالرِّيَاءِ الْيَسِيرُ وَالسُّمْعَةُ مِنْ أَنْوَاعِ الشِّرْكِ الْأَصْغَرِ. نَحْوَ تَصْحِيحِ الْعَقِيدَةِ ، الْإِرْشَادُ إِلَى تَوْحِيدِ رَبِّ الْعِبَادِ অর্থাৎ (ছোট শিরকের মধ্যে রয়েছে) গাইরুল্লাাহর নামে শপথ করা (আল্লাহর নাম ব্যতিত অন্য কিছু নিয়ে শপথ করা) যেমন,কুরআন মাজীদের শপথ, মা-বাবা,ছেলে-সন্তানের কছম, আমানতের কছম ইত্যাদি) তেমনিভাবে এ রকম বলা যে, যদি জনসাধারণের ধ্যান ধারনায় ও কথাবার্তায় কিছু প্রচলিত কুফর ও শিরক। অনুরূপ হাদীসে এসেছে- عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: أَلاَ مَنْ كَانَ حَالِفًا فَلاَ يَحْلِفْ إِلَّا بِاللَّهِ، فَكَانَتْ قُرَيْشٌ تَحْلِفُ بِآبَائِهَا، فَقَالَ: لاَ تَحْلِفُوا بِآبَائِكُمْ (আবু দাউদ, বুখারী৩৮৩৬ মুসলিম ১৬৪৬ )
জ্যোতিষি বা গণকের কথা বিশ্বাস করা শিরক ঃ অনেকে জ্যোতিষি বা গণকের কাছেও যায় ভবিষ্যতের সংবাদ জানতে গনকের কাছে যায়। এ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে- قَالَ مَنْ أَتَى كَاهِنًا فَصَدَقَهُ بِمَا يَقُوْلُ فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ অর্থাৎ: হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত,রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন গনকের নিকট এসে তার কথাকে বিশ্বাস করল সে যেন মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি অবতীর্ণ পূর্ণ দ্বীনকেই অস্বীকার করল। -(আবু দাউদ)। অতএব উক্ত আক্বীদাসমূহ নিয়ে তাদের নিকট গমন করা কুফুরী। অপর দিকে গায়েব সংক্রান্ত জ্ঞান, কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। এ গুলি আল্লাহর গুণ। আল্লাহ তায়ালার গুণে অন্যকে গুণান্বিত মনে করা শিরক। অনুরূপ বিপদে এরূপ বলা যে, আল্লাহ শুধু আমাকেই দেখেন অন্য কাউকে দেখেন না ইত্যাদি ধরণের কথাবার্তা বলা এক ধরণের শিরকী কাজ। মুমিনদের কর্তব্য হচ্ছে বিপদে ও কষ্টে সবরের সাথে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা আর ভাল অবস্থায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা। নিজের প্রতিটি কথাবার্তায় সতর্ক থাকা। কেননা আমাদের প্রতিটি কথা- কাজ লেখার জন্য ফেরেশতা প্রস্তুত রয়েছেন। মুমিন বান্দা কোন অবস্থায়ই কল্যাণমুক্ত না।
শিরক থেকে বাঁচার জন্য দোয়াঃ শিরক থেকে বাঁচার জন্য ইব্রাহীম (আঃ) এই বলে দোয়া করেছিলেনযে وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ أَنْ نَعْبُدَ الْأَصْنَامَ অর্থাৎ: (হে আল্লাহ) আমাকে এবং আমার সন্তানগণকে মূর্তি পূজা থেকে দূরে রাখুন। -(সূরা-ইব্রাহীম-৩৫) আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বলেন, শিরক তোমাদের মাঝে পিঁপড়ার বিচরণ থেকে ও অতি সূ² তবে আমি একটি বিষয়ের সন্ধান দিচ্ছি যা পালন করলে ছোট বড় সব শিরক আল্লাহ তোমার থেকে দূর করে দিবেন। শিরক থেকে বাঁচার জন্য এ দোয়াটি পাঠ করো। اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوْذُبِكَ أَنْ أُشْرِكَ بِكَ وَأَنَا أَعْلَمُ وَاسْتَغْفِرُكَ لِمَا لَا أَعْلَمُ অর্থাৎঃ হে আল্লাহ! জেনে বুঝে (ইচ্ছাকৃতভাবে) তোমার সাথে শিরক করা থেকে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আর অজানা শিরক থেকে তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। (বোখারী আল-আদাবুল মুফরাদ-৭৬১) দোয়াটি শব্দের কিছুটা ব্যবধানসহ অন্য হাদীস গ্রন্থেও বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহ ছাড়া অন্যদের ند ডাকা ঃ আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ند ডাকা সম্পর্কে কোরআনের বানী হচ্ছে এ রকম যে- আল্লাহ্ তাআলা বলেন فَلا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَاداً وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ তোমরা আল্লাহ্র সাথে সমকক্ষ নির্ধারণ করো না। অথচ তোমরা জান (আল্লাহ্ই স্রষ্টা, তিনিই রিজিকদাতা..)।”(সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২২) আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেন-وَجَعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَاداً لِيُضِلُّوا عَنْ سَبِيلِهِ قُلْ تَمَتَّعُوا فَإِنَّ مَصِيرَكُمْ إِلَى النَّارِ তারা আল্লাহ্র পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য তাঁর বহু সমকক্ষ বানিয়ে নিয়েছে। আপনি বলুন, তোমরা উপভোগ করতে থাক। তোমাদের গন্তব্য হচ্ছে অগ্নি। (সূরা ইব্রাহিম, আয়াত: ৩০) হাদীসে আছে-নবী (সাঃ) বলেছেন-“যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে যে,সে আল্লাহ্র সাথে অপর কোন সমকক্ষকে ডাকে সে অগ্নিতে প্রবেশ করবে।” (বুখারী ৪৪৯৭ মুসলিম ৯২)
ছোট শির্ক বিভিন্ন ভাবে হতে পারে; যেমন- চুড়ি, সুতা, তাবিজ-কবচ-মাদুলি ইত্যাদি পরা। আবার অপ্রকাশ্যও হতে পারে যেমন- সূক্ষাতিসূ² রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছা। তেমনিভাবে ছোট শির্ক বিশ্বাসশ্রেণীয় বিষয়ে হতে পারে যেমন কেউ কোন কিছু ব্যাপারে এই বিশ্বাস করল যে, এটি কল্যাণ আনয়ন করে ও অকল্যাণ দূর করে; অথচ আল্লাহ্ তায়ালা এর মধ্যে এমন কোন উপকরণ রাখেননি। কিংবা কোন কিছুতে বরকত আছে বলে বিশ্বাস করা; অথচ আল্লাহ্ তাতে বরকত রাখেননি। ছোট শির্ক কখনও কখনও কথাবার্তায়ও হতে পারে
--2400:C600:3367:A435:AF:31C3:6E42:3E40 ২০:৫৯, ১৯ অক্টোবর ২০২৪ (ইউটিসি)আমাদের কথা ঃ আল্লাহ তায়ালার জাত ও ছিফাত বা আসমা ও ছিফাতে উলুহিয়াত ও রুবুবিয়্যাতের মধ্যে কথা ও কাজে,আমলে বিশ্বাসে অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ গন্য করা যাবেনা এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা। এখন আল্লাহর জাত ও সিফাতে বিশ্বাসের দাবী করে সেখানে যদি নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে কেউ দেব-দেবির কেউ চন্দ্র সুর্য্যরে উপাসনা করে আবার কেউ পীরের পায়ে,কেউ পীরের মাজারে গিয়ে সহযোগিতা চায় তাদের উপাসনা করে। আল্লাহ কে মুখে রব মানে নামাজে দাড়িয়েও বলে আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। কিন্তু বাস্তব জীবনে কথা ও কাজে আকারে ইঙ্গিতে নিজের ক্ষেত খামার, চাকুরী- বাকরী, সন্তানের বিদেশের ইনকাম কে প্রতিপালনের দায়িত্বশীল ভাবে তাহলে সে আল্লাহর রবুবিয়্যতে শিরক করল অথবা যদি মনে করে আল্লাহ নয় এই মাধ্যম ই তার প্রতিপালনের মাধ্যম তাহলে সে কুফরী করলো। এটাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা বিশ্বাস। আমাদের মধ্যে একটা ভ্রান্ত ধারণার জন্ম নিয়েছে যে এই শেষোক্ত শিরক এর কথা গুলো বললেই তার আক্বীদা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এটা ঠিক নয় শিরক থেকে বেচে না থাকলে ঈমানের দাবী করে অন্যান্য ইবাদতি করলেও তা কোন কাজে লাগবেনা। এখন আপনিই আপনার বিবেকের আদালতে ইনসাফের মানদন্ডে বিচার করে বলুন যে এইর উপর গুরুত্ব দেয়ার কারণে কি একজন মানুষকে ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসী বলা যায়? সে তিনি হোন মাওলানা মওদুদী আর যেই।ঈমানের এই মৌলিক সংঃজ্ঞা ও পরিভাষার সাথে মাওলানা মওদুদীর কোন মতানৈক্য আছে বা ভিন্নমত আছে এমন কোন প্রমাণ কি কেউ কোন দিন দেখাতে পেরেছেন?
আমলঃ সংজ্ঞা ও ঈমান আমলের পারস্পরিক সম্পর্কঃ সঃজ্ঞা ঃ আমল আরবী শব্দ যার আভিধানিক অর্থ কাজ, আমল করা অর্থ কাজ করা। যে কোনো কাজকেই আরবীত আমল বলে। কোনো বিশ্বাসকে কাজে পরিণত করার নামও আমল। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ইমানের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করার নামও আমল তবে এটাকে আমলে সালেহ বলে। আল্লাহ আল্লাহ তায়ালার জাত ও সিফাত বা সত্ত¡া,গুণাবলি এবং আল্লাহর রাসুল ও রাসুলের দাওয়াত সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রতি ঈমান বা বিশ্বাস স্থাপন করার নাম ঈমান। এই ঈমানের দাবী অনুযায়ী আল্লাহর হুকুম বা আইন / দ্বীন/শরীয়ত মেনে চলার নাম আমলে সালেহ যার আরেক নাম ইসলাম। তাই ঈমান ও ইসলাম বা আমলে সালেহ আঙ্গাঙ্গি ভাবে পরস্পর সম্পর্ক যুক্ত। তাই ঈমানের সাথে যে বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেটি হলো আমলে সালেহ বা নেক কাজ সৎকর্ম আর যে নেক আমল করে সেই সৎলোক। ঈমানের সাথে নেক আমল যেমন অন¯ী^কার্য্য তেমনি ঈমানের প্রতিদানের সাথে নেক আমলের অনস্বিকার্য্যতা অপরিহার্য্য। কোরআন হাদীসের যত যায়গায় ঈমানের কথা এসেছে সাথে আমলে সালেহ এর কথা এসেছে। এখানেই সৎকাজের নিগুড় তত্ব ও রহস্য এবং গুরুত্ব লুকায়িত।
আমল তিন প্রকার ঃ আমল দু রকম হলেও শব্দ ব্যবহারের দিক থেকে আমল তিন প্রকার। নেক আমল,বদ আমল ও বে আমল। (ক) নেক আমল বা আমলে সালেহ মানে আল্লাহর হুকুম ও রাসুলের সুন্নাহ মোতাবেক আমল করা। তা হোক ইবাদাত বা মুয়ামালাত মুয়াসারাতে,জাগতিক বা আখেরাতের কাজে। (খ) বদ আমল বা গোনাহর কাজ হলো যা আল্লাহ-রাসুল নিষেধ করেছেন তা করা আর যা করতে বলেছেন তা অমান্য করার নাম বদ আমল। বদ আমলের কারণে বা বদ আমল করলে কর্তাকে পাপাচারী বলা হয়। আবার খেলাফে সুন্নাহ নিজের মনগড়া আমল বানিয়ে ইবাদত গন্য করে সওয়াবের আশায় তা করাকে বিদআত ও বদ আমল বলা হয়। (গ) যে মন্দ কাজ করে এবং নেক আমল না করাকে বে আমল বলা হয়। আমলে সালেহ যার যত বেশি হবে তার ঈমান তত প্রবল বা শক্তিশালী বুঝা যাবে। আর যার আমলে সালেহ কম বা আমলে সালেহ’র প্রতি ইচ্ছা শক্তি যত দুর্বল তার ঈমান ততদুর্বল ও ক্ষয়যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। ভালো আমল ইমানদারদের বৈশিষ্ট্য আর খারাপ আমল পাপীদের বৈশিষ্ট্য। এ জন্য আমল শব্দের অর্থ কাজ হলেও ঈমানের সাথে সম্পর্কিত কাজকে আমলে সালেহ বলা হয়েছে। তাই আল্লাহতায়ালা ভালো আমল এবং ঈমানকে একই আয়াতে রেখেছেন। পবিত্র কোরআনের যেখানে ইমানের কথা এসেছে সেখানে আমলের কথাও এসেছে। এর কয়েকটি উদাহরণ এখানে উপস্থাপন করছি। যেমন- সুরা এ আসর এ এরশাদ হচ্ছেÑو الۡعَصۡر সময়ের কসম ان الانسان لفی خسر নিশ্চয় সকল মানুষ ক্ষতিগ্রস্থতায় নিপতিত।اِلَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ وَ تَوَاصَوۡا بِالۡحَقِّ তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে,পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে وَ تَوَاصَوۡا بِالصَّبۡرِ এবং পরস্পরকে ধৈর্য্যের উপদেশ দিয়েছে। সূরা ত্বীনে আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সবচেয়ে সুন্দর আকৃতিতে। ثُمَّ رَدَدۡنٰہُ اَسۡفَلَ سٰفِلِیۡنَ ۙ তারপর বদ আমলের কারণে তাকে পৌঁছে দেই সবচেয়ে নিকৃষ্ট অবস্থায়। اِلَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ فَلَہُمۡ اَجۡرٌ غَیۡرُ مَمۡنُوۡنٍ ؕ তবে তাদের নয়, যারা ঈমান আনে এবং নেক আমল করে। তাদের জন্য তো রয়েছে এমন পুরস্কার, যা কখনো শেষ হবে না।’(৫-৭)
আমলে সালেহ এর প্রতিদান জান্নাত ঃ যাদের ঈমান এবং আমল সঠিক রয়েছে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে তাদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ রয়েছে সূরা বাকারাহ’র২৫ নম্বার আয়াতে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- وَبَشِّرِ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَہُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ বলেন, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং ভালো আমল করেছে তাদের জান্নাতের সুসংবাদ দিন যার তলদেশে নহর প্রবাহিত। ”একই সুরার ৮২ নম্বার আয়াতে বলা হয়েছেÑ وَالَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ الۡجَنَّۃِ ۚ ہُمۡ فِیۡہَا خٰلِدُوۡنَ অর্থাৎ ঃ যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারা জান্নাতবাসী। তারা সর্বদা সেখানে থাকবে।”
আমাদের কথা ঃ মাওলানা মওদুদী (রঃ)এই দায়ীত্বটা পালন করেছেন এবং মোসলমানদের এই আহবান জানিয়েছেন যে- (১) ঈমানের ভিত্তিমূলে আল্লাহর বান্দা ও আল্লাহর বান্দাহদের মধ্যে যারা ঈমানদার তারা আল্লাহর জমীনে আল্লাহর দ্বীন তথা আল্লাহর আইন ও রাসুলের আদর্শ বাস্তবায়নের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। এতে যতই বাধা বিপত্তি আসুক সেটাকে পরীক্ষা গন্য করে যাবতীয় ভয়ভীতি,লোভ,মোহ এবং ক্ষোভ ও ক্রোধ সংযত করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। (২) ঈমানের মূল মন্ত্রের সাথে কুফরী আক্বীদা এবং ঈমানের শেকড় তাওহীদের সাথে শিরকের মিশ্রণ না ঘটানো ঈবাদতের বেলায় সকল ফরজকে সমান গুরুত্ব দিয়ে আল্লাহর ফরজের মধ্যে তারতম্য না করা সুন্নতে নববীর সাথে খেলাফে সুন্নাহ ও বিদআতের মিশ্রণ না ঘটানো। (৩) আল্লাহর জাত ও সিফাতের সাথে কারো সমকক্ষতা ও মধ্যস্থতা সাব্যস্থ না করে আল্লাহর হুকুম রাসুলের আদর্শ সমর্থন করে এমন ভাবেই আল্লাহর জন্য আল্লাহর আল্লাহর বান্দাহদের সাথে সু সম্পর্ক দ্বীনের সম্পর্ক এবং মানুষ হিসাবে মানুষের সাথে বনী আমদের সু সম্পর্ক বজায় রেখে চলা।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় ইক্বামতে দ্বীন বা ইসলামী আন্দোলনের কথা বললেই কাফের মুশরিক তো বটেই কিছু মোসলমানও এটা সহ্য করতে পারেন না। এটাই যে কুফরী এটা যে মুনাফিক্বী চরিত্র তারা বুঝতে পারেন না অথবা বুঝেও না বুঝার ভান করেন মানুষের মনোতুষ্টির জন্য। অথচ মহান রাব্বুল আলামীন ঈমানের পুর্ব শর্ত হিসাবে তাগুতকে অস্বীকার করতে বলেছেন। আর তাগুত হলো শয়তান আর তার অনুগত এমন সব মানুষ যারা আল্লাহর আইন তথা আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধানের মোকাবেলায় মানুষের মনগড়া আইন ও বিধান প্রতিষ্ঠার সর্বত্বক চেষ্টা করে থাকে। ব্যক্তি বিশেষের আদর্শ,চিন্তা-চেতনাকে আদর্শ বা আদর্শের প্রতীক গন্যকরে। জাগতিক সাফল্য ও আখেরাতের মুক্তির মূল ভিত্তি হচ্ছে বিশুদ্ধ বিশ্বাস বা আক্বীদা। মানুষের মন ও বিশ্বাস-ই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। এজন্য একজন মানুষকে প্রকৃত মানুষ হতে এবং মানবতার পূর্ণতায় উপনীত হতে বিশুদ্ধ বিশ্বাসের অপরিহার্যতা আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি। কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা থেকে সুস্পষ্ট যে, বিশ্বাসের বিশুদ্ধতার উপরেই মানুষের মুক্তির মূল ভিত্তি। আর এ জন্যই ইমাম আবূ হানীফা ইলমুল আকীদার নামকরণ করেছেন: ‘আল-ফিকহুল আকবার’ বা শ্রেষ্ঠতম ফিকহ। বিশ্বাস-জ্ঞানকে ‘‘শ্রেষ্ঠতম ফিকহ’’ নামকরণের মাধ্যমে ইমাম আযম বুঝিয়েছেন যে, ফিকহ বা ধর্মীয় জ্ঞানের যত শাখা রয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ শাখা ও দ্বীনী ইলমের শ্রেষ্ঠতম বিষয় ঈমান বিষয়ক জ্ঞান। তিনি নিজেই এ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন এবং এটিই পরবর্তিতে আক্বিদা নামে পিিচতি লাভ করেছে।
ইসলাম ঃ সংজ্ঞা,ভিত্তি ও ঈমান ইসলামের সম্পর্ক
ইসলামের সঃজ্ঞা ঃ আল ইসলাম শন্দের অর্থ আল্লাহর আনুগত্যে আত্মসমর্পন করা,আল্লাহর আনুগত্যের তরে নত-শির হওয়া। মানে আল্লাহর আইন-কানুন দ্বীন,শরীয়ত বিনা বাক্যে মেনে চলা। নত-শির অর্থ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা পছন্দ অপছন্দকে আল্লাহর ইচ্ছা-পছন্দের কাছে ন্যস্ত করা। এর বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায় কথা ও কাজে। তাই ইসলাম মানি এই কথা বলার পর আল্লাহর আইন কানুন ও রাসুলের আদর্শ তথা ইসলামী শরীয়ত পালন ছাড়া অন্য কারো আইন কানুন ও আদর্শ চিন্তা চেতনা লালন-পালন করা যাবেনা সেটা হোক কোন ব্যাক্তি সমাজ বা পীরের ব্যাক্তিগত চিন্তা-চেতনা,দর্শন, আদর্শ অথবা সামাজিক রীতিনীতি। এর নাম ই প্রকৃত ইসলাম মানা আর এটা একমাত্র একক অদ্বিতীয় আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর ই সন্তুষ্টি অর্জনে করা হচ্ছে বা হবে এই দৃঢ় বিশ্বাস অন্তরে বদ্ধমুল করার নাম হলো ঈমান। এই হুকুমের মধ্যে রাসুলের আদর্শ অনুসুরণও শামিল আছে। আরো সহজ কথায় ঈমান হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) যা কিছু আদেশ করেছেন সেগুলোর ওপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা। আর ইসলাম হলো আল্লাহ ও তার রাসূল (সাঃ) যা কিছু আদেশ করেছেন তা মেনে চলা যা নিষেধ করেছেন তা বর্জন করে চলার নাম। একমাত্র আল্লাহর সমীপে আত্মসমর্পণ করা ও তাঁরই আনুগত্য স্বীকার করাকে ইসলাম বলে। ঈমান ও ইসলামের সম্পর্ক পারস্পিরিক সম্পুরক। অন্তরে বিশ্বাস করার নাম ই ইমান আর বিশ্বাসকারীর নাম মুমিন। বিশ্বাসের দাবী অনুযায়ী যাকে বিশ্বাস করা হলো তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলার নাম ই ইসলাম যে মেনে চলল সেই মুসুলিম। সুতরাং ইমান আর আমলের সমন্বয় না হলে মুমিন বা মুসলিম হওয়া যায়না। অনুরূপ ঈমান ছাড়া আমল আল্লাহর কাছে অগ্রহণযোগ্য আবার আমল চাড়া ঈমান ক্ষয়যোগ্য বা অগ্রহণযোগ্য। এর পরেও যার কিঞ্চিত পরিমান ঈমান থাকবে শিরক ও কুফরী করবে না আবার নেক আমল বা আমলে সালেহ করবে না সে শাস্তি ভোগের পরও জান্নাতে যাওয়ার আশা করা যায় এটাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা । এটাই ঈমান ও ইসলামের সম্পর্ক ও পার্থক্য। এ জন্য কোরআন করীমে গোটা মানব জাতিকেই আল্লাহ প্রদত্ত নবী-রাসুল ও আসমানী কিতাবের প্রতি ঈমান আনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং আগের সকল নবী-রাসুলদের মৌলিক দাওয়াতের সাথে ইসলামের দাওয়াতের ধারাবাহিকতা রয়েছে মর্মে উল্লেখ আছে। এরশাদ হচ্ছেÑ قُوۡلُوۡۤا اٰمَنَّا بِاللّٰہِ وَمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡنَا وَمَاۤ اُنۡزِلَ اِلٰۤی اِبۡرٰہٖمَ وَاِسۡمٰعِیۡلَ وَاِسۡحٰقَ وَیَعۡقُوۡبَ وَالۡاَسۡبَاطِ وَمَاۤ اُوۡتِیَ مُوۡسٰی وَعِیۡسٰی وَمَاۤ اُوۡتِیَ النَّبِیُّوۡنَ مِنۡ رَّبِّہِمۡ ۚ لَا نُفَرِّقُ بَیۡنَ اَحَدٍ مِّنۡہُمۡ ۫ۖ وَنَحۡنُ لَہٗ مُسۡلِمُوۡنَ অর্থাৎ “তোমরা বলো,-‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর ওপর এবং যা নাজিল করা হয়েছে আমাদের ওপর ও যা নাজিল করা হয়েছে ইবরাহিম, ইসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাদের সন্তানদের ওপর, আর যা প্রদান করা হয়েছে মূসা ও ঈসাকে এবং যা প্রদান করা হয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে নবীগণকে। আমরা তাদের কারও মধ্যে তারতম্য করি না। আর আমরা তাঁরই অনুগত” মুসলিম (সূরা বাকারা, ১৩৬)।
হাদীসেও ঈমান ও ইসলামের সম্পর্ক ও পার্থক্য সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা রয়েছে। যেমন- হাদীসে জিবরীল খ্যাত দীর্ঘ এক হাদীসে ইসলাম ও ঈমানের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বলেছেনÑ وقال يا محمد اخبرني عن الاسلام . فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم " الاسلام ان تشهد ان لا اله الا الله وان محمدا رسول الله وتقيم الصلاة وتوتي الزكاة وتصوم رمضان وتحج البيت ان استطعت اليه سبيلا . قال صدقت ” ইসলাম হল, তুমি এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল, সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, রামাযানের রোযা পালন করবে এবং বায়তুল্লাহ পৌছার সামর্থ্য থাকলে হজ্জ পালন করবে। এর পর ঈমান সম্পর্কে বললেন- ان تومن بالله وملاىكته وكتبه ورسله واليوم الاخر وتومن بالقدر خيره وشره " ------এর পর রাসুল (সাঃ) বললেনঃ ঈমান হল আল্লাহর প্রতি, তার ফেরেশতাদের প্রতি, তার কিতাবসমূহের প্রতি, তার রাসুলগণের প্রতি এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান আনবে, আর তাকদিরের ভালমন্দের প্রতি ঈমান রাখবে। আগন্তুক বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। (বুখারি, কিতাবুল ইমান, ১/২৭, মুসলিম ১/৩৬ কিতাবুল ঈমান) এই হাদীস থেকে আরো যে বিষয়টি পরিস্কার জানা গেলো সেটা হচ্ছেÑ ঈমান ও
ইসলাম নাম করণের কারণ ‘ইসলাম’ শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণ। আল্লাহপ্রদত্ত ধর্মকে এ নামে অভিহিত করার কারণ, এ ধর্মের অনুসারী ব্যক্তি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তায়ালার হাতে সমর্পণ করে ও তাঁর যাবতীয় আদেশ শিরোধার্য করে। সে কারণেই এর অনুসারীকে মুসলিম অর্থাৎ আত্মসমর্পণকারী বলে। এমনিতে তো সকল আসমানী ধর্মই ইসলাম। কিন্তু প্রাচীন ধর্মগুলোকে যেহেতু তাদের অনুসারীগণ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেনি, বরং ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তা বিকৃত করে ফেলেছে, অবশেষে শেষ নবীর আবির্ভাবের পর তার শরীআত দ্বারা সেগুলোর অনেক বিধান রহিতও হয়ে গেছে, তাই সেগুলো আর ইসলাম নামে অভিহিত হওয়ার উপযুক্ত থাকেনি। এখন ইসলাম হল সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সাঃ) কর্তৃক আনীত ও প্রচারিত দীন ও শরীয়ত, যা এক পরিপূর্ণ, সার্বজনীন ও কিয়ামতকাল পর্যন্ত স্থায়ী ধর্ম। (তাওযীহুল কোরআন)
ইসলামের বিষয়বস্ত ঃ
ইসলামের বিষয় বস্তু হলো পঁচটি যেটাকে ইসলামের ভীত বা বুনিয়াদ বলা হয়। এর অনুকুলে হাদীসে আছে - عبد الله بن عمر بن الخطاب رضي الله عنهما قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : بني الإسلام على خمس شهادة أن لا إله إلا الله ، وأن محمدا رسول الله ، وإقام الصلاة ، وإيتاء الزكاة ، وحج البيت ، وصوم رمضان আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বলেছেন ইসলামের বুনিয়াদ হলো পাঁচটি,আর তা হলো (১) কলিমা এ তাওহীদ/ বা তাওহীদের বিশ্বাস সম্বলিত কলিমা। (২) নামাজ কায়েম করা (৩) রোজা বা সিয়াম সাধনা (৪) হজ্বব্রত পালন করা (৫) যাকাত প্রদান করা।” এর তিনটি ধনী গরীব সকল মোসলমানের জন্য আত্বিক শারিক ফরজ ইবাদত। হজ্ব যাকাত দুটি হলো ধনী ভিত্তশালী মোসলমানের জন্য জান-মালের সমন্বিত ইবাদত। ঈমান ও ইবাদতের মধ্যে পর্দা হালাল- হারাম,রাসুলের আদর্শ অনুস্মরণ,ন্যায় অন্যায়,হাশর-নসর, ফেরেশতা, আসমানী কিতাব সবই অন্তর্ভূক্ত।
ইসলাম ই একমাত্র দ্বীনঃ
আল্লাহর কাছে ইসলাম ই একমাত্র দ্বীন । আল্লাহ তায়ালাবলেছেনÑ اِنَّ الدِّیۡنَ عِنۡدَ اللّٰہِ الۡاِسۡلَامُ ۟ وَمَا اخۡتَلَفَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ اِلَّا مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَہُمُ الۡعِلۡمُ بَغۡیًۢا بَیۡنَہُمۡ ؕ وَمَنۡ یَّکۡفُرۡ بِاٰیٰتِ اللّٰہِ فَاِنَّ اللّٰہَ سَرِیۡعُ الۡحِسَابِ অর্থাৎঃ নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট (গ্রহণযোগ্য) দ্বীন কেবল ইসলামই। যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল তারা তাদের কাছে জ্ঞান আসার পর কেবল পারস্পরিক বিদ্বেষবশত ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছে। আর যে-কেউ আল্লাহর আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করবে (তার স্মরণ রাখা উচিত যে,) আল্লাহ অতি দ্রæত হিসাব গ্রহণকারী।
একই সুরার ৮৫ নম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ ফরমান- وَمَنۡ یَّبۡتَغِ غَیۡرَ الۡاِسۡلَامِ دِیۡنًا فَلَنۡ یُّقۡبَلَ مِنۡہُ ۚ وَہُوَ فِی الۡاٰخِرَۃِ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ যে ব্যক্তিই ইসলাম ছাড়া অন্য কোনও দ্বীন অবলম্বন করতে যাবে, তার থেকে সে দ্বীন কবুল করা হবে না এবং আখিরাতে সে মহা ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
দ্বীন (ইসলাম) অর্থ জীবন ব্যবস্থা ঃ অর্থাৎ আল্লাহর কাছে মানুষের জন্য একটি মাত্র দ্বীন اِنَّ الدِّیۡنَ জীবন ব্যবস্থা ও একটি মাত্র জীবন বিধান সঠিক ও নির্ভুল বলে গৃহীত। সেটি হচ্ছে, মানুষ আল্লাহকে নিজের মালিক ও মাবুদ বলে স্বীকার করে নেবে এবং তাঁর ইবাদাত,বন্দেগী ও দাসত্বের মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সোপর্দ করে দেবে। আর তাঁর বন্দেগী করার পদ্ধতি নিজে আবিষ্কার করবে না। বরং তিনি নিজের নবী-রসূলগণের মাধ্যমে যে হিদায়ত ও বিধান পাঠিয়েছেন কোনো প্রকার কমবেশী না করে তার অনুসরণ করবে। এই চিন্তা ও কর্মপদ্ধতির নাম “ইসলাম” আর বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টার ও প্রভুর নিজের সৃষ্টিকুল ও প্রজা সাধারণের জন্য ইসলাম ছাড়া অন্য কোন কর্মপদ্ধতির বৈধতার স্বীকৃতি না দেয়াও পুরোপুরি ন্যায়সঙ্গত। মানুষ তার নির্বুদ্ধিতার কারণে নাস্তিক্যবাদ থেকে নিয়ে শিরক ও মূর্তিপূজা পর্যন্ত যে কোন মতবাদ ও যে কোন পদ্ধতির অনুসরণ করা নিজের জন্য বৈধ মনে করতে পারে কিন্তু বিশ্ব-জাহানের প্রভুর দৃষ্টিতে এগুলো নিছক বিদ্রোহ ছাড়া আর কিছুই নয়। (তাফহীমুল কোরআন) দ্বীনের আরো একাধিক অর্থ আছে তবে এখানে এটাই মানান সই বলেই প্রমাণিত এ কারণে যে আয়াতের পরের অংশে বলা হয়েছে وَمَا اخۡتَلَفَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ মানে ইসলাম বা দ্বীনকে তারা পুর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা মানবে কি না এ নিয়ে নিজেদের মধ্যেই এখতেলাফে জড়িয়ে পড়ে। মুলত কিছু লৌকিক এবাদত বন্দেগীর প্রতি তাদের কোন মতবিরোধ ছিলনা যে যার মত করে ই পালন করে নিত কিন্তু জীবনের সামগ্রীক বিষয়ে আসমানী কিতাবের ফয়সালা বা বিচার ব্যবস্থা মেনে নিতে পারতনা বলেই তাদের মধ্যে শিরক এর প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। তাই এই ব্যাখ্যার সাথে আহলে ইলমের কিছু সংখ্যক ওলামায়ে কেরাম ভিন্নমত পোষণ করেন। কিন্তু এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা এটা এখানে বলা হয়নি বা অন্য কোথাও মাওলানা মওদুদী বলেন নি। ধরে নেয়া যাক দ্বীন অর্থ যদি শরীয়ত নেয়া হয় তাহলে কারো দ্বীমত নেই মাওলানা মওদুদীও শরীয়ত অর্থ গওহণ করেছেন। তাহলে শরীয়ত অর্থ কি কেবলই নামাজ রোজার বিধান মানা আর কোরআনের বিচার ফায়সালার গুরুত্ব না দেয়া? তা তো মোটেও নয়? তাহলে আর এখতেলাফ রইলো কোথায়? এই আয়াতে ইসলামের ব্যাখ্যায় সকল তাফসীরে ই ভিন্ন ভিন্ন শব্দ একই কথা বলা হয়েছে যে-إن الدين عند الله الإسلام في هذه الآية الطاعة والملة ، والإسلام بمعنى الإيمان والطاعات ; قاله أبو العالية ، وعليه جمهور المتكلمين অর্থৎ ইসলামের মূল কথা হলো আল্লাহ’র বিধান ও রাসুলের আদর্শের আনুগত্য করা। আবুল আলীয়া বলেছেন এর উপর জমহুর উলামায়ে কেরাম একমত। আবুল আলীয়া বলেছেন- أبو العالية في قوله: " إن الدين عند الله الإسلام "، قال: " الإسلام "، الإخلاص لله وحده، وعبادته لا شريك له، وإقامُ الصّلاة، وإيتاءُ الزكاة، وسائرُ الفرائض لهذا تَبعٌ. ইসলাম হলো ইখলাসের সাথে একক ও অদ্বিত্বীয় আল্লাহর ইবাদতি করা যার কোন শরীক নেই। আর তা হলো নামাজ কায়েম করা,জাকাত প্রদান করা, আর এ ভাবেই সকল ফরজ ওয়াজিব আমলিয়াতের অনুস্মরণ করা। (তফসীরে বগভী)
আক্বীদাঃ সংজ্ঞা গুরুত্ব,তাৎপর্য্য ও বিষয়বস্তু আকী¡দার সংজ্ঞাঃ আকীদা العقيدة শব্দের আভিধানিক অর্থ বিশ্বাস, ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো স্বীকৃতি দেয়া, স্বীকার করা বা মেনে নেয়া। অর্থাৎ কোন বিষয়ে বিশ্বাসের প্রকৃতি বা ধরনের নাম হলো আকীদা,আর কোন আকীদা বা বিশ্বাসকে স্বীকৃতি দেয়া বা মেনে নেয়ার নাম হলো তার উপর ঈমান আনা।فالعقيدة هي ما يعقد عليه الإنسان قلبَه، ويؤمن به إيمانا جازما، ويتخذه مذهبًا ودينًا يدين به. فإذا كان هذا الإيمان الجازم صحيحًا؛ كانت العقيدة صحيحة. وإن كان باطلاً؛ كانت العقيدةُ باطلة এর ব্যাথয় হলে আক্বীদা বাতিল বলে গন্য হবে। আল ফিক্বহুল আকবর এর পরিভাষায়- ”ধর্ম-বিশ্বাস বিষয়ক প্রসিদ্ধতম পরিভাষা ‘আক্বীদা’। আকীদা ও ই’তিকাদ শব্দদ্বয় আরবী ‘আক্দ (عقد) শব্দ থেকে গৃহীত। এর অর্থ বন্ধন করা, গিরা দেওয়া, চুক্তি করা, শক্ত হওয়া ইত্যাদী। ভাষাবিদ ইবনে ফারিস এ শব্দের অর্থ সম্পর্কে বলেন-‘‘শব্দটির মূল অর্থ একটিই: দৃঢ় করণ, দৃঢ়ভাবে বন্ধন, ধারণ বা নির্ভর করা। শব্দটি যত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা সবই এই অর্থ থেকে গৃহীত। ‘বিশ্বাস’ বা ধর্মবিশ্বাস অর্থে ‘আকীদা’ ও ‘ই’তিকাদ’ শব্দের ব্যবহার কুরআন - হাদীসে দেখা যায় না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর যুগে বা তাঁর পূর্বের যুগে আরবী ভাষায় ‘বিশ্বাস’ অর্থে বা অন্য কোনো অর্থে ‘আকীদা’ শব্দের ব্যবহার ছিল বলে জানা যায় না। তবে ‘দৃঢ় হওয়া’ বা ‘জমাট হওয়া’ অর্থে ‘ই’তিকাদ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। শক্ত বিশ্বাস বা ধর্ম-বিশ্বাস বুঝাতে আকীদা শব্দের ব্যবহার পরবর্তী যুগগুলিতে ব্যাপক হলেও প্রাচীন আরবী ভাষায় এর ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় না। ‘আকীদা’ শব্দটিই কুরআন, হাদীস ও প্রাচীন আরবী অভিধানে পাওয়া যায় না। হিজরী চতুর্থ শতকের আগে এ শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায় না। চতুর্থ হিজরী শতক থেকে এ পরিভাষাটি প্রচলন লাভ করে। পরবর্তী যুগে এটিই একমাত্র পরিভাষায় পরিণত হয়।”
আক্বীদা ঃ পরিভাষাগত অর্থে পরিভাষাগত অর্থে আক্বীদা হচ্ছে, এমন সব দ্বীনি বিষয়াদির সমষ্টি, যার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা একজন মুমিনের জন্য অপরিহার্য। এমন সুদৃঢ় বিশ্বাস, যাতে সন্দেহের লেশমাত্র নেই। আর দ্বীনি বিষয়াদির সমষ্টি দ্বারা উদ্দেশ্য কোরআন-সুন্নাহ তথা ওহী দ্বারা সাব্যস্থ প্রতিটি বিষয় তথা আল্লাহ, ফেরেশতা, কিতাব, রাসুল, আখিরাত তথা মৃত্যু-পরবর্তী জীবন, তাকদির, পুনরুত্থান ইত্যাদী। পরিভাষাগত অর্থে আক্বীদার দুটি অর্থ নেয়া হয়েছে, ইতিবাচক ও নেতী বাচক। أما العقيدة في الاصطلاح فلها معنيان: معنى عام يشمل كل عقيدة، العقيدة الحق أو العقيدة الباطلة عند أهل الباطل، وهي تعني الإيمان واليقين الجازم الذي لا يتطرق إليه شك لدى معتقده সহী আক্বীদা আর বাতিল আক্বীদা। ঈমানের ভিত্তিমুলে কোরআন সুন্নাহর নিয়ম মেনে আমল আখলাক গড়ে তোলার নাম সহী আক্বীদাহ আর এর বিপরীত ও ব্যথয় হলে বা মনগড়া কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক না হলে এটা বাতিল আক্বীদা। (দ্রঃ أصول أهل السنة) فالعقيدة هي ما يعقد عليه الإنسان قلبَه، ويؤمن به إيمانا جازما، ويتخذه مذهبًا ودينًا يدين به. فإذا كان هذا الإيمان الجازم صحيحًا؛ كانت العقيدة صحيحة. وإن كان باطلاً؛ كانت العقيدةُ باطلة. অর্থাৎ সহী ও বাতিল আক্বীদা এর সহীহ বিশ্বাস ও আমলের উপর।
ইলমুল আক্বয়ীদ এর গুরুত্ব ঃ বিশুদ্ধ আক্বীদা ঃ বিশুদ্ধ আকীদা বিশ্বাসের মানে হচ্ছে, কোরআন-সুন্নাহে স্পষ্টভাবে উল্লেখিত ইসলামী আক্বীদা, যা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর শিক্ষা ও নির্দেশনা মোতাবেক ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। আর তা সংশয়হীনচিত্তে নিশ্চিত সত্য বলে বিশ্বাস করা এবং সব ধরনের কুফরি,শিরকি ও বিদআতি আকিদা থেকে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ আকিদার ওপর আমৃত্যু অটল অবিচল থাকাই আকিদা বিশ্বাসের পরিশুদ্ধি। আক্বীদা হলেই কেবল হবেনা বিশুদ্ধ আক্বীদার অপরিহার্য্যতা অপরিসীম। কারণ বিশুদ্ধ আক্বীদা ঈমানের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ইসলামের সুবিশাল অট্টালিকা আকিদা নামক সুদৃঢ় স্তম্ভের ওপর স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। ইসলামে আকিদার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই। নেই কোনো অস্পষ্টতা ও দোদুল্যমানতার সুযোগ। আমৃত্যু বিশুদ্ধ আকিদা সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করে ইসলামী শরিয়াহর পূর্ণাঙ্গ অনুশীলনের চেষ্টা করে যাওয়ার মধ্যেই মানবজীবনের চূড়ান্ত সফলতা নিহিত। আকিদা বিশুদ্ধ করা বান্দার প্রতি আল্লাহর সর্ব প্রথম নির্দেশনা। বিশুদ্ধ আকিদা সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। জীবনজুড়ে যা থেকে এক মুহূর্ত বিচ্যুত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
বান্দাহর প্রতি আল্লাহর সবচেয়ে বড় হক ও বড় ফরজ হচ্ছে ঈমান। পৃথিবীতে ঈমানের চেয়ে মূল্যবান সম্পদ আর কিছু নেই। একজন মুসলমানের কাছে তার জীবনের চেয়েও বেশি প্রিয় তার ঈমান। আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা অর্জন ও দুনিয়া-আখিরাতে চূড়ান্ত সফলতা অর্জনের প্রধান ও মৌলিক উপায় হচ্ছে ঈমানের আলোয় নিজেকে আলোকিত করা। সব নবীর দাওয়াতের মৌলিক বিষয়ও ছিল এটি। সব নবী-রাসুলের সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক তাগিদ ছিল আকিদা বিশুদ্ধ করার ব্যাপারেই। পবিত্র কোরআনে নবীদের দাওয়াতের যে চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তা থেকে এ বিষয়টি সূর্যালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায়। আকিদা পরিশুদ্ধির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করার মধ্য দিয়েই নবীদের দাওয়াতের সূচনা হতো। আকিদা পরিশুদ্ধ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ আকিদা বিশুদ্ধ না হলে সব আমল বরবাদ হয়ে যায়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি বিশ্বাসের বিষয় অবিশ্বাস করে অর্থাৎ যার ঈমান-আকিদা শুদ্ধ নয়, তার সব কাজ অর্থহীন এবং সে আখিরাতে ব্যর্থ মনোরথ হবে।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৫) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘নবী, আপনি বলুন, আমি কি তোমাদের সেসব লোকের সংবাদ দেব, যারা কর্মের দিক দিয়ে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত। তারাই সেসব লোক, যাদের প্রচেষ্টা পার্থিবজীবনে বিভ্রান্ত হয়, অথচ তারা মনে করে যে তারা খুব ভালো কাজ করছে।’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ১০৩-১০৪) বিখ্যাত ইমামুল মুফাস্সিরীন-ও তাফসীরকারক ইমাম ইবনে জারির আত তাবারি (রহ.) তাঁর তাফসির গ্রন্থ ‘জামেউল বায়ান’-এ উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘এখানে ক্ষতিগ্রস্ত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ইহুদি-খ্রিস্টান এবং কাফির তথা আকিদা বিশুদ্ধ নয় এমন সব ব্যক্তি।’ ইসলাম আক্বীদার বিষয়ে কোনো ধরনের শিথিলতা প্রদর্শন করেনি। আকিদার বিষয়ে ইসলাম সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। কোরআন-সুন্নাহর আলোকে সালফে সালেহিন তথা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত আমাদের সামনে যেসব আকিদা উপস্থাপন করেছেন সেগুলো সর্বান্তকরণে মেনে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এখানে মতামতের স্বাধীনতার মূলনীতি অচল।
আল্-ফিক্বহ ঃ বিশুদ্ধ আক্বীদা বিশ্বাস জাগতিক সাফল্য ও আখেরাতের মুক্তির মূল ভিত্তি হচ্ছে বিশুদ্ধ বিশ্বাস বা আক্বীদা। মানুষের মন ও বিশ্বাস-ই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। এজন্য একজন মানুষকে প্রকৃত মানুষ হতে এবং মানবতার পূর্ণতায় উপনীত হতে বিশুদ্ধ বিশ্বাসের অপরিহার্যতা আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি। কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা থেকে সুস্পষ্ট যে, বিশ্বাসের বিশুদ্ধতার উপরেই মানুষের মুক্তির মূল ভিত্তি। আক্বীদা শব্দ ইসলামী পরিবাষায় ব্যবহারের আগে ফিক্বহ কেই আক্বীদার মর্মে ব্যবহার করা হতো । কোর আন হাদীসে ফিক্বহ বা ফিক্বাহ শব্দের ব্যহহার থেকেই এর গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। যেমন কোরআনে এরশাদ হচ্ছেÑ فَلَوۡلَا نَفَرَ مِنۡ کُلِّ فِرۡقَۃٍ مِّنۡہُمۡ طَآئِفَۃٌ لِّیَتَفَقَّہُوۡا فِی الدِّیۡنِ সুতরাং তাদের প্রতিটি বড় দল থেকে একটি অংশ কেন বের হয় না, যাতে তারা দীনের উপলব্ধি অর্জনের চেষ্টা করে--------- ফলে তারা (গুনাহ থেকে) সতর্ক থাকবে।” আয়াতে একটি দলকে ইসলামের গভীর জ্ঞানার্জনের কাজে থাকে বলা হয়েছে যাতে যারা এই সুযুগ পায়না জেহাদ আন্দোলন সংগ্রাস বা অন্যান্য বাজে থাকার কারণে তাদেরকে দ্বীনের জ্ঞান দিয়ে গোনাহ’র কাজ থেকে ফিরাতে পারে জায়েজ না জায়েজ হালাল হারামের জ্ঞান দিয়ে। হাদীসে আছেÑ " مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ، وَإِنَّمَا أَنَا قَاسِمٌ وَاللَّهُ يُعْطِي، আল্লাহ্ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন। আমি তো কেবল বিতরণকারী, আল্লাহ্ই দানকারী। (বুখারী ৭১) ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) ইলমুল আকীদার নামকরণ করেছেন- ‘আল-ফিকহুল আকবার’ বা শ্রেষ্ঠতম ফিক্বহ। বিশ্বাস-জ্ঞানকে ‘‘শ্রেষ্ঠতম ফিকহ’’ নামকরণের মাধ্যমে ইমাম আযম বুঝিয়েছেন যে, ফিকহ বা ধর্মীয় জ্ঞানের যত শাখা রয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ শাখা ও দ্বীনী ইলমের শ্রেষ্ঠতম বিষয় ঈমান বিষয়ক জ্ঞান। তিনি নিজেই এ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। ‘‘আল-ফিকহুল আবসাত’’ গ্রন্থের শুরুতে আবূ মুতী বলখী (রঃ) (১৯৯ হিঃ) বলেনঃÑ سَأَلْتُ أَبَا حَنِيْفَةَ النُّعْمَانَ بْنَ ثَابِتٍ عَنِ الْفِقْهِ الأَكْبَرِ، فَقَالَ: أَنْ لاَ تُكَفِّرَ أَحَداً مِنْ أَهْلِ الْقِبْلَةِ بِذَنْبٍ، وَلاَ تَنْفِيْ أَحَداً مِنَ الإِيْمَانِ، وَأَنْ تَأْمُرَ بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَى عَنِ الْمُنْكَرِ، وَتَعْلَمَ أَنَّ مَا أَصَابَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُخْطِئَكَ، وَأَنَّ مَا أَخْطَأَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُصِيْبَكَ، وَلاَ تَتَبَرَّأَ مِنْ أَحَدٍ مِنْ أَصْحَابِ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ، وَلاَ تُوَالِيْ أَحَداً دُوْنَ أَحَدٍ، وَأَنْ تَرُدَّ أَمْرَ عُثْمَانَ وَعَلِيٍّ إِلَى اللهِ تَعَالَى.‘‘আমি আবূ হানীফা নুমান ইবনে সাবিতকে ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ (শ্রেষ্ঠতম ফিকহ) সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। তিনি বললেন-”তা এই যে, তুমি কোনো আহলে কিবলাকে পাপের কারণে কাফির বলবে না, কোনো ঈমানের দাবিদারের ঈমানের দাবি অস্বীকার করবে না, তুমি ন্যায়ের আদেশ করবে এবং অন্যায়ের নিষেধ করবে, তুমি জানবে যে, তোমার উপর যা নিপতিত হয়েছে তার ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো পথ ছিল না এবং তুমি যা পাও নি তা পাওয়ার ছিল না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ))-এর কোনো সাহাবীর প্রতি অবজ্ঞা-অভক্তি প্রকাশ করবে না, তাঁদের কাউকে বাদ দিয়ে কাউকে ভালবাসবে না, এবং উসমান (রা;) ও আলী (রা)-এর বিষয় আল্লাহর প্রতি সমর্পণ করবে।’’ ‘ফিক্হ’ শব্দটি কুরআন ও হাদীসে বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ। কুরআনে এই শব্দটি অন্তত কুড়িবার ব্যবহৃত হয়েছে গভীর জ্গান উপলব্ধি ও পান্ডিত্য বুঝানোর জন্য। কুরআন হাদীসের আলোকে ইসলামী বিধিবিধানের গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে ‘ফিকহ’ বলা হয়। ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) উল্লেখ করেছেন যে, শরীয়তের আহকাম বা বিধিবিধান বিষয়ক ফিকহ শিক্ষা করার চেয়ে দীনের বিশ্বাস বিষয়ক ফিকহ অর্জন করা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।তিনি বলেন-الْفِقْهُ فِيْ الدِّيْنِ أَفْضَلُ مِنَ الْفِقْهِ فِيْ الأَحْكَامِ... قُلْتُ: فَأَخْبِرْنِيْ عَنْ أَفْضَلِ الْفِقْهِ. قَالَ أَبُوْ حَنِيْفَةَ: أَنْ يَتَعَلَّمَ الرَّجُلُ الإِيْمَانَ بِاللهِ تَعَالَى وَالشَّرَائِعَ وَالسُّنَنَ وَالْحُدُوْدَ وَاخْتِلاَفَ الأُمَّةِ وَاتِّفَاقَهَا অর্থাৎ-দ্বীন বিষয়ে জ্ঞানার্জন আহকাম বিষয়ে জ্ঞানার্জনের চেয়ে উত্তম। আমি বললাম: তাহলে আপনি আমাকে ফিকহের উত্তম বিষয় সম্পর্কে বলুন। আবূ হানীফা (রঃ) বলেন: শ্রেষ্ঠ ফিকহ এই যে, মানুষ আল্লাহর প্রতি ঈমান শিক্ষা করবে, শরীয়তের বিধিবিধান, সুন্নাত, সীমারেখা এবং উম্মাতের মতভেদ ও ঐকমত্য শিক্ষা করবে।’’ এখানে ইমামে আযম দ্বীন ও আহকামের পার্থক্য নির্দেশ করেছেন।
আক্বীদা ঃ বিশ্বাস ও তাওহীদের নাম দ্বীন হলো বিশ্বাস ও তাওহীদের নাম, পক্ষান্তরে আহকাম ও শরীয়াহ কর্ম বা আমল বিষয়ক বিধানাবলির নাম। বিভিন্ন নবী ও রাসূলকে আল্লাহ বিভিন্ন শরীয়াহ দিয়েছেন, তবে সকলের দ্বীন এক ও অভিন্ন। এ প্রসঙ্গে ‘আল-আলিম ওয়াল-মুতাআল্লিম’ গ্রন্থে ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) বলেন- أَلَسْتَ تَعْلَمُ أَنَّ رُسُلَ اللهِ صَلَوَاتُ اللهِ وَسَلاَمُهُ عَلَيْهِمْ أَجْمَعِيْنَ لَمْ يَكُوْنُوْا عَلَى أَدْيَانٍ مُخْتَلِفَةٍ، لَمْ يَكُنْ كُلُّ رَسُوْلٍ مِنْهُمْ يَأْمُرُ قَوْمَهُ بِتَرْكِ دِيْنِ الرَّسُوْلِ الَّذِيْ كَانَ قَبْلَهُ؛ لأَنَّ دِيْنَهُمْ كَانَ وَاحِداً، وَكَانَ كُلُّ رَسُوْلٍ يَدْعُوْ إِلَى شَرِيْعَةِ نَفْسِهِ، وَيَنْهَى عَنْ شَرِيْعَةِ الرَّسُوْلِ الَّذِيْ قَبْلَهُ؛ لأَنَّ شَرَائِعَهُمْ كَثِيْرَةٌ مُخْتَلِفَةٌ، وَلِذَلِكَ قَالَ اللهُ تَعَالَى: (لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً) -----------অর্থাৎ- ‘‘তুমি কি জান না যে, আল্লাহর রাসূলগণ (আঃ) ভিন্ন ভিন্ন দ্বীনের অনুসারী ছিলেন না, প্রত্যেক রাসূল তাঁর জাতিকে পূর্ববর্তী রাসূলের দীন বর্জন করতে নির্দেশ দিতেন না; কারণ তাঁদের দীন ছিল এক। প্রত্যেক রাসূল তাঁর নিজ শরীয়ত পালনের দাওয়াত দিতেন এবং পূর্ববর্তী রাসূলের শরীয়ত পালন করতে নিষেধ করতেন; কারণ তাঁদের শরীয়ত ছিল ভিন্ন ভিন্ন। এজন্য আল্লাহ বলেছেন: ‘‘তোমাদের প্রত্যেককে শরীয়ত ও স্পষ্ট পথ প্রদান করেছি, ইচ্ছা করলে আল্লাহ তোমাদেরকে এক জাতি করতে পারতেন’’(সূরা মায়িদা: ৪৮) আর তিনি তাঁদের সবাইকে দীন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন, আর দীন হচ্ছে ‘‘তাওহীদ’’। আর তিনি নির্দেশ দিয়েছেন দীন, অর্থাৎ তাওহীদের বিষয়ে পরস্পর দলাদলি না করতে, কারণ তিনি তো তাদের একই দ্বীন প্রদান করেছেন। এজন্য তিনি বলেছেন: ‘‘তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দ্বীন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে- আর যা আমি ওহী করেছি আপনাকে- এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম,মূসা এবং ঈসাকে, এ বলে যে, তোমরা দীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে দলাদলি-বিচ্ছিন্নতা করো না।’’ ( সুরা শুরা ১৩) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন- ‘‘আমি তোমার পূর্বে কোনো রাসূলই প্রেরণ করি নি এই ওহী ব্যতীত যে, আমি ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই, সুতরাং আমারই ইবাদত কর।’’( সূরা আম্বিয়া আয়াত২৫)। মহান আল্লাহ আরো বলেন: ‘‘আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই; এটিই প্রতিষ্ঠিত দীন’’( সূরা রুম আয়াত ৩০)। অর্থাৎ তাঁর দীনের কোনো পরিবর্তন নেই। অতএব দীন কোনোভাবে পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত বা স্থানান্তরিত হয় নি; তবে শরীয়ত বা বিধি-বিধানসমূহ পরিবর্তিত হয়েছে।’’ (দ্রঃ- ইমাম আবূ হানীফা’র , আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৪১,আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম, পৃ. ১৪-১৫)
কুরআন বা হাদীসে নেই এরূপ কোনো বিষয় মুসলিমের আকীদার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। আকীদার সম্পর্ক গাইবী জগতের সাথে এবং আল্লাহ, ফিরিশতা, নবীগণ, কিতাব, আখিরাত, তাকদীর ইত্যাদির সাথে। এসকল বিষয়ে কোনো কিছু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর যুগে ছিল না কিন্তু পরে মুমিনের আকীদা বা বিশ্বাসের সাথে সংযোজিত না হলে তার আকীদার ত্রুটি হতে পারে এরূপ বাতুল চিন্তা কোনো মুসলিম করেন না। এ বিষয়ে ৫ম হিজরী শতকের অন্যতম প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ আল্লামা ইবনু আব্দল র্বার ইউসুফ ইবনু আব্দুল্লাহ (৪৬৩ হি) বলেন:- لا خلاف بين فقهاء الأمصار وسائر أهل السنة ، وهم أهل الفقه والحديث في نفي القياس في التوحيد وإثباته في الأحكام ‘‘সকল দেশের ফকীহগণ এবং আহলুস সুন্নাতের সকল ইমাম, যারা হাদীস ও ফিকহের ইমাম তাঁরা সকলেই একমত যে, ইলমুত তাওহীদ বা ইলমুল আকীদার ক্ষেত্রে কিয়াস নিষিদ্ধ এবং ফিকহী আহকামের ক্ষেত্রে কিয়াস প্রযোজ্য।’’ (জামিউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহী, পৃষ্ঠা ৭৪)
পরিশুদ্ধ আক্বীদা বলতে যা বোঝায় ঃ আকিদা ও বিশ্বাসের পরিশুদ্ধির মানে হচ্ছে, কোরআন-সুন্নাহে স্পষ্টভাবে উল্লিখিত ইসলামী আকিদা, যা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর শিক্ষা ও নির্দেশনা মোতাবেক ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। আর তা সংশয়হীনচিত্তে নিশ্চিত সত্য বলে বিশ্বাস করা এবং সব ধরনের কুফরি,শিরকি ও বিদআতি আকিদা থেকে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ আকিদার ওপর আমৃত্যু অটল অবিচল থাকাই আকিদা বিশ্বাসের পরিশুদ্ধি। বিশুদ্ধ আকিদা ঈমানের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ইসলামের সুবিশাল অট্টালিকা আকিদা নামক সুদৃঢ় স্তম্ভের ওপর স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। ইসলামে আক্বীদার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই। নেই কোনো অস্পষ্টতা ও দোদুল্যমানতার সুযোগ। আমৃত্যু বিশুদ্ধ আক্বীদা সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করে ইসলামী শরিয়াহর পূর্ণাঙ্গ অনুশীলনের চেষ্টা করে যাওয়ার মধ্যেই মানবজীবনের চূড়ান্ত সফলতা নিহিত। আক্বীদা বিশুদ্ধ করা বান্দার প্রতি আল্লাহর সর্ব প্রথম নির্দেশনা। বিশুদ্ধ আক্বীদা সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। জীবনজুড়ে যা থেকে এক মুহূর্ত বিচ্যুত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আকিদা ও বিশ্বাসের পরিশুদ্ধির মানে হচ্ছে, কোরআন-সুন্নাহে স্পষ্টভাবে উল্লিখিত ইসলামী আক্বীদা যা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর শিক্ষা ও নির্দেশনা মোতাবেক ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। আর তা সংশয়হীনচিত্তে নিশ্চিত সত্য বলে বিশ্বাস করা এবং সব ধরনের কুফরি, শিরকি ও বিদআতি আক্বীদা থেকে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ আকিদার ওপর আমৃত্যু অটল অবিচল থাকাই আকিদা বিশ্বাসের পরিশুদ্ধি। আক্বীদা ও বিশ্বাসের পরিশুদ্ধির মানে হচ্ছে, কোরআন-সুন্নাহে স্পষ্টভাবে উল্লেখিত ইসলামী আক্বীদা যা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর শিক্ষা ও নির্দেশনা মোতাবেক ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। আর তা সংশয়হীনচিত্তে নিশ্চিত সত্য বলে বিশ্বাস করা এবং সব ধরনের কুফরি, শিরকি ও বিদআতি আক্বীদা থেকে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ আকিদার ওপর আমৃত্যু অটল অবিচল থাকাই আকিদা বিশ্বাসের পরিশুদ্ধি।
আক্বীদার কয়েকটি পরিভাষা ঃ আক্বীদা العقيدة–আরবী শব্দ এর বহুবচন: العقائد–আল-আক্বা'ইদ যা ইসলামি ধর্মতত্ব নামেও পরিচিত। আক্বীদা একটি ইসলামি পরিভাষা,যার অর্থ 'কিছু মূল ভিত্তির উপর বিশ্বাস স্থাপন'। বিশ্বাস বা ধর্মবিশ্বাস বুঝাতে মুসলিম সমাজে সাধারণত দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়,ইমান ও আক্বীদা। তবে কুরআন-হাদীসে সর্বদাই 'ঈমান' শব্দটিই ব্যবহৃত হয়েছে। "আক্বীদা" ব্যবহৃত হয়নি। হিজরী দ্বিতীয় শতক থেকে তাবেয়ীগণ (সাহাবীদের ছাত্র) ও পরবর্তী যুগেই ঈমাম মুজতাহিদ ইমামগণ ধর্মবিশ্বাসের খুঁটিনাটি বিষয় আলোচনার জন্যেই" ঈমান" ছাড়াও আরো কিছু পরিভাষা ব্যবহার শুরু করেন। এসকল পরিভাষার মধ্যে রয়েছে 'আল-ফিকহুল আকবার','ইলমুত তাওহীদ,'আস–সুন্নাহ','আশ শরীয়াহ','উসূলুদ-দীন','আল- আক্বীদা বা আক্বায়ীদ' ইত্যাদি। এসবের মধ্যে 'আক্বীদাহ' শব্দটি সর্বশেষ ও নতুন হলেও এটাই অধিক প্রচলিত। আক্বীদা শব্দটির ব্যবহার শুরু হয় ইসলামের সুচনাকাল থেকে প্রায় তিন শত বছর পরে হিজরী চতুর্থ শতকে। এর আগে বিষয় একই হলেও শব্দ ছিল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন। যেমন-
(১) তাওহীদ ঃ ইলমুত তাওহীদ বা আল্লাহর অদ্বিতীয়বাদ/একত্ববাদের জ্ঞান বা তাওহীদ শাস্ত্র বলতে যা বুঝানো হতো বা হয় সেটাই ইলমুল আক্বায়ীদ বা আক্বায়ীদ শাস্ত্র। ইমাম আবু হানিফা (রঃ) আক্বায়ীদকে তাওহীদ নামেই অভিহিত করেছেন। এই পরিভাষাটিও হিজরী ২য় থেকে ৩য় শতকের মধ্যেই পরিচিতি লাভ করে। (২) আল-ফিক¦হ বা ফেক্বাহ ঃ ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) আকীদা বিষয়ে রচিত তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থটির নাম রেখেছেন ‘আল-ফিকহুল আকবার’। যার মানে‘আকীদা’ তাই আক্বিদা বুঝাতেই প্রাচীনতম এই পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। এ জন্য আজকাল অনেকে তাওহীদের গুরুত্ব দিলেও ফেক্বাহকে গুরুত্ব দেয়না এই কারণে যে তারা মনে করেন তাওহীদ ই মূল। বিশেষত মাদখালী আহলে হাদীস সালাফিদের কোন কোন ফিরক্বাহ ফিক্বাহ মানতেই চায়না। মূলত এটা একই অর্থবোদক যদিও শব্দ ভিন্ন। (৩) আস-সুন্নাহ ঃ ‘সুন্নাহ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ মুখ,ছবি, প্রতিচ্ছবি, প্রকৃতি, জীবন পদ্ধতি, কর্মধারা ইত্যাদী। শরীয়তের পরিভাষায়‘সুন্নাত’ অর্থ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কথা, কর্ম, অনুমোদন তথা সামগ্রিক জীবনাদর্শ। শরীয়ত পালনে রাসুলের জীবনাদর্শ থেকে বিচ্যুতি ঘটলেই মানুষ বিভ্রান্ত বা ভ্রষ্ট হয়ে যায় বলেই হিজরী তৃত্বীয় শতাব্দী থেকে আক্বীদাকে সুন্নাহ নামেই অবিহিত করা হত বা যেটা সুন্নাহ সেটাই সঠিক আক্বীদা আর সুন্নাহর খেলাফ হলেই এটা ভ্রান্ততা বা গোমরাহী । সুন্নাহর মধ্যে আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামের অনুসৃত আমলও শামিল। যারা আক্বীদা কে সুন্নাহ নামে অভিহিত করে গ্রন্থ রচনা করেছেন তাদের মধ্যে আছেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রঃ) সহ তাঁর পরের অনেক ওলামায়ে কেরাম রয়েছেন। (৪) আস-শারীয়া’হ ঃ শারীয়ত’ বা ‘শারীয়া’হ’র আভিধানিক অর্থ নদীর ঘাট,পানি পানের স্থান বা পথ ইত্যাদী। ইসলামের পরিভাষায় ‘শারী‘য়াহ’ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ রয়েছে। এর মধ্যে এক অর্থ ‘‘ধর্ম বিশ্বাস’’ বা বিশ্বাস বিষয়ক মূলনীতিসমূহ। তৃতীয় শতকের কোনো কোনো ইমাম ‘‘আশ-শারী‘য়াহ’’ বা ইলমে শরীয়াহ নামে আকীদা বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন। (৫) উসূলুদ্দীন বা উসূলুদ্বীনিয়্যাহ ঃ উসূলুদ্দীন বা উসূলুদ্বীনিয়্যাহ: দ্বীনের ভিত্তিসমূহ। চতুর্থ শতক থেকে কোনো কোনো আলিম আক্বীদা বুঝাতে এ পরিভাষাটি ব্যবহার করেছেন। (৬) ইলমুল কালাম: ইলমুল কালাম বা কথাশাস্ত্র ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস বিষয়ক আলোচনা বা গবেষণাকেও কখনো কখনো ‘ইলমুল কালাম’ বলা হয়। দ্রঃ আল ফিক্বহুল আকবর, ইয়াহইয়াউল উলুমুদ্বীন,আল-মিসবাহুল মুনীর ১/৩১০,আকীদাতু আহলিস সুন্নাহ, পৃ. ১৬-১৭, মু’জামু মাকায়িসিল লুগাহ ৪/৮৬, ইসলামী আকীদা, পৃষ্ঠা ২১-৩২।
ইলমুল আক্বায়ীদ এর আলোচ্য বিষয় ও উদ্দেশ্য ঃ স্বভাবতই ইলমুল আক্বয়ীদ এর আলোচনা বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। আলোচনার বিষয়স্তুর দিকে দৃষ্টি দিলে আক্বীদার মৌলিক চারটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়। (১) ‘আল-উলূহিয়্যাহ’ الالوهية:অর্থাৎ মহান আল্লাহর সত্তা, বিশেষণ,মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়। (২)‘আন-নুবুওয়াত’ النبوة: অর্থাৎ নবীগণের পরিচয়, মর্যাদা, দায়িত্ব, তাঁদের প্রতি বিশ্বাসের স্বরূপ ইত্যাদি। (৩):‘আল-ইমামাহ’ (الإمامة: অর্থাৎ মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের যোগ্যতা,মর্যাদা, দায়িত্ব ইত্যাদি। (৪) ‘আল-আখিরাহ’ (الآخرة: অর্থাৎ মৃত্যু পরবর্তী জীবন,কবর,পুনরুত্থান,বিচার,জান্নাত,জাহান্নাম ইত্যাদি। আকীদা বিষয়ক সকল আলোচনাই মূলত এগুলোকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। আর সকল আলোচনার উদ্দেশ্য সুন্নাতে নববীর অনুসরণ। মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর পদ্ধতিতে ও অনুকরণে আল্লাহর ইবাদতই ইসলাম। ইসলামী ইলমের সকল শাখার উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন, এবং মুমিনের জীবনকে হুবহু রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অনুসরণে পরিচালিত করা। ইলমুল ফিকহ-এর উদ্দেশ্য মুমিনের ইবাদত, মুআমালাত ও সকল কর্মকান্ড যেন অবিকল রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবীগণের আদলেই পালিত হয়। ইলমুত তাযকিয়া বা তাসাউফের উদ্দেশ্য মুমিনের হৃদয়ের অবস্থা যেন অবিকল তাঁদের পবিত্র হৃদয়গুলোর মত হয়ে যায়। অনুরূপভাবে ইলমুল আকীদা বা আল-ফিকহুল আকবারের উদ্দেশ্য মুমিনের বিশ্বাস যেন হুবহু তাঁদের বিশ্বাসের সাথে মিলে যায়। এ ছাড়া উসূলুস্সুন্নাহ কিতাবের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আক্বীদার বিষয়বস্তুর মধ্যে আছে যেমন- أما العقيدة الإسلامية، فهي تعني: اليقين والتسليم والإيمان الجازم بالله عز وجل، وما يجب له من التوحيد والعبادة والطاعة، ثم بملائكته وكتبه ورسله واليوم الآخر والقدر، --------------------- মর্ম- সামগ্রিক অর্থে আক্বীদা হল, ইসলামের যে সকল ভিত্তি কিতাব, সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কেরামের ঐক্যমত দ্বারা নির্দেশিত তা নির্দ্বিধায় অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা এবং বিনা বাক্যে মেনে নেয়া এবং এক্ষেত্রে অন্তরে কোনো ধরনের কপটতার স্থান না দেয়া। সে সকল বিষয় হল: আল্লাহ, ফেরেশতা, তাঁর কিতাব, তাঁর রসূল, কেয়ামত, তাকদিরের ভালো ও মন্দে বিশ্বাস করা এবং কুরআনে যা কিছু এসেছে তার সমস্ত কিছুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা সেই সাথে নবী (সাঃ) যা কিছু আল্লাহর তরফ থেকে নিয়ে এসেছেন তা বিনা দ্বিধায় মেনে নেয়া। এছাড়াও অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস,আল্লাহর একত্ববাদ এবং মহত্ব, তার নির্দেশিত পথে ইবাদত বন্দেগী করা, কুফরি বাতিল বা অসত্য হওয়ার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন, ইসলামে অবিশ্বাসী ও আল্লাহর সাথে অপরকে শরিককারী সকলের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন, আল্লাহর সাথে সাক্ষাত হওয়া, তাঁকে দেখা ও হাশরের মাঠে তাঁর পুরস্কার ও পরিণতির প্রতি বিশ্বাস রাখাও আকিদার অন্তর্ভুক্ত। দ্বীনী স্বার্থে আল্লাহর ওয়াস্তে ওলামায়ে কেরাম ও সালেহীনদের প্রতি মুহব্বত রাখাও সহী আক্বীদার অন্তর্ভূক্ত। এর পর বলা হয়েছে যে هذا ملخص ما عرف به أهل العلم هذا المصطلح الشرعي، لهذا العلم الجليل، ويدخل في أفراد العقيدة الصحيحة أركان الإيمان الستة، وتفريعاتها، وما التحق بذلك من الحب في الله، والبغض في الله، والولاء والبراء، والموقف من الصحابة ونحو ذلك. মর্ম - সার কথা হলো ঈমানের মৌলিক ছয় বিশ্বাস ও ইসলামের পঞ্চস্তম্ব মেনে চলার নাম ই আক্বীদা। ইসলামের মৌলিক স্তম্ভ হচ্ছেÑপাঁচটি। (এক) ঈমানঃ আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর বান্দাহ ও রাসুল-এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা। (দুই) সলাত আদায় করা (তিন) যাকাত আদায় করা (চার) হজ্জ পালন করা এবং (পাঁচ) রমজানের রোজা রাখা।
ঈমান- আক্বীদার পারস্পরিক সম্পকর্ ঃ আগেই বলা হয়েছে আক্বীদা শব্দটি আরবী উক্বদ ধাতু থেকে যার অর্থ চুক্তি,অঙ্গিকার,ওয়াাদা,প্রতিজ্ঞা ইত্যাদী হয়। যার মূল স্প্রীট আস্থা বিশ্বাস বা অবিচলতা ইত্যাদী। শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহর বিধান আল্লাহ প্রেরিত রাসুলের আদর্শ বা প্রদর্শিত পদ্ধতিতে পালন করা বা মেনে চলার নাম আক্বীদা বা আক্বায়ীদ বা ধর্ম বিশ্বাস। ইসলামে ঈমান আক্বীদা পারস্পরিক সম্পুরক ও অবিচ্ছেদ্য বিষয় তাই এখান থেকেই এ গুরুত্ব অনুধাবন করে নিতে হয়। ঈমান আছে আমল নেই ভালো আমল বা কাজ আছে কিন্তু ঈমান নেই এই অবস্থা যেমন নিস্ফলা গাছের মত ঠিক ঈমান আছে কিন্তু আক্বীদা সঠিক নেই মানে ঈমানের উপর বা বিশ্বাসের উপর আস্থা বা দর্শন নেই এটাও নিস্ফলা গাছের মতো। এজন্য ইমান-ইসলামের সাথে সাথে আমলে সালেহ এর গুরুত্ব যেমন অবিচ্ছেদ্য তেমনী ঈমানের সাথে আক্বীদাও অবিচ্ছেদ্য। এ থেকেও অনুমান করা যায় আাক্বীদা কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ঈমান আক্বীদার মৌলিক পার্থক্য ও সম্পর্ক ঃ আরবী ভাষায় আকীদা শব্দের আভিধানিক অর্থ বিশ্বাস, আর ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো স্বীকৃতি দেয়া, স্বীকার করা বা মেনে নেয়া। অর্থাৎ কোন বিষয়ে বিশ্বাসের প্রকৃতি বা ধরনের নাম হলো আকীদা, আর কোন আকীদা বা বিশ্বাসকে স্বীকৃতি দেয়া বা মেনে নেয়ার নাম হলো তার উপর ঈমান আনা। এছাড়াও ওলামায়ে কেরাম আক্বীদা ও ঈমানের পার্থক্য করে বলেন যে, আকীদা বলতে ধর্মবিশ্বাসের সকল মত, পথ, প্রচলন, বৈচিত্র ও বর্ণালীকে বোঝায় আর ঈমান শুধু সুনির্দিষ্ট বিশুদ্ধ ইসলামী ধর্মবিশ্বাসকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
ঈমান অর্থ হলো স্বীকৃতি দেয়াা বা স্বীকার করা, যার তিনটি স্তর বা ধাপ রয়েছে (এক) অন্তরে বিশ্বাসের মাধ্যমে স্বীকৃতি প্রদান করা। এর সম্পর্ক ক্বলব বা অন্তরের সাথে (দুই) মুখ দ্বারা অর্থাৎ প্রকাশ্যে বলে ঘোষণার মাধ্যমে স্বীকৃতি প্রদান করা। এর সম্পর্ক প্রকাশ্যে মুখ দিয়ে স্বীকার ও প্রকাশ করা। (তিন) আমল বিল আরকান বা কাজের মাধ্যমে স্বীকৃতি প্রদান করা অথবা ঈমানের দাবী অনুযায়ী রাসুলের অদর্শ মোতাবেক আমল করা। এর মধ্যে অন্তরে বিশ্বাসের মাধ্যমে স্বীকৃতি প্রদান করার ধাপ বা স্তরটি আক্বীদা বা বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কযুক্ত, যা ঈমানের মৌলিক ভিত্তি বা শেকড়।
এর অনুকুলে আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণিত হাদীস যেখানে তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, ’’তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোন গর্হিত কাজ দেখবে, সে যেন তা নিজ হাত দ্বারা পরিবর্তন করে দেয়। যদি সেই ক্ষমতা বা সক্ষমতা না রাখে, তাহলে উপদেশ প্রদানের মাধ্যমৈ পরিবর্তন করে। যদি সেই সামর্থ্যও না রাখে, তাহলে অন্তর দ্বারা ঘৃণা করে। আর এ হল সবচেয়ে দুর্বল ঈমান।’’ বুখারী ৯৫৬, মুসলিম ৪৯,তিরমিযী২১৭২,
আক্বীদাহ’র ব্যবহারগত প্রকারভেদ ঃ
আক্বীদা প্রকারের সংখ্যা বিভিন্ন মতের হতে পারে, তবে সাধারণত আক্বীদাকে তিনটি প্রকারে ভাগ করা হয়-আক্বীদা মানে হল একজন ব্যক্তির বিশ্বাস ও অর্থগত ধারণা। এই দিক থেকে আক্বীদার ব্যবহারিক তিনটি ধারা আছে। যেমন - ইসলাম, মানবতাবাদ, বিচার ও মতানৈক্যবাদ।
(এক) ইসলামে আক্বীদা হল আল্লাহর অসল ও বিশ্বাসী পরিচয়ের প্রকাশ।
(দুই) মানবতাবাদে আকিদা মানে হল মর্যাদার ও মানবিক অন্তর্ভুক্তিতা বজায় রাখার ধারণা। যেমন- মানবাধিকার,ন্যায্য অধিকার জুলুম প্রতিরোধ ইত্যাদি।
(তিন) বিচার ও মতানৈক্যবাদে আকিদা মানে হল তত্ব এবং মত সাম্প্রদায়িকতার প্রমাণ ও পরিমাপন, ধারণা বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মানবিক উৎপাদক কার্যকারিতা।
মৌলিক আক্বীদা বিশ্বাসের পাশাপাশি কিছু ক্ষুদ্র ও বৃহত্ত ফেরকা ও সলুক আছে যাদের কিছু নিজস্ব বৈশীষ্টগত আক্বীদা আছে যে গুলো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখা জরুরী। তা না হলে বাতিল ফেরকা গুলো চেনা মুশকিল হবে। যেমনÑ মুরজিয়া, খাওয়ারিজ বা খারেজী,জাহমিয়া,কাদারিয়া ইত্যাদী। উদ্দেশ্য হল সেই দলগুলোর সাথে ধার্মিক পূর্বসূরিরা বা সালাফে সালেহীন কীভাবে আচরণ করেছিলেন সেদিকে ফিরে আসা। আক্বীদার এই বিষয়ে বিভিন্ন ফেরক্বা বা উপদল গুলো এবং তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো জানার দরকার আছে। প্রত্যেক ফেরাকা বা উপদলগুলো তাদের আক্বীদা বিশ্বাসের বিষয়গুলো নিজেদের কিতাবাদী লিখেছেন।
এ ছাড়াও কিছু মৌলিক ফেরক্বা বা গোষ্ঠি আছে যাদের আক্বীদার স্বাতন্ত্ররতা আছে। যেমন- আশআরী,মাতুরিদি,আছারী,কালাম প্রভৃতি এরা সকলেই সুন্নী বা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অনুসারী।
আক্বীদা বিশ্বাসের মৌলিক ভিত্তি ঃ ওহী ঃ আগেই বলা হয়েছে যে ইসলামী আক্বীদার একমাত্র উৎস হচ্ছে ওহী আর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ওহীর ব্যাখ্যাতা বা সাহেবে শারেহ হিসাবে তাঁর আদর্শ বা সুন্নাহ হচ্ছে ওহীর ব্যাখ্যা আর কুরআন হচ্ছে ওহীর লিখিত দলীল। তাই বলা হয়ে থাকে এবং এটাই সত্য বিশ্বাস যে ওহী দু প্রকারে প্রেরিত হয়েছে, (এক) কিতাবুল্লাহ বা আল্লাহর কিতাব কুরআন মজিদ। (দুই) সুন্নাহ বা হাদীস। কুরআন অনুসারে আল্লাহ রাসূলের প্রতি কিতাব ও হিকমত অবতীর্ণ করেছেন। হিকমতকে রাসূলের সুন্নাহ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। কুরআনের সাথে সুন্নাহর পার্থক্য হল, সুন্নাহর শব্দাবলী আল্লাহর পক্ষ থেকে নয় কিন্তু কুরআনের শব্দাবলিও আল্লাহর। তবে উভয়টিরই তথ্যসমূহ আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত। কর্ম বা আমলের বিষয়ে ইসলামের বিধান নির্ণয়ে কিয়াস বা অনুমানের উপরে নির্ভর করা যায়। কিন্তু ইসলামি বিশ্বাস গায়েব বা অদৃশ্য বিষয়ের উপর নয়। আহলে ইলিম এর মতে, এ সকল বিষযে মানুষ ওহীর নির্দেশনা ছাড়াা অনুমান করে অথবা গবেষণা করে কোনো সমাধান দিতে সক্ষম নয়। এছাড়া ওহীর ব্যাখ্যা সেভাবেই করতে হয়, যেভাবে সাহাবী ও তাবেয়ীগণ ব্যাখ্যা করেছেন। কুরআনুল করীমে ঈমানের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে বলা হয়েছে- اٰمَنَ الرَّسُوْلُ بِمَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْهِ مِنْ رَّبِّهٖ و الْمُؤْمِنُوْنَ١ؕ كُلٌّ اٰمَنَ بِاللّٰهِ وَ مَلٰٓئِكَتِهٖ وَ كُتُبِهٖ وَ رُسُلِهٖ١۫ لَا نُفَرِّقُ بَیْنَ اَحَدٍ مِّنْ رُّسُلِهٖ١۫ وَ قَالُوْا سَمِعْنَا وَ اَطَعْنَا١٘ۗ غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَ اِلَیْكَ الْمَصِیْرُ অর্থাৎ রসূল তার রবের পক্ষ থেকে তার ওপর যে হিদায়াত নাযিল হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছে। আর যেসব লোক ঐ রসূলের প্রতি ঈমান এনেছে তারাও ঐ হিদায়াতকে মনে-প্রাণে স্বীকার করে নিয়েছে। তারা সবাই আল্লাহকে, তাঁর ফেরেশতাদেরকে, তাঁর কিতাবসমূহকে ও তাঁর রসূলদেরকে মানে এবং তাদের বক্তব্য হচ্ছেঃ “আমরা আল্লাহর রসূলদের একজনকে আর একজন থেকে আলাদা করি না। আমরা নির্দেশ শুনেছি ও অনুগত হয়েছি। হে প্রভু! আমরা তোমার কাছে গোনাহ মাফের জন্য প্রার্থনা করছি। আমাদের তোমারই দিকে ফিরে যেতে হবে। ( বাকারা-২৮৫ )
ইসলামী আকীদার উৎস ঃ আক্বীদা বিশ্বাসের মৌলিক ৭টি বিষয় আছে যে গুলোকে ঈমানের রোকনও বলা হয়। আর ইসলামী আক্বীদার একমাত্র উৎস হচ্ছে ওহী। ইসলামী আক্বীদা বিশ্বাস অনুসারে ওহী দু পদ্ধতীতে প্রেরিত হয়েছে (এক) কিতবুল্লাহ বা আল্লাহর কিতাব কুরআন। (দুই) সুন্নাহ বা হাদীস। কুরআনের বর্ণনামতে আল্লাহ রাসূলের প্রতি কিতাব ও হিকমত অবতীর্ণ করেছেন। হিকমতকে রাসূলের সুন্নাহ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর কুরআনের সাথে সুন্নাহর মৌলিক পার্থক্য হল, সুন্নাহর শব্দাবলী আল্লাহর পক্ষ থেকে নয়। তবে উভয়টিরই তথ্যসমূহ আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত। কুরআনে করীমে এরশাদ হচ্ছে-
ইলমুল আক্বায়ীদ এর প্রসিদ্ধ ইমামদের পরিচিতিঃ
ইমাম মাতুরিদীর (রঃ) ঃ আবু মানসুর মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে মাহমুদ আল-সমরকন্দী (৮৫৩-৯৪৪ খ্রিঃ)) ছিলেন একজন হানাফি ইসলামী স্কলার ও ইলমুল আক্বায়ীদ বিশেষজ্ঞ। বিচারপতি,তাফসীর ও ফিক্হ বিশেষজ্ঞ। তিনি আবু মনসুর আল মাতুরিদি বা ইমাম মাতুরিদি নামেই বেশি পরিচিত। আল মাতুরিদি ফিকাহ শাস্ত্রের প্রবর্তকদের মধ্যে অন্যতম এবং তার লেখা দুটি গ্রন্থ এই শাস্ত্রের মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ গুলো হচ্ছেÑ تأويلات أهل السنة ও كتاب التوحيد তিনি তাঁর সমকালীন ওলামা মাশায়েখদের মধ্যে ছিলেন উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। তাঁর উসতাযগণের মধ্যে ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে মুকাতিল (রঃ) (২৪৮ হিঃ), ইমাম আবু নসর ‘ইয়াযী, ইমাম নুসাইর ইবনে ইয়াহইয়া বলখী (২৬৮ হিঃ) এবং ইমাম আবু বকর আহমদ ইবনে ইসহাক জুরজানী (রঃ) এর কথা বিশেষভাবে আলোচিত হয়। আবু বকর জুরজানী হলেন ইমাম আবু সুলাইমান জুরজানীর শাগরিদ, যিনি ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান শায়বানী (১৮৯ হি.) (রঃ) এর শাগরিদ। আর ইমাম মুহাম্মাদ হলেন ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম সুফিয়ান সাওরীসহ হাদীস, ফিকহ ও আকাইদের অনেক ইমামের শাগরিদ। মুহাম্মাদ ইবনে মুকাতিল রাযী (রঃ) সরাসরি ইমাম মুহাম্মাদের (রঃ) শাগরিদ। অপর দিকে নুসাইর ইবনে ইয়াহইয়া ইমাম আবু সুলায়মান জুরজানীরও (রঃ) শাগরিদ আবার ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সামাআ’রও শাগরিদ। মুহাম্মাদ ইবনে সামাআ ইমাম আবু ইউসুফের শাগরিদ আর তিনি ইমাম আবু হানীফার (রঃ) শাগরিদ। এ জন্য ই হানাফী মাজহাবের অনুসারী আহলে ইলিমগণ মাতুরিদী চিন্তার লালন করে সব সময় বাতিল ফিরকা সমূহের অপতৎপরাতা সম্পর্কে বেশী ব্যস্ত থাকেন।
ইমাম আশআরী (রঃ) আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আরেক ধারার ভাষ্যকার ও ইলমুল আক্বয়ীদ এর ঈমাম যাকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ও ইমাম বলা হয় তাঁর নাম হলো ইমাম আশআরী (রঃ)।ইমাম আশআরী’র উপনাম আবুল হাসান,নাম আলী ইবনে ইসমাঈল। নবী আলাইহিস সালাম এর বিশিষ্ট সাহাবী আবু মূসা আশআরী’র (রাঃ) বংশধর। (২৬০- ৩২৪ হিঃ)বসরার অধিবাসী ছিলেন। ইমাম আবুল হাসান আশআরী (রঃ) প্রথমে মু‘তাযিলা ফেরকার বড় ব্যক্তিত্ব আবু আলী জুব্বায়ীর শাগরিদ ও তার আকীদার অনুসারী ছিলেন। আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহে পরবর্তীতে তাঁর কাছে মু‘তাযিলাদের গোমরাহী স্পষ্ট হয়ে যায়। ফলে তিনি প্রকাশ্যে তওবা করে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদায় ফিরে আসেন এবং মু‘তাযিলাদের ভ্রান্ত আকীদাসমূহের খন্ডনে কলম ধরেন। তিনি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আক্বাঈদের সমর্থনে এবং বিভিন্ন বাতিল ফেরকার সংশয়সমূহের অপনোদনে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু কিতাব রচনা করেন। তার কিতাবসমূহের মধ্যে ‘আলইবানা আন উসূলিদ দিয়ানা’ (الإبانة عن أصول الديانة) , ‘আল লুমা ফির রদ্দি আলা আহলিয যায়গি ওয়াল বিদা’(اللمع في الرد على أهل الزيغ والبدع) , ‘মাকালাতুল ইসলামিয়্যীন ওয়াখতিলাফুল মুসাল্লীন’ ((مقالات الإسلاميين واختلاف المصلين ‘ইসতিহসানুল খওযি ফী ইলমিল কালাম’ (استحسان الخوض في علم الكلام) ইত্যাদি ছাপা হয়েছে। আবুল হাসান আশআরী’র (রাঃ) ইলিম হাসিল করেছেন ইমাম শাফেয়ী (রঃ) ও তাঁর সমসাময়িক শাফেয়ী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফকীহ আবু ইসহাক মারওয়াযী থেকে। তিনি আবুল আব্বাস ইবনে সুরাইজের শাগরিদ ছিলেন। ইবনে সুরাইজ হলেন ইমাম আবুল কাসেম আনমাতীর (রঃ) শাগরিদ আর তিনি ইমাম মুযানীর শাগিরদ। আর মুযানী (রঃ) ছিলেন ইমাম শাফেয়ীর বিশিষ্ট শাগরিদ। ইমাম আবুল হাসান আশআরীর অন্যান্য উসতাযগণের মধ্যে যাকারিয়া সাজী (৩০৭ হিঃ), আবু খলীফা জুমাহী (২০৬--৩০৫ হিঃ), আবদুর রহমান ইবনে খালাফ বসরী (২৭৯ হিঃ) (রঃ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁদের মধ্যে যাকারিয়া সাজী (রঃ) হাফিযুল হাদীস এবং মুফতী ছিলেন। তিনি ইলমে ফিকহ হাসিল করেছেন ইমাম শাফেয়ী’র (রঃ) দুই শাগরিদ রবী‘ ও মুযানী (রঃ) এর কাছ থেকে। যাকারিয়া সাজী ইলমে হাদীসের ইমামগণের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। তাঁর সম্পর্কে শামসুদ্দীন যাহাবী রাহ. লিখেছেন-كان من أئمة الحديث، أخذ عنه أبو الحسن الأشعري مقالة السلف في الصفات، واعتمد عليها أبوالحسن في عدة تآليف. আবুল হাসান আশআরী আল্লাহ তাআলার সিফাত সংক্রান্ত বিষয়ে সালাফের নীতি তাঁর থেকেই গ্রহণ করেছেন এবং তিনি তাঁর বিভিন্ন কিতাবে এই নীতিরই অনুসরণ করেছেন। (-সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, খন্ড১৪ পৃষ্ঠা১৯৮) ইমাম আবু মানসুর মাতুরীদী বয়সে ইমাম আবুল হাসান আশআরীর বড় ছিলেন। তাঁর জন্ম ইমাম আশআরীর আগে হয়েছিল, তবে ওফাত হয়েছিল পরে। এদিকে আশআরী’র (রঃ)-মত তাঁর জীবনে দুই ভাগ ছিল না, তিনি শুরু থেকে ওফাত অবধি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের নীতি ও আদর্শের উপর অবিচল ছিলেন।এ থেকেই অনুমান করা যায় ইমাম মাতুরিদীর (রঃ) ও ইমাম আশআরী’র (রঃ) ইলমী যেগ্যতা কতটা উঁচুমানের ছিল এটা বুঝানোর জন্যই আমরা তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরলাম।
আকীদাতুত ত্বাহাবি ঃ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের এই ইমামদ্বয় ছিলেন ইমাম আবু জাফর তহাবী (রঃ) এর সমসাময়িক। ইমাম আবু জাফর ত্বাহাবী হিজরী তৃতীয় শতকের শেষার্ধে ও চতুর্থ শতকের প্রথম এক-চতুর্থাংশে মিসরে ইলমে হাদীস ও ইলমে ফিকহের বড় ইমামগণের অন্যতম ছিলেন। আক্বীদার দিক থেকে তিনি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের ইমাম ছিলেন আর মাযহাবের দিক থেকে হানাফী মাযহাবের ফকীহ ছিলেন। তাঁর জন্ম ২৩৯ হিজরীতে আর ওফাত ৩২১ হিজরীতে। হাদীস শাস্ত্রে তাঁর রচিত ‘শরহু মাআনিল আসার’ ও ‘শরহু মুশকিলিল আসার’ হল তাজদীদী কিতাব। ইলমে ফিকহ ও ইলমে তাফসীরেও তাঁর লিখিত কিতাবগুলো সর্বজন সমাদৃত। তিনি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আকাঈদ বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত কিতাব রচনা করেন,যা ‘আলআকীদাতুত তহাবিয়্যা’ নামে পরিচিত। সমগ্র পৃথিবীতে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের নীতি ও আদর্শের মুখপত্র হিসেবে এই কিতাবটি গ্রহণ করা হয়েছে।
এই কিতাবের শুরুতে ইমাম ত্বাহাবী (রঃ) লিখেছেন-هذا ذكر بيان عقيدة أهل السنة والجماعة على مذهب فقهاء الملة، أبي حنيفة النعمان بن ثابت الكوفي، وأبي يوسف يعقوب بن إبراهيم الأنصاري، وأبي عبد الله محمد بن الحسن الشيباني، رضوان الله عليهم أجمعين، وما يعتقدون من أصول الدين এই কিতাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আকীদা বর্ণনা করবেন। আর এসব আক্বীদা তিনি হানাফী মাযহাবের প্রথম সারির তিন ইমাম (ইমাম আবু হানীফা রাহ. ৮০ হি.-১৫০হি., ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ) ১১৩ হি.- ১৮২ হিঃ ও ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান ১৩২ হি.- ১৮৯ হিঃ)-এর রেওয়ায়েতও আক্বীদা মোতাবেক বর্ণনা করবেন।
ইতিহাসে এমন কোনো বর্ণনা সংরক্ষিত নেই, যার দ্বারা বোঝা যায়, এই ইমামত্রয়ের অর্থাৎ ইমাম আবু মানসুর মাতুরীদী, ইমাম আবুল হাসান আশআরী ও ইমাম আবু জাফর ত্বাহাবী পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছে। তবে যেহেতু এই তিনজনই ইলমে ওহী ও উলূমে শরীয়তে পারদর্শী ছিলেন এবং ইলমে দ্বীন নিয়মমাফিক সালাফে সালেহীনের স্থলবর্তী ইমামগণ থেকে হাসিল করেছেন সেজন্য তাঁরা সকলে একই গন্তব্যে পৌঁছেছেন এবং ইসলামী আকীদার প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে তাঁরা যে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন তার ফলাফল একই হয়েছে। তিনজন একই সময়ে ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মাসলাক ও নীতি-আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পার্থক্য এটুকু যে, ইমাম ত্বাহাবী সংক্ষেপে শুধু মৌলিক আকীদাগুলো উপস্থাপন করেছেন। আর ইমাম মাতুরীদী ও ইমাম আশআরী সেই আকীদাগুলো ব্যাখ্যা ও দলীলসহ সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। পাশাপাশি সেসব আকীদার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভ্রান্ত ফেরকা বিকৃতির যে অপচেষ্টা চালিয়েছে তার খ-নও করেছেন। নতুবা মূল আকীদার বিষয়ে এই তিন ইমামের আলোচনায় মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। এজন্যই আমরা দেখি, মাতুরীদী মাসলাকের অনুসারী অনেক আলেম ‘আলআকীদাতুত ত্বাহাবি’-এর ব্যাখ্যা লিখেছেন। তবে তাদের কেউই ইমাম ত্বাহাবীর সঙ্গে মতবিরোধ করেননি। এমনিভাবে আশআরী আলেমগণও ‘আলআকীদাতুত ত্বাহাবিয়্যা’-এর সঙ্গে একমত।
আহলে সুন্নত ওয়াল জামা'য়াত'পরিচিতিঃ জামায়াত বলতে বুঝায় ছাহাবী ও তাবেঈগণের জামায়াত এবং তাঁদের অনুসারী পরবর্তী সকল যুগের ওলামায়ে কেরাম, যারা কিতাব ও সুন্নাহতে বর্ণিত মানহাজকে সুদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকেন।(শারহুল আকায়ী¡দ আল-ওয়াসিত্বিয়াহ, পৃঃ ১০) ইমাম ইবনে হাযম আন্দালুসী (রঃ) (৩৮৪-৪৫৬ হিঃ) বলেছেন, وَأَهْلُ السُّنَّةِ الَّذِيْنَ نَذْكُرُهُمْ أَهْلَ الْحَقِّ وَمَنْ عَدَاهُمْ فَأَهْلُ الْبَاطِلِ فَإِنَّهُمُ الصَّحَابَةُ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمْ وَكُلُّ مَنْ سَلَكَ نَهْجَهُمْ مِنْ خِيَارِ التَّابِعِيْنَ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ ثُمَّ أَهْلُ الْحَدِيْثِ وَمَنْ تَبِعَهُمْ مِنَ الْفُقَهَاءِ جِيْلاً فَجِيْلاً إِلَى يَوْمِنَا هذَا وَمَنِ اقْتَدَى بِهِمْ مِنَ الْعَوَامِ فِى شَرْقِ الْأَرْضِ وَغَرْبِهَا رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ- অর্থাৎ- ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘য়াত- যাদেরকে আমরা হক্বপন্থী ও তাদের বিরোধী পক্ষকে বাতিলপন্থী বলেছি, তাঁরা হ’লেন (ক) ছাহাবায়ে কেরাম (খ) তাঁদের অনুসারী শ্রেষ্ঠ তাবেঈগণ (গ) আহলে হাদীছগণ (ঘ) ফক্বীহদের মধ্যে যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন যুগে যুগে আজকের দিন পর্যন্ত (ঙ) এবং প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ঐ সকল ‘আম জনসাধারণ,যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন। আল্লাহ তাদের উপর রহমত বর্ষণ করুন’। (আল-ফাছলু ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল, ২/৯০) এর আরেক পরিচয় হলো-এই দলটি বিদ‘আত এবং মুসলমানদের জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্নতাকে সর্বতোভাবে পরিহার করে, এজন্য দলটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রঃ) (৬৬১-৭২৮হিঃ) বলেন,هم متمسكون بكتاب الله وسنة رسوله وما اتفق عليه السابقون الأولون من المهاجرين والأنصار والذين اتبعوهم بإحسان. ‘তারা হ’লেন আল্লাহর কিতাব এবং রাসূল (সাঃ)-এর সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে ধারণকারী ব্যক্তিগণ, যারা মুহাজির ও আনছারদের মধ্যকার প্রথম সারির ছাহাবীগণ এবং তাঁদের যথাযথ অনুসারীদের গৃহীত ঐক্যবদ্ধ নীতির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত’। (মাজমূ‘উল ফাতাওয়া, ৩/৩৭৫। আল-ওয়াজীয ফী আক্বীদাতিসসালফি ছালিহ,পৃঃ ৩৯। তিনি আরো বলেছেনÑوالبدعة مقرونة بالفرقة كما ان السنة مقرونة بالجماعة فيقال أهل السنة والجماعة كما يقال أهل البدعة والفرقة ‘বিদ‘আতের সাথে যেমন সম্পর্ক বিচ্ছিন্নতার,তেমনি সুন্নাতের সাথে সম্পর্ক হ’ল ঐক্যবদ্ধতার।এজন্য বলা হয়, ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ’, যেমন এর বিপরীতে বলা হয় ‘আহলুল বিদ‘আহ ওয়াল ফুরক্বাহ’। (আল-ইস্তিকামাহ, ১/৪২ )
নামকরণের কারণ : এই জামায়াতে অন্তর্ভুক্তদেরকে এজন্য ‘আহলুস সুন্নাহ’ বলা হয় যে, তারা সুন্নাতকে ধারণকারী, সুন্নাতের বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং সুন্নাত অনুসারে জীবন পরিচালনাকারী। আর ‘আহলুল জামা‘য়াত’বলা হয় এই কারণে যে, তারা হক্ব বা সঠিক পথ ও পন্থাকে গ্রহণ করেছে, হক্বের উপর একতাবদ্ধ হয়েছে এবং মুসলমানদের সেই জামা‘য়াতের পদাংক অনুসরণ করেছে, যারা সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরেছে। তারা হ’লেন সকল ছাহাবী, তাবেঈ এবং তাঁদের অনুসারীগণ। একই সাথে তারা তাদের মধ্যকার মুসলিম নেতাদের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে থাকে এবং রাসূল (সাঃ)-এর নির্দেশ মোতাবেক তারা তাদের আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নেয় না। অর্থাৎ সুন্নাতের যথাযথ অনুসরণ, হক্বের উপর ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং মুসলমানদের জামা‘য়াত থেকে বিচ্ছিন্ন না থাকা তাদের মৌলিক নিদর্শন। (মাজমূ‘উল ফাতাওয়া, ৩/১৫৭ ইলমুত তাওহীদ ইনদা আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ, পৃঃ ২৩।)
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ধারাবাহিকতা ঃ ‘আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতে’র প্রথম সারিতে হলেন আল্লাহর রাসুলের ছাহাবীগণ (রাঃ)। কেননা তাঁরাই সর্বপ্রথম রাসূল (সাঃ) এর নিকট থেকে সুন্নত শিক্ষা লাভ করেছিলেন এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁরাই সুন্নাতের প্রতিরক্ষা দান করেছিলেন তাই তাঁরাই প্রথম ‘আহলে সুন্নাত’ হিসাবে পরিগণিত। তারা ‘আহলুল জামায়াহ’ এজন্য যে তাদের যুগে ইসলামের মধ্যে কোন দল-উপদলের সৃষ্টি হয়নি। ইবনু তায়মিয়া (রঃ) বলেন, ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত’ একটি প্রাচীন মাযহাব যা ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহিমাহুমুল্লাহ )-এর জন্মেরও বহু পূর্ব থেকে সুপরিচিত ছিল। সেটি হ’ল ছাহাবায়ে কেরামের মাযহাব,যারা তাঁদের নবীর নিকট থেকে সরাসরি জ্ঞান হাছিল করেছিলেন। (মাজমূ‘উল ফাতাওয়া, ৩/১৫৯ পৃঃ) অতঃপর পরবর্তী যুগে যারা ছাহাবীগণের নিকট থেকে দ্বীন শিক্ষা লাভ করেছিলেন এবং তাদের অনুসৃত পথে পরিচালিত হয়েছিলেন এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত যারা ছাহাবীদের অনুসৃত নীতিতে পরিচালিত হবেন, তারা সকলেই আহলুস সুন্নাহ-এর অন্তর্ভূক্ত। কেননা তারা রাসূল (সাাঃ)-এর সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরে থাকেন এবং দ্বীনের মধ্যে নতুন পথ ও মতের আবির্ভাব ঘটান না। তারা মুমিনদের সর্বসম্মত কোন নীতি থেকেও বিচ্যুত হন না। ( ইলমুত তাওহীদ ইনদা আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ২৪) ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘য়াত’ পৃথক কোন দল,গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের নাম নয়, বরং ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসারীদেরই একটি বৈশিষ্ট্যগত পরিচয়। বিদ‘আতীদের থেকে পৃথকীকরণের জন্য তাদেরকে এই নামে অভিহিত করা হয়েছে। ইবনু তায়মিয়া (রঃ) বলেন, ‘আহলে সুন্নাতের তরীক্বা (ভিন্ন কিছু নয়) বরং তা দ্বীন ইসলামই, যা নিয়ে মুহাম্মাদ (সাঃ) প্রেরিত হয়েছিলেন। কিন্তু যখন তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে, তাঁর উম্মত ৭৩টি দলে বিভক্ত হবে এবং এগুলোর সবই জাহান্নামে যাবে কেবল একটি দল ছাড়া; আর সে দলটি হ’ল যারা রাসূল (সাাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদের অনুসৃত পথে পরিচালিত হবে- তখন ইসলামকে নিষ্কলুষ এবং পূর্ণাঙ্গভাবে ধারণকারীদের নাম হয়ে যায় ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘য়াহ’।এরাই হল বিজয়ী দল (মাজমূ‘উল ফতোয়া,৩/১৫৯)
নামকরণের উৎপত্তি ও উদ্দেশ্য : ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত’ একটি প্রাচীনতম পরিভাষা। ছাহাবীগণের জামায়াতকে সর্বপ্রথম এই নামে আখ্যায়িত করা হয়। মুসলিম সমাজে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ফিৎনার আবির্ভাব শুরু হওয়ার পূর্বে মুসলমানদের ভিন্ন কোন পরিচয়ে ডাকা হ’ত না। কিন্তু ফিৎনার আবির্ভাবের পর মুসলিম সমাজ নানা দল-উপদলে বিভক্ত হ’লে এই পরিভাষাটির ব্যবহার শুরু হয়। এই নামকরণের উদ্দেশ্য ছিল বাতিলপন্থীদের থেকে হক্বপন্থীদেরকে পৃথক করা। যেমন বিশিষ্ট তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবসে সীরীন (রঃ) (মৃ. ১১০ হিঃ ) বলেন, لم يكونوا يسألون عن الإسناد، فلما وقعت الفتنة قالوا: سموا لنا رجالكم فينظر إلى أهل السنة فيؤخذ حديثهم، وينظر إلى أهل البدع فلا يؤخذ حديثهم، ‘মানুষ ইতিপূর্বে ইসনাদ (তথ্যসূত্র) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করত না। কিন্তু যখন ফিৎনার যুগের আবির্ভাব ঘটল তখন তারা বলা শুরু করল, তোমরা তোমাদের (তথ্যদাতা) রাবীদের নাম বল। অতঃপর যদি দেখা যেত যে,তারা (তথ্যদাতাগণ) আহলুস সুন্নাহ বা সুন্নাহর অনুসারী তখন তাদের বর্ণিত হাদীছসমূহ গৃহীত হত। আর যদি দেখা যেত যে, তারা আহলুল বিদ‘আহ বা বিদ‘আতের অনুসারী, তখন তাদের হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত না’। (ছহীহ মুসলিম, ১/১৫ পৃঃ)
সাহাবীগণ (রাঃ) আহলুস সুন্নাহ নাম ব্যবহার করতেন ঃ
ছাহাবীগণও নামটি ব্যবহার করেছেন। যেমন ইবনে আববাস (রাঃ) يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ আয়াতটির তাফসীরে বলেন,فأما الذين ابيضت وجوههم فأهل السنة والجماعة وأولو العلم، وأما الذين اسودت وجوههم فأهل البدع والضلالة ‘সেদিন যাদের চেহারা উজ্জ্বল হবে- তারা হ’ল আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘য়াত এবং এবং কৃষ্ণকায় চেহারা হবে বিদ‘আতী এবং পথভ্রষ্টদের’। (উছূলিল ই‘তিক্বাদ, ১/৭৯ পৃঃ।)
ইমাম আবূ জা‘ফর ত্বাহাবী (রঃ) লিখেছেন,هذا ذكر بيان عقيدة أهل السنة والجماعة ‘এটা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘য়াতের আক্বীদার বিবরণী’। ইমাম আবুল কাসেম আল-লালকাঈ (মৃ. ৪১৮হিঃ)লিখেছেন شرح أصول اعتقاد أهل السنة والجماعة ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়া‘ত কর্তৃক অনুসৃত আক্বীদার মূলনীতিসমূহ বিশ্লেষণ’। এই পরিভাষাটি হিজরী ৪র্থ-৫ম শতকের আহলে ইলিমদের লেখনিতে পাওয়া যায়। (শারহু উছূলিল ই‘তিক্বাদ, ১/৬০, ৬৬,৭১ পৃঃ।)
নামকরণের শরয়ী ভিত্তি : এই পরিভাষাটি কুরআন,হাদীছ এবং সালাফদের আছার থেকে প্রমাণিত। যেমন - পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে রাসূল (সাাঃ) কে অনুসরণের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে এবং তাঁর অবাধ্যতা করা ও তাঁর নির্দেশকে অগ্রাহ্য করা থেকে সতর্ক করা হয়েছে। সুতরাং পরিভাষাটির প্রথমাংশে যেখানে রাসূল (সাঃ)-এর সুন্নাত অনুসরণের কথা উল্লেখিত হয়েছে, তা মূলতঃ এই কুরআনী নির্দেশেরই প্রতিফলন। পরিভাষাটি রাসূল (সাঃ)-এর হাদীছ থেকে সংগৃহীত হয়েছে। যেমন তিনি বলেন, عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي ‘তোমরা আমার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরে থাক’।( মিশকাত হা/১৬৫, সনদ ছহীহ।) সেই সাথে রাসুল (সাঃ) মুসলিম উম্মাহকে ‘জামা‘য়াতে’র সাথে থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, وَأَنَا آمُرُكُمْ بِخَمْسٍ اللهُ أَمَرَنِى بِهِنَّ بِالْجَمَاعَةِ ‘আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছি, যে বিষয়ে আল্লাহ আমাকে নির্দেশ করেছেন। প্রথমটি হ’ল, জামা‘আতবদ্ধ থাকা...’। আর যারা জামা‘য়াত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে তাদের প্রতি হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে রাসূল (সাঃ) বলেন,فَإِنَّهُ مَنْ خَرَجَ مِنَ الْجَمَاعَةِ قِيْدَ شِبْرٍ، فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَ الْإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِهِ، إِلَى أَنْ يَرْجِعَ، ‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি জামা‘য়াত থেকে এক বিঘত পরিমাণও বের হয়ে যাবে, সে যেন তার কাঁধ থেকে ইসলামের রজ্জুকে অপসারণ করে ফেলল, যতক্ষণ না সে পুনরায় (জামা‘য়াতে) ফিরে আসে’। (তিরমিযী হা/১০৩৬, সনদ ছহীহ।) অপরদিকে নাজাতপ্রাপ্ত দল সম্পর্কে তিনি বলেন,أَلَا إِنَّ مَنْ قَبْلَكُمْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ افْتَرَقُوْا عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً، وَإِنَّ هَذِهِ الْمِلَّةَ سَتَفْتَرِقُ عَلَى ثَلَاثٍ وَسَبْعِيْنَ: ثِنْتَانِ وَسَبْعُوْنَ فِي النَّارِ، وَوَاحِدَةٌ فِي الْجَنَّةِ، وَهِيَ الْجَمَاعَةُ، ‘জেনে রেখো, তোমাদের পূর্ববর্তী আহলে কিতাব বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে। আর এই উম্মত বিভক্ত হবে তিহাত্তর দলে। এর মধ্যে বাহাত্তরটি দলই হবে জাহান্নামী আর একটি দল হবে জান্নাতী। সেই দলটি হচ্ছে ‘আল-জামায়াত’। (আবূদাউদ হা/৪৫৯৭; মিশকাত হা/১৭২)
রাসূল (সাাঃ) আরও বলেন,وَإِنَّ بني إسرائيل تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً، وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلَاثٍ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً، كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلَّا مِلَّةً وَاحِدَةً، قَالُوا: وَمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ: مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي، ‘বনী ইসরাঈল বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে আর আমার উম্মত তিহাত্তর দলে বিভক্ত হবে। তন্মধ্যে একটি দল ছাড়া আর সবাই জাহান্নামী হবে। ছাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা কারা? রাসূল (ছাঃ) বললেন, যারা আমি ও আমার ছাহাবীগণের পথে (অবিচল থাকবে)’। (তিরমিযী হা/২৬৪১; মিশকাত হা/১৭১, সনদ হাসান।) এ সকল হাদীছ থেকে সুস্পষ্ট যে, মুসলিম উম্মাহ দল-উপদলে বিভক্ত হবে এবং বহু পথ ও মতের অনুসারী হবে। এসময় নাজাতপ্রাপ্ত দল তারাই হবে যারা রাসূল (সাঃ) ও ছাহাবীদের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরে থাকবে এবং মুসলমানদের জামা‘য়াতে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত রাখবে। বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করবে না। সুতরাং এই নাজাতপ্রাপ্তদের দু’টি বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক হিসাবে এই দলটিকে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘য়াত’ নামকরণ করা হয়েছে। কিতাব ও সুন্নাতের প্রকৃত অনুসারীগণ প্রাথমিক যুগ থেকে এই নামেই প্রসিদ্ধ ছিলেন। ইবনে তাইমিয়া (রঃ) বলেন,وشعار هذه الفرق مفارقة الكتاب والسنة والإجماع فمن قال بالكتاب والسنة والإجماع كان من أهل السنة والجماعة ‘(এ সকল) পথভ্রষ্ট দলগুলোর বৈশিষ্ট্য হ’ল কিতাব,সুন্নাত ও ইজমার বিপরীতে অবস্থান করা। পক্ষান্তরে যারা কিতাব,সুন্নাত ও ইজমার পক্ষাবলম্বন করে,তারাই‘আহলুস সুন্নত ওয়াল জামা‘য়াত’। (মাজমূ‘উল ফাতাওয়া, ৩/৩৪৬ পৃঃ।) আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মূলনীতি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মূলনীতি হলো সুন্নাত ও জামা‘আত অর্থাৎ আকীদার বিষয়ে হুবহু সুন্নাতের অনুসরণ করা, সুন্নাতের অতিরিক্ত বা ব্যতিক্রম কিছুই না বলা না করা। আল-জামা‘আত বা সাহাবীগণ ও তাঁদের অনুসারী মূলধারার তাবেয়ী-তবে-তাবিয়ীগণের অনুসরণ করা ও উম্মতের ঐক্য বজায় রাখার চেষ্টা করা। মতভেদীয় বিষয়গুলিতে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকীদার মূলনীতি হলো কুরআন ও সুন্নাতের নিকট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন এবং কুরআন কারীম ও সহীহ হাদীসকে আকীদার একমাত্র মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা। পক্ষান্তরে বিদআতীরাও কোরআন সুন্নাহকে মানে এবং দলীল দেয় কোরআন সুন্নাহ থেকেই বটে। কিন্তু তারা এটা তাদের মনগড়া কখনো কাশফ কারামতি ও ইলহামের দলীলে জায়েজ করে নিতে চান। এটা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের মৌলনীতি নয়।
আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের প্রসিদ্ধি লাভের প্রধান কারণ সমূহ ঃ ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘য়াত’ পরিভাষাটি প্রসিদ্ধ হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল। যেমন- ১) খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহঃ রাসূল (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পর মুসলিম সমাজে আবির্ভূত হওয়া প্রথম বিদআত ইসলামী খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। ২) বাইয়াত ভঙ্গ ঃ বাইয়াত ভঙ্গ করে মুসলিম সমাজকে খন্ড-বিখন্ড করা। ৩) খারেজী সম্প্রদায় এর উদ্ভবঃ খারেজী সম্প্রদায় প্রথম এই নীতি গ্রহণ করে যার ভিত্তিতে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত বিরোধী একটি নতুন মতবাদ ও চিন্তাধারার জন্ম হয়। তারা কবীরা গোনাহের কারণে একজন মুসলিমকে কাফির ঘোষণা করে এবং তার জান ও মালকে হালাল করে নেয়। এমনকি হযরত আলী (রাঃ)-কে কাফের ফতোয়া দানের মাধ্যমে হত্যা করে। ৪) হযরত আলী ও হযরত মু‘আবিয়া (রাঃ) দ্বন্ধ ঃ হযরত আলী (রাঃ) এবং হযরত মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্ধের সৃষ্টি হয় এবং মুসলিম উম্মাহর বন্ধন আরও শিথিল ও বিযুক্ত হ’তে থাকে। ৫) রাফেযী শী‘য়াদের উদ্ভব ঃ ৪১ হিজরীতে মুসলিম উম্মাহ আবারও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়।অন্যদিকে খারেজীদের এই নবতর নীতি গ্রহণের পরপরই রাফেযী শী‘য়াদের আবির্ভাব ঘটে। তারা মিথ্যাচারের জন্য ব্যাপক কুখ্যাাতি লাভ করে। ৬) কাদারিয়াদের উদ্ভবঃ অতঃপর আবির্ভাব ঘটে কাদারিয়া গোষ্ঠীর- যারা তক্বদীর অস্বীকার করে মুসলিম সমাজে ব্যাপক বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। ৭) জাহমিয়া ও জাবরিয়া ফেরক্বা ঃ অতঃপর আবির্ভাব ঘটে জাহমিয়া ও জাবরিয়া ফেরক্বার- যারা প্রচার করে যে, মানুষ স্বীয় কর্মে কোন স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি রাখে না। সুতরাং মানুষ তার পাপকর্মের জন্য দায়ী নয়। ৮) মু‘তাযিলা মতবাদঃ হিজরী তৃতীয় শতকে আবির্ভূত হয় মু‘তাযিলা মতবাদ। তারা কুরআনকে মাখলুক্ব বা সৃষ্টি বিশ্বাস করে যা সুস্পষ্ট কুফরী। আববাসীয় খলীফা আল-মামূন এর সমর্থক হওয়ায় এর প্রতিবাদ করায় ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এর উপর নেমে আসে রাষ্ট্রীয় জুলুম এর খড়গ হস্ত। অবশ্য সেসময় ইমাম আহমাদের সম্মুখে খলীফা আল-মামূনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার যথেষ্ট কারণও উপস্থিত হয়েছিল। যেহেতু আল-মামূন একদিকে ‘কুরআন সৃষ্ট’-এই কুফরী আক্বীদা পোষণ করেছিলেন, অপরদিকে তিনি ছিলেন অত্যাচারী শাসক। (ইলমুত তাওহীদ ইনদা আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘য়াহ, পৃঃ ২৭-২৮।) ইমাম আহমদের গৃহীত এই অবস্থান থেকে যেটি প্রকাশ পায় তা হলো হক্ব জানার পর তা প্রকাশে তিনি শাসকের শত অত্যাচারকেও পরোয়া করেননি। আবার সাধারণ মানুষের মধ্যে ফিতনা ছড়ায় এমন কোন পদক্ষেপও গ্রহণ করেন নি। এভাবেই তাঁর মাধ্যমে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতে’র মানহাজ ও নীতিগত অবস্থান সাধারণ মানুষের মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত হয় যে, সুন্নাতের মর্যাদা কোন অবস্থাতেই ভূলুণ্ঠিত হ’তে দেয়ার নয়। ফলে তিনিই সর্বপ্রথম ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতে’র ইমাম হিসাবে উপাধি লাভ করেন।
আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের দৃষ্টিতে এ গুলো হলো বাতিল ফেরক্বা। আর এ এ ভাইে একের পর এক এ জাতীয় বাতিল ফেরক্বাগুলোর আবির্ভাব ঘটতে থাকলে আহলে ইলিমদের একটি দল এদের আক্বীদাসমূহ খন্ডন করে গ্রন্থ রচনা করতে শুরু করেন। এ সকল গ্রন্থের নামকরণ করলেন ‘কুতুবুস সুন্নাহ’ বা ‘সুন্নাহর কিতাব’। তখন থেকে আহলে ইলিমদের এই দলটি ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘য়াত’ হিসাবে পরিচিতি পায়। (ইলমুত তাওহীদ ইনদা আহলিস সুন্নাহ পৃঃ ২৬-২৭; খাছাইছু আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘য়াহ পৃঃ ১১০। পরবর্তীকালে প্রত্যেক যে ব্যক্তি সুন্নাহর যথাযথ অনুসারী এবং এর ভিত্তিতে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যকামী হক্বপন্থীদের অনুসারী হ’লেন তাদের উপাধি হয়ে গেল ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’। (ইলমুত তাওহীদ ইনদা আহলিস সুন্নাহ পৃঃ ২৭-২৮।) এর পর আরো অনেক বাতিল ফেরকার জন্ম হয়েছে তবে আমরা কোন ছোট খাটো এখতেলাফি বিষয় নিয়ে বা কোন সলুকের বিরুদ্ধে যাওয়ায় কোন সলুককে বিরুদ্ধে বাতিল ফেরক্বা বলতে পারিনা। ইমাম আজম (রঃ) এ বিষয়ে কঠোর নীতি অবলম্ভন করেছেন। যেমন-
দ্বীনের বিষয়ে বিবাদ বিতর্ক বিদআত ঃ ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) সত্যের পথেও বিবাদ-বিতর্ক অপছন্দ করতেন। ইমান আবূ ইউসুফ (রঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমরা আবূ হানীফার নিকট উপবিষ্ট ছিলাম। এমতাবস্থায় কিছু মানুষ দুব্যক্তিকে নিয়ে সেখানে আগমন করে বলেন- এ দুজনের একজন বলছে, কুরআন সৃষ্ট এবং অন্য ব্যক্তি তার সাথে বিতর্ক করছে ও বলছে, কুরআন সৃষ্ট নয়। তিনি বলেন- এদের উভয়ের কারো পিছনে সালাত আদায় করবেন না। আমি বললাম, প্রথম ব্যক্তির পিছনে সালাত আদায় করব না একথা ঠিক, কারণ সে কুরআনের অনাদিত্ব বিশ্বাস করে না। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তির পিছনে সালাত আদায় করা হবে না কেন? তিনি বলেন, قدم القرآن. وأما الآخر فما باله لا يصلى خلفه؟ فقال: إنهما يتنازعان في الدين، والمنازعة في الدين بدعة কারণ তারা দ্বীনের বিষয়ে বিবাদ-বিতর্ক করছে আর দ্বীনের বিষয়ে বিবাদ-বিতর্ক বিদ‘আত।’’ (ফিকহুল আকবর শরহে খামীস পৃ. ২১-৩৭।)
আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের নাম আশআরিয়া কেন ঃ এখানে এ কথা স্পষ্ট করে দেয়া আবশ্যক যে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা ما أنا عليه وأصحابي (যে পথে আমি ও আমার সাহাবীরা আছি।)-এর বাস্তবরূপ। চতুর্থ শতাব্দী থেকে এই আকীদার অনুসারী অধিকাংশ মানুষকে আশআরী বা মাতুরীদী বলা হয়। এর কারণ হল, আকীদায়ে আহলে সুন্নতের সংরক্ষণ ও এ বিষয়ে উদ্ভূত বিভিন্ন বাতিল ফেরকার খন্ডনে এই দুই ইমাম অধিক পরিচিতি লাভ করেন। মুসলিম উম্মাহ তাঁদের এই খেদমত গ্রহণ করে। সেজন্য তাঁদের মাসলাকের অনুসারীগণ ‘মাতুরীদী’ বা ‘আশআরী’ নিসবতে পরিচিতি লাভ করেন। এই বাস্তবতাটি একাধিক আলেম স্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন। আমরা এখানে কয়েকজন মনীষীর বক্তব্য উদ্ধৃত করব। আর তাই আমরাও এই বিষয়গুলো এখানে তুলে ধরছি এ জন্য যে এই ইমামগনের সাথে কারো কোন কথায় বা উক্তিতে বা তাশরীহে ব্যথয় ঘটেছে কি না তা দেখার জন্য বিবেকের আদালতে ইনসাফের মানদন্দে বিচার করে নেয়ার জন্য যাতে আমাদের মতো ক্ষুদে লেখকদের ছোট মুখ থেকে বড় কথা বলতে না হয়।
আল্লামা মুরতাযা জাবেদী (১২০৫ হি.) (রঃ) আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লামা মুরতাযা জাবেদী (রঃ) বলেন-"وليعلم أن كلا من الإمامين أبي الحسن وأبي منصور رضي الله عنهما وجزاهما عن الإسلام خيرا، لم يُبْدِعا من عندهما رأيا، ولم يَشْتَقّا مَذْهَبا، إنما هما مُقَرِّران لمذاهب السلف، مُناضلان عما كانت عليه أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم، فأحدهما قام بنصرة نصوص مذهب الشافعي وما دلت عليه، والثاني قام بنصرة نصوص مذهب أبي حنيفة وما دلت عليه، وناظر كل منهما ذوي البدع والضلالات، حتى انقطعوا ووَلّوا مُنهزمين.------------------- মুরতাযা জাবেদী’র (রঃ) এই বক্তব্য তাঁর কিতাব ‘ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন’-এর দ্বিতীয় খন্ডের শুরুতে (২/ ৬-৭) রয়েছে। ইতহাফ হল ইমাম গাযালী’র (রঃ) কিতাব ‘ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন’-এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ।‘ইহইয়া’-এর দ্বিতীয় অধ্যায় হল قواعد العقائد অর্থাৎ আকীদা সংক্রান্ত নীতিমালা। এর ব্যাখ্যায় শুরুতে আল্লামা যাবীদী’র (রঃ) ভূমিকা হিসেবে যা লিখেছেন তাতে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত’ বলতে কাদের বুঝায় সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন। উচ্চতর স্তরে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীগণ এটি অধ্যঅয়ন করতে পারেন। সেখানে আল্লামা জাবেদী (রঃ) বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থের উদ্ধৃতিতে এ বিষয়টিও স্পষ্ট করেছেন যে, ইমাম মাতুরীদী (রঃ) ও ইমাম আশআরী (রঃ) আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আকীদা সংক্রান্ত ইলিম কোন্ মাধ্যমে হাসিল করেছেন?
সেখানে জাবেদী (রঃ) সংক্ষেপে এই গুরুত্ব¡পূর্ণ কথাটির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যে, ইমাম আবু মানসুর মাতুরীদী (রঃ) এবং ইমাম আবুল হাসান আশআরী (রঃ) আল্লাহর পানাহ- কোনো নতুন আক্বীদা বা নতুন ফেরকা আবিষ্কার করেননি। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আকীদা তো সাহাবায়ে কেরাম, তাবেবয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনের যুগ থেকে চলে আসছে। ইমাম মাতুরীদী ও ইমাম আশআরী সেসব আক্বীদারই সংকলন ও বিশ্লেষণ করেছেন এবং সেগুলোর প্রতি বাতিলপন্থীদের উত্থাপিত আপত্তিসমূহের জবাব দিয়েছেন। সেজন্য তাঁদের পরবর্তীদেরকে তাঁদের দিকে সম্বন্ধ করা হয়। আবু হাসান আশআরী (রঃ) ছিলেন ইরাকের বাসিন্দা। তাই চতুর্থ শতাব্দী থেকে ইরাক, শাম ও খোরাসানে আহলুস সুন্নাহ বলতে আশাইরা তথা আশআরী’র (রঃ)অনুসারীদের বোঝানো হয়।
আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের নাম মাতুরিদিয়া কেন ঃ আবু মানসুর মাতুরীদী (রঃ) ছিলেন হানাফী এবং সমরকন্দের অধিবাসী। সেজন্য ‘মাওরাআন নাহর’-এ আহলুস সুন্নাহ বলতে মাতুরীদীয়া তথা মাতুরীদী’র (রঃ) অনুসারীদের বোঝানো হয়। (দ্রঃ শরহুল আকায়েদের উপর মুস্তফা ইবনে মুহাম্মাদ কাসতালী (৯০১ হি.) শামসুদ্দীন আহমাদ ইবনে মূসা খয়ালী (৮৭০ হি.)-ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন, খন্ড ২ পৃ. ৬) বলতে গেলে ইরাক,শাম ও খোরাসানের হানাফী আলেমগণের অধিকাংশ মাতুরীদীই ছিলেন। তবে যেহেতু আশআরী ও মাতুরীদী মাসলাকের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই সেহেতু হানাফীদেরকেও সাধারণত আশআরী বলা হয়, বিশেষত যেসব অঞ্চলে আবুল হাসান আশআরী’র (রঃ) ইলিম ও খেদমত অধিক প্রচারিত হয়েছে। কারণ সেখানে তিনিই ছিলেন ‘সুন্নাহ’-এর নিদর্শন। তাই পুরো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতকে তাঁর দিকেই নিসবত করা হত। যেমন হিন্দুস্তানে বেরেলভীদের মোকাবেলায় সকল আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের অনুসারীকে দেওবন্দী বলা হয়, অথচ তাদের অনেকেই দেওবন্দের সাথে যুক্ত নয়। ইমাম আবু মানসুর মাতুরীদী (রঃ) ও ইমাম আবুল হাসান আশআরী (রঃ) এবং তাঁদের অনুসারীগণ যে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত- এটা স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। তা অস্বীকার করেন একমাত্র মু‘তাযিলীগণ এবং ওই সালাফীগণ,যারা মুশাব্বিহার মাসলাক গ্রহণ করেছেন কিংবা তার দিকে ঝুঁকে গেছেন। উল্লিখিত বাস্তবতাটি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক মুহাক্কিক আলেম স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। এখানে আমরা ইমাম বায়হাকী’র (৪৫৮ হি.) (রঃ) বক্তব্য থেকে সংশ্লিষ্ট অংশটুকু উদ্ধৃত করছি। ইমাম বায়হাকী’র (রঃ) বক্তব্যটি মুহাদ্দিস ইবনে আসাকির দিমাশকী’র (৪৯৯ হি.-৫৭১ হি.)-কিতাব"تبيين كذب المفتري، فيما نسب إلى الإمام أبي الحسن الأشعري" (পৃঃ ৮৬-৯১, প্রকাশনা : আলমাকতাবাতুল আযহারিয়্যা লিত তুরাস, কায়রো, মিশর)-এ সনদসহ বর্ণিত আছে। সেখান থেকে তাজুদ্দীন সুবকী (রঃ) তাঁর কিতাব ‘তবাকাতুশ শাফিইয়্যাতিল কুবরা’ (খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ৩৯৫-৩৯৯)-এ ইমাম আশআরী’র (রঃ) জীবনীতে সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন।
মোদ্দাকথা ঃ তার মানে এই নয় যে- এক.এই কথা তো একদম পরিষ্কার যে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ ইমাম মাতুরীদী ও ইমাম আশআরী এবং তাঁদের অনুসারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁদের উভয়ের জন্ম হিজরী তৃতীয় শতকে আর ওফাত চতুর্থ শতকে। অথচ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের প্রথম জামাত হলেন সাহাবায়ে কেরাম। দ্বিতীয় জামাত তাবেয়ীন আর তৃতীয় জামাত তাবে তাবেয়ীন। অতঃপর সমস্ত ইসলামী শহর ও অঞ্চলে যেসকল মনীষী ও তাদের অনুসারীগণ ঈমান-আকীদা,নীতি-আদর্শ ও ঐতিহ্যে খায়রুল কুরূনের মনীষীদের পথে রয়েছেন তারা সকলে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের অংশ,আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ বললে তারাও উদ্দেশ্য। স্পষ্ট কথা- ইমাম মাতুরীদী ও ইমাম আশআরী তাঁদের পূর্ববর্তী এই মনীষীগণের মাধ্যমেই দ্বীন-শরীয়ত ও ঈমান-আমলের সঠিক ও নির্ভরযোগ্য ইলিম হাসিল করেছেন। অতএব মাতুরীদী ও আশআরী তাঁদের পূর্ববর্তী মনীষীগণের পথে আছেন। এই নয় যে, তাঁরা এই দুইজনের পথে ছিলেন। ( মাওলানা মুফতি আব্দুল মালিক (হাফিঃ) রচিত প্রবন্ধ থেকে সংগৃহিত সংক্ষেপিত)
কার ফতোয়ায় কে কাফের কে গোমরাহ ঃ (১) কারো সমালোচনা করতে হলে যার সমালোচনা করা হবে তার থেকে সমালোচনাকারীর জ্ঞানের পরিধি বেশী থাকতে হবে। যে বিষয়ে সমালোচনা করা হবে তার সামঞ্জস্য বা সাংঘর্ষিকতা পুর্বাপর বর্ননা থেকে মিলিয়ে দেখতে হয় এটাই মূলনীতি। বস্তুত যারা সমালোচনা করেন তাদের এ সম্পর্কে নুন্যতম জ্ঞান নেই বলেই প্রতীয়মান হয়। দেখা যায় সায়্যিদ মাওলানা আবুল আলা মওদূদীর (রঃ) বিরুদ্ধে যারাই অভিযোগ তুলেছেন সমসাময়িক ওলামায়ে কেরাম ছাড়া হালে ওনারা জ্ঞানের দিক দিয়ে আবুল আলা মওদূদীর (রঃ) ধারে কাছেও নাই সম্মান মর্যাদার দিক দিয়েও আবুল আলা মওদূদীর (রঃ) তুলনায় ওনাদেরকে বিশ্বের মানুষ খুব কম জানে এবং চিনে আর সাহিত্যের দিক দিয়েও আবুল আলা মওদূদী জীবিত অবস্থায় যে বইপুস্তক গুলো লিখে গিয়েছিলেন সেই দিক দিয়ে অভিযোগকারীরা সবাই মিলেও আবুল আলা মওদূদীর (রঃ) ধারে কাছে যাবে না এবং বয়সের দিক দিয়েও অভিযোগকারির তুলনায় অনেক সম্মানী এবং সিনিয়র, অতএব তারা যদি বয়সে এত কম হয়ে লেখাপড়া শিক্ষার দিক দিয়ে, মর্যাদার দিক দিয়ে, পরিচিতির দিক দিয়ে, জ্ঞানের দিক দিয়ে সমতুল্য না হয়ে ওনার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে পারে তাহলে আমি কেন তাদের আনিত ভিত্তিহীন অভিযোগের জবাব এবং সমকালীন ওলামায়ে কেরাম কর্তৃক আমাদের আকাবীরে দেওবন্দের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে পারবো না? যদি সত্য তথ্য প্রমাণ পেশ করতে পারি ?
(২) বেরলভিদের কোন কোন ফিরক্বা দেওবন্দিদেরকে গোমরাহ বাতিল এমনকি কাফের পর্যন্ত ফতুয়া দিয়ে থাকেন, এখন প্রশ্ন হলো ওনারা মাওলানা মওদূদী (রঃ) কে গোমরা বাতিল আরও অনেক কিছু ফতোয়া দিয়ে থাকেন, এখন তাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহন করতে হলে প্রথমে তো তাদেরও অবিতর্কিত মুসলিম হিসেবে স্বীকৃতি থাকতে হবে, যেহেতু বেরলভিরা তাদেকে গোমরা বাতিল এমনকি কাফের পর্যন্তও ফতোয়া দিয়ে থাকেন তাহলে আগে বেরলভিদের চ্যালেঞ্জ গ্রহন করে বহসের মাধ্যমে প্রমাণ করুক তারা নিজেরা মুসলিম! কেননা কট্রর বেরলভিদে'র ফতোয়া অনুযায়ী তারা যদি কাফের হয়ে থাকে তাহলে কেন তাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা হবে ?? আগে তারা বেরলভিদে'র কাছ থেকে মুসলিম হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করুক, তারপরে না হয় অন্যরা চিন্তা করলেন তাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহন করা যায় কি না ? অতএব তাদেরকে যারা গোমরাহ কাফের বলতেছে, আগে ওই সমস্যা সমাধান করুন!
(৩) এখতেলাফি বিষয় নিয়ে ভুল বুঝাবুঝির কারণে যদি কোনো দল থেকে কেউ বের হয়ে যায়, অর্থাৎ জামায়াতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিতা হওয়ার পর যে দেওবন্দি মতবাদে বিশ্বাসী কয়েকজন আলেম আবুল আলা মওদূদীর (রঃ) কথার সাথে, চিন্তাধারার সাথে একমত হতে না পেরে দু'একজন দল থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন এই দু'একজন যাওয়ার কারণে তাদের দৃষ্টিতে যদি দলকে বাতিল বলে গণ্য করতে হয়, তাহলেতো আমরা দেখতে পাই গোলাম আহমদ কাদিয়ানি, নাস্তিক মাসুদুর রহমান, নাস্তিক আসাদ নূর সহ এরা সবাই-ই তো দেওবন্দি আকিদায় বিশ্বাসী ছিলো এক পর্যায়ে তারা বের হয়ে গিয়ে কেউ নাস্তিক হয়েছে, কেউ নিজেকে নবী বলে দাবী করেছে তাহলে কি এইজন্য দেওবন্দিদেরকে দায়ী করে গোমরাহ বা বাতিল বলা যাবে ? অতএব এই শর্ত অনুযায়ী দেওবন্দি মতবাদ থেকে কয়েকজন বের হয়ে গেলে যদি দেওবন্দিরা দায়ী না হয়ে তাকেন তাহলে জামায়াতে ইসলাম থেকে দু-চারজন বের হয়ে গেলে জামায়াতে ইসলামী দায়ী এবং গোমরা হবে কেন ? এখানে আক্বীদার কোন বিষয়টির সাথে মাওলানা মওদুদীর ভিন্নমত আছে আপনারাই বিবেচেনা করে নেবেন।
আল্লাহ সম্পর্কে আক্বীদা ঃ আল্লাহর অবস্থান কুরআন হাদীসের আলোকে ইসলামী আক্বীদা বিশ্বাসে আল্লাহ সম্পর্কে বিশ্বাস হলো তাওহীদ বা এক ও অদ্বিত্বীয়। আল্লাহকে তাঁর জাত (সত্বা) ও সিফাত (বা গুণাগণ) সহ বিশ্বাস করা। যেমন- তিনি এক ও অদ্বীত্বীয় তার কোন শরীক নেই তার কোন তুলণা নেই আসমান জমীন সহ গোটা মাখলুকাত তাঁর ই সৃষ্টি তাঁর ই সৃষ্টি। তাঁর হুকুম ব্যতীত চোখের পলক ও নড়েনা। একটি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বস্তুও তার দৃষ্টর বাইরে নয়। আল্লাহর জাত ও সিফাত বা কুদরতের উপর ও সমান বিশ্বাস রাখতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আরশে আজীমে অবস্থান করেন বটে কিন্তু গোটা সৃষ্টি জগত তাঁর নখদর্পে। আল্লাহ আমাদেরর ব আল্লাহ আমাদের সব। আমাদের জীবন –আমাদের মরণ সবই আল্লাহর জন্য তাই আমরা তাঁর হুকুম মেনে চলতে তাঁর আইন ও বিধান মেনে চলতে বাধ্য। রাসুলকে মানা রাসুলের আদর্শ মেনে চলা আল্লাহ কে মেনে চলারই নামান্তর। তাই আল্লাহর আইন-বিধান,শরীয়ত মেনে চলাই মুমিনের কাজ মানলে মুমিন জান্নাতী না মানলে বা মেনেও শিরক করলে কিছু মানলে কিছু না মানলে কাফির মুনাফিক মুশরিক জাহান্নামী এটাও আল্লাহকে বিশ্বাস করার অবিচ্ছেধ্য আক্বীদা। কোরআনে এ সম্পর্কে বিশদ বিবরণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়,তিনি অমুখাপেক্ষি,তাঁর কোন সন্তানাদি নেই তিনিও কারো সন্তান নয়,তার সমকক্ষও কেউ নেই। আল্লাহ তায়ালা সব কিছুর ¯্রষ্টা তিনিই রব তিনিই সত্য ইলাহ তাঁর দ্বীন ই সত্য দ্বীন তিনি ঘুমানও না তন্দ্রাও যান না তিনি চিরন্তন ও চিরঞ্জীব, তার হুকুম ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়েনা। তার কোন কর্ম সম্পাদনের জন্য হও বলাই যথেষ্ট,জীবন মৃত্যু তারই হাতে, ইত্যাদী।
আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে তিনটি মত ইমাম মাতুরিদী (রঃ) বলেনÑ ‘আল্লাহ তায়ালার অবস্থানের ক্ষেত্রে মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। (ক) তাদের কেউ কেউ ধারণা করছেন যে,আল্লাহ তাআলা আরশের ওপর অধিষ্ঠিত। তাদের নিকট আরশ হলো একটি সিংহাসন, ফেরেশতাগণ যা বহন করে এবং এর চারদিক প্রদক্ষিণ করে। এর পক্ষে কোরআনের দলীল রয়েছে। যেমন-এরশাদ হচ্ছেÑوَ تَرَی الۡمَلٰٓئِكَۃَ حَآفِّیۡنَ مِنۡ حَوۡلِ الۡعَرۡشِ یُسَبِّحُوۡنَ بِحَمۡدِ رَبِّهِمۡ ۚ وَ قُضِیَ بَیۡنَهُمۡ بِالۡحَقِّ وَ قِیۡلَ الۡحَمۡدُ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ আর তুমি ফেরেশতাদেরকে আরশের চারপাশ ঘিরে তাদের রবের প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করতে দেখতে পাবে। আর তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে বিচার করে দেয়া হবে এবং বলা হবে ‘সকল প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য’। অন্য আয়াতে রয়েছে, ‘যে সকল ফেরেশতা আরশ বহন করে এবং আরশের চারপাশ প্রদক্ষিণ করে।’ পবিত্র কুরআনের সুরা তহার ৫ নম্বর আয়াতে আছে,২০:৫ اَلرَّحۡمٰنُ عَلَی الۡعَرۡشِ اسۡتَوٰی ‘দয়াময় আরশের ওপর ইস্তিয়া করেছেন।’ (খ) কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, আল্লাহ তায়ালা সব য়ায়গায় রয়েছেন। এরা পবিত্র কুরআনের কয়েকটি আয়াত দ্বারা দলিল দিয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন- اَلَمۡ تَرَ اَنَّ اللّٰهَ یَعۡلَمُ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ مَا یَكُوۡنُ مِنۡ نَّجۡوٰی ثَلٰثَۃٍ
اِلَّا هُوَ رَابِعُهُمۡ وَ لَا خَمۡسَۃٍ اِلَّا هُوَ سَادِسُهُمۡ وَ لَاۤ اَدۡنٰی مِنۡ ذٰلِكَ وَ لَاۤ اَكۡثَرَ اِلَّا هُوَ مَعَهُمۡ اَیۡنَ مَا كَانُوۡا ۚ ثُمَّ یُنَبِّئُهُمۡ بِمَا عَمِلُوۡا یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بِكُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ তুমি কি লক্ষ্য করনি যে, আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে নিশ্চয় আল্লাহ তা জানেন? তিন জনের কোন গোপন পরামর্শ হয়না যাতে চতুর্থজন হিসেবে আল্লাহ থাকেননা, আর পাঁচ জনেরও হয়না,যাতে ষষ্ঠজন হিসেবে তিনি থাকেন না। এর চেয়ে কম হোক কিংবা বেশি হোক, তিনি তো তাদের সঙ্গেই আছেন,তারা যেখানেই থাকুক না কেন। তারপর কিয়ামতের দিন তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জানিয়ে দেবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব বিষয়ে সম্যক অবগত।
(গ) এরশাদ হচ্ছেوَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ وَ نَعۡلَمُ مَا تُوَسۡوِسُ بِهٖ نَفۡسُهٗ ۚ وَ نَحۡنُ اَقۡرَبُ اِلَیۡهِ مِنۡ حَبۡلِ الۡوَرِیۡدِ আর অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার প্রবৃত্তি তাকে যে কুমন্ত্রণা দেয় তাও আমি জানি। আর আমি তার গলার ধমনী থেকেও কাছে। (ঘ) এরশাদ হচ্ছেÑ وَ نَحۡنُ اَقۡرَبُ اِلَیۡهِ مِنۡكُمۡ وَ لٰكِنۡ لَّا تُبۡصِرُوۡنَ আর তোমাদের চাইতে আমি তার খুব কাছে-কিন্তু তোমরা দেখতে পাও না। (সুরা ওয়াক্বেয়া ৮৫) (ঙ) অন্য আয়াতে আছেÑ وَ هُوَ الَّذِیۡ فِی السَّمَآءِ اِلٰهٌ وَّ فِی الۡاَرۡضِ اِلٰهٌ ؕ وَ هُوَ الۡحَكِیۡمُ الۡعَلِیۡمُ আর তিনিই আসমানে ইলাহ এবং তিনিই যমীনে ইলাহ,আর তিনি প্রজ্ঞাময়,সর্বজ্ঞ। তারা ধারণা করছেন যে,যদি আল্লাহ তায়ালাকে সব জায়গায় বিরাজমান না বলা হয়,তাহলে এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালাকে সীমিত করা হয়। (চ) তৃতীয় দলের বক্তব্য হলো, আল্লাহ তায়ালা সকল স্থান ও জায়গা থেকে মুক্ত ও পবিত্র। রূপক অর্থে কখনো কোনো স্থানের দিকে আল্লাহ তায়ালাকে সম্পৃক্ত করলেও এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তায়ালা উক্ত স্থানের সংরক্ষণ ও লালন-পালনকারী।’(কিতাবুত তাওহীদ ১৩২পৃঃ) ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদি (রঃ) আরও লেখেন-‘আল্লাহ তায়ালার অবস্থানের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের মূলনীতি হলো,যখন কোনো স্থান ছিল না,তখনো আল্লাহ তায়ালা ছিলেন। কোনো জায়গার অস্তিত্ব না থাকলেও আল্লাহর অস্তিত্ব সম্ভব। আল্লাহ তায়ালা অনাদি থেকে বিদ্যমান রয়েছেন। যেমন কোনো স্থানের অস্তিত্ব না থাকা সত্বেও তিনি অবিনশ্বর রয়েছেন। মহান আল্লাহর সত্তা বা গুণাবলি পরিবর্তন-পরিবর্ধন,সংযোজন-বিয়োজন হ্রাস-বৃদ্ধি ও বিলুপ্তি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে আল কোরআন ঃ আল্লাহ তায়ালার জাত ও সিফত এবং তাঁর অবস্থান সম্পর্কে ইতিবাচক বা নেতীবাচক প্রশ্ন তোলা এ নিয়ে ঈমান ধ্বংসের কারণ হতে পারে এটাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়ত কোরআন হাদীসের দলীলের ভিত্তিতে এটাই বিশ্বাস করে যে আল্লাহর জাত ও সিফাত সত্য এটাই ঈমান আর আল্লাহর অবস্থান আল্লাহর মতই মানুষের ধারণার ও জ্ঞানের বাইরে বা উপরে। এই বিশ্বাস না থাকলে বা এই বিশ্বাসে দুর্বলতা দেখা দিলে ঈমান থাকবেনা সুতরাং এ জাতীয় প্রশ্ন অবন্তর। দ্বিত্বীয় কথা হলো যেহেতু কুরআন হাদীসের দলীলে আল্লাহ তায়ালা আরশে আজীমে থাকেন তাই এটাই বিশ্বাস করতে হবে। কিন্তু একদল আহলে ইলিম এই ধারণা করেন আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান বা উহদাতুল ওজুদে বিশ্বাস করেন যা অন্যান্য বাতিল ধর্মাবলম্বিরাও রাখে এবং তারা সব কিছুতেই ঈশ্বর ভগবানের অস্তি¡ত্ব ও রূপ দেখে বলে নানা মাখলুকাতের এমনকি তাদের নিজেদের তৈরী মুর্তিরও পুজা করে। যা কোরআন হাদীসের বিপরীত।
মহান আল্লাহ আছেন আরশের উপর তাঁর জাত বা সত্ত্ সিফাত বা গুনাবলীর যে বর্ণনা কোরআন হাদীসে দেয়া হয়েছে তাতে ঈমান আনা ওয়াজিব। যেমন, আমরা জানি, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সবকিছু শোনেন ও দেখেন, তার মানে এই না যে, তার শোনার যন্ত্র কান ও দেখার যন্ত্র চোখ আমাদেরই মতোই। আল্লাহর সিফাত বা গুনাবলীর কান, চোখ, হাত যেভাবে কোরআন ও সহীহ হাদীসে আছে সেভাবেই স্বীকার ও বিশ্বাস করতে হবে। “আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান” আক্বিদা দুইটি জাতির মধ্যে বিদ্যমান, এর মধ্যে জাহমিয়া ইসলামের নামে একটি ভ্রান্ত দল ও মুশরিক হিন্দু স¤প্রদায় আছে। অনুরূপ দুনিয়াতে আল্লাহ নাই এর মর্ম এই নয় যে আল্লাহর ক্ষমতা, দয়া, জ্ঞান সর্বত্র বিরাজমান নয়। গাছের একটি পাতাও ঝরে পড়ে না যা তার জ্ঞানে নাই এমন কি এ্র আওয়াজও তাঁর শ্রবন এড়াতে পারেনা। তিনি সবকিছু দেখেন, শুনেন এবং জানেন। তবে সেটা আরশ থেকে যা সপ্তমাসমানের উপর অবস্থিত। এ সব দেখা ও শুনার জন্য তাঁকে দুনিয়াতে আসতে হয়না, সর্বত্র বিরাজ বা বিদ্যমানও থাকতে হয়না। তাই এ বিষয়ে দালিলিক কিছু পর্যালোচনা আবশ্যক।
আল্লাহ তায়ালা আছেন আরশের উপরে ঃ কোরআনের অসংখ্য আয়াতে এ কথাকেই সমর্থন করে যে আল্লাহ তায়ালা আছেন আরশের উপরে যেমনÑ (১) আল্লাহ তায়ালা বলেন: الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى পরম করুণাময় আল্লাহ রয়েছেন আরশের উপর। (সূরা তাহা-৫) (২) আল্লাহ তায়ালা এরশাদ ফরমানÑثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ অতঃপর তিনি আরশের উপর ক্ষমতাশীল হোন। (সূরা হাদীদ-৩) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেÑ আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের ইমামগনের মতে “استوى” বা অধিষ্ঠিত হওয়া, এটা আল্লাহ তার বড়ত্ব ও মহত্তে¡র জন্য যেভাবে উপযোগী সেভাবেই হয়েছেন। তারা “استوى” কে (অধিষ্ঠিত হওয়াকে) “استولى” (ক্ষমতাসীন হয়েছেন) অর্থে ব্যাখ্যা করেন না। বরং তারা এই গুণটিকে এভাবেই নির্ধারণ করেন এবং এভাবেই ঈমান পোষণ করেন যেমন ভাবে আল্লাহ তায়ালার বড়ত্ব ও মহত্তে¡র উপযোগী হয়। কেননা “استيلاء” শব্দের দ্বারা “استوى” এর ব্যাখ্যা করা, শব্দকে তার স্থান থেকে পরিবর্তন করা ও কোন প্রমাণ ছাড়া শব্দকে তার বাহ্যিক বা প্রকাশ্য অর্থ থেকে পরিবর্তন করে দেয়ার নামান্তর। মদীনার ইয়াহুদিরা মহানবী (সাঃ) এর সঙ্গে কখনও যুদ্ধ করবে না মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল,তাই প্রকাশ্যে যুদ্ধ না করলেও পর্দার অন্তরালে ইসলাম ও মুসলিমদের শত্রুদের সাথে মিলিত হয়ে চেষ্টা চালাত যাতে মুসলিমদের উপর শত্রæগণ আক্রমণ চালায় এবং তাতে মুসলিমগণ পরাস্ত হয়। তখন আল্লাহ তা‘য়ালা কিছু দিনের জন্য তাদেরকে অর্থ সংকটে নিক্ষেপ করলেন। এ অবস্থায় তারা আল্লাহর কাছে নত না হয়ে উল্টো তাদের নেতারা বলাবলি করতে লাগল یَدُ اللّٰہِ مَغۡلُوۡلَۃٌ আল্লাহর হাত বাঁধা মানে কৃপণ। আল্লাহ তায়ালা বললেন - بَلۡ یَدٰہُ مَبۡسُوۡطَتٰنِ আল্লাহর উভয় হাত প্রসারিত। বস্তুত ইয়াহুদীরাই কৃপণতায় এগিয়ে থাকে তাই তারা তাদের মতো মনে করে আল্লাহ কে ই কৃপণ বলতে থাকে। (নাউযুবিল্লাহ) এ সম্পর্কে সুরা মায়েদার ৬৪ নম্বার আয়াতে এরশাদ হচ্ছেÑوَقَالَتِ الۡیَہُوۡدُ یَدُ اللّٰہِ مَغۡلُوۡلَۃٌ ؕ غُلَّتۡ اَیۡدِیۡہِمۡ وَلُعِنُوۡا بِمَا قَالُوۡا ۘ بَلۡ یَدٰہُ مَبۡسُوۡطَتٰنِ ۙ یُنۡفِقُ کَیۡفَ یَشَآءُ ؕ ইয়াহুদীগণ বলে, আল্লাহর হাত বাঁধা। হাত বাঁধা তো তাদেরই। তারা যে কথা বলেছে, সে কারণে তাদের উপর লানত বর্ষিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর উভয় হাত প্রসারিত। তিনি যেভাবে চান ব্যয় করেন------ এখানেও তারা আল্লাহ্র হাত বলতে এমন হাতই নির্ধারণ করেন, যা আল্লাহ্র মহান শান উপযোগী। অনুরূপ কুরআনের সুরা আল ফাজর এর ২২ নম্বার আয়াতে এরশাদ হচ্ছে- “وَجَاء رَبُّكَ” এখানে আল্লাহর আসা আল্লাহর মতোই এটা মানুষের জ্ঞানের বাইরে এবং কোন মাখলুকাতের মতো আসা নয়।
ভ্রান্ত মতবাদঃ পক্ষান্তরে (ক) জাহমিয়্যাহ (খ) মু‘তাজিলা সম্প্রদায় এবং তাদের পদাঙ্ক অনুসারী (গ) মুআওয়্যিলাহ বা অপব্যাাখ্যাকারী সম্প্রদায় (ঘ) মুমাছ্ছিলা (ঙ) মুশাব্যিহা সম্প্রদায় এই মাসআলায় ভ্রান্তির মধ্যে আছে। কারণ তারা এর ভিন্ন ব্যাখ্যা করে তাকে কুদরত ও নেয়ামত অর্থে। মুমাছ্ছিলা ও মুশাব্যিহা সম্প্রদায় অপেক্ষাকৃত মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী বলে গণ্য হন। তাই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের মতে আল্লাহ্র নামাবলি ও গুণাবলির ক্ষেত্রে যাহমিয়্যাহ ও মু‘তাযিলাহ সম্প্রদায়ের বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতায় পতিত হওয়ার মূল কারণ হলো- তারা এগুলোকে সৃষ্টির নাম ও গুণাবলির মতই বলে বুঝতে পারে। তাই তারা মহান স্রষ্টাকে সৃষ্টির সাথে যাতে তুলনা করতে না হয়, সে জন্য তারা আল্লাহ্র নাম ও গুণাবলিকে বাতিল ও অনর্থক সাব্যস্ত করে কিংবা এগুলোর অপব্যাখ্যা করে থাকে। বলা হয়ে থাকে তাদের অবস্থা হলো- রোদ থেকে বাঁচতে আগুনে ঝাঁপ দেয়ার মতই। কেননা তারা আল্লাহ্র সদৃশ্য নির্ধারণ থেকে বাঁচতে গিয়ে মহান আল্লাহ্র নাম ও গুণাবলিকে অস্বীকার করে বসে, কিংবা এগুলোর প্রকৃত সঠিক অর্থ বাদ দিয়ে ভুল অর্থ গ্রহণ করে নেয়। তাই প্রত্যেক মুছলমানের জন্য ওয়াজিব-আল্লাহ্র নাম ও গুণাবলি যেভাবে তার মহান শান ও শওকতের জন্য হওয়া উপযোগী, ঠিক সেভাবেই এগুলোর প্রতি ঈমান পোষণ করা। ইমাম মালিক (রঃ) কে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, আল্লাহ ‘আরশের উপর কিভাবে অধিষ্ঠিত? এ প্রশ্নের অত্যন্ত উত্তরে তিনি বলেছিলেন- ”আল্লাহ ‘আরশের উপর অধিষ্ঠিত” এটা জানা বিষয়, কিন্তু কিভাবে অধিষ্ঠিত তা আমাদের অজানা, ”আল্লাহ ‘আরশের উপর অধিষ্ঠিত” এ সত্যকে বিশ্বাস করা ওয়াজিব, তবে কিভাবে অধিষ্ঠিত, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা বিদআাত।
(৩) আল্লাহ তায়ালা এরশাদ ফরমান- أَأَمِنْتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يَخْسِفَ بِكُمُ الْأَرْض তোমরা তার থেকে নির্ভয় হয়ে গেলে যিনি আসমানের উপরে আছেন,আর তিনি তোমাদের সহকারে জমিনকে ধ্বসিয়ে দিবেন না? (সূরা মূলক১৬) ইবনে আব্বাস (রাঃ) এই আয়াতের তাফসীরে বলেন- যিনি আসমানে আছেন, তিনি হলেন আল্লাহ। (তাফসীরে ইবনুল জাওযি) (৪)এরশাদ হচ্ছে-وَ تَرَی الۡمَلٰٓئِكَۃَ حَآفِّیۡنَ مِنۡ حَوۡلِ الۡعَرۡشِ یُسَبِّحُوۡنَ بِحَمۡدِ رَبِّهِمۡ ۚ وَ قُضِیَ بَیۡنَهُمۡ بِالۡحَقِّ وَ قِیۡلَ الۡحَمۡدُ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ আর তুমি ফেরেশতাদেরকে আরশের চারপাশ ঘিরে তাদের রবের প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করতে দেখতে পাবে। আর তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত ভাবে বিচার করে দেয়া হবে এবং বলা হবে ‘সকল প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য’। (৫) আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, يَخَافُونَ رَبَّهُمْ مِنْ فَوْقِهِم তারা তাদের উপরস্থ রবকে ভয় করে। (সূরা নাহল ৫০) (৬) আল্লাহ তায়ালা ঈসা আঃ সম্বন্ধে বলেন- بَلْ رَفَعَهُ اللَّهُ إِلَيْهِ বরং আল্লাহ ঈসা (আঃ) কে তার নিকটে (অর্থ্যাৎ আসমানের দিকে) তুলে নিয়েছেন। (সূরা নিসা-১৫৮) (৭) এরশাদ হচ্ছে-وَهُوَ اللَّهُ فِي السَّمَاوَاتِ আর তিনিই আল্লাহ যিনি আসমানের উপরে আছেন। (সূরা আনআম ৩) এ সমস্ত আয়াতের তাফসীরে ইবনে কাসীর (রঃ) বলেন- তাফসীরকারকগণ এ ব্যাপারে একমত পোষন করেন যে, তারা আল্লাহ সম্বন্ধে ঐ ভাবে বর্ণনা করবেন না যেভাবে জাহমিয়ারা (একটি ভ্রষ্ট দল) বলে যে, আল্লাহ সর্বত্র আছেন। আল্লাহ তাদের এ জাতীয় কথা হতে পবিত্র ও অনেক উর্ধ্বে। (৮) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- اِنَّ رَبَّكُمُ اللّٰهُ الَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ فِیۡ سِتَّۃِ اَیَّامٍ ثُمَّ اسۡتَوٰی عَلَی الۡعَرۡشِ ۟ یُغۡشِی الَّیۡلَ النَّهَارَ یَطۡلُبُهٗ حَثِیۡثًا ۙ وَّ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ وَ النُّجُوۡمَ مُسَخَّرٰتٍۭ بِاَمۡرِهٖ ؕ اَلَا لَهُ الۡخَلۡقُ وَ الۡاَمۡرُ ؕ تَبٰرَكَ اللّٰهُ رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ অর্থাৎ নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশের উপর অধিষ্ঠিত হয়েছেন। (সূরা আরাফ-৫৪) আল্লাহ তা'য়ালা আরশের উপর উঠেছেন এটাই সহীহ আকীদা,কিন্তু তিনি কিভাবে উঠেছেন, কুরআন-সুন্নাহে এ ব্যাপারে কোন বক্তব্য নাই বিধায় তা আমরা জানি না। এ বিষয়ে সূরা আল-বাকারার ২৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আয়াতে ব্যবহৃত استواء ইস্তাওয়া শব্দের অর্থ হল,উপরে ওঠা, সমাসীন হওয়া, কিন্তু এর ধরণ মানুষের জ্ঞানের উর্দ্ধে। এ সম্পর্কে ইমাম মালেক (রঃ) কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন- استواء শব্দের অর্থ তো জানাই আছে; কিন্তু এর স্বরূপ ও অবস্থা মানব বুদ্ধি সম্যক বুঝতে অক্ষম। এতে বিশ্বাস স্থাপন করা ওয়াজিব। এর অবস্থা ও স্বরূপ জিজ্ঞেস করা বিদ'আত। কেননা, সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে এ ধরনের প্রশ্ন কখনো করেননি। কারণ, তারা এর অর্থ বুঝতেন।
সৃষ্টির সাথে ¯্রষ্টার তুলনা করা কুফরী ঃ নাঈম ইবনে হাম্মাদের উক্তি হল‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সাথে তুলনা করল, সে কুফরী করল এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর নিজের ব্যাপারে বর্ণিত কোন কথাকে অস্বীকার করল, সেও কুফরী করল।’’অতএব আল্লাহ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহর অথবা তাঁর রসূলের বর্ণিত কথাকে বর্ণনা করা সাদৃশ্য স্থাপন করা নয়।কাজেই আল্লাহ সম্পর্কে যে কথাগুলো কুরআনও হাদীসের আলোকে প্রমাণিত,কোন অপব্যাখ্যা,ধরণ-গঠন নির্ণয়এবং সাদৃশ্যস্থাপন করা ছাড়াই তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা জরুরী। (ইবনে কাসীর) (৯) সুরা এ বাক্বারা’র ১৪৪ নম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ ফরমান- قَدۡ نَرٰی تَقَلُّبَ وَجۡهِكَ فِی السَّمَآءِ ۚ فَلَنُوَلِّیَنَّكَ قِبۡلَۃً تَرۡضٰهَا ۪ فَوَلِّ وَجۡهَكَ شَطۡرَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ ؕ وَ حَیۡثُ مَا كُنۡتُمۡ فَوَلُّوۡا وُجُوۡهَكُمۡ شَطۡرَهٗ ؕ وَ اِنَّ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡكِتٰبَ لَیَعۡلَمُوۡنَ اَنَّهُ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّهِمۡ ؕ وَ مَا اللّٰهُ بِغَافِلٍ عَمَّا یَعۡمَلُوۡنَ আকাশের দিকে বার বার তোমার মুখ ফিরানো আমি অবশ্যই দেখছি। অতএব আমি অবশ্যই তোমাকে এমন কিবলার দিকে ফিরাব,যা তুমি পছন্দ কর। সুতরাং তোমার চেহারা মাসজিদুল হারামের দিকে ফিরাও এবং তোমরা যেখানেই থাক, তার দিকেই তোমাদের চেহারা ফিরাও। আর নিশ্চয় যারা কিতাবপ্রাপ্ত হয়েছে, তারা অবশ্যই জানে যে, তা তাদের রবের পক্ষ থেকে সত্য এবং তারা যা করে, সে ব্যাপারে আল্লাহ গাফিল নন। (সূরা বাকারা১৪৪) এখানে মূল বক্তব্য হলো আল।লাহ যদি সর্বত্র বিরাজমান হতেন তাহলে নবীজি (সাঃ)কেন বার বার আকাশের দিকে তাকালেন। তিনি তো ডানে বামে সামনে পেছনে তাকাতে পারতেন। (১০) সুরা মাআরিজের ৪ নম্বার আয়াতে এরশাদ হচ্ছেÑ تَعۡرُجُ الۡمَلٰٓئِکَۃُ وَالرُّوۡحُ اِلَیۡہِ فِیۡ یَوۡمٍ کَانَ مِقۡدَارُہٗ خَمۡسِیۡنَ اَلۡفَ سَنَۃٍ ফেরেশতাগণ এবং রুহ আল্লাহ তায়ালার দিকে ঊর্ধ্বগামী হয়। (সূরা মায়ারিজ-৪) আয়াতে ব্যবহৃত مِقۡدَارُہٗ خَمۡسِیۡنَ اَلۡفَ سَنَۃٍ পরিমান পঞ্চাশ হাজার বছর বলে আরশ থেকে সর্বনিম্ন যমীনের দূরত্ব বোঝানো হয়েছে বলে যে মত আছে এর খোলাসা হলো আল্লাহর অবস্থান আরশের উপরে । (১১) এরশাদ হচ্ছেÑ من كان یرید العزۃ فلله العزۃ جمیعا الیه یصعد الكلم الطیب و العمل الصالح یرفعهٗ অর্থাৎ- কেউ যদি সম্মান চায় (তবে তা যেন আল্লাহর কাছেই চায়) কেননা সকল সম্মান আল্লাহরই। তাঁরই পানে উত্থিত হয় ভাল কথা আর নেক আমল তা উন্নীত করে। আর যারা মন্দকাজের চক্রান্ত করে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন আযাব আর ওদের ষড়যন্ত্র তো নস্যাৎ হবে। (সূরা ফাতির-১০) অর্থাৎ সে জেনে নিক যাবতীয় সম্মান-সুখ্যাতির অধিকারী হলেন আল্লাহ। তাঁরই দিকে উত্থিত হয় পবিত্র কথাগুলো আর সৎকাজ সেগুলোকে উচ্চে তুলে ধরে। (কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর তাইসিরুল বয়ান, উম্মুল কোরআন) ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ভাল কথা হচ্ছে, আল্লাহর যিকির। আর সৎকাজ হচ্ছে, আল্লাহর ফরয আদায় করা, সুতরাং যে কেউ আল্লাহর ফরয আদায় করে আল্লাহর যিকির করবে তারই সে আমল উপরের দিকে উঠবে। আর যে কেউ যিকির করবে, কিন্তু আল্লাহর ফরয আদায় করবে না তার কথা তার আমলের দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে, তখন সেটা তার ধ্বংসের কারণ হবে। (তাবারী) কাতাদাহ বলেন, আল্লাহ্ তা'আলা আমল ব্যতীত কোন কথা কবুল করেন না। যে ভাল বলল এবং ভাল আমল করল সেটাই শুধু আল্লাহ কবুল করেন। (তাবারী) এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় উপরের দিক বলতে আল্লাহর অবস্থান আরশে বা উপরে তাই নেক আমল উপরের দিকে উঠে বলা হয়েছে। (১২) আল্লাহ তায়ালা ফরমান- اَللّٰهُ الَّذِیۡ رَفَعَ السَّمٰوٰتِ بِغَیۡرِ عَمَدٍ تَرَوۡنَهَا ثُمَّ اسۡتَوٰی عَلَی الۡعَرۡشِ আল্লাহ, যিনি খুঁটি ছাড়া আসমানসমূহ উঁচু করেছেন যা তোমরা দেখছ। অতঃপর তিনি আরশে উঠেছেন (রা’দ-২) এই আয়াতের অনেক ব্যাখ্যার মধ্যে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত ব্যাখ্যা হলো- তিনি আরশের উপর উঠেছেন । কিন্তু কিভাবে তিনি তা করেছেন তা আমাদের জ্ঞানের বাইরের বিষয়। আয়াতের আরেক অনুবাদ হলো আল্লাহ্ তা'য়ালা আসমান সমূহকে কোন খুঁটি ব্যতীত উপরে উঠিয়েছেন, তোমরা সে আসমানসমূহকে দেখতে পাচ্ছ। (তাবারী; কুরতুবী, ইবনে কাসীর) অর্থাৎ আল্লাহ এমন এক সত্তা, যিনি আসমানসমূহকে সুবিস্তৃত ও বিশাল গম্বুজাকার খুঁটি ব্যতীত উচ্চে উন্নীত রেখেছেন যেমন তোমরা আসমানসমূহকে এ অবস্থায়ই দেখ। এ অর্থের স্বপক্ষে পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে- وَ یُمۡسِكُ السَّمَآءَ اَنۡ تَقَعَ عَلَی الۡاَرۡضِ اِلَّا بِاِذۡنِهٖ “আর তিনিই আকাশকে স্থির রাখেন যাতে তা পড়ে না যায় পৃথিবীর উপর তার অনুমতি ছাড়া।” (সূরা আল-হাজ্জঃ ৬৫) আয়াতের অন্য এক অনুবাদ হলো, আল্লাহ তা'য়ালা আসমানসমূহকে অদৃশ্য ও অননুভূত স্তর সমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ অনুবাদটি ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, হাসান ও কাতাদা রাহেমাহুমুল্লাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে। (তাবারী, কুরতুবী, ইবনে কাসীর) তবে ইবনে কসীর প্রথম তাফসীরকে প্রাধান্য দিয়েছেন। (১৩) সুরা আল ইমরানের ৫৫ নম্বার আয়াতে এরশাদ হচ্ছেÑ اذ قال الله یعیسی انی متوفیك و رافعك الی و مطهرك من الذین كفروا و جاعل الذین اتبعوك فوق الذین كفروا الی یوم القیمۃ ثم الی مرجعكم فاحكم بینكم فیما كنتم فیه تختلفون অর্থাৎ-স্মরণ কর, যখন আল্লাহ বললেন, ‘হে ঈসা, নিশ্চয় আমি তোমাকে পরিগ্রহণ করব, তোমাকে আমার দিকে উঠিয়ে নেব এবং কাফিরদের থেকে তোমাকে পবিত্র করব। আর যারা তোমার আনুগত্য করেছে তাদেরকে কিয়ামত পর্যন্ত অবিশ্বাসীদের উপরে প্রাধান্য দেব। অতঃপর আমার নিকটই তোমাদের প্রত্যাবর্তন হবে। তখন আমি তোমাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেব, যে ব্যাপারে তোমরা মতবিরোধ করতে’। (আল ইমরান ৫৫) আয়াতে বলা হয়েছে و رافعك الی তোমাকে আমার দিকে উঠিয়ে নেব। এতে কি প্রমাণিত হয় না যে আল্লাহ আরশের উপর থাকেন ? (১৪) ফেরাউন নিজেকে আল্লাহ দাবী করে কাফের ছিল। এতদ সত্বেও হযরত মুসার (আঃ) কথা বিশ্বাস করত যে আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর থাকেন । তাই সে হামানকে বলেছিলÑ হে হামান! তুমি আমার জন্য এক সুউচ্চ প্রাসাদ তৈরী কর, যাতে আমি অবলম্বন পাই আসমানে আরোহনের এবং আমি দেখতে পাই মূসা’র (আঃ) রব আল্লাহকে। (সূরা মুমিন :৩৭-৩৮) এতেই বুঝা যায় মুসা আঃ আল্লাহর ঠিকানা দিয়েছেন আরশের। আল্লাহ যদি সর্বত্র হতেন তবে ফেরআউন কোন কারণে হামান কে সুউচ্চ প্রাসাদ বানানোর নির্দেশ দিবে?
হাদীস দ্বারা প্রমাণ ঃ (১) হাদীসে আছে (বুখারী হা/১১৪৫,) حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مَسْلَمَةَ، عَنْ مَالِكٍ، عَنِ ابْنِ شِهَابٍ، عَنْ أَبِي سَلَمَةَ، وَأَبِي عَبْدِ اللَّهِ الأَغَرِّ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الآخِرُ يَقُولُ مَنْ يَدْعُونِي فَأَسْتَجِيبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ ". অর্থাৎ-আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বণিত, তিনি বলেন রাসূল (সাঃ) বলেছেন প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, কে আছ যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আছ যে আমার কাছে কিছু চাইবে? আমি তাকে তা দান করব। কে আছ যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। (বুখারী হা/১১৪৫, মুসলিম হা/৭৫৮, আবু দাউদ হা/১৩১৫, ইবনে মাজাহ হা/১৩৬৬, মিশকাত হা/১২২৩, সালাত অধ্যায়, তাহাজ্জুদের প্রতি উৎসাহিতকরণ অনুচ্ছেদ)। হাদীসে ব্যবহৃত বাক্য থেকে বুঝা যায় আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আছমানে অবতরণ করেন। তাহলে নিশ্চয়ই তিনি আরশে থাকেন সেখান থেকে অবতরণ করেন। যদিও এই অবতরণের ধরণ মানুষের জ্ঞানের উর্দ্ধে। তিনি যদি সর্বত্র বিরাজমান হয়ে থাকেন তো “দুনিয়ার আসমানে নেমে আসা” সংক্রান্ত এই হাদীস বাতিল হয়ে যায় যেটা অসম্ভব।
(২) মুসলিম শরীফের ৫৩৭ নম্বার হাদীসে আছে--------- . قَالَ وَكَانَتْ لِي جَارِيَةٌ تَرْعَى غَنَمًا لِي قِبَلَ أُحُدٍ وَالْجَوَّانِيَّةِ فَاطَّلَعْتُ ذَاتَ يَوْمٍ فَإِذَا الذِّيبُ قَدْ ذَهَبَ بِشَاةٍ مِنْ غَنَمِهَا وَأَنَا رَجُلٌ مِنْ بَنِي آدَمَ آسَفُ كَمَا يَأْسَفُونَ لَكِنِّي صَكَكْتُهَا صَكَّةً فَأَتَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَعَظَّمَ ذَلِكَ عَلَىَّ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلاَ أُعْتِقُهَا قَالَ " ائْتِنِي بِهَا " . فَأَتَيْتُهُ بِهَا فَقَالَ لَهَا " أَيْنَ اللَّهُ " . قَالَتْ فِي السَّمَاءِ . قَالَ " مَنْ أَنَا " . قَالَتْ أَنْتَ رَسُولُ اللَّهِ . قَالَ " أَعْتِقْهَا فَإِنَّهَا مُؤْمِنَةٌ " . মু’আবিয়া বিন আল হাকাম আস সুলামী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার একজন ক্রীতদাসী ছিল। ওহুদ ও জাওয়ানিয়্যাহ নামক স্থানে সে আমার ছাগল চরাত। একদিন দেখি নেকড়ে আমাদের একটি ছাগল ধরে নিয়ে গেছে। আমি ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে একটি থাপ্পড় মারি। অতঃপর রাসুল (সাঃ) এর নিকট আসলে একে আমি সাংঘাতিক অন্যায় কাজ বলে গণ্য করি। তাই আমি বলি, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমি কি ক্রীতদাসীকে আজাদ করে দিব? রাসুল সাঃ বললেন, তাকে আমার নিকট নিয়ে আস। আমি তাকে রাসুল (সাঃ) এর নিকট নিয়ে আসলাম। রাসুল (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহ কোথায়? সে উপরের দিকে আঙ্গুল তুলে বলল, আসমানে। তখন নবী (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কে? তখন সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসূল মোহাম্মদ (সাঃ)। তখন নবী (সাঃ) বললেন,তাকে মুক্তি দিয়ে দাও, কারণ সে একজন মুমিনা/ঈমানদার নারী। (সহীহ মুসলিম হা /৫৩৭)
এই হাদীসে ব্যবহৃত বাক্য দ্বারা প্রমাণিত হলো আল্লাহ তায়ালা আরশের উপরে আছেন। তা না হলে উপরে বলার পর তিনি নিষেধ করতেন বা শুধরিয়া দিতেন। এখান থেকেও প্রমাণ হয় যে মুমিনা সত্য বলেছিল। কিন্তু আল্লাহ যদি সর্বত্র বিরাজমান হতেন তবে নবী (সাঃ) কেন ওই মুমিনাকে শুধরিয়ে দিলেন না ? কেন তিনি বললেন না যে, আল্লাহ আসমানে নয় সর্বত্র। আসলে ওই মুমিনা সত্যই বলেছিল। আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান নয়। তিনি রয়েছেন আরশে। (৩) আরেক হাদীসে আছে- حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ، حَدَّثَنَا مُغِيرَةُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ الْقُرَشِيُّ، عَنْ أَبِي الزِّنَادِ، عَنِ الأَعْرَجِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " لَمَّا قَضَى اللَّهُ الْخَلْقَ كَتَبَ فِي كِتَابِهِ، فَهْوَ عِنْدَهُ فَوْقَ الْعَرْشِ إِنَّ رَحْمَتِي غَلَبَتْ غَضَبِي ".- অর্থাৎ- আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত,তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন,“আল্লাহ যখন সৃষ্টির কাজ সমাপ্ত করলেন তখন তার কাছে (আল্লাহর কাছে) আরশের উপর রক্ষিত এক কিতাবে লিপিবদ্ধ করেন এবং নিজের সত্বা সম্পর্কে লিখেন- নিশ্চয়ই আমার করুণা আমার ক্রোধের উপর জয়লাভ করেছে”। (বুখারী হা/২৯৬৭, সৃষ্টির সূচনা অধ্যায়, অনুবাদ-ইসলামিক ফাউন্ডেশন, মিশকাত হা/২৩৬৪, দোয়া অধ্যায়, আল্লাহর রহমতের প্রশস্থতা অনুচ্ছেদ)। হাদীসে ব্যবহৃত فَهْوَ عِنْدَهُ فَوْقَ الْعَرْشِ বাক্য প্রমাণ করে আল্লাহ তায়ালা আরশের উপরে আছেন। আরশের উপর আল্লাহর নিকট রক্ষিত কিতাব প্রমাণ করে কিতাব এবং আল্লাহ রয়েছেন আরশের উপর। আল্লাহর ওহীও নাজিল হতো আসমান থেকে। আল্লাহ সৃষ্টির কাজ সমাপ্ত করে সেই কিতাবেই বাকী বক্তব্যগুলো লিখেছেন।
(৪) হাদীসে আরো আছেÑ عَنْ سَلْمَانَ الْفَارِسِيِّ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " إِنَّ اللَّهَ حَيِيٌّ كَرِيمٌ يَسْتَحِي إِذَا رَفَعَ الرَّجُلُ إِلَيْهِ يَدَيْهِ أَنْ يَرُدَّهُمَا صِفْرًا خَائِبَتَيْنِ সালমান ফারসী (রাঃ) রাসুল সাঃ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ লজ্জাশীল ও মহানুভব। যখন কোন ব্যক্তি তার (আল্লাহর) নিকট দু’হাত তুলে দোয়া করে, তখন তাকে শূন্য হাতে ফেরত দিতে তিনি লজ্জাবোধ করেন। (তিরমিজী হা/৩৫৫৬, ইবনু মাজাহ হা/৩৮৬৫, হাদিস সহীহ) দোয়া করার সময় দু’হাত উত্তোলন করে আল্লাহর নিকট চাওয়ার অর্থ হলো আল্লাহ উপরে অর্থ্যাৎ আরশের উপরে আছেন। (৫) বিদায় হজ্জের ভাষণে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) সাহাবীগণকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,তোমাদের আমার সম্পর্কে (আল্লাহ তায়ালা) জিজ্ঞাস করা হলে কি বলবে? ঐ সময় উপস্থিত সাহাবীগণ বলেছিলেন, আমরা স্বাক্ষী দিব যে, আপনি আপনার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছেন। একথা শুনার পর রাসুল (সাঃ) তার হাতের আঙ্গু আসমানের দিকে উত্তোলন করে বলেছিলেন, হে আল্লাহ! তুমি স্বাক্ষী থেকো। (সহীহ মুসলিম হা/১২১৮ ‘হজ্জ্ব অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৯) আল্লাহ যদি সর্বত্রই বিরাজমান হতেন তবে রাসুল সাঃ কেন শুধুমাত্র আসমানের দিকে হাত উত্তোলন করবেন? তিনি তো ডানে বামে সামনে পিছনে বিভিন্ন দিকে হাতের আঙ্গুল তুলতে পারতেন। যারা বলে আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান, তারা কি এটাই বলতে চান যে আল্লাহ পাহাড় পর্বত, নদী নালা, খাল-বিল, হাওড়-সাগর, আকাশ-বাতাস, আগুন-পানি, ময়লা আবর্জনা তথা বাঞ্চিত-অবাঞ্চিত সব কিছুতেই রয়েছেন (নাউযুবিল্লাহ)।
(৬) আরেক হাদীসে আছে- بَابُ: {وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ}، {وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ} قَالَ أَبُو الْعَالِيَةِ: {اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ} ارْتَفَعَ، {فَسَوَّاهُنَّ} خَلَقَهُنَّ. وَقَالَ مُجَاهِدٌ: {اسْتَوَى} عَلاَ عَلَى الْعَرْشِ. وَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ الْمَجِيدُ الْكَرِيمُ، وَالْوَدُودُ الْحَبِيبُ. يُقَالُ حَمِيدٌ مَجِيدٌ كَأَنَّهُ فَعِيلٌ مِنْ مَاجِدٍ، مَحْمُودٌ مِنْ حَمِيدٍ মহান আল্লাহ্র বাণীঃ তখন তাঁর আরশ পানির ওপর ছিল। তিনি আরশে আযীমের প্রতিপালক। আবুল আলীয়া (রহঃ) বলেন, اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ এর মমার্থ হচ্ছে আসমানকে উড্ডীন করেছেন। فَسَوَّاهُنَّ এর মর্মার্থ হচ্ছে, তিনি আসমান জমিনকে সৃষ্টি করেছেন। মুজাহিদ (র) বলেছেন, اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ এর মর্মাথ হল, আরশের উপর অধিষ্ঠিত হলেন। আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, مَجِيد অর্থ সম্মানতি, الوَدُود অর্থ প্রিয়। বলা হয়ে থাকে, حَمِيدٌ مَجِيدٌ মূলত প্রশংসনীয় ও পবিত্র। বস্তুত এটি مَاجِدٍ থেকে فَعِيلٌ এর ওযনে এসেছে। আর مَحْمُودٌ (প্রশংসনীয়) এসেছে حمد থেকে (বুখারী ৩১২৪) (৭) হাদীসে আছে- قَالَ فَكَانَتْ زَيْنَبُ تَفْخَرُ عَلَى أَزْوَاجِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم تَقُولُ زَوَّجَكُنَّ أَهَالِيكُنَّ وَزَوَّجَنِي اللهُ تَعَالَى مِنْ فَوْقِ سَبْعِ سَمَوَاتٍ وَعَنْ ثَابِتٍ وَتُخْفِي فِي نَفْسِكَ مَا اللهُ مُبْدِيهِ وَتَخْشَى النَّاسَ نَزَلَتْ فِي شَأْنِ زَيْنَبَ وَزَيْدِ بْنِ حَارِثَةَ আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন,যয়নব (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর অন্যান্য স্ত্রীগণের উপর গর্ব করে বলতেন যে, তাঁদের (অন্যান্য স্ত্রীদের) বিয়ে দিয়েছে তাদের নিজ নিজ পরিবার। আর রাসুল (সাঃ) এর সাথে আমার বিয়ে আল্লাহ তায়ালা সপ্ত আসমানের উপর (অর্থ্যাৎ আরশ) থেকে সম্পাদন করেছেন। (বুখারী হা/৬৯১৫) এই হাদীসও স্পষ্ট প্রমাণ করছে যে উম্মুল মুমিনিন যয়নব (রাঃ) ও বিশ্বাস করতেন যে আল্লাহ সপ্ত আসমানের উপর আরশে রয়েছেন। (৮) মিরাজ সম্পর্কিত এক দীর্ঘ হাদীসে সালাত ফরজ হওয়া সম্পর্কিত অংশে আছে - فَأَوْحَى اللَّهُ فِيمَا أَوْحَى إِلَيْهِ خَمْسِينَ صَلاَةً عَلَى أُمَّتِكَ كُلَّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ. ثُمَّ هَبَطَ حَتَّى بَلَغَ مُوسَى فَاحْتَبَسَهُ مُوسَى فَقَالَ يَا مُحَمَّدُ مَاذَا عَهِدَ إِلَيْكَ رَبُّكَ قَالَ عَهِدَ إِلَىَّ خَمْسِينَ صَلاَةً كُلَّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ.----------মিরাজ এর ঘটনা থেকে আমরা জানি যে, রাসুল সাঃ কে যখন একের পর এক সপ্ত আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তখন তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছিল নবী রাসুলগণের (আঃ) এবং আল্লাহর সান্নিধ্যের জন্য সপ্ত আসমানের উপরে তিনি গিয়েছিলেন। এরপর যখন আল্লাহ ৫০ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করলেন। তখন রাসুল (সাঃ) ৫০ ওয়াক্ত ফরজ সালাত নিয়ে মূসা (আঃ) এর সাথে ৬ষ্ঠ আসমানে দেখা হলে মুসা (আঃ) সালাত কমানোর পরামর্শ দেন। পরামর্শ মোতাবেক রাসূল (সাঃ) আরশে গিয়ে সালাত কমানোর আবেদন করলে ফরজ সালাতের পরিমাণ ৫০ থেকে কিছুটা কমানো হয়। আরশ থেকে ফিরে আসার সময় আবার ৬ষ্ঠ আসমানে মুসা (আঃ) এর সাথে দেখা হয় এবং আবারও তিনি সালাত কমানোর পরামর্শ দেন। এরপর কমতে কমতে ৫ ওয়াক্ত হয়। (বুখারী হা /৭০০৯) এ দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা’য়ালা আরশের উপরে আছেন, তিনি সর্বত্র বিরাজমান নন।(৯) আবু বকর ছিদ্দীক রাঃ বলেছেন-ومَنْ كَانَ يَعْبُدُ اللهَ فإنَّ اللهَ فيِ السماء حَيٌّ لا يمُوتُ (رواه الدارمي في الرد غلي الجهمية باسناد صحيح) যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদাত করে (সে জেনে রাখুক) নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা আসমানের উপর জীবিত আছেন, কখনোই তিনি মারা যাবেন না। (সুনানে দারেমী সহীহ সনদ)। জাহমিয়া স¤প্রদায়ের ”আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান” আক্বিদার লোকদের তিনি একথা বলেন। আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ) এর আক্বিদাও হলো আল্লাহ আসমানের উপর আরশে। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষের আক্বিদাহ আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান (নাউযুবিল্লাহ)। আয়িম্মায়ে মুজতাহিদীন ও ওলামায়ে কেরামের অভিমতঃ ইমাম আবু হানিফা (রঃ) আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদীর (রঃ) বক্তব্য হচ্ছে আল্লাহ, আল্লাহর মতোই আরশে আজীমে অবস্থান করে গোটা মাখলুকাত নিয়ন্ত্রণ করেন। সব কিছুই আল্লাহর নখদর্পে তাঁর জন্য কোন কিছু করা কেবল ইচ্ছা আর হও বলার ব্যাপর মাত্র। অনেকেই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের এই সহীহ আক্বীদাকে ভুল প্রমানিত করে তাঁকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে দলীলহীন যুক্তি উপস্থাপন করে নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছেন। এ বিষয়ে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের ইমাম মুজতাহিদগণের এবং সমকালীন ইসলামী স্কলারদের মতামত পর্যালোচনা করলেই তা পরিস্কার হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। তাই আমরা এখানে কোন মন্তব্য না করে তাদের বক্তব্য গুলোই এখানে উপস্থাপন করছি।-
ইমাম আবু হানিফা’র (রঃ) একটি উক্তি সকল আক্বীদার কিতাবেই এ ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে-:”قلتُ: أرأيتَ لو قيل أين الله تعالى؟ فقال ـ أي أبو حنيفة ـ : يقال له كان الله تعالى ولا مكان قبل أن يخلق الخلق، وكان الله تعالى ولم يكن أين ولا خَلْق ولا شىء، وهو خالق كل شىء” অর্থাৎ- যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় যে আল্লাহ তায়ালা কোথায় ? তাহলে আপনার জবাব কি হবে? ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এর উত্তরে বলেন, তাকে বলা হবে, সৃষ্টির অস্তিত্বের পূর্বে, যখন কোন স্থানই ছিলনা, তখনও আল্লাহ তায়ালা ছিলেন। আল্লাহ তায়লা তখনও ছিলেন যখন কোন সৃষ্টি ছিলো না, এমন কি ‘কোথায়’ বলার মতো স্থানও ছিলো না। সৃষ্টির একটি পরমাণুও যখন ছিলো না তখনও আল্লাহ তায়ালা ছিলেন। তিনিই সব কিছুর সৃষ্টা” (الفقة الأبسط আল-ফিকহুল আবসাত, পৃঃ ৫৭) ইমাম আবু হানিফা (রঃ) আরও বলেন-“ولقاء الله تعالى لأهل الجنة بلا كيف ولا تشبيه ولا جهةٍ حقٌّ” অর্থাৎ জান্নাতবাসীর জন্য কোন সাদৃশ্য,অবস্থা ও দিক ব্যতীত আল্লাহ তায়ালার দর্শন সত্য (وصية الإمام إبي حنيفة কিতাবুল ওসিয়্যা, পৃ.৪, শরহে ফিকহুল আকবার, মোল্লা আলী কারী, পৃ.১৩৮) আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, الله خالق كل شي অথর্: সকল কিছুর স্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা। সূরা জুমার, আয়াত ৬২ এতে সুস্পষ্ট প্রমাণিত যে সমস্ত স্থান ও দিকের স্রষ্টাও আল্লাহ।
ইমাম আবু আবু হানিফার (রঃ) আরেকটি অভিমত হলো যে- তিনি তাঁর ‘ওসীয়াত’ নামক কিতাবে বলেছেন- ‘‘আমরা স্বীকার ও বিশ্বাস করি যে, মহান আল্লাহ আরশের উপর সমাসীন, আরশের প্রতি তাঁর কোনোরূপ প্রয়োজন ব্যতিরেকে এবং আরশের উপরে স্থিরতার প্রয়োজন ব্যতিরেকে। তিনি আরশ ও অন্য সবকিছুর সংরক্ষক। তিনি যদি আরশের মুখাপেক্ষী হতেন তাহলে বিশ্ব সৃষ্টি করতে ও পরিচালনা করতে পারতেন না, বরং তিনি মাখলূকের মত পরমুখাপেক্ষী হয়ে যেতেন। আর যদি তার আরশের উপরে উপবেশন করার বা স্থির হওয়ার প্রয়োজনীয়তা থাকে তবে আরশ সৃষ্টির পূর্বে তিনি কোথায় ছিলেন? কাজেই আল্লাহ এ সকল বিষয় থেকে পবিত্র ও অনেক অনেক ঊর্ধ্বে।’’ অর্থাৎ অবস্থানের ধরণ অজ্ঞাত তথা মানুষের জ্ঞানের বাইরে।
ইমাম মালিক (রঃ) ইমাম মালিক (রঃ) কে আল্লাহর আরশের উপরে সমাসীন হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন:‘‘সমাসীন হওয়ার বিষয়টি পরিজ্ঞাত,এর পদ্ধতি বা স্বরূপ অজ্ঞাত,এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদ‘আত এবং এ বিষয় বিশ্বাস করা জরুরী।’’(শারহু ফিকহিল আকবর,মোল্লা আলী কারী পৃ৭০।)
ইমাম আবু জা’ফর ত্বাহাবী (রঃ) ইমাম ত্বাহাবী (রঃ) বলেন-تعالى عن الحدود والغايات ، والأركان والأعضاء والأدوات ، لا تحويه الجهات الست كسائر المبتدعات মহান আল্লাহ তায়ালা সব ধরনের সীমা-পরিসীমা, অঙ্গ-প্রতঙ্গ, সহায়ক বস্তু ও উপায়-উপকরণ থেকে পবিত্র। অন্যান্য সৃষ্ট বস্তুর ন্যায় ছয় দিক তাকে বেষ্টন করে না। (অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা সব ধরণের দিক থেকেও পবিত্র)
ইমাম আবুল লাইস সমরকন্দি (রঃ)
‘আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে কিছু লোক মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে। কাররামিয়া ও মুশাব্বিহাদের বক্তব্য হলো, আল্লাহ তায়ালা স্থানগত ভাবে আরশের ওপর রয়েছেন। তাদের নিকট নশ্বর আরশ হলো আল্লাহর অবস্থান বা অধিষ্ঠানের জায়গা। তারা স্থানের দিক থেকে আল্লাহ তায়ালার জন্য এখান থেকে অবতরণ,চলাফেরা ইত্যাদি সাব্যস্থ করেছে। তারা বলেন, আল্লাহ তায়ালা দেহবিশিষ্ট। তবে তিনি অন্যান্য দেহবিশিষ্টদের মতো নন। মহান আল্লাহ তাদের এসব ভ্রান্ত আকিদা থেকে সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে। তারা তাদের মতবাদ প্রমাণে সুরা ত্বাহার ৫ নম্বর আয়াত اَلرَّحۡمٰنُ عَلَی الۡعَرۡشِ اسۡتَوٰی আল্লাহ তায়ালা আরশের ওপর ইস্তিয়া করেছেন।” দলীল দেন। আমরা তাদের এই মতবাদ এভাবে খন্ডন করি, আরশ এক সময় ছিল না। আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির মাধ্যমে তা অস্তিত্ব লাভ করেছে। এখন নশ্বর আরশের ওপর হয়তো আল্লাহ তায়ালা নিজের ক্ষমতা, বড়ত্ব ও কর্তৃত্ব প্রকাশ করবেন অথবা নিজের বসার প্রয়োজনে সেখানে আসন গ্রহণ করবেন। অকাট্যভাবে প্রমাণিত সত্যহলো, অন্যের মুখাপেক্ষী কেউ কখনো স্রষ্টা হতে পারে না। সে তো নিজের প্রয়োজনেই অন্যের দ্বারস্থ। সে কীভাবে অন্যের ওপর ক্ষমতাবান হবে? অন্যের দ্বারস্থ ব্যক্তি তো নেতা হওয়ারই যোগ্য নয়। সে কীভাবে প্রতিপালক হবে? আরশে বসা বা এর ওপর অবস্থান গ্রহণের সম্ভাবনা যখন ভ্রান্ত প্রমাণিত হলো, তখন প্রথম সম্ভাবনাই সঠিক। অর্থাৎ আরশ আল্লাহর সৃষ্টি হওয়ার কারণে তা আল্লাহর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সামনে তুচ্ছ। এর প্রতি কোনোরূপ প্রয়োজন ব্যতীত আল্লাহ তায়ালা নিজের কর্তৃত্ব ও বড়ত্ব প্রকাশ করেছেন।’ (শারহু ফিকহিল আবসাত ২৫-২৬) তিনি আরও বলেন -‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা হলো,আল্লাহ তায়ালা নিজের মহত্ব, বড়ত্ব ও প্রভুত্বের দিক থেকে আরশের ওপর সমুন্নত। স্থান, দূরত্ব ও উচ্চতার দিক থেকে তিনি আরশের ওপর সমুন্নত নন; যেমনটি ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেছেন। তিনি আল্লাহর মর্যাদাগত সমুন্নত হওয়ার কথা বলেছেন। কেননা, মর্যাদা ও বড়ত্বের দিক থেকে সমুন্নত হওয়াটা মহান প্রতিপালকের গুণ।’ (ফিকহিল আবসাত ২৫)
ইমাম আবুল ইয়াসার বাজদাবি (রঃ) ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক¦ীদা-বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা স্থান থেকে মুক্ত । তিনি আরশে বা অন্য কোনো স্থানে নন। তিনি আরশের ওপরও নন। আল্লাহ তায়ালা সমস্ত দিক থেকেও সম্পূর্ণ মুক্ত। ভ্রান্ত আকিদায় নিপতিত কিছু হাম্বলি, কাররামিয়া, ইহুদি ও মুজাসসিমার আক্বীদা হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশে অবস্থান করেন বা অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন। তাদের কেউ কেউ বলেন, অন্যান্য দেহবিশিষ্ট বস্তুর মতো আল্লাহ তাআলার ছয় দিক রয়েছে। তাদের কেউ কেউ বলেন, আল্লাহ তায়ালার একটি দিক রয়েছে (ওপরের দিক)। আর এই দিকের কারণে তিনি আরশে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। (উসুলুদ দীন ৪০)
ইমাম গাজ্জালি (রঃ) ইমাম গাজ্জালি (রঃ) বলেন-তুমি জাহাম ইবনু সাফওয়ানের আকিদাগত ভ্রান্তি থেকে বেঁচে থেকো। কিছু লোকের ভ্রান্ত বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা সব যায়গায় রয়েছেন। যারা আল্লাহ তায়ালাকে কোনো যায়গা অথবা দিকের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে, তাদের পদস্খলন হয়েছে। তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। তারা তাদের সমস্ত চিন্তাভাবনাকে জীব-জন্তুর ইন্দ্রীয় ক্ষমতার মধ্যেই কেন্দ্রীভূত করে রেখেছে। তাদের চিন্তাশক্তি দেহ ও দেহ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গন্ডি থেকেও মুক্ত হয়নি। (আল-আরবাইন ফি উসুলিদ দীন ১৯৮)
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনি (রঃ) ‘আবুল আলিয়া বলেছেন, (আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে) ইসতাওয়া’র অর্থ হলো উঁচু হওয়া। তার এই ব্যাখ্যায় ত্রুটি রয়েছে। কেননা, আল্লাহ তায়ালা কখনো নিজের সম্পর্কে ইরতাফাআ বা উঁচু হওয়ার গুণ ব্যবহার করেননি। মুজাসসিমাদের (দেহবাদী) বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের ওপর স্থির হয়ে আছেন বা স্থিতি গ্রহণ করেছেন। তাদের এই বক্তব্যটি (আল্লাহ তায়ালা আরশে স্থির আছেন) ভ্রান্ত। কেননা, স্থির হওয়া বা স্থিতি গ্রহণ করা নশ্বর দেহের বৈশিষ্ট্য। এর দ্বারা কোনো কিছুর মধ্যে প্রবীষ্ট হওয়া ও সীমাবদ্ধ হওয়া আবশ্যক হয়। আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে এগুলো অবান্তব ও অকল্পনীয়। (উমদাতুল কারী, ২৫/১১১)
আল্লামা ইবনু নুজাইম (রঃ) আল্লামা ইবনু নুজাইম (রঃ) বলেন আল্লাহর জন্য স্থান সাব্যস্থ করা কুফরী। ‘আল্লাহর জন্য স্থান সাব্যস্তের কারণে কাফির হয়ে যাবে। কেউ যদি বলে, আল্লাহ তায়ালা আকাশে রয়েছেন, এটা যদি সে হাদীসের বাহ্যিক বক্তব্য উদ্ধৃত করার উদ্দেশ্যে বলে, তবে সে কাফির হবে না। কিন্তু বাস্তবে যদি আল্লাহ তায়ালা আকাশে রয়েছেন এ ধরনের বিশ্বাস রাখে, তবে সে কাফির হয়ে যাবে। এ বক্তব্য দ্বারা যদি তার বিশেষ কোনো নিয়ত না থাকে, তবুও অধিকাংশের নিকট এটা কুফরি হবে। এটাই সঠিক এবং এর ওপরই ফতোয়া। (আল-বাহরুর রায়িক্ব ৫/১২৯ ফতোয়ায়ে আলমগিরী)
আল্লামা আবদুল হক মুহাদ্দীসে দেহলভি (রঃ)
আল্লামা আবদুল হক মুহাদ্দীসে দেহলভি (রঃ) বলেন-সকল স্থান ও যায়গা আল্লাহর নিকট সমান ঃ উলামায়ে দেওবন্দের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব বিখ্যাত তাফসির ও হাদিস-বিশারদ আল্লামা আবদুল হক মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) লিখেছেনÑ ‘আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব ও অবস্থানের জন্য কোনো স্থানের প্রয়োজন নেই। কেননা, দেহবিশিষ্ট ও স্থানিক বস্তুর জন্যই কেবল অবস্থানের যায়গার প্রয়োজন হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা দেহ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। সুতরাং তিনি আকাশে থাকেন না। তিনি জমিনেও অবস্থান করেন না। পূর্ব-পশ্চিম কোথাও তিনি থাকেন না। বরং সমগ্র মহাবিশ্ব তাঁর নিকটি অণু-পরমাণুতুল্য। সুতরাং তিনি এই ক্ষুদ্র সৃষ্টির মধ্যে কেন অবস্থান করবেন? তবে সৃষ্টির সবকিছুই আল্লাহর সামনে পূর্ণ উদ্ভাসিত। কোনো কিছুই তাঁর থেকে সুপ্ত বা অজ্ঞাত নয়। সকল স্থান ও যায়গা আল্লাহর নিকট সমান। (আক্বায়ীদুল ইসলাম ৩২)
শামসুল আইম্মা সারাখসী (রঃ) হানাফী মাজহাবের মুজতাহিদ ফিল মাজহাব বিখ্যাত ইমাম শামসুল আইম্মা সারাখসী (রঃ) (৪৯০ হিজরী) বলেন ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ কে নেককাররা দেখবে। তিনি তাঁর বিখ্যাত কিতাব উসুলুস সারাখসী-তে লিখেছেন, رؤية الله بالأبصار في الآخرة حق معلوم ثابت بالنص অর্থাৎ: পরকালে আল্লাহ তায়ালাকে চোখে দেখা সত্য,কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, তারা তাদের রবের দিকে তাকিয়ে থাকবে। অর্থাৎ সেদিন কিছু মুখমন্ডল হাসি-খুশী ও সজীব হবে এবং তারা তাদের রবের দিকে তাকিয়ে থাকবে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আখেরাতে জান্নাতীগণ স্বচক্ষে আল্লাহ্ তা‘য়ালার দীদার (দর্শন) লাভ করবে। আহলে সুন্নাত-ওয়াল-জামায়াতের সকল আলেম ও ফেকাহবিদ এ বিষয়ে একমত।
ইমাম ইবনে ফুরাক (রঃ) ইমাম ইবনে ফুরাক (রঃ) (মৃত: ৪০৬ হিজরী) বলেন আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান ধারণা ভ্রান্ত ঃ اعلم أن الثلجي كان يذهب مذهب النجار في القول بأن الله في كل مكان وهو مذهب المعتزلة وهذا التأويل عندنا منكر من أجل أنه لا يجوز أن يقال إن الله تعالى في مكان أو في كل مكان অর্থাৎ: জেনে রেখো, সালজী মূলত: নাজ্জারের আকিদা-বিশ্বাস লালন করতো। নাজ্জারিয়া ফেরকার বিশ্বাস ছিলো, আল্লাহ সবর্ত্র বিরাজমান। এটি মূলত: মু’তাজিলাদের মতবাদ। আমাদের নিকট এই বক্তব্যটি নিন্দনীয়। কেননা, আল্লাহর তায়ালার ক্ষেত্রে এটি বলা বৈধ নয় যে, আল্লাহ তায়ালা সব যায়গায় অথবা কোন একটি নিদির্ষ্ট জায়গায় রয়েছেন। (ইবনে ফুরাক,মুশকিলুল হাদীস পৃ.৬৫) ইবনে ফুরাক (রঃ) আরও বলেন- فمتى ما رجعوا في معنى إطلاق ذلك إلى العلم والتدبير كان معناهم صحيحًا واللفظ ممنوعًا ألا ترى أنه لا يسوغ أن يقال إن الله تعالى مجاور لكل مكان أو مماس له أو حال أو متمكن فيه على معنى أنه عالم بذلك مدبرٌ له অর্থাৎ: কেউ যদি“সর্বত্র বিরাজমান” দ্বারা উদ্দেশ্য নেয় যে, আল্লাহ তায়ালা ইলিম, ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সবর্ত্র বিরাজমান, তাহলে তাদের উদ্দেশ্য সঠিক। তবে “সর্বত্র বিরাজমান” শব্দটি ব্যবহার করার অনুমতি নেই। আপনি এ ব্যাপারে সচেতন যে, কেউ যদি বলে,“আল্লাহ সব যায়গার সাথে রয়েছেন” অথবা “সব যায়গা স্পর্শ করে আছেন” “সকল যায়গায় মিশ্রিত আছেন”“সব যায়গায় অবস্থান করছেন” এবং এসব ব্যবহার দ্বারা সে উদ্দেশ্য নেয় যে, আল্লাহ তায়ালা এগুলো সম্পর্কে অবগত রয়েছেন এবং এগুলো প্রতিপালন করছেন, এরপরও আল্লাহর তায়ালার ক্ষেত্রে এজাতীয় শব্দ ব্যবহার কখনও শোভনীয় নয়।
ইমাম বায়হাকী (রঃ) ঃ ইমাম বায়হাকী (রঃ) (মৃত:৪৫৮ হি:) আল্লাহ তায়ালা জ্ঞানের দিক থেকে আমাদের সাথে রয়েছেন। ইমাম বায়হাক্বী (রঃ) বলেন- وفيما كتبنا من الآيات دلالة على إبطال قول من زعم من الجهمية أن الله سبحانه وتعالى بذاته في كل مكان وقوله عز وجل: ((وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ)) إنما أراد به بعلمه لا بذاته অর্থাৎ- আমি যেসমস্ত আয়াত উল্লেখ করেছি,এগুলো কিছু কিছু জাহমিয়াদের বক্তব্য বাতিল প্রমাণ করছে। তারা বলে, আল্লাহ তায়ালা সত্বাগতভাবে সর্বত্র বিরাজমান। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, অর্থাৎ- “তোমরা যেখানেই থাকো, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের সাথে রয়েছেন”। এই আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তায়ালা জ্ঞানের দিক থেকে আমাদের সাথে রয়েছেন। এর দ্বারা সত্তাগতভাবে আমাদের সাথে রয়েছেন,এটি উদ্দেশ্য নয়। (আল-ই’তিক্বাদ ওয়াল হিদায়া ইলা সাবিলির রাশাদ,পৃষ্ঠা৭০)
ইমাম ইবনে কসীর (রঃ) ঃ ইমাম ইবনে কাসীর (রঃ মৃতঃ৭৭৪ হি:) বলেছেন আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান এই বিশ্বাস ভ্রান্ত। তিনি লিখেছেনÑ اتفق المفسرون على إنكار قول الجهمية الأول القائل تعالى عن قولهم علوًّا كبيرًا بأنه في كل مكان অর্থাৎ জাহমিয়ারা সর্বপ্রথম আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে এই মতবাদ প্রচার করে যে, তিনি সর্বত্র বিরাজমান। আল্লাহ তায়ালা এর থেকে মহা পবিত্র। সমস্ত মুফাসসির জাহমিয়াদের এই বক্তব্য খন্ডনে একমত পোষণ করেছেন। (তাফসীরে ইবনে কাসীর,খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ৭ )
ইমাম সাদ উদ্দীন তাফতাজানী (রঃ) ইমাম সাদ উদ্দীন তাফতাজানী (রঃ) বলেছেন-আল্লাহ, কোন দিকে অবস্থান করা থেকে পবিত্র ঃ ইমাম সা’দুদ্দীন তাফতাজানী (রঃ) তার বিখ্যাত আক্বীদার কিতাব শরহুল আক্বাঈদ আন নাসাফিয়্যাতে বলেছেনÑ لا يتمكن في مكان অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা কোন স্থানে অবস্থান করেন না। ইমাম সা’দুদ্দীন তাফতাজানী (রঃ) এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা ও দলিল লিখেছেন শরহুল আকাইদে। উক্ত আলোচনার শেষে ইমাম তাফতাজানী (রঃ) বলেন, و إذا لم يكن في مكان لم يكن في جهة، لا في علو ولا في سفل ولافي غيرهما অর্থাৎ-“আল্লাহ তায়ালা যেহেতু স্থান থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, এ কারণে তিনি কোন দিকেও অবস্থান করেন না। উপরেও নয়। নীচেও নয়। অন্য কোন দিকেও নয়”। যার সার কথা হলো আল্লাহ তায়ালা স্থান ও দিক থেকে মুক্ত। তিনি পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, উপর-নীচ সকল দিক থেকে মুক্ত। স্থান ও দিক সব কিছুই আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির মাঝে প্রবেশ ও এগুলোর মাঝে অবস্থান থেকে মহাপবিত্র। (আকাঈদে নাসাফিয়্যা, পৃ.১৩২) উল্লেখ্য দারুল উলুম দেওবন্দ সহ উপমহাদেশের আলীয়া ও ক্বওমী ধারার মাদ্রাসা গুলোতে এবং মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশ গুলোর বিশ্ববিদ্যায় গুলোতেও আক্বীদা বিভাগে এই কিতাবখানা পড়ানো হয়। দারুল উলুম দেওবন্দের আক্বীদা বিভাগ থেকে আল বয়ানুল ফাওয়াঈদ নামে এর একটা শরাহ প্রকাশিত হয়েছে।
ইমাম আবুল মুঈন নাসাফী (রঃ) ইমাম আবুল মুঈন নাসাফী (রঃ) (মৃত: ৫০৮ হি:) বলেন- আল্লাহ তায়ালার জন্য কোন দিক ধারণ করা অবান্তর । আবুল মুঈন নাসাফী (রঃ) মাতুরিদি আক্বীদার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন। ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদি (রঃ) এর কিতাব সমূহের পর তার কিতাবগুলোকে মাতুরিদি আক্বীদার মৌলিক কিতাব মনে করা হয়। ইমাম গাজালী (রঃ)ও ইমাম বাকিল্লানী (রঃ) যেমন আশআরী আক্বীদার ব্যাখ্যাকার ছিলেন,একই পর্যায়ের ইমাম ছিলেন আবুল মুইন নাসাফী (রঃ)। আক্বীদার দলীল বণর্না এবং ভ্রান্ত আক্বীদা সমূহের খন্ডনে তার মতো মহান ব্যক্তিত্ব বিরল। আক্বীদার উপর তার বিশাল কলেবরের কয়েকটি কিতাব রয়েছে। বিশেষভাবে তাবসিরাতুল আদিল্লা কিতাবটি সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। মাতুরিদি আক্বীদার মৌলিক কিতাব হিসেবে এটি সর্বমহলে পরিচিত। ইমাম আবুল মুঈন নাসাফী (রঃ) তার অদ্বিতীয় কিতাব তাবসিরাতুল আদিল্লা-তে আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়তের আকিদা উল্লেখ করেছেন। সেই সাথে বিভিন্ন ফেরকার আক্বীদা উল্লেখ করে সেগুলো খন্ডন করেছেন। ইমাম আবুল মুঈন নাসাফী (রঃ) লিখেছেন, “পূর্বের আলোচনা থেকে অকাট্য প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, আল্লাহ তায়ালা মহাবিশ্বের একটি অণু-পরমাণুর সাথেও বিন্দুমাত্র সাদৃশ্য রাখেন না। কেননা, মহাবিশ্বের কোন কিছুর সাথে সাদৃশ্য বা সমপর্যায়ের হলে মহাবিশ্বের মতো তিনি সৃষ্ট ও নশ্বর হয়ে যাবেন। আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে সৃষ্ট বা নশ্বর হওয়া অকল্পনীয়। আমাদের সামনে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় রয়েছে, আল্লাহ তায়ালা কি কোন স্থানে অবস্থান করেন? কোন যায়গা বা দিক কি আল্লাহ তায়ালাকে ধারণ করতে পারে? অকাট্য প্রমাণ দ্বারা আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালার জন্য স্থান ও দিক সাব্যস্থকরা অসম্ভব ও অকল্পনীয়।
ওয়াহদাতুল উজুদ কি ঃ কুরআনুল করীমে এরশাদ হচ্ছেÑ اَنّٰی یَكُوۡنُ لَهٗ وَلَدٌ وَّ لَمۡ تَكُنۡ لَّهٗ صَاحِبَۃٌ ؕ وَ خَلَقَ كُلَّ شَیۡءٍ ۚ وَ هُوَ بِكُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ بدیع السموت و الارض انی یكون لهٗ ولد و لم تكن لهٗ صاحبۃ و خلق كل شیء و هو بكل شیء علیم অর্থাৎ-তিনিই আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা। কিভাবে তার সন্তান হবে অথচ তার কোন সঙ্গিনী নেই! আর তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি প্রতিটি জিনিসের ব্যাপারে সর্বজ্ঞ। (সূরা আনআম: ১০১) বাস্তব কথা হচ্ছে, অস্তিত্ব একটি নয়; বরং দু’টি। একটি স্রষ্টার (আল্লাহর) অস্তিত্ব,আরেকটি সৃষ্টির অস্তিত্ব। কুরআন -হাদীছে দিবালোকের মত পরিস্কার করে বলা আছে যে, মহান আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা, তিনি আরশের উপরে সমুন্নত,তার সুউচ্চ গুণাবলী সৃষ্টি জীবের গুণাগুণ,স্বভাব ও বৈশিষ্ট থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির সাথে মিশ্রিত নন, কোন সৃষ্টির ভিতরে নন, যেমন সুফীরা ধারণা করে থাকে। বরং তিনি সৃষ্টির বহু উপরে, সকল সৃষ্টি তার নীচে, তিনি আসমানের উপরে, আরশের উপর সমুন্নত। উপরে থাকাই আল্লাহর সত্তাগত সিফাত বা বিশেষণ। সুফি অধিবিদ্যা বা সুফি অতিপ্রাকৃতিকতা وحدة ওয়াহদা "ঐক্য" বা توحيد তাওহীদের ধারণাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে। উহদাতুল উজুদ এর আক্ষরিক অর্থ"অস্তিত্বের ঐক্য"বা"সত্তার ঐক্য।"উজুদ বা"অস্তিত্ব, উপস্থিতি" বলতে এখানে ঈশ্বরকে বোঝায়।
এ বিষয়ে দুটি প্রধান সূফী দর্শন রয়েছে- (এক) ওয়াহদাতুল-উজুদ যার আক্ষরিক অর্থ "অস্তিত্বের ঐক্য" বা "সত্তার ঐক্য।" উজুদ বা "অস্তিত্ব, উপস্থিতি" বলতে এখানে ঈশ্বরকে বোঝায়। বলা হয়ে থাকে এই দর্শণের প্রবক্তা মুহিউদ্দীন ইবনুল আরবী। অন্যদিকে,ওয়াহদাতুশ-শুহুদ,যার অর্থ"সাপেক্ষবাদ"বা"সাক্ষীর একেশ্বরবাদ" যা বিশ্বাস করে যে,ঈশ্বর এবং তার সৃষ্টি সম্পূর্ণ পৃথক। এটা ওয়াহদাতুল উজুদ এর বিপরীত দর্শন যার প্রবক্তা ছিলেন আদ-দাওলা সিমনানি এর সমর্থক ও প্রচারক শায়খ আহমদ সেরহিন্দী মুজাদ্দিদে আলফেসানি (রঃ)। অন্যদিকে,ওয়াহদাতুশ শুহুদ,যার অর্থ"সাপেক্ষবাদ"বা "সাক্ষীর একেশ্বরবাদ যা বিশ্বাস করে যে,ঈশ্বর এবং তার সৃষ্টি সম্পূর্ণ পৃথক। এটি একটি বিতর্কিত অভিব্যক্তি যা ইবনুল আরাবী (মৃত্যু ১২৪০) এর নামের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। যদিও তিনি এটিকে তার লেখায়ব্যবহার করেননি বলে অনেকে মনে করেন। কারো কারো মতে ইবনে তাইমিয়ার (মৃত্যু ১৩২৮) বিতর্কে এটি প্রথমবারের মতো তাকে দায়ী করা হয়েছে বলে মনে হয়। আধুনিক সময়ের পন্ডিতরা এর অর্থের ব্যাপকভাবে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে ’ওয়াহদাতুল উজুদ’ এর সাতটি বিশ্লেষণ করেছেন। কিছু সংস্কারক দাবি করেছেন যে দুটি দর্শনের মধ্যে পার্থক্য কেবল শব্দার্থবিজ্ঞানেই পৃথক এবং পুরো বিতর্কটি কেবল "মৌখিক বিতর্কের" সংকলন যা দ্ব্যর্থক ভাষার কারণে এসেছে। তবে, ঈশ্বর এবং মহাবিশ্বের মধ্যে সম্পর্কের ধারণাটি এখনও সুফীদের মধ্যে এবং সুফি এবং অ-সুফী মুসলমানদের মধ্যে সক্রিয়ভাবে বিতর্কিত রয়েছে।
ওয়াহদাতুশ-শুহুদ কি ঃ ওয়াহদাতুশ শুহুদ প্রায়শই ইংরেজিতে এপারেন্টিজম বা সাপেক্ষবাদ হিসাবে অনুবাদ করা হয়েছে। আরবিতে এর আক্ষরিক অর্থ "সাক্ষীর একতা", "উপলব্ধির একতা", "উপস্থিতির একতা" বা "প্রকাশের একত্ব"। যারা ওয়াহদাতুল-উজুদের মতবাদের বিরোধিতা করেছিলেন তাদের মধ্যে এমন কিছু ব্যক্তি ছিলেন যারা ওয়াহদাতুশ-শুহুদ মতবাদ তৈরি করতে কর্মের জায়গায় কর্তাকে প্রতিস্থাপন করেছিলেন।এই মাজহাবটি আদ-দাওলা সিমনানি দ্বারা প্রণয়ন করা হয়েছিল, যিনি আহমেদ সিরহিন্দি সহ ভারতের বহু অনুগামীদের আকৃষ্ট করেছিলেন, যিনি ভারতীয় উপমহাদেশে এই মতবাদের কয়েকটি বহুলভাবে স্বীকৃত সূত্র সরবরাহ করেছিলেন। শায়খ আহমদ সিরহিন্দি মতবাদ অনুসারে, ঈশ্বর ও সৃষ্ট বিশ্বের মধ্যে ঐক্যের যে কোনও অভিজ্ঞতা নিখুঁতভাবে বিষয় ভিত্তিক এবং তা কেবল বিশ্বাসীর মনেই ঘটে; বাস্তব বিশ্বে এর কোনও উদ্দেশ্যমূলক অংশ নেই। এর পূর্বে শায়খ আহমদ যা অনুভব করেছিলেন,তা তাকে সর্বেশ্বরবাদের দিকে পরিচালিত করেছিলো,যা সুন্নি ইসলামের আদর্শের পরিপন্থী ছিল।
ওয়াহদাতুল উজুদ বিষয়ে আল কোরআন ও আইম্মায়ে কেরামের মতামত ঃ (১) পবিত্র কুরআনুল করীমের সুরা বাক্বারার ২৫৫ নম্বার আয়াতে এরশাদ হচ্ছেÑ? اللَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لاَ تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلاَ نَوْمٌ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কোন মাবুদ নাই। তিনি চিরঞ্জীব,স্ব-প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিধাতা। তাকে স্পর্শ করে না তন্দ্রা, না নিদ্রা। আসমান এবং জমিনে যা কিছু আছে সব তারই। এই আসমান জমীনের সব কিছুর ¯্রষ্টা আল্লাহ এবং সবখানেই আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন পাওয়া যায়। যারা ওয়াহদাতুল উজুদে বিশ্বাস করেন তাদের মতে এটাই ওয়াহদাতুল উজুদের মুল কথা। (২) সূরা হাদীদের ৩ নম্বার আয়াতে এরশাদ হচ্ছে هُوَ الأَوَّلُ وَالآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ তিনিই আদি,তিনিই অন্ত,তিনিই প্রকাশ্য,তিনিই গুপ্ত। তিনিই সর্ব বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।”এই সম্যক জ্ঞানের বিষয়টিকেই ওয়াহদাতুল উজুদ বলা হয়। (৩) এরশাদ হচ্ছে-كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلاَّ وَجْهَهُ لَهُ الْحُكْمُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ তাঁর সত্তা ব্যতীত সব কিছুই ধ্বংসশীল। (আনকাবুত-৮৮) (৪) আল্লাহ তায়ালা বলেন-كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ (২৬) وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلالِ وَالإِكْرَامِ সব কিছুই হবে ধ্বংস। অবশিষ্ট থাকবে কেবল তোমার প্রতিপালকের সত্তা, যিনি মহিমাময়, মহানুভব। (আর রহমান-২৬) উপরোক্ত আয়াত সমূহ থেকে একথা সুস্পষ্ট প্রমানিত যে, আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র সত্তা, যিনি আদি,এবং অন্ত। তিনি তন্দ্রাও যান না, যান না নিদ্রাও। সব কিছুই ধ্বংস হবে কিন্তু ধ্বংস হবে না আল্লাহ তায়ালার সত্তা। এটাই ওয়াহদাতুল উজুদ ও ওয়হদাতুশ শুহুদ এর ধারণা।
ওয়াহদাতুল উজুদ এর ওয়াহদাতুন এর অর্থ হল একক আর উজুদ মানে হল বিদ্যমান। সুতরাং অহদাতুল ওজুদ অর্থ দাঁড়ায় এক সত্বার বিদ্যমান থাকা। যখন কোন সৃষ্টি ছিল না, তখন আল্লাহ ছিলেন,আবার যখন কিছুই থাকবে না, তখনও আল্লাহ তায়ালাই থাকবেন, সকল বস্তুই মরণশীল বা ধ্বংসশীল একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া। প্রতিটি বস্তুরই সূচনা আছে আবার সমাপ্তি আছে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার সূচনাও নাই,সমাপ্তিও নাই। সকল বস্তুই যে-কোন সময় নিস্প্রাণ হয়ে পড়তে পারে, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা কখনই নিদ্রাও যান না, তন্দ্রায়ও আচ্ছন্ন হন না তাই অস্থিত্বহীন হবার প্রশ্নই উঠে না। মানে হলো যেই সত্তা সর্বদা ছিলেন, সর্বদা আছেন, সর্বদা থাকবেন, সর্বদাই যিনি সচল তিনি হলেন আল্লাহ। তাই আল্লাহ ছাড়া বাকি সবই অস্তিত্বহীন এবং সকল কিছুকে আল্লাহ তায়ালার সামনে হীন মনে করার নামই ওয়াহদাতুল উজুদ। “রাত্রিকালে যে জোনাকী প্রদীপের ন্যায় জ্বলে, তাকে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, দিনের বেলা তুমি বাহিরে আস না কেন? জোনাকী চমৎকার জবাব দিল, আমিতো দিবানিশি মাঠে প্রান্তরেই থাকি, কিন্তু সূর্যের দীপ্তির সামনে আমার আলো প্রকাশ পায় না। এরই নাম ওয়াহদাতুল উজুদ। অর্থাৎ সব সৃষ্টি দেখলে আল্লাহর মেহেরবানী,তার অনুগ্রহ, করূণার দৃষ্টি প্রতিভাত হয়, তখন সৃষ্টি নয়, আমাদের মূল নিবদ্ধতা হয়ে পরে স্রষ্টার দিকে, এরই নাম সকল সৃষ্টিতেই আল্লাহকে পাওয়া যায়। সব সৃষ্টিই আল্লাহ নয়, সব সৃষ্টিতেই আল্লাহ যে স্রষ্টা সেটা বুঝা যায় এটাই হলো ওয়াহদাতুল উজুদ।
মুহিউদ্দীন ইবনুল আরবী (রঃ) ঃ বলা হয়ে থাকে ওয়াহদাতুল উজুদ এর প্রবক্তা বা প্রচারক মুহিউদ্দীন ইবনুল আরবী (রঃ)। ইবনে-আরাবির মূল নাম মোহাম্মদ এবং পারিবারিক নাম আবু আব্দুল্লাহ মোহম্মদ ইবনুল আলী ইবনুল মোহাম্মদ ইবনুল আরাবী। তিনি ১৭ রমজান,৫৬১ হিজরউ (২৭ অথবা ২৮ জুলাই ১১৬৫ খৃঃ) তারিখে তৎকালীন আন্দালুসিয়া বা বর্তমান স্পেনের মূর্সিয়া নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। আন্দালুসিয়া/মূর্সিয়া নগরীতে জন্ম বলে তাঁকে ‘আন্দালুসি’ও বলা হয়। তাছাড়া তিনি দামেস্কে মৃত্যুবরণ করায় ডাকা হয়‘দামেস্কি’। অন্যদিকে ইয়েমেনের সুপ্রসিদ্ধ দাতা হাতেম তাঈ তাঁর পূর্বপুরুষ হওয়ায়‘আল-হাতেমী’ এবং ‘আল-তাঈ’ উপনামেও তার প্রসিদ্ধি রয়েছে। ইবনে আরাবী ছিলেন একজন আন্দালুসিয়ার সুফি সাধক, লেখক, ও দার্শনিক। সুফিতত্বে তাঁর অনবদ্য অবদানের কারনে তিনি ‘শায়খুল আকবর বা শায়খুল আকবর মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবী’ (জ্ঞানীকুল শিরোমণি) নামেই সমধিক পরিচিত। হুজ্জাতুল্লাহিল যাহিরা- আল্লাহর প্রত্যক্ষ্য সাক্ষ্য ও আয়াতুল্লাহিল যাহিরা- আল্লাহর আশ্চ্যর্য ইংগিত নামেও পরিচিত। তাঁর পান্ডিত্য সম্পর্কে যেমন অনেকেই পঞ্চমুখ হয়ে তাঁকে সুফি সম্রাট,শায়খে আকবরও বলা হয়েছে তেমনি তাঁকে বিতর্কিতও বলা হয় এমনকি তাঁর উপর কুফরী ফতোয়াও আরোপ করা হয়েছে। তাঁর অনেক গুলো অনবদ্য রচনা রয়েছে। অনেকে ধারণা করেন আকাবীরে দেওবন্দ ইবনুল আরাবীর ওয়াহদাতুল উজুদ এর আক্বীদা বিশ্বাস করেন।
মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রঃ) শায়খ আহমদ সিরহিন্দি (রঃ) (১৫৬৪-১৬২৪) ভারতের সিরহিন্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চিশতিয়া,কাদিরিয়া এবং সোহরাওয়রর্দিয়া তরীক্বার শিক্ষায় দিক্ষীত ছিলেন। মধ্য এশিয়ার নকশবন্দী শায়খ মুহাম্মদ বাকি বিল্লাহ’ (মৃত্যু ১৬০৩) (রঃ) খলিফা ছিলেন। পরবর্তিতে তিনি এই তরীক্বার প্রচারক ও শায়খ হিসাবে খ্যাতিলাভ করেন। সিরহিন্দির মৃত্যুর পর,নকশবন্দিয়া মুজাদ্দিদিয়া নামে খ্যাতি লাভ করে, কারণ তিনি "দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সংস্কারক" বা মুজাদ্দিদে আলফে ছানি উপাধির নামানুসারে। তিনি ওয়াহদাতুল উজুদ আক্বীদার ভ্রান্ততার বিরুদ্ধে ওয়াহদাতুস শুহুদ আক্বীদার প্রবর্তন করেন। (”বাওয়াদিরুন নাওয়াদির এর বরাতে -জনাব ইজহারুল ইসলাম এর প্রবন্ধ থেকে সংক্ষেপিত)
ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রঃ) হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রঃ) বলেছেন-যেহেতু ওয়াহদাতুল উজুদের অর্থ সাধারণ মানুষের মাঝে একটি ভ্রান্ত অক্বীদার জন্ম দেয়, এ কারণে গবেষক আলেমগণ এই পরিভাষায় পরিবর্তন আনেন। ওয়াহদাতুশ শুহুদ শব্দটি ওয়াহদাুতল উজুদের তুলনায় মূল বক্তব্যকে স্পষ্টভাবে সমর্থন করে। কেননা, উল্লেখিত উদ্দেশ্য বর্ণনায় ওয়াহদাতুল উজুদের ব্যবহার রূপক। আর ওয়াহদাতুশ শুহুদের ব্যবহার বাস্তব। এই মাসআলায় শরয়ী দলীল হলো, আ্ল্লাহ তায়ালা বলেন, আল্লাহর সত্ত্বা ব্যতীত সব কিছুই ধ্বংসশীল। আকাইদে নাসাফীর ব্যাখ্যাকার এমনটিই ব্যাখ্যা করেছেন।”বাওয়াদিরুন নাওয়াদির (জনাব ইজহারুল ইসলাম এর প্রবন্ধ থেকে সংক্ষেপিত)
আশরাফ আলী থানবী (রঃ) হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী (রঃ) ওয়াহদাতুল উজুদ এর বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই বলে-عن أبي هريرة رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم قال الله عز و جل يؤذيني ابن آدم يسب الدهر وأنا الدهر بيدي الأمر أقلب الليل والنهار আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, আদম সন্তান জমানাকে মন্দ বলে আমাকে কষ্ট দেয়, অথচ জমানাতো আমিই। অর্থাৎ- আমারই আয়ত্বে সকল কাজ। (যা জমানা ও কালের মাঝে সংঘটিত হয়)। রাত দিনকে (যা কাল সময়ের অংশ) আমিইতো পরিবর্তন করি। (যেদিকে মানুষ ঘটনাবলীকে সম্পৃক্ত করে। অতএব জমানাতো তার মধ্যকার যাবতীয় বিষয়সহ আমারই অধীন। তাই এসব কার্যকলাপ সবইতো আমারই। একে মন্দ বললেতো আমাকেই মন্দ বলা অবধারিত হয়।(সহীহ বুখারী,৪৫৪৯,মুসলিম,৬০০০, সুনানে আবু দাউদ,৫২৭৬) (“আত তাকাশশুফ”)
হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী (রহ) তার রচিত তা’লিমুদ্দীন কিতাবের দ্বিতীয় খন্ডে আরো পরিষ্কারভাবে ‘ওয়াহদাতুল উজুদ’ এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই বলে যে-এটাতো প্রকাশ্য ব্যাপার যে, সমস্ত পূর্ণাঙ্গতা বা বৈশিষ্ট্য প্রকৃতপক্ষে একমাত্র আল্লাহ পাকের জন্যই সুপ্রতিষ্ঠিত। ওয়াহদাতুল উজুদ দ্বারা প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো,আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কাউকে নিজের মকসুদ বা উদ্দিষ্ট বানাবে না এবং সকল কাজে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিকেই উদ্দিষ্ট বানাবে। সুতরাং এ বিষয়টি ওয়াহদাতুল উজুদ ছাড়াও অর্জিত হতে পারে। তবে এটিও সত্য যে, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য সকল কিছুর অস্তিত্ব থেকে যদি নিজের চিন্তাকে মুক্ত রাখা যায় তাহলে আল্লাহর সন্তুষ্টিকেই একমাত্র লক্ষ্যবস্তু বানানো সহজ হয়। পয়ষট্রি বছর পরে আজ অনুধাবন করেছি যে, ওয়াহদাতুল উজুদ তাউহীদে মাকসুদের কোন স্তরই নয়। এতো দিন আমিও একে তাউহীদে মাকসুদের একটি স্তর মনে করতাম। আল-হামদুলিল্লাহ, আজ ভুল অনুধাবন করেছি। লা মাউজুদা ইল্লাল্লাহ বা ওয়াহদাতুল উজুদকে তাওহীদে হালীও বলে। কিন্তু এটি শরীয়ত নির্ধারিত তাওহীদের কোন স্তর নয়। বরং এটি একটি সহায়ক বিষয়। শরীয়তের তাওহীদের সর্বশেষ স্তর হলো, লা মাকসুদা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টিই একমাত্র লক্ষ্য)। লা মাউজুদা ইল্লাল্লাহ এটি শরীযতের কোন নির্দেশনাও নয় বা এ ব্যাপারে শরীয়তের পক্ষ থেকে কোন সওয়াবও নেই। এটিও যদি তাওহীদের কোন স্তর হতো, তাহলে শরীয়ত অবশ্যই এর আদেশ করতো এবং এর মাধ্যমে সওয়াবও হতো। কিন্তু বাস্তবে শরীয়ত এ ব্যাপারে চুপ রয়েছে। তবে কেউ যদি রূপক অর্থে তাওহীদের এই সহায়ক বিয়টিকে তাওহীদ বলে, তবে এতে কোন সমস্যা নেই। কেননা, পরিভাষা ব্যবহারে কোন দোষ নেই। তবে একে যদি পূর্ণতা অর্জনের ভিত্তি মনে করো, তবুও ঠিক আছে। “ (জাওয়াহিরাতে হাকীমুল উম্মত,পৃ.৪১) (জনাব লুতফুর রহমান ফরায়েজী লিখিত প্রবন্ধ থেকে সংক্ষেপিত)
আহলে হাদীস ঃ সব কিছুকেই আল্লাহ বিশ্বাস করা কে ওয়াহদাতুল উজুদ নয় এটাকে বলা যায় ওয়াহদাতুশ শুহুদ এই অর্থ নেন কথিত আহলে হাদীসরা।“সব কিছুই আল্লাহ” এই ভ্রান্ত বাতিল অর্থটি আমাদের আকাবীরদের নয়, কথিত আহলে হাদীসদের। আমাদের কথা হল সব কিছুতেই আল্লাহ যে স্রষ্টা এটি বুঝা যায়। সব কিছু আল্লাহ নয়, সব কিছুতে একমাত্র স্রষ্টা আল্লাহর পরিচয় পাওয়া যায় এটাই হলো ওয়াহদাতুশ শুহুদ এর সঠিক অর্থ। আমরা যখন কোন বস্তু দেখি তখন যেমন বুঝতে পারি এর একজন নির্মাতা আছেন। তেমনি গোটা সৃষ্টিজগত আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন, তো সৃষ্টি জগতের দিকে তাকালে এর সুনিপূণ স্রষ্টাকে মনে আসার নাম ওয়াহদাতুল ওজুদ। সেই সৃষ্টিটা আল্লাহ নয়, বরং সে বস্তুর স্রষ্টা আল্লাহ। তেমনি যদি আমার কাছে সৃষ্টি বাদ দিয়ে সৃষ্টার কল্পনা চলে আসে সৃষ্টি দেখলেই। মাঝখান থেকে সৃষ্টির কথা মনেই থাকে না, অর্থাৎ সব সৃষ্টি দেখলে আল্লাহর মেহেরবানী, তার অনুগ্রহ, করূণার দৃষ্টি প্রতিভাত হয়, তখন সৃষ্টি নয়, আমাদের মূল নিবদ্ধতা হয়ে পরে স্রষ্টার দিকে, এরই নাম সকল সৃষ্টিতেই আল্লাহকে পাওয়া যায়। সব সৃষ্টিই আল্লাহ নয়, সব সৃষ্টিতেই আল্লাহ যে স্রষ্টা সেটা বুঝা যায় এটাই হলো ওয়াহদাতুল উজুদ। (জনাব লুতফুর রহমান ফরায়েজী)
সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) আল্লাহ তায়ালার অবস্থান সম্পর্কে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদার অনুরূপ মত প্রকাশ করে সুরা ত্বাহার ৫ নম্বার আয়াত عَلَی الۡعَرۡشِ اسۡتَوٰی এর ব্যাখ্যাই লিখেছেন- সৃষ্টি করার পর তিনি কোথাও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েননি। বরং সৃষ্টিজগতে ব্যবস্থা নিজেই পরিচালনা করছেন। এই সীমাহীন রাজ্যে তিনি নিজেই রাজত্ব করছেন। তিনি কেবল স্রষ্টাই নন, কার্যত শাসকও। মূলত আমরা একটু গভীর ভাবে খেয়াল করলে দেখতে পাই মাওলানা মওদুদী (রঃ) অত্যন্ত চমৎকার ভাবে সকল মত ও পথ সকল এখতেলাফের একটি সমন্বয় এনেদিয়েছেন এ ভাবে যে তিনি একজন শাসক। সুতরাং সৃষ্টি জগতটাই তার রক্ষণাবেক্ষণ দেখবাল সবই তাঁর দায়িত্ব। উঠা নামা উপরে নীচে সবই তার নখদর্পে তিনি তাঁর মতোই এ নিয়ে কোন বিতর্কের আবশ্যকতা নেই। আর এটিই হলো আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা। মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) এ সম্পর্কিত আয়াত সমূহের তাফসীরে আল্লাহর অবস্থান ও তার হেকমত ও কুদরতের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে তিনি এটাই বুঝিয়েছেন যে আল্লাহ তায়ালা উপরে থাকেন মানে চিন্তা ভাবনা কর্ম ও শ্রবনের দিক থেকে আল্লাহ তায়ালা সকল কিছুর উর্দ্ধে। সব কিছুই তাঁর নখদর্পে তিনি আশা যাওয়া অবতরণ করা এ সব ই রূপক অর্থে আর দেখা শুনা সবখানে থাকা এটাও রূপক অর্থে। আল্লাহ আল্লাহর মতই দেখেন,শুনেন অবতরণ করেন এটার কোন তুলনা বা এর সাথে কোন সমঞ্জস্যতা চলেনা এবং তাঁর সবখানে সর্বত্র বিরাজমান থাকারও প্রয়োজন পড়েনা। সবখানে সর্বত্র বিরাজমান থাকার ধারণাও আল্লাহর শানের খেলাফ কারণ সর্বত্র বিচরণ করে সৃষ্টি জগতের তদারকী করা তাঁর বড়ত্বের খেলাফ। মাওলানা মওদুদী (রঃ) হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী (রঃ) যে কথাটি বলেছেন যে-’ওয়াহদাতুল উজুদ দ্বারা প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো,আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কাউকে নিজের মকসুদ বা উদ্দিষ্ট বানাবে না এবং সকল কাজে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিকেই উদ্দিষ্ট বানাবে। সুতরাং এ বিষয়টি ওয়াহদাতুল উজুদ ছাড়াও অর্জিত হতে পারে। তবে এটিও সত্য যে, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য সকল কিছুর অস্তিত্ব থেকে যদি নিজের চিন্তাকে মুক্ত রাখা যায় তাহলে আল্লাহর সন্তুষ্টিকেই একমাত্র লক্ষ্যবস্তু বানানো সহজ হয়।’ এই কথাটিই বুঝাতে চেয়েছেন। অথচ বলা হয় মওলানা মওদুদী (রঃ) আল্লাহর অবস্থান বিষয়ে বিষয়ে ভ্রান্ত আক্বিদা পোষণ করেন। অথচ তিনি এ জাতীয় কোন স্বতন্ত্র আক্বীদার কথা বা এটাকে শরীয়তের কোন অপরিহার্য্য বিষয় মনেও করেন নি। এখন বিজ্ঞ পাঠক মহলই ইনসাফের মানদন্ডে বিবেকের আদলতে বিচার করে বলবেন মাওলানা মওদুদীর উপর আনিত অভিযোগ সত্য না ভিত্তিহীন।
আমাদের কথা ঃ আমাদের (লেখকের) মতে এর অর্থ এই নয় যে তিনি আরশের উপর বসে আছেন বা অবকাশ জীবন যাপন করছেন। বরং আরশও আল্লাহর সৃষ্টি যার অবস্থান উর্ধ্ব জগতে সব কিছুর উপরে । আল্লাহর অবস্থান স্বত্বাগত ভাবে তারও উপরে। আল্লাহর জাত ও সিফাত বা কুদরতের দিক থেকেও তিনিই সকলের উপরে। তিনি তাঁর মতই অবস্থান করছেন কোন কিছু সৃষ্টির আগেও যে ভাবে ছিলন এখনও সে ভাবে আছেন অনন্তকাল সে ভাবেই থাকবেন। এটা নিয়ে বিতর্ক কোন মাখলুকাতের মানায়না মানে জ্ঞানের বাইরে। প্রকৃত মুমিন মোসলমান আহলে ইলিম যে যে ভাবেই ব্যাখ্যা করেন না কেন শেষ কথা এটাই যে আল্লাহ আল্লাহর মতোই সকলের উর্দ্ধে আছেন আর মাখলুকাতের মধ্যে যখন যেখানেই যা কিছুই হচ্ছে ঘটছে তা তিনি তাঁর মতোই দেখছেন শুনছেন করছেন।
ওয়াহদাতুল উজুদ মাসআলায় দেওবন্দী আক্বীদা ঃ প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ফতেহ মুহম্মদ পানিপতি দেওবন্দী (রঃ) ফাজিলে দেওবন্দ। আল্লামা ফতেহ মুহাম্মাদ পানিপতি (রঃ) ওয়াহদাতুল উজুদ মাসআলায় আকাবীরে দেওবন্দের আক্বীদাকেও ওয়াহদাতুল ওজুদ বিশ্বাসী বলেছেন। নীচে ফতেহ মুহাম্মাদ ওসমানীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও তার অভিযোগ ও মতাতম তুলে ধরা হলোÑ
পরিচিতি ঃ ফতেহ মুহম্মদ পানিপতি (রঃ) আল্লামা ফতেহ মুহম্মদ পানিপতি (রঃ) ১৯০৫ সালের ১৮ জানুয়ারী (১২ জ্বিলক্বদ ১৩২২ হিজরী ) পানিপথে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে ঐতিহ্যবাহী দরস-ই-নিজামীতে দাওরায়ে হাদীস পাশ করেন। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন আসগর হুসেন ,হোসাইন আহমদ মাদানী,ইব্রাহিম বালিয়াবী,ইজাজ আলী আমরোহী এবং মুফতি মুহাম্মদ শফি দেওবন্দী (রঃ) ১৯৪৭ সালে,পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে তিনিও পাকিস্তানে চলে যান এবং সেখানে ইছরা ও পিন্দ দাদনখানে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। তিনি ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত শিকারপুরের মাদ্রাসা এ আশরাফিয়াহ ফায়জুল কুরআনে অধ্যাপনা করেন। তিনি ১৯৫৭ সালে মুফতি মুহাম্মদ শফি দেওবন্দীর আমন্ত্রণে করাচিতে চলে যান এবং দারুল করাচির নানক ওয়ারাম শাখায় শিক্ষকতা করেন।পনের বছরেরও বেশি সময় ধরে তাকে তার সময়ে একজন শায়খুল র্কুরা হিসাবে গণ্য করা হতো। জাষ্টিস মুফতি মুহাম্মাদ তাকী উসমানী (হাফিঃ) তাকে সমসাময়িক আল-জাযারি বলে বর্ণনা করেছেন । তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন আবদুল হালিম চিশতী,আবদুশ শাকুর তিরমিজি,রহিম বখশ পানিপতি এবং সিদ্দিক আহমদ বান্দলভী (রঃ) । ফতেহ মুহম্মদ পানিপতি (রঃ) ১৯৭২ সালে মদীনায় চলে যান এবং মসজিদে নববীতে শিক্ষকতা শুরু করেন । জীবনের শেষ কয়েক বছর মদীনায় অতিবাহিত করেন। তিনি অল্প সময়ের জন্য লাহোর পরিদর্শন করেন। ২০ মে ১৯৭৯ তারিখে জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মদীনায় ফিরে যান। ১৬ এপ্রিল ১৯৮৭ সালে ইন্তেকাল করলে তাঁকে আল-বাকি কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। আলী ইবনে আবদুর-রহমান আল হুজাইফী তাঁর জানাযায় ইমামতি করেন। পানিপতি (রঃ) উর্দুতে সতেরোটি বই লিখেছেন। এরমধ্যে ইনায়তে রাহমানী,আল-কাসিম ইবনে ফিররুহর হিরজ আল-আমানি ওয়া ওয়াজ আল-তাহানির একটি ভাষ্য,যা সাধারণত আল-শাতিবিয়্যাহ নামে পরিচিত। তার অন্যান্য রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে- আল-কুররাহ আল-মারজিয়্যাহ, আশআল-মাওয়ারিদ ফী শারহে আকিলাত আতরাব আল-কাসাঈদ, মিফতাহ আল-কামাল, নুরানী কায়েদাহ, তাশিল আল-কাওয়াইদ,উমদাতুল-মাওয়ানী প্রভৃতি।
"সকল সূফীই ওয়াহদাতুল উজুদের প্রবক্তা ঃ আল্লামা ক্বারী ফতেহ মুহাম্মদ পানিপতি দেওবন্দী (রঃ) বলেছেন সকল সুফি ই ওয়াহদাতুল উজুদে বিশ্বাসী । তিনি লিখেছেন-" تمام صوفیا حضرات وحدت الوجود کے قائل ہیں، یعنی وہ حق تعالی کے وجود کے علاوہ ہر وجود کی نفی کرتے ہیں ---------"সকল সূফীই ওয়াহদাতুল উজুদের প্রবক্তা,অর্থাৎ তারা আল্লাহ তা'য়ালার অস্তিত্ব ব্যতীত বাকি সমস্ত অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন এবং বলেন যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন অস্তিত্ব নেই। আর এই জগতে যা কিছু দৃশ্যমান, বলা হয় যে তাদের নিজস্ব আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই, বরং এই সমস্ত মহাবিশ্ব এবং মহাবিশ্বের যত বস্তসমূহ একমাত্র আল্লাহ তা'য়ালারই অস্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ এবং তাঁর নামগুলি ও তাঁর গুণাবলীর প্রকাশ।... শেখ মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবির মতবাদ হল যে,আল্লাহ ছাড়া বাকি সবকিছুই অস্তিত্বহীন। আর অস্তিত্ব শুধুমাত্র আল্লাহ তা'য়ালার জন্য। এবং তিনি ছাড়া যা কিছু আমরা দেখতে পাই, তার সবকিছুই মুলত তাঁরই (আল্লাহর) অবিকল সত্বা। এসবের নিজস্ব কোন পৃথক অস্তিত্ব নেই।" (আয়নায়ে সলুক ১১০পৃষ্টা) এখানে ওয়হদাতুল উজুদ এর যে ব্যাখ্য দেয়া হয়েছে এতে কিন্তু এটা বলা হয়নি যে আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান যেটা বর্তমান সময়ে আমাদের বাংলাদেশের কিছু সুফি কিছু তরিকতের পীর কিছু বক্তা মুফাস্সির মুখস্ত করান যে আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান। এটা দেহবাদী শিরকী ধারণা। কিন্তু আল্লাহ ছাড়া সবই অস্থিত্বহীন ক্ষণস্থায়ী এবং সকল সৃষ্টির মাঝেই আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন পাওয়া যায় এটা শিরক নয় বরং কুরআন হাদীসের সুস্পষ্ট দলীল এটাই বলে।
হাজী এমদাদ উল্লাহ মুহাজীরে মক্কী (রঃ)ঃ দীর্ঘ আলোচনার পর আল্লামা ক্বারী ফতেহ মুহাম্মদ পানিপতি দেওবন্দী (রঃ) হাজী এমদাদ উল্লাহ মুহাজিরে মক্কীর উক্তি তুলে ধরে বলেন যে তিনি লিখেছেনÑ,”عینیت و غیریت: یہ دو اصطلاحیں بھی مسئلہ وحدت الوجود کی بڑی اہم اصطلاحات ہیں۔ عین کے معنی ہیں دو چیزوں کا ایک جیسا ہونا۔" আইনিয়্যত (অবিকল/হুবহু সত্বা) এবং গাইরিয়্যত (পৃথক সত্তা)- এই দুটি পরিভাষাও মাসআলায়ে ওয়াহদাতুল উজুদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা। আইন মানে হলো দুটো বস্তুর একই হওয়া। বর্তমান সূফীগণ স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে আইনিয়্যত তথা উভয়কে একই সত্ত¡া বলে বিশ্বাস করেন এবং বলেন যে একমাত্র ওয়াজিবুল উজুদ আল্লাহর অস্তিত্ব ছাড়া আর কোন অস্তিত্ব নেই। আর জগতে যা কিছু দেখা যায় তা আল্লাহ তা'য়ালার অস্Íিত্ব ব্যতীত পৃথক কোন অস্তিত্ব নয়। কারণ সৃষ্টি হচ্ছে স্রষ্টার সৃষ্টিগুণের বহিঃপ্রকাশ। আর স্রষ্টা থেকে তাঁর গুণকে পৃথক করা যায় না। তাই সৃষ্টিও স্রষ্টা থেকে পৃথক হয় না। (আয়নায়ে সলুক ১১৩ পৃষ্ঠা) আল্লামা পানিপতি (রঃ) উদ্ধৃত এই অংশটিকে সহী মানতে পারেননি। আর কারো পক্ষে মানা সম্ভবও নয়। কারণ সকল সৃষ্টিই আল্লাহ বা সৃষ্টির মাঝে আল্লাহর সত্বা লুকিয়ে থাকার ধারণা বিশ্বাস তওহীদের পরিপন্থি। সৃষ্টি আর ¯্রষ্টাকে একাকার করে ফেলা হয়েছে যা কুফরী আক্বীদা। ¯্রষ্টা আর সৃষ্টি কখনো সমান নয় বরং সৃষ্টির মাঝে ¯্রষ্টার কুদরতের নিদর্শন পাওয়া যায় এটাই সঠিক আক্বীদা। তাই তিনি বলেছেন এই আক্বীদা যারা পোষণ করেন যে ¯্রষ্টা সৃষ্টির মাঝেই লুকায়িত তারা ভ্রান্ত।
এর পর তিনি আকাবীরে দেওবন্দকে ওয়াহদাতুল উজুদে বিশ্বাসী বলে এর পক্ষে হাজী এমদাদ উল্লাহ মুহাজীরে মক্কী (রঃ) এর কয়েকটি বক্তব্য তুলে ধরেন। যেখানে এমদাদ উল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রঃ) বলেনÑ نکتہ شناسا مسئلہ وحدۃ الوجود حق وصحيح ہے۔ اس مسئلہ میں کوئی شک وشبہ نہیں ہے۔ -----------"ওয়াহদাতুল উজুদের মাসআলা সত্য এবং সঠিক। এই মাসআলায় কোন সন্দেহ নেই। ফকির (আমি) ও আমার পীর-মাশায়েখগণ এবং যারা ফকিরের (আমার) হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছে, তাদের সবার আক্বিদা এটাই। মৌলভী মুহম্মদ কাসিম সাহেব মরহুম (দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা) এবং মৌলভী রশীদ আহমদ (গাঙ্গুহী) সাহেব এবং মৌলভী মুহাম্মদ ইয়াকুব (নানুতভী) সাহেব, মৌলভী আহমদ হাসান সাহেব এবং অন্যান্যরা ফকিরের (আমার) অত্যন্ত প্রিয়ভাজন এবং সবাই আমার সাথে সুসম্পর্ক রাখে। তারা কখনও আমার আকীদার বিপরীতে কিংবা আমার মাশায়েখদের দেয়া তরিকার বিপরীতে নিজেরা কোন তরিকা এখতিয়ার করবে না। (শামায়িমে এমদাদী (মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রঃ)) খন্ড ২ পৃষ্ঠা ৩২ কুল্লিয়াতে এমদাদিয়া পৃষ্ঠা ২১৮)
মুহাজীরে মক্কী (রঃ) আরো বলেছেন- তিনি আরো বলতেন " وحدت الوجود کا عقیدہ رکھنا ہی حق اور سچ ہے " ওয়াহদাতুল উজুদের পোষণ করাই হক এবং সঠিক। "বরং এই পর্যন্ত লিখেছেন, " عابد اور معبود کے درمیان فرق کرنا ہی صریحشرک ہے "আবেদ (বান্দা) এবং মাবুদের (আল্লাহ) মাঝে পার্থক্য করাই হলো সুস্পষ্ট শিরক। "শুধু এটুকুতেও ক্ষান্ত হননি। তিনি বলেছেন, "بندہ اپنے وجود سے پہلے مخفی طور پر رب تھا اور رب ہی ظاہر میں بندہ ہے العیاذباللہ " বান্দা নিজের অস্তিত্ব লাভের পূর্বে স্বয়ং রব (আল্লাহ) ছিল। আর রবই হলেন দৃশ্যত বান্দা। (শামাঈম এ ইমদাদিয়া ৩৭-৩৮)
মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রঃ)
আল্লামা ফতেহ ওসমানী (রঃ) বলেন এর প্রমান পাওয়া যায় আকাবীরে দেওবন্দের শীর্ষ আকাবীরদের উক্তি থেকে যেমন- হযরত পানিপতি (রঃ) বলেন হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কির (রঃ) কথার যথার্থতা খুজে পাওয়া যায় তাঁর ভক্ত শিষ্য,খলিফা মুরিদানদের মধ্যে। যেমন মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রঃ) (১৮২৬ - ১৯০৫) বলেন, ” ضامن علی جلال آبادی کی سہارن پور میں بہت رنڈیاں مرید تھیں۔ ایک بار یہ سہارن پور میں کسی رنڈی کے مکان پر ٹھہرے ہوۓ تھے،-------------------- জামেন আলী জালালাবাদীর সাহারানপুরে অনেক বেশ্যা মুরীদা ছিল। একবার তিনি সাহারানপুরে কোন এক বেশ্যার বাড়ীতে অবস্থান করছিলেন। ওখানকার সমস্ত মুরীদানরা মিয়া সাহেবকে দেখতে আসলেন। কিন্তু একজন বেশ্যা সেখানে উপস্থিত হয়নি। মিঁয়া সাহেব বললেন, অমুক কেন আসেনি? বেশ্যারা জবাবে বললো, আমরা তাকে কত করে বলেছি চল, মিঁয়া সাহেবকে দেখতে যাই। সে বললো, আমি বড় গুনাহগার এবং দেখতে কালো। মিঁয়া সাহেবকে মুখ দেখাই কী করে? আমি তার সাথে দেখা করার উপযুক্ত নই। একথা শুনে মিঁয়া সাহেব বললেনঃ জ্বী না, তোমরা তাকে অবশ্যই আমার কাছে নিয়ে আসো। শেষ মেষ বেশ্যারা তাকে নিয়ে আসলো। যখন সে সামনে আসলো তখন তাকে মিঁয়া সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এলে না কেন? তো বেশ্যা বললো, দেখতে কালো হওয়ার কারণে আপনার সামনে আসতে আমার লজ্জা হচ্ছিল। মিঁয়া সাহেব বললেন, বেটি তুমি লজ্জা পাবে কেন? করনেওয়ালা কে আর করানেওয়ালা কে? তিনিই (আল্লাহ) তো সব! বেশ্যা একথা শুনে রেগে গেল আর হতবাক হয়ে বললো "লা-হাওলা ওয়ালা কুউওয়াহ"। আমি দেখতে কালো ও গুনাহগার হতে পারি, তবুও এ রকম পীরের মুখে পেশাব করতেও রাজি নই। মিঁয়া সাহেব লজ্জা পেয়ে মাথানিচু করে বসে রইল আর বেশ্যা ওঠে চলে গেল। " (তাজকিরাতুর রশিদ খন্ড ২ পৃষ্ঠা ২৪৬)
অবশ্য রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রঃ) জামেন আলী জালালাবাদীর ব্যাপারে লিখেন, "ضامن علی جلال آبادی تو توحید ہی میں غرق تھے" জামেন আলী জালালাবাদী তো তাওহীদের মধ্যেই ডুবে ছিলেন। রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রঃ) হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কীর কাছে চিঠি লিখেন- যে" یا اللہ معاف فرمانا! کہ حضرت کے ارشاد سے تحریر ہوا ہے: جھوٹا ہوں کچھ نہیں ہوں ، تیرا ہی ظل ہے، تیرا ہی وجود ہے، میں کیا ہوں، کچھ نہیں ہوں اور وہ جو میں ہوں، وہ تو ہے اور میں اور تو خود شرک در شرک ہے۔“ " হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন। কারণ এই চিঠি হযরতের কথায় লেখা হয়েছে। আমি মিথ্যাবাদী,আমি কিছুই না,আমি আপনারই ছায়া। আমি আপনারই অস্তিত্ব। আমি কি? কিছুই না। এবং আমি যে হই সে হলেন আপনি। আর আমি ও আপনি নিজেরাই পরস্পর পরস্পরের অংশীদার। "(ফজায়েলে সাদাকাত (তাবলীগী নেসাব ) ২য় খন্ড পৃষ্ঠা ৫৫৭, মাকাতিবে রশিদিয়া পৃষ্ঠা ৩৬)
হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরফ আলী থানভী (রঃ) এর বক্তব্য তবে হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরফ আলী থানভী (রঃ) (১৮৬৩-১৯৪৩) হাজী এমদাদ উল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রঃ) এর উক্তির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন- وحدت الوجود کے یہ معنی ہیں کہ خدا کے سوا کوئی دوسرا مستقل وجود نہ سمجھا جاۓ۔ اس سلسلہ میں فرمایا کہ حضرت حاجی (امداد اللہ کی) صاحب نے مولوی احمد حسن صاحب کے جواب میں فرمایا کہ شیخ عین رسول ہے، بل کہ عین حق ہے------- ওয়াহদাতুল উজুদ এর অর্থ হল এই যে,আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই জ্ঞান করা। এ প্রসঙ্গে হযরত হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজীরে মক্কী (রঃ) মৌলভী আহমদ হাসান সাহেবের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন,নিজেই রাসুল! বরং নিজেই আল্লাহ! আল্লাহর প্রতিচ্ছবিও নন! হযরত হাজী সাহেবের অভ্যাস ছিল, তিনি মজলিসে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে ওঠতেন এখানে (আল্লাহ ছাড়া) অন্য কেউ তো নেই। একবার তিনি এই বাক্যাংশটি বারবার পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন,'গাইর কোথায়, গাইর কোথায়। (অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া এখানে অন্য কেউ কোথায়?)। হযরত হাজী সাহেবের রসিকতা আমাদের জানা ছিল যে হযরতের উপর ওয়াহদাতুল উজুদের আধিপত্য বিরাজ ছিল। (মলফুজাতে হাকিমুল উম্মত ১৫/২০৩) আশরফ আলী থানভী (রঃ) আরো বলেন, ” حضرت صاحب رحمۃ اللہ علیہ کے وہی عقائد ہیں، جو اہل حق کے ہیں۔“ "হযরত হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী (রঃ) এর আকী¡দা ওটাই, যেটা আহলে হকের আকী¡দা। ইমদাদুল ফতোয়া ৫/২৭০
আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রঃ) মাওলানা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রঃ) (১৮৭৫ - ১৯৩৩) বলেন, সুফিদের ভাষায় আল্লাহর নৈকট্য অর্জনকারী ব্যক্তির মধ্যে ইলাহিয়্যতের (প্রভুত্ব) গুণ চলে আসে। আমি এর উপর কঠোরতা আরোপ করিনা। তিনি উদ্ধৃতি পেশ করেছেন এই ভাবে যে-" كنت سمعةগ্ধ بصيغة المتكلم، يدل على أنه لم يبق من المتقرب بالنوافل إلا جسده وشبحه، وصار المتصرف فيه الحضرة الإلهية فحسب، وهو الذي عناه الصوفية بالفناء في الله، أي الإنسلاخ عن داوي نفسه، حتى لا يكون المتصرف فيه إلا هو، وفي الحديث لمعة إلى وحدة الوجود، وكان مشايخنا مولعين بتلك "আমি তার কান বনে যাই, এই অংশে মুতাকাল্লিমের ছিগাহ (কর্তাবাচক) এসেছে। যা প্রমাণ করে নফল আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনকারীর শুধু দেহ আর অস্তিত্ব অবশিষ্ট থাকে।এমনকি মুতাসার্রাফ ফীহ (নৈকট্য অর্জনকারী ব্যক্তি) এর মধ্যে ইলাহিয়্যতের (প্রভুত্ব) গুণ চলে আসে। সূফীদের পরিভাষায় এটাকে ফানা-ফিল্লাহ (আল্লাহর অস্তিত্বে বিলীন হয়ে যাওয়া) বলে। অর্থাৎ নিজের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হয়ে যাওয়া। এমনকি নৈকট্য অর্জনকারী ব্যক্তি সরাসরি আল্লাহ বনে যায়। এই হাদীসে ওয়াহদাতুল ওজুদ প্রমাণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দীস দেহলভী (রহ.) এর জামানা পর্যন্ত আমাদের আকাবেরগণ এই মাসআলার উপর জোর দিয়ে আসছেন। তবে আমি এর উপর কঠোরতা আরোপ করছি না। " ( ফয়জুল বারী ৪/৪২৮ - المسألة إلى زمن الشاه عبد العزيز)
দেওবন্দীরাও ওয়াহদাতুল উজুদের প্রবক্তা ঃ কুতবে আলম হযরত হুসাইন আহমদ মাদানীর (রঃ) খাস শাগেরদ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান সিওয়াতী (১৯১৭ - ২০০৮) বলেন ”- یہ بات کس قدر افسوس ناک ہے اور کس قدر لاعلمی کی بات ہے کہ یہ کہا جاۓ کہ علماۓ دیو بند وحدۃ الوجود کے قائل نہیں تھے۔ علماۓ دیو بند اور ان کے مقتدا و پیشوا حضرات بھی اس مسئلہ کے بڑی شدومد سے قائل تھے۔“ "একথা কতটা দুঃখজনক এবং কতটা অজ্ঞতাপূর্ণ যে, বলা হয় ওলামায়ে দেওবন্দ ওয়াহদাতুল উজুদের প্রবক্তা ছিলেন না। ওলামায়ে দেওবন্দ ও তাদের অনুগামী এমনকি তাদের আকাবেররাও এই মাসআলার (ওয়াহদাতুল ওজুদ) কট্টর প্রবক্তা ছিলেন। " মোক্বালাতে সিওয়াতি খন্ড ১ পৃষ্ঠা ৩৭৮) তিনি আরো বলেন, ”علمائے دیو بند کے اکابر مولانا محمد قاسم نانوتوی اور مولانا حسین احمد مدنی اور دیگر اکابر مسئلہ وحدۃ الوجود کے قائل تھے۔ " আকাবীরে উলামায়ে দেওবন্দ মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতভী (মৃত ১২৯৭ হিঃ), ও মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী (মৃত ১৩৭৭ হিঃ) (রঃ) এবং অন্যান্য আকাবিরগণ মাসআলায়ে ওয়াহদাতুল উজুদের প্রবক্তা ছিলেন। " মোক্বালাতে সুওয়াতি খন্ড ১ পৃষ্ঠা ৩৭৫) আল্লামা পানিপতি (রঃ) বলেন মাওলানা আব্দুর রহমান জামীর (প্রকাশ মোল্লা জামী) বরাতে আয়নায়ে সুলুক গ্রন্থকার আরো লিখেন," چنانچہ مولانا جامی لائحہ بست و پنجم میں اس بات کو اس طرح بیان کرتے ہیں: پس یہ کائنات حق تعالی کا ظاہر ہے اور حق تعالی اس کا باطن ہے۔ یہ کائنات ظہور سے پہلے عین حق تعالی تھی اور حق تعالی بعد الظہور عین کائنات ہے۔ حقیقت میں ہستی ایک ہے " অতএব, মাওলানা জামী তার লায়েহায়ে বিসত ওয়া পঞ্জম (পঁচিশতম পরিকল্পনা) এ ওয়াহদাতুল উজুদ বিষয়টি এভাবে বর্ণনা করেছেন-সুতরাং এই মহাবিশ্বই হলো আল্লাহ তা'য়ালার প্রকাশ এবং এর ভিতরেই রয়েছেন আল্লাহ তা'য়ালা। এই মহাবিশ্ব প্রকাশ পাওয়ার পূর্বে এটি আল্লাহ তা'য়ালার আইন (সত্বা) ছিল এবং প্রকাশ পাওয়ার পরেও আল্লাহ তা'য়ালা এই মহাবিশ্বের মতই। প্রকৃতপক্ষে সত্বা এক।" (আয়নায়ে সলুক)
শায়খুল হাদীস জাকারিয়া কান্দলভী (রঃ) সূফী ড. ইকবাল মুহাম্মদ (১৮৭৭- ১৯৩৮) শায়খুল হাদীস আল্লামা জাকারিয়া কান্দলভীর (রঃ) প্রশংসায় লিখেন- "اس نے ہمیں وحدت الوجود کا راز معلوم کروایا، وہ ایسے کہ انہوں نے ہی ہمیں بتایا کہ عشق، معشوق اور عاشق سب ایک ہی ہیں "” তিনিই (জাকারিয়া কান্দলভী) আমাকে ওয়াহদাতুল ওজুদের পদ্ধতি জানিয়ে দিয়েছেন। তা হলো এমন যে, তিনিই আমাকে বলেছেন ইশক, মাশুক এবং আশেক সবই এক।" (মুহাব্বাত পৃষ্ঠা ৭০)
প্রত্যেক অস্তিত্বশীল বস্তুই আল্লাহ ঃ মুফতী কেফায়েত উল্লাহ (রঃ) (১৮৭৫ - ১৯৫২) তার সুপ্রসিদ্ধ কিতাব তা'লীমুল ইসলামে লিখেন, " یہاں پر تصوف کا ایک انتہائی پیچیدہ مسئلہ ہے اور وہ ہے " وحدت الوجود" جس کا مطلب یہ ہے کہ ہر موجود چیز اللہ ہے، اور اس کے علاوہ کسی وجود کا ہونا صرف وہم اور خیال ہے ۔۔۔ چنانچہ اس سے معلوم ہوا کہ مشائخ کا یہ کہنا کہ اللہ کے علاوہ کوئی وجود نہیں، بالکل درست ہے۔ " এই জায়গায় তাসাউফের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা রয়েছে। তা হলো ওয়াহদাতুল ওজুদ। যার অর্থ হলো এই যে, প্রত্যেক অস্তিত্বশীল বস্তুই আল্লাহ। আর তা (আল্লাহ) ছাড়া কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকা কেবলই ভ্রষ্টতা এবং ধারণাপ্রসূত। অতএব এখান থেকে জানা গেল যে, পীর মাশায়েখদের আল্লাহ ছাড়া আর কোন অস্তিত্ব মজুদ নেই বলা একদম সঠিক। "( তালিমুল ইসলাম পৃষ্ঠা ৫৫২) উল্লেখ্য মুফতি কেফায়েত উল্লাহর (রঃ) তালিমুল ইসলাম থেকে সংকলিত একটি অংশ ক্বওমী মাদ্রাসায় মক্তব পাঞ্জমে (৫ম শ্রেণী) পড়ানো হয় প্রশ্নত্তোর আকারে।
ওয়াহদাতুল উজুদ মাসআলা ঃ কাদিয়ানী দেওবন্দী একই আক্বীদা এ দিকে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (১৮৩৫ - ১৯০৮) ফিতনায়ে মওদুদিয়ত বইয়ে লিখেছে-” میں نے اپنے ایک کشف میں دیکھا کہ میں خود خدا ہوں اور یقین کیا کہ وہی ہوں اور میرا اپنا کوئی ارادہ اور کوئی خیال اور کوئی عمل نہیں رہا------------------ “ আমি আমার একটি কাশফের মধ্যে দেখেছি যে আমি নিজেই আল্লাহ এবং আমি বিশ্বাস করেছিলাম যে আমি সেটাই। আর আমার নিজস্ব কোন ইচ্ছা, নিজস্ব কোন চিন্তা এমনকি নিজস্ব কোন আমলও অবশিষ্ট রইল না। এর মর্ম হলো ওয়াহদাতুল উজুদ মাসআলায় ক্বাদিয়ানী ও দেওবন্দীর মিল আছে।
আমাদের ( কথা ঃ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের আকাবীরে দেওবন্দ আক্বীদা নিয়ে অনেক ঘাটাঘাটি করেন অন্যের আক্বীদা নিয়ে ফতোয়বাজী করেন। কিন্তু নিজেদের মধ্যকার এই সব ভ্রান্ত আক্বীদা সম্পর্কে কিছু বলেনও না এর কোন জবাবও দেননা। এটা ইলমের খেয়ানত সত্যের অপলাপমাত্র। আল্লাহ আমাদেরকে হেদায়েত ও হেফাজত করুন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের মাফ করুন এবং হেদায়েত দান করুন। এই যদি হয় ওয়াহদাতুল উজুদ আর ওয়াহদাতুশ শুহুদ এর মাসআলায় আকাবীরে দেওবন্দ আর কাদিয়ানীদের নেতা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানীর আক্বীদা তাহলে তারাই আবার অন্যদের আক্বীদা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন কি ভাবে? দেওবন্দী প্রসিদ্ধ আলেম যেখানে এই মাসআলায় দেওবন্দীদের ভ্রান্ত ও কুফরী আক্বীদা গুলো তুলে ধরেছেন এবং ফিতনায়ে দেওবন্দিয়ত এর রেফারেন্স উপস্থাপন করেছেন যেখানে মানুষকেই আল্লাহ আর মানুষকেই আল্লাহ তে রূপান্তর ও বিবর্তনের কুফরী, শিরকী আক্বীদা ভরপুর আল্লাহকে ই অস্বীকারের কুফরীতে ভরা সুফিজম সেখানে তাদের মুখে আম্বিয়ায়ে কেরামের সমালোচনার,সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনার ভ’য়া অভিযোগ তুলে মুসলিম উম্মাহ তথা ইসলামী শক্তিকে বিভাজন করার সুক্ষ বুদ্ধিবৃত্তিক মিশন চালিয়ে যারার মিশন সম্পর্কে সাধারণ অক্ষরজ্ঞানহীন,ধর্মজ্ঞানহীন মুসলিমদের ক,জন ই বুঝতে পারেন? তারাতো আক্বীদার নামে ধর্মীয় আবেগকে সস্তা ধর্মব্যবসায় রূপ নেবেই। আমার মনে হচ্ছে ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে বিবেকের অপমৃত্যু ঘটিয়ে সাধূ সৈন্যাসী বৈরাগীদের দেখাদেখি উপমহাদেশীয় মুসলিম সমাজে পীর মুরিদীর নামে এই পদ্ধতীটা চালু হয়। প্রকৃত বাইয়াত এবং আত্মশুদ্ধির ভাব ও অনিবার্য্য একটি ধারাকেই তারা বিকৃত করে ব্যাক্তি কেন্দ্রীক নিয়ে এসেছে। আর এখান থেকেই মারেফাত ভেদে মারেফাত আশিক মাশুক পাচ পাঞ্জাতন মাজার ব্যবসা ইত্যাদির প্রবর্তন ও বিকাশ সাধিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এই বিনাপূঁজির আবেগী ব্যক্তিকেন্দ্রীক ধর্মচর্চার ভ্রান্ত ধারণার মূলে আঘাত করায়ই মাওলানা ম্যওদুদীর দোষ। আর এ দোষই মাওলানার বিরুদ্ধে এতো বিকৃত মিথ্যা ভিত্তিহীন অভিযোগ। আপনারা আপনাদের বিবেকের আদালতে ইনসাফের মানদন্ডে বিচার করেই বলবেন যে মাওলানা মওদুদী কি অপরাধ করেছেন।
নবী-রসূল সম্পর্কে আক্বীদা ঃ আল্লাহ তা'য়ালা কর্তৃক প্রেরিত সকল নবী-রাসুলগণকে (আঃ) বিশ্বাস করতে হবে যে তারাও আল্লাহর নবী-রাসুল ছিলেন। তারাও তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন। তাই ইসলামী আক্বীদা-বিশ্বাস অনুসারে,আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতির জন্য একজন মানুষকে রাসূল (বার্তাবাহক) করে পাঠিয়েছেন যারা তাদেরকে তাওহীদের আহ্বান জানান। আল্লাহ তাদেরকে যে বাণী দিয়ে প্রেরণ করেছেন তারা তার কোনো অংশ গোপন বা পরিবর্তন করেননি। ভিন্ন রাসূলের ক্ষেত্রে বিধিবিধান ও আইন-কানুন ভিন্ন হতে পারে। এক রাসূলের উম্মতের উপর যে ইবাদাত ফরজ করা হয়েছে তা অন্য রাসূলের উম্মতের উপরে ফরজ করা হয়নি। আবার এক রাসূলের উম্মতের উপরে যে বিষয়গুলো হারাম করা হয়েছে তা অন্য রাসূলের উম্মতের জন্য হয়তো হালাল করা হয়েছে। কুরআন ও হাদীসে রাসূলদের মধ্যে কারো কারো নাম জানা যায়। যেমন- মুহাম্মদ, ঈসা, দাউদ, মূসা, ইব্রাহিম, নূহ (আঃ) ,তবে সব নবী-রাসূলদের নাম ও তাদের বর্ণনা জানানো হয়নি। কয়েক জনের নাম কোরআনে উল্লেখ আছে। পবিত্র কোরআনুল করীমে নবী রাসুলদের ব্যাপারে এবং আখেরী নবী হযরত মোহাম্মাদ (সঃ) এর আনুগত্য বিষয়ে কোরআনে অজ¯্র দলীল রয়েছে। এর কিছু উদাহরণ তুলে ধরছি। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ ফরমান- اٰمَنَ الرَّسُوْلُ بِمَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْهِ مِنْ رَّبِّهٖ و الْمُؤْمِنُوْنَ١ؕ كُلٌّ اٰمَنَ بِاللّٰهِ وَ مَلٰٓئِكَتِهٖ وَ كُتُبِهٖ وَ رُسُلِهٖ١۫ لَا نُفَرِّقُ بَیْنَ اَحَدٍ مِّنْ رُّسُلِهٖ١۫ وَ قَالُوْا سَمِعْنَا وَ اَطَعْنَا١٘ۗ غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَ اِلَیْكَ الْمَصِیْرُ অর্থাৎ রসূল তার রবের পক্ষ থেকে তার ওপর যে হিদায়াত নাযিল হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছে। আর যেসব লোক ঐ রসূলের প্রতি ঈমান এনেছে তারাও ঐ হিদায়াতকে মনে-প্রাণে স্বীকার করে নিয়েছে। তারা সবাই আল্লাহকে, তাঁর ফেরেশতাদেরকে, তাঁর কিতাবসমূহকে ও তাঁর রসূলদেরকে মানে এবং তাদের বক্তব্য হচ্ছেঃ “আমরা আল্লাহর রসূলদের একজনকে আর একজন থেকে আলাদা করি না। আমরা নির্দেশ শুনেছি ও অনুগত হয়েছি। হে প্রভু! আমরা তোমার কাছে গোনাহ মাফের জন্য প্রার্থনা করছি। আমাদের তোমারই দিকে ফিরে যেতে হবে। ( বাকারা-২৮৫ )
নবুওতের পরিচয় ওহী ঃ
নবুওতির প্রথম পরিচয় হলো ওহী। ওহীর মানে হলো বার্তা ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী-রাসুলগণের প্রতি প্রেরিত বার্তা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের নবী সহ আরো অনেক নবী রাসুলের প্রতি ওহী নাযেল করেছেন এবং কিতাব নাযিল করেছেন বলে কোরআনে জানিয়েছেন । যেমন এরশাদ হচ্ছে انا اوحینا الیك كما اوحینا الی نوح و النبیٖن من بعدهٖ و اوحینا الی ابرهیم و اسمعیل و اسحق و یعقوب و الاسباط و عیسی و ایوب و یونس و هرون و سلیمن و اتینا داوٗد زبورا অর্থাৎ- নিশ্চয় আমি তোমার নিকট ওহী পাঠিয়েছি, যেমন ওহী পাঠিয়েছি নূহ ও তার পরবর্তী নবীগণের নিকট এবং আমি ওহী পাঠিয়েছি ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়া‘কূব, তার বংশধরগণ,ঈসা, আইয়ূব, ইউনুস, হারূন ও সুলায়মানের নিকট এবং দাঊদকে প্রদান করেছি যাবূর। সুতরাং নবী রাসুলগনের কাছে ওহী আসতো এটা বিশ্বাস করা ঈমানের দাবী।
হযরত মুহাম্মদ সাঃ শেষ নবী ঃ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে শেষ নবী হিসেবে পাঠানো হয়েছে তাঁর পরে আর কোন নবী নবুওতের দাবী নিয়ে আসবেন না। যদি কেউ এই দাবী করে তাহলে সে মিথ্যাবাদী কাফের। আমাদের কে এই বিশ্বাস রাখতে হবে এটাই ঈমানের মুল দাবী এটাই সহীহ আক্বীদা। যদি কেউ এই বিশ্বাস রাখেনা বরং সে ভাবে ইলহামী নবী-রাসুল হতে পারে তাহলে সে কাফের। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ ফরমান مَا كَانَ مُحَمَّدٌ اَبَاۤ اَحَدٍ مِّنۡ رِّجَالِكُمۡ وَ لٰكِنۡ رَّسُوۡلَ اللّٰهِ وَ خَاتَمَ النَّبِیّٖنَ মুহাম্মাদ তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নয়, তবে আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী। (সুরা আহযাব ৪০)
কাদিয়ানীরা কাফিরঃ
উপমহাদেশে একজন গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেকে নবী দাবী করে বসে। এদেশের ওলামায়ে কেরাম তাকে কাফির ফতোয়া দিয়ে ময়দানে নামেন রাষ্ট্রীয় ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করার জন্য। যারা মুহাম্মাদ (সাঃ) কে নবী মানে কিন্তু শেষ নবী মানেনা কল্পিত ইলহামী নবীর অস্থিত্ব আবিস্কার করে তাকেও নবী মানে তারা কুরআন হাদীস অস্বীকার করার কারণে কাফের। হোক তারা আহমদিয়া নামে বা কাদিয়ানী নামে অথবা আরো যে কোন ইসলামী নামে। এ জন্য গোটা উম্মাহ এ ব্যাপারে একমত যে কোরআনে মোহাম্মাদ (সাঃ) কে শেষ নবী বলা সত্বেও কোরআন না মেনে গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে নবী বিশ্বাস করার কারণে কাদিয়ানী বা আহমদিয়া জামায়াত কাফের। যারা তাদেরকে কাফের বিশ্বাস করবেনা তারাও কাফের। এক পর্যায়ে মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) কে গ্রেফতার করে তার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দেয়া হয়। মুসলিম উম্মাহর চাপের মুখে রায় বাতিল করে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। দুর্ভাগ্য জনক হলেও সত্য যে পাকিস্তানে তাদেরকে অ মুসলিম ঘোষণা করা হলেও বাংলাদেশে তাদেরকে অমুসলিম ঘোষনা করা হয়নি।
আফসোস এই সেই মর্দে মুমিন মুজাহিদ কে অনেকে সহ্য করতে পারেন না তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে, আক্বীদা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। সঙ্গত কারণেই বলতে হয় আক্বীদার প্রশ্ন কাদিয়ানীদের পক্ষ থেকে আসা স্বাভাবিক কিন্তু অন্যদের পক্ষে কি এটা ইনসাফ হয় না জায়েজ হয়।
রাসুল প্রেরণের উদ্দেশ্য ঃ রাসুল প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা অনেক আয়াত নাযিল করেছেন। এর মধ্যে একটি আয়াতে বলা হয়েছে যে-هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمْ وَإِعَلِّمُهُمْ الَكَالُمْ وَيُعَلِّمُهُمْ الْحَكُمُ وا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ অর্থাৎ তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি তাদের নিরক্ষরদের মধ্য থেকেই তাদের জন্য একজন রসূল পাঠিয়েছেন, যাতে তাদের কাছে তাঁর আয়াত তেলাওয়াত করেন, তাদের পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদের শিরক ও বিভেদ থেকে মুক্তি দেন এবং তাদেরকে আসমানী কিতাব ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেন। আর নিঃসন্দেহে তারা ইতিপূর্বে প্রকাশ্য বিভ্রান্তিতে ছিল। (সুরা জুমা’য়া ২-৩) এই আয়াত থেকে বোঝা যায় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন কোরআন শুনিয়ে, কোরআন বুঝিয়ে মানুষকে ভ্রষ্টতার অন্ধকার থেকে বের করে আত্মা পরিশুদ্ধ করে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সু শিক্ষা দেয়ার জন্য। আজো দুনিয়াতে যারা নিজেদের আখেরি নবীর উম্মত দাবী করেন তাদের কাজ হলো কোরআন শিখা শিখানো, বুঝা বুঝানো, হারাম-হালাল জায়েজ না জায়েজ মেনে আল্লাহর ইবাদতি করে তাক্বওয়া অর্জন করা। সেই সাথে কোরআন সুন্নাহর আলোকে প্রজ্ঞাভিত্তিক জীবন ও সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। নবী (সাঃ) তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে গেছেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে এর স্বীকৃতিও পেয়েছেন। এখন যারা নিজেদের নবীর ওয়ারিছ দাবী করেন তাদের প্রধান মিশন হলো এই কাজ করা। এখন আমরা যদি জাগতিক শিক্ষা আর দ্বীনি শিক্ষা নামে ভাগ করে দেই সেটা হবে নবুওতের বিভাজন, সেটা হবে ওহীর বিভাজন এবং এই আয়াতের অপব্যাখ্যা। কারণ মানুষের জন্য যা শিখার যা বুঝার তাকেই হিকমাত শব্দের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে তাই শিক্ষা বিভাজনের কোন সুযোগ নেই। সাবজেক্ট বা ধারা বিভিন্ন হতে পারে। এটাই সঠিক আক্বীদা। পক্ষান্তরে কোরআন হাদীস আখেরাতের মুক্তির জন্য আর দুনিয়ার জন্য জাগতিক বা জেনারেল শিক্ষা এই ধারণা গোমরাহী বা ভ্রান্ত আক্বীদা। রাসুল (সাঃ) কে দুনিয়াতে পাঠানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে--هُوَ الَّذِیۡۤ اَرۡسَلَ رَسُوۡلَهٗ بِالۡهُدٰی وَ دِیۡنِ الۡحَقِّ لِیُظۡهِرَهٗ عَلَی الدِّیۡنِ كُلِّهٖ ۙ وَ لَوۡ كَرِهَ الۡمُشۡرِكُوۡنَ অর্থাৎ-তিনিই সে সত্তা যিনি তার রাসূলকে হেদায়ত ও সত্য দ্বীনসহ পাঠিয়েছেন, যেন তিনি আর সব দ্বীনের উপর একে বিজয়ী করেন, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।
আয়াতের দীর্ঘ ব্যাখ্যা করেছেন মুফাস্সিরীনে কেরাম। যার সার সংক্ষেপ হলো আল্লাহর রাসুল (সাঃ) কে দ্বীনে হক্ব সহ পাঠানো হয়েছে বলে কোরআন বুঝানো হয়েছে। আর এতে এটাও প্রমাণিত হয় যে দুনিয়াতে বাতিল দ্বীন বা ধর্ম মত আইস-কানুন থাকবে। এর পর বলা হয়েছে সকল দ্বীনের উপর আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন ই হক্ব কে বিজয়ী করবেন। শেষে বলা হয়েছে যে যদিও এটা মুশরিকরা পসন্দ করবেনা। অর্থাৎ তখনকার ও পরবর্তি সময়ে ক্বিয়ামত পর্যন্ত দুনিয়াতে যত বাতিল মতবাদ (দ্বীন) আসকে থাকবে এর উপর দ্বীন ই হক্ব বা সত্য দ্বীন ইসলাম সত্য সঠিক জীবন ব্যবস্থা কে বিজয়ী করতে হবে। আল্লাহর রাসুল এটা করেছিলেন যার স্বীকৃতি স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা নিজেই দিয়েছেন। এটা করতে গিয়ে চরম বাধার সম্মুখিন হতে হয়েছে এমনকি নিজের ভিটে মাটি ত্যাগ করতে হয়েছে জেল জুলুম সহ নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। একের পর এক যুদ্ধও করতে হয়েছে, কতই না প্রলোভন তাকে দেখানো হয়েছে কিন্তু তিনি তাতে কর্ণপাত করেন নি। তাই ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মুসলমানের জন্যই দ্বীনে হক্ব কে বিজয়ের জন্য সর্বাত্বক চেষ্ট করা ফরজ। আর এই ফরজ আল্লাহর পক্ষ থেকে সকল নবী রাসুল ও তাদের অনুসারীদের জন্যই ফরজ ছিল। সুতরাং সকল দ্বীনের উপর দ্বীনে হক্ব বা ইসলামকে বিজয়ের ফরজ প্রচেষ্টা বাদ দিয়ে কেউ খাটি মুসলমান হতে পারেনা। হ্যাঁ এটা হতে পারে বিভিন্ন ভাবে । যেমন ইবনে কছীর বলেছেন দুনিয়া আখেরাতের জন্য কল্যঅণকর এমন সব বিদাতমুক্ত আমল করা। ইলমে অহীর ভিত্তিতে শিক্ষা প্রশিক্ষণ দেয়া ও গ্রহণ করা। ব্যাক্তি ও পরিবারিক জীবনে দ্বীন মেনে চলার অভ্যাস গড়ে তুলা। কিন্তু এই ফরজিয়ত অস্বিকার করা কুফরি এটাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা।
রাসুল গোটা মানব জাতির জন্য প্রেরিত ঃ এরশাদ হচ্ছে قُلۡ یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنِّیۡ رَسُوۡلُ اللّٰهِ اِلَیۡكُمۡ جَمِیۡعَۨا বল,‘হে মানুষ, আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর রাসূল। এই আয়াত প্রমাণ করে রাসুলকে (সাঃ) বিশ্বাস করতে হবে গোটা মানব জাতির রাসুল হিসাবে। এটা ঈমানের দাবী। কে মানল আর কে মানলনা এটা দেখার ও ভাবার বিষয় নয়। সেই সাথে এই আয়াতে এটাও বলা হয়েছে যে নবী যে দাওয়াত দিয়েছেন আল্লাহর অদ্বীতীয়বাদ এবং শিরক মুক্ত ইবাদতির সেটাও মানতে হবে। এটাই ঈমানের দাবী এবং সহী আক্বীদা। ইবাদতে আর কাউকে কথা ও কাজে আকারে ইঙ্গিতে কাউকে শরীক করা যাবেনা। হোন তিনি কোন পীর ওলী এমন কি নবী ও। এটাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা।
রাসুলের আদর্শই একমাত্র সঠিক আদর্শ ঃ وَ اِنَّكَ لَعَلٰی خُلُقٍ عَظِیۡمٍ আর নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের উপর রয়েছেন। সুরা ক্বলম ৪ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর তাফসীর অনুযায়ী মহৎ চরিত্রের অর্থ মহৎ দ্বীন। কেননা, আল্লাহ তা'য়ালার কাছে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন গ্রহণযোগ্য নয়। আলী (রাঃ) ও হযরত আয়েশা (রাঃ) এর তাফসীর অনুযায়ী “মহৎ চরিত্র” বলে কুরআনের শিষ্টাচার বোঝানো হয়েছে; যা রাসুলের জীবনাদর্শ ছিলো। (কুরতুবী) এই হিসাবে রাসুলের চরিত্রকে কোরআনের বাস্তব রূপ হিসাবেই বিশ্বাস করতে হবে কারণ রাসুল কোন নিজের ইচ্ছায় কিছু করেন না। অন্য আয়াতে এরশাদ হচ্ছেÑ لَقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰهِ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ لِّمَنۡ كَانَ یَرۡجُوا اللّٰهَ وَ الۡیَوۡمَ الۡاٰخِرَ وَ ذَكَرَ اللّٰهَ كَثِیۡرًا অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে। ( সুরা আহযাব ২১) এই দলীল গুলো থেকে আমরা যতটুকু বুঝতে পারলাম তা হলো রাসুলকে (সাঃ) বিশ্বাস করার অর্থ হলো আল্লাহর রাসুল আল্লাহর প্রেরিত এবং তাঁর আদর্শই দুনিয়ার মানুষের জন্য উত্তম আদর্শ তাই আল্লাহর রাসুলের আদর্শ অনুস্মরণ করে জীবন পরিচালনা করতে হবে এই বিশ্বাস করে এর দাবী অনুযায়ী আমল করা। এর বাইরে কিছু হলে তা হবে বিদআত এবং রাসুল তথা দ্বীনে হক্ব না মানার নামান্তর।
আমাদের কথা ঃ- মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) এবং তার আগে শাহওলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ)এই উপমহাদেশের মোসলমানদের মধ্যে এই প্রেরণা জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন যে কোরআনের আইন আর আল্লাহর রাসুলের আদর্শ ছাড়া মানুষের শান্তি ও মুক্তি আসতে পারেনা। যা মোসলমানদের মধ্য থেকে হারিয়ে গিয়েছিল ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থার পতন হয়ে যাওয়ার কারণে। আর এ জন্যই মাওলানা মওদুদীর উপর মুশরিকরা ক্ষ্যপে গিয়ে নানা জুলুম নির্যাতন চালিয়েছিল। সেই সাথে তাদের কিছু অন্তরঙ্গ বন্ধুবান্ধবদেরও কাজে লাগিয়েছিল মাওলানার বিরুদ্ধে ধর্মের মোড়কে কিছু লাগানোর জন্য। যার ধারাবাহিকতা আজো আছে। অথচ এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন সকল দ্বীনের উপর দ্বীনে হক্ব কে বিজয়ী করার। অথচ আমরা এটাকে প্রচলিত রাজনীতি মনে করেই উদাস পড়ে আছে। এই উদাসীনতা সহী আক্বীদার ও আক্বীদার মূলনীতির খেলাফ। বিস্তারীত জানার জন্য দেখা যেতে পারে বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থ এবং আক্বীদার ক্বিতাব।
ফেরেশতাদের সম্পর্কে ইসলামী আকীদা ঃ ফেরেশতাগনের অীস্তত্ব ও আমল বিশ্বাস করা যে এরা আল্লাহর সৃষ্টি অনুগত মাখলুক। তাদের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ইবাদত বন্দেগী করান এবং সেই সাথে পলকে এতো বড় বড় কাজ করান যার কল্পনাও মানুষ করতে পারবেনা। কিন্তু তারা কোন দেবতা বা পুজনীয় পাত্র নয় বরং তারাও আল্লাহর ইবাদতি করেন। তাদের মধ্যকার একজন হলেন জিবরাঈল (আঃ) যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী নিয়ে আসতেন। এ জন্য তাদের অীস্তত্বের ও কর্মের প্রতি ঈমান রাখতে । তাই ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে নূর বা আলো দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তারা আল্লাহর নির্দেশ পালনে রত আছেন। কুরআনে বলা হয়েছে, ফেরেশতাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা'র ঘোষণা হলো- وَ لَهٗ مَنْ فِی السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ١ؕ وَ مَنْ عِنْدَهٗ لَا یَسْتَكْبِرُوْنَ عَنْ عِبَادَتِهٖ وَ لَا یَسْتَحْسِرُوْنَۚ () یُسَبِّحُوْنَ الَّیْلَ وَ النَّهَارَ لَا یَفْتُرُوْنَ পৃথিবী ও আকাশের মধ্যে যে সৃষ্টিই আছে তা আল্লাহরই। আর যে (ফেরেশতারা) তাঁর কাছে আছে তারা না নিজেদেরকে বড় মনে করে তাঁর বন্দেগী থেকে বিমুখ হয়এবং না ক্লান্ত ও বিষন্ন হয়। দিন রাত তাঁর প্রশংসা ও মহিমা ঘোষণা করতে থাকে, বিরাম-বিশ্রাম নেয় না। (সুরা আম্বিয়া ১৯-২০) সুতরাং ফেরেশতাদের আল্লাহর মাখলুক ও তার অনুগত আবেদ হিসাবে বিশ্বাস করতে হবে। কোন মতেই ফেরেশতাদের পুজা আর্চনা করা বা তাদের সাহায্য সহযোগিতা চাওয়া যাবেনা এই বিশ্বাস রাখতে হবে।এরশাদ হচ্ছে- اَلَّذِیۡنَ یَحۡمِلُوۡنَ الۡعَرۡشَ وَمَنۡ حَوۡلَہٗ یُسَبِّحُوۡنَ بِحَمۡدِ رَبِّہِمۡ وَیُؤۡمِنُوۡنَ بِہٖ وَیَسۡتَغۡفِرُوۡنَ لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ۚ رَبَّنَا وَسِعۡتَ کُلَّ شَیۡءٍ رَّحۡمَۃً وَّعِلۡمًا فَاغۡفِرۡ لِلَّذِیۡنَ تَابُوۡا وَاتَّبَعُوۡا سَبِیۡلَکَ وَقِہِمۡ عَذَابَ الۡجَحِیۡمِ অর্থাৎ যারা (ফেরেশতাগণ) আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা তাঁর চারপাশে আছে, তারা তাদের প্রতিপালকের প্রশংসার সাথে তাঁর তাসবীহ পাঠ করে ও তাঁর প্রতি ঈমান রাখে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করে (যে,) হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার রহমত ও জ্ঞান সমস্ত কিছু জুড়ে ব্যাপ্ত। সুতরাং যারা তওবা করেছে ও তোমার পথের অনুসারী হয়েছে তাদেরকে। এ ছাড়াও আরো বহু আয়াতে ফেরেশতাদের সম্পর্কে এবং তাদের এবাদত বন্দেগী ও দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। বিশেষত সুরা এ যুখরূফ এর ১৯ নম্বার আয়াতে মুশরিকদের একটি ধারণা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে তারা ফেরেশতাদের আল্লাহর কন্যা মনে করে। এ জাতীয় শিরকী ধারণা-বিশ্বাস থেকে ফেরেশতাদের অস্তি¡ত্ব বিশ্বাস করাই আমাদের আক্বীদা বিশ্বাস।
আসমানী কিতাব সম্পর্কে ইসলামী আকীদা ঃ কুরআন সহ আল্লাহ তা'আলা কর্তৃক প্রেরিত আসমানী সকল কিতাবসমূহে বিশ্বাস রাখতে হবে যে কুরআন আল্লাহর বানী বা কালাম এবং এতে রয়েছে মানব জাতীর কল্যাণ ও মুক্তির পয়গাম যার কার্যকরিতা নিয়ে গোটা মানব জাতী আজ দ্বিধা বিভক্ত। এতে আছে আইন বিধান শিক্ষা সংস্কৃতি সহ মানব জীবনের সমূহ কল্যাণ অকল্যাণের মৌলনীতি। পূর্বে নাযিলকৃত আসমানী গুলোর সাথে কোরআনের ধারাবাহিকতা বজায় আছে। তাই মুসলমানদের আক্বীদা বিশ্বাস হলো আসমানী কিতাবসমূহ আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে। এ সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে, এরশাদ হচ্ছেÑ وَ مَا كَانَ لِبَشَرٍ اَنْ یُّكَلِّمَهُ اللّٰهُ اِلَّا وَحْیًا اَوْ مِنْ وَّرَآئِ حِجَابٍ اَوْ یُرْسِلَ رَسُوْلًا فَیُوْحِیَ بِاِذْنِهٖ مَا یَشَآءُ١ؕ اِنَّهٗ عَلِیٌّ حَكِیْمٌ কোন মানুষই এ মর্যাদার অধিকারী নয় যে,আল্লাহ তার সাথে সরাসরি কথা বলবেন। তিনি কথা বলেন হয় অহীর (ইঙ্গিত) মাধ্যমে,অথবা পর্দার আড়াল থেকে,কিংবা তিনি কোন বার্তাবাহক (ফেরেশতা) পাঠান এবং সে তাঁর হুকুমে তিনি যা চান অহী হিসেবে দেয়। তিনি সুমহান ও সুবিজ্ঞ। (আশ শুরা ৫১ ) মুসা (আঃ) এর কথা বলা সম্পর্কে এরশাদ হচ্ছে- وَ رُسُلًا قَدْ قَصَصْنٰهُمْ عَلَیْكَ مِنْ قَبْلُ وَ رُسُلًا لَّم نَقْصُصْهُمْ عَلَیْكَ١ؕ وَ كَلَّمَ اللّٰهُ مُوْسٰى تَكْلِیْمًاۚ এর পূর্বে যেসব নবীর কথা তোমাকে বলেছি তাদের কাছেও আমি অহী পাঠিয়েছি এবং যেসব নবীর কথা তোমাকে বলিনি তাদের কাছেও। আমি মূসার সাথে কথা বলেছি ঠিক যেমনভাবে কথা বলা হয়। (সুরা নিসা ১৬৪ ) আসমানী কিতাব সমূহের মধ্যে কয়েকটির নাম কুরআনে বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- কুরআন,তওরাত, ইঞ্জিল,যাবুর,সহিফায়ে ইব্রাহিম ও সহিফায়ে মূসা। তওরাত,জবুর ইঞ্জিল ও কুরাআন সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আলোচনা হয়েছে। যেমনÑ তওরাত ও ইঞ্জিল সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে সুরা ইমরান এর ৩,৪৮,৫০,৬৫,৯৩,সুরা মায়েদার ৪৩ম৪৪,৬৬,৬৮,১১০ সুরা আরাফ এর ১৫৭,সুরা তওবার ১১১,সুরা বনী ইসরাঈল এর ৪৫,১০০,সুরা ফাতহ এর ২৯ সুরা সফ এর ৬ সুরা জুমা এর ৫ নম্বার আয়াত সমূহে।জবুর সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে সুরা নিসার ১৬৩,সুরা বনী ইসরাঈল এর ৫৫ এবং সুরা আম্বিয়ার ১০৫ নম্বার আয়াত সমূহে। কুরআন সম্পর্কে কুরআনের ৬৯ স্থানে আলোচনা হয়েছে। আর সহীফা সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে- সুরা ত্বাহা এর ১৩৩ সুরা এ নাজম এর ৩৬ সুরা এ মুদ্দাস্সির এর ৫২ সুরা আবাসার ১৩ সুরা তাকভীর এর ১০ সুরা আলা এর ১৮,১৯ এবং সুরা বাইয়্যিনাহ এর ২ নম্বার আয়াত সমূহে। মুসলমানদের আক্বীদা বিশ্বাস অনুযায়ী শেষ আসমানী কিতাব কুরআনুল করীম পূর্বের কিতাব সমূহের সত্য বিষয় গুলোর সত্যায়ন করে,ঐ কিতাবগুলোতে যেসব বিকৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে।
তকদীর সম্পর্কে ইসলামী আকীদা ঃ তকদীরে বিশ্বাস করতে হবে মানে তক্বদীরের ভালো মন্দ দুটিই লিপীবদ্ধ এই বিশ্বাস করা। অর্থাৎ তাকদীর হল নির্ধারিত ভাগ্য। এ মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটবে আল্লাহ তার পূর্বজ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী সেসব কিছু নির্ধারণ করেছেন। এর প্রতি বিশ্বাসকে ইসলামে তাকদীর বলা হয়। ইসলামে তাকদীরের ওপর বিশ্বাস করা আল্লাহ তা'আলার রবুবিয়্যাত বা প্রভুত্বের ওপর বিশ্বাস করার অন্তর্ভুক্ত এবং তা ঈমানের ছয়টি রুকনের অন্যতম একটি রুকন। মুসলমানদের এই বিশ্বাস থাকা অনিবার্য্য যে আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেকটি বিষয় সম্পর্কে জানেন এবং তিনি লওহে মাহফুজে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির হাজার হাজার বছর পূর্বে সবকিছু লিখে রেখেছেন। কোনো কিছুই আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে ঘটে না। সবকিছুর জাত-বৈশিষ্ট্য আল্লাহরই সৃষ্টি। কোরআন হাদীসে এর ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে।
কোরআনের বর্ণনায় মানুষের ভাগ্য তক্বদীরে বিশ্বাস করা ছাড়া কোনো ব্যক্তি মুমিন হতে পারে না। ভাগ্য আল্লাহর এক রহস্যময় জগৎ যে জগৎ সম্পর্কে আল্লাহ কাউকে অবগত করেননি। তক্বদীর সম্পর্কে কোরআনের বর্ণনা হলো এ রূপ যে- وَ مَا كَانَ اللّٰهُ لِیُطۡلِعَكُمۡ عَلَی الۡغَیۡبِ وَ لٰكِنَّ اللّٰهَ یَجۡتَبِیۡ مِنۡ رُّسُلِهٖ مَنۡ یَّشَآءُ فَاٰمِنُوۡا بِاللّٰهِ وَ رُسُلِهٖ ۚ ‘অদৃশ্য সম্পর্কে তোমাদেরকে আল্লাহ অবহিত করার নয়; তবে আল্লাহ তাঁর রাসুলদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৭৯) এর মর্ম হলো ভাগ্য সম্পর্কে মানুষ ততটুকু জানে, যতটুকু আল্লাহ কোরআন ও তাঁর নবীর মাধ্যমে জানিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন اِنَّا کُلَّ شَیۡءٍ خَلَقۡنٰہُ بِقَدَرٍ আমি প্রতিটি জিনিস সৃষ্টি করেছি মাপজোকের সাথে وَمَاۤ اَمۡرُنَاۤ اِلَّا وَاحِدَۃٌ کَلَمۡحٍۭ بِالۡبَصَرِ আমার আদেশ একবার মাত্র চোখের পাতা ফেলার মত (মুহূর্তের মধ্যে পূর্ণ) হয়ে যায়। (কামার : ৪৯-৫০) ইরশাদ হচ্ছে- إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ ۚ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍقَدْرًا‘আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা পূরণ করবেনই, আল্লাহ সব কিছুর জন্য স্থির করেছেন নির্দিষ্ট মাত্রা।’ (সুরা : তালাক, আয়াত : ৩) আরো বহু আয়াতে তক্বদীর সম্পর্কে দলীল রয়েছে। এতে সুস্পষ্ট প্রমাণিত যে ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত মানুষের ভাগ্যে যা ঘটে তা পূর্ব থেকেই আল্লাহ নির্ধারণ করে রেখেছেন।ইরশাদ হয়েছে,‘পৃথিবীতে অথবা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের ওপর যে বিপর্যয় আসে আমি তা সংঘটিত করার আগেই তা লিপিবদ্ধ থাকে। আবার দোয়ার বদৌলতে তক্বদীর পরিবর্তন হয় মর্মেও হাদীসে আছে। মুসলিম শরীফে আব্দুল্লাহ বিন উমারের সূত্রে বর্ণিত كتب الله مقادير الخلائق قبل ان يخلق السماوات والأرض بخمسين الف سنة হাদীসটি আল্লাহ তা‘য়ালার ইলম অনুসারে লাওহে মাহফূজে যা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তার উপর আমল হয়েছে। ইমাম ত্বাহাবী (রঃ) আক্বীদাতুত্বাহাবীতে বলেছেন তাকদীর সম্পর্কে আসল কথা হলো- এটি সৃষ্টিকুলের ব্যাপারে আল্লাহর একটি গোপন বিষয়; যা নৈকট্যপ্রাপ্ত কোনো ফেরেশতা কিংবা প্রেরিত কোনো নাবীও অবহিত নন। ...... ইমাম ইবনে আবীল ইয আল-হানাফীও তাই বলেছেন। সার কথা হলো ঈমানদার মুমিন মোসলমানদের ঈমানের মৌলিক দাবী বা আক্বীদা বিশ্বাস হতে হবে এটাই যে তাক্বদীরের ভালোমন্দ যা কিছ’ হয় তা আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক পূর্বনির্দ্ধারিত যার খবর আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না। তবে দোয়ার মাধ্যমে তক্বদীরের মন্দ দিক আল্লাহ তায়ালা পরিবর্তন করে দিতে পারেন। এটাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদঅ
আখিরাত/ কিয়ামত, সম্পর্কে আক্বীদাঃ আখেরাতের বা ক্বিয়ামতের বিশ্বাসের প্রথম কথা হলো মৃত্যুর পর আবার আল্লাহতায়ালা জীবন দান করবেন। সেই জীবনটা হবে অনন্তকালের। দুনিয়াতে কৃত আমলের ভিত্তিতে প্রতিদান ও পরিণাম প্রদান করবেন। পুনরুথানের প্রতি বিশ্বাস বা এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই জগতের জীবন শেষ হলেও পরকালে আবারো জীবিত করা হবে এবং এই জগতের যাবতীয় কাজের হিসাব নেয়া হবে। ভালো কাজ করে গেলে ঈমানের সাথে সহী আক্বীদা বিশ্বাস নিয়ে সৎকাজ করলে জান্নাত পাওয়া যাবে। আর আমল নামা খারাপ হলে জাহান্নামে যেতে হবে। তাই আখিরাত বা পরকালে বিশ্বাস বলতে এই দুনিয়ার জীবন ই আসল জীবন নয় আসল ও চিরস্থায়ী জীবন হচ্ছে পরকালের জীবন এই বিশ্বাস রাখতে হবে। তাই মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, এবং করাই বাঞ্চনীয় যে পার্থিব জীবন শেষ হয়ে মৃত্যু ও কবর জীবনের মাধ্যমে অন্য জগত শুরু হবে। একসময় কিয়ামত সংঘটিত হবে,তারপর পুনরুত্থান, হাশর ও হিসাব-নিকাশের পর ফলাফল প্রাপ্ত হয়ে জান্নাতীরা জান্নাতে এবং জাহান্নামীরা জাহান্নামে যাবে। ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে,মৃত ব্যক্তিকে দাফনের পর তাকে তার রব, দীন ও শেষনবী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা বা প্রশ্ন করা হবে। মানুষ তাদের কর্ম অনুসারে কবরে শাস্তি বা শান্তি ভোগ করবে। মৃত ব্যক্তি কবর জীবনের শাস্তি অথবা শান্তি প্রাপ্ত হবে, যদিও তাকে ভূগর্ভস্থ করা না হয়। এটাকে আলমে বরযখও বলে তা মাটির নীচেও হতে পারে কফিনের ভেতরও হতে পারে অথবা ছাই করে দেয়ার পরেও হতে পারে। ইসলামী আকীদা অনুসারে, ইসরাফীল শিঙ্গায় ফুৎকার দিলে কিয়ামত হবে, অর্থাৎ বিশ্বজগৎ ধ্বংস হবে। প্রথম ফুৎকার দেওয়ার সাথে সাথেই আল্লাহ যা জীবিত রাখবেন তাছাড়াা সকল সৃষ্টজীব মারা যাবে। দ্বিতীয় ফুৎকার দেয়ার সাথে সাথেই পৃথিবী সৃষ্টি থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যত সৃষ্টজীবের আর্বিভাব হয়েছিল, তারা সকলেই জীবিত হয়ে উঠে দাঁড়াাবে। এরপর তাদের হিসাব-নিকাশের জন্য ময়দানে একত্রিত করা হবে। এই একত্রিত করাকে হাশর বলা হয়। ময়দানে অবস্থানকালে সূর্য তাদের নিকটবর্তী হবে। এ উত্তপ্ত ও কঠিন অবস্থান দীর্ঘ হওয়ায় শরীর থেকে নির্গত ঘামে হাবু-ডুবু খাবে তাদের (ভালো-মন্দ) কর্ম অনুপাতে। কোরআন হাদীসে হাশরের বিবরণ আছে বিস্তর । এর মধ্যে কিছু আলোচনা এখানে তুলে ধরা হলোÑ কুরআনে হাশর নশরের বিবরণঃ
দুনিয়ার জীবন থেকে আখেরাতের জীবন উত্তম ঃ এরশাদ হচ্ছে- یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَا لَكُمۡ اِذَا قِیۡلَ لَكُمُ انۡفِرُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ اثَّاقَلۡتُمۡ اِلَی الۡاَرۡضِ ؕ اَرَضِیۡتُمۡ بِالۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا مِنَ الۡاٰخِرَۃِ ۚ فَمَا مَتَاعُ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا فِی الۡاٰخِرَۃِ اِلَّا قَلِیۡلٌ হে ঈমানদারগণ, তোমাদের কী হল, যখন তোমাদের বলা হয়, আল্লাহর রাস্তয়া (যুদ্ধে) বের হও, তখন তোমরা যমীনের প্রতি প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়? তবে কি তোমরা আখিরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে সন্তুষ্ট হলে? অথচ দুনিয়ার জীবনের ভোগ-সামগ্রী আখিরাতের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। (সুরা তওবা ৩৮)
আরো এরশাদ হচ্ছে- وَقِیۡلَ لِلَّذِیۡنَ اتَّقَوۡا مَاذَاۤ اَنۡزَلَ رَبُّکُمۡ ؕ قَالُوۡا خَیۡرًا ؕ لِلَّذِیۡنَ اَحۡسَنُوۡا فِیۡ ہٰذِہِ الدُّنۡیَا حَسَنَۃٌ ؕ وَلَدَارُ الۡاٰخِرَۃِ خَیۡرٌ ؕ وَلَنِعۡمَ دَارُ الۡمُتَّقِیۡنَ ۙ অর্থাৎ- (অন্য দিকে) মুত্তাকীদের জিজ্ঞেস করা হল,তোমাদের প্রতিপালক কী নাযিল করেছেন? তারা বলল, সমূহ কল্যাণই নাযিল করেছেন। (এভাবে) যারা পুণ্যের কর্মপন্থা অবলম্বন করেছে তাদের জন্য ইহকালেও মঙ্গল আছে, আর আখেরাতের নিবাস তো আগাগোড়া মঙ্গলই। মুত্তাকীদের নিবাস কতই না উত্তম। ( সুরা নাহল ৩০)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেনÑ وَمَا ہٰذِہِ الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَاۤ اِلَّا لَہۡوٌ وَّلَعِبٌ ؕ وَاِنَّ الدَّارَ الۡاٰخِرَۃَ لَہِیَ الۡحَیَوَانُ ۘ لَوۡ کَانُوۡا یَعۡلَمُوۡنَ অর্থাৎ- এই পার্থিব জীবন খেলাধুলা ছাড়া কিছুই নয়। বস্তুত আখেরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত! (আনকাবুত ৬৪) এর মর্ম হলো- কিছুক্ষণ খেলাধুলার আনন্দ কিছু সময়ের এর পর তা নিঃশ্বেস হয়ে যায়। দুনিয়ার জীবনটাও এ রকমই এর কোন সুখ ও আনন্দই স্থায়ী নয় সবই অতি ক্ষণস্থায়ী,কিছুকাল পর সব খতম হয়ে যায়। পক্ষান্তরে আখেরাতের জীবন স্থায়ী ও অনিঃশেষ। সুতরাং প্রকৃত জীবন কেবল আখেরাতেরই জীবন।
দুনিয়ার প্রয়োজনেই আখেরাত সৃষ্টি ঃ এরশাদ হচ্ছেÑ وَمَا خَلَقۡنَا السَّمٰوٰتِ وَالۡاَرۡضَ وَمَا بَیۡنَہُمَا لٰعِبِیۡنَ আমি আকাশমন্ডলী,পৃথিবী ও তার অন্তর্গত বস্তু নিশ্চয়ই ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি।مَا خَلَقۡنٰہُمَاۤ اِلَّا بِالۡحَقِّ وَلٰکِنَّ اَکۡثَرَہُمۡ لَا یَعۡلَمُوۡنَ আমি তা সৃষ্টি করেছি যথার্থ উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাদের অধিকাংশেই বোঝে না। আমি বিশ্ব-জগতকে তামাশা করার জন্য সৃষ্টি করিনি,বরং এর যথাযথ এক উদ্দেশ্য আছে। তা হল, মানুষকে পরীক্ষা করা, সে এখানে স্বেচ্ছায় ভালো কাজ করে, না মন্দ কাজ। তারপর একদিন আসবে, যখন তাকে তার ভালো-মন্দ কাজ অনুসারে ফলাফল দেওয়া হবে। অর্থাৎ ভালো লোক যাবে জান্নাতে এবং মন্দ লোক জাহান্নামে ( সুরা দুখান ৩৮-৩৯)
কিয়ামত আসবে এতে সন্দেহ নেইঃ এরশাদ হচ্ছে وَ مَا خَلَقۡنَا السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ مَا بَیۡنَهُمَاۤ اِلَّا بِالۡحَقِّ ؕ وَ اِنَّ السَّاعَۃَ لَاٰتِیَۃٌ فَاصۡفَحِ الصَّفۡحَ الۡجَمِیۡلَ আর আমি আসমানসমূহ, যমীন ও এ দুয়ের মধ্যে যা আছে, তা যথার্থতা ছাড়া সৃষ্টি করিনি এবং নিশ্চয় কিয়ামত আসবে। সুতরাং তুমি সুন্দরভাবে তাদেরকে এড়িয়ে যাও। (সুরা হিজর ৮৫) এ ভাবে আরো বহু আয়াত ও হাদীসে আখেরাতের বিবরণ আছে তাই এটা বিশ্বাস করা ঈমানের পূর্ণতার অনিবার্য্য অঙ্গ। মরার পর জীবিত হওয়া এবং হাশর নশর বিচার বিশ্বাস না করলে মুমিন হওয়া যায়না।
হাওজে কাওসার সম্পর্কে আক্বীদা ঃ ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, হাউয নামের একটি সুপ্রশস্ত পানির ধারা আল্লাহ্ তায়ালা নবীকে হাশরের মাঠে দান করেছেন। হাউযের পানি দুধের চেয়ে সাদা, বরফের চেয়ে ঠান্ডা, মধুর চেয়ে অধিক মিষ্টি, মিশকের চেয়েও সুগন্ধি। যে ব্যক্তি তা থেকে একবার পানি পান করবে, সে আর কখনও পিপাসার্ত হবে না। এই বিশ্বাস মোসলমানদের থাকতেই হবে বা এই বিশ্বাস রাখতে হবে। হাওজে কাওসার সম্পর্কে কুরআন কুরআনে করীমের সুরা কাওসারে বলা হয়েছে: اِنَّاۤ اَعۡطَیۡنٰكَ الۡكَوۡثَرَ নিশ্চয় আমি তোমাকে আল-কাউসার দান করেছি। ”আমি অবশ্যই তোমাকে (হওযে) কাউসার (বা প্রভূত কল্যাণ) দান করেছি। আরবী كَوثَر শব্দটির উৎপত্তি كَثرَة থেকে। এর বিভিন্ন অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে। ইবনে কাসীর (রঃ) ‘প্রভূত কল্যাণ’ অর্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন। যার মর্ম হল-দুনিয়ার বিজয়, নবী (সাঃ)-এর মর্যাদা ও খ্যাতি, চিরস্থায়ী ভাবে তাঁর সুনাম এবং আখেরাতের প্রতিদান ও বিনিময় ইত্যাদি সমস্ত জিনিসই ‘প্রভূত কল্যাণ’-এ শামিল হয়ে যায়। (ইবনে কাসীর) হাউজে কাওসার এর নিগুঢ় তত্ব হ'ল মুসলমানদেরকে শেষ বিচারের দিনের ভয়াবহতা সর্ম্পকে সচেতন করা এবং সেই অনুসারে তাদের পরকালের ভালোর জন্য এখন থেকেই পরিকল্পনা করতে অনুপ্রাণিত করা। এটি মুহাম্মাদের প্রতি তাদের ভালবাসার প্রকাশ এবং কেয়ামতের দিনের না দেখা বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করে। হাওজে কাওসার হলো জান্নাতে বিদ্যমান একটি নদী বা ঝর্নাধারাকে বোঝানো হয়। ফার্সী ভাষায় এটিকে 'আবে হায়াত' শব্দ দ্বারা বোঝানো হয়, যদিও এ শব্দটির অন্য অর্থও রয়েছে। ইসলামী আক্বীদা বিশ্বাস মতে কেয়ামতের দিন সবাইকে যখন পুনরুত্থিত করা হবে তখন জেগে ওঠার পর সবাই অনেক বেশি পিপাসা নিয়ে এবং বিশৃঙ্খল পরিবেশে তৃষ্ণা নিবারণ করার চেষ্টা করবে। তারপর, আল্লাহ তায়’ালা মুহাম্মাদ (সাঃ) কে দায়িত্ব দেবেন বাছাই করার জন্য যে, বিশ্বাসীদের মধ্যে তৃষ্ণা নিবারণে কে কে অগ্রাধিকার পাবেন। এর পর তাদেরকে তৃষ্ণা মেটাবার জন্য হাউজে কাওসার থেকে শীতল আর সুস্বাদু পানি পান করানো হবে। কুরআন শরীফের সূরা আল-কাওসারে এ কথাই বলা হয়েছে এই বলে যে । হাদীসে বলা হয়েছে যে, ‘এটা একটি নহর যা বেহেশ্েেত নবী (সাঃ)-কে দান করা হবে’। কোন কোন হাদীসে কাওসার বলতে ‘হাওয’ বুঝানো হয়েছে। যে হাওয হতে ঈমানদাররা জান্নাতে যাওয়ার পূর্বে নবী (সাঃ)-এর মুবারক হাতে পানি পান করবে। জান্নাতের ঐ নহর থেকেই পানি সেই হওযের মধ্যে আসতে থাকবে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, قَالَ عَبْدُ اللهِ بْنُ عَمْرٍو قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم حَوْضِي مَسِيرَةُ شَهْرٍ مَاؤُهُ أَبْيَضُ مِنْ اللَّبَنِ وَرِيحُهُ أَطْيَبُ مِنْ الْمِسْكِ وَكِيزَانُهُ كَنُجُومِ السَّمَاءِ مَنْ شَرِبَ مِنْهَا فَلاَ يَظْمَأُ أَبَدًا ’আবদুল্লাহ্ ইবনু ’আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমার হাউযের প্রশস্ততা এক মাসের পথের সমান। তার পানি দুধের চেয়ে সাদা, তার ঘ্রাণ মিশক-এর চেয়ে বেশি সুগন্ধযুক্ত এবং তার পানপাত্রগুলো হবে আকাশের তারকার মত অধিক। তাত্থেকে যে পান করবে সে আর কক্ষনো পিপাসার্ত হবে না। (বুখারী ৬৫৭৯ ) রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আরো বলেছেন- حَدَّثَنِي أَنَسُ بْنُ مَالِكٍ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّ قَدْرَ حَوْضِي كَمَا بَيْنَ أَيْلَةَ وَصَنْعَاءَ مِنْ الْيَمَنِ وَإِنَّ فِيهِ مِنْ الأَبَارِيقِ كَعَدَدِ نُجُومِ السَّمَاءِ আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু (সাঃ) বলেছেনঃ আমার হাউযের প্রশস্ততা হল আয়লা হতে ইয়ামানের সান’আ নামক স্থানদ্বয়ের দূরত্বের সমান আর তার পানপাত্রগুলোর সংখ্যা আকাশের নক্ষত্ররাজির ন্যায়। (বুখারী: ৬৫৭৯, মুসলিম: ২২৯২) মোটকথা: কাউসারের মূল উৎস হলো জান্নাতে। তা থেকেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর আরেকটি হাউযে পানি আসবে। সেখানে তার উম্মতকে তিনি পানি পান করাবেন। তাছাড়া সমস্ত নবীর হাউযের পানির উৎসও এ কাউসারই, মুসলমানদের এই আক্বীদা বিশ্বাস থাকতে হবে।
হাওজে কাওসার সম্পর্কে মাওলানা মওদুদীর ব্যখ্যা এরশাদ হচ্ছে-اِنَّاۤ اَعْطَیْنٰكَ الْكَوْثَرَؕ (হে নবী!) আমি তোমাকে কাউসার দান করেছি কাউসার শব্দটি এখানে যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তাতে আমাদের ভাষায় তো দূরের কথা দুনিয়ার কোন ভাষায়ও এক শব্দে এর পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এ শব্দটি মূলে কাসরাত كثرة থেকে বিপুল ও অত্যধিক পরিমাণ বুঝাবার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, সীমাহীন আধিক্য। কিন্তু যে অবস্থায় ও পরিবেশে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তাতে শুধুমাত্র আধিক্য নয় বরং কল্যাণ ও নিয়ামতের আধিক্য এবং এমন ধরনের আধিক্যের ধারণা পাওয়া যায় যা বাহুল্য ও প্রাচুর্যের সীমান্তে পৌঁছে গেছে? আর এর অর্থ কোন একটি কল্যাণ বা নিয়ামত নয় বরং অসংখ্য কল্যাণ ও নিয়ামতের আধিক্য।---- নিয়ামতগুলো আল্লাহ তাঁর নবীকে এ মরজগতেই দান করেছেন। কত বিপুল পরিমাণে দান করেছেন তা লোকেরা দেখেছে। এগুলো ছাড়াও কাউসার বলতে আরো দু’টো মহান ও বিশাল নিয়ামত বুঝানো হয়েছে, যা আল্লাহ তাঁকে আখেরাতে দান করবেন। সেগুলো সম্পর্কে জানার কোন মাধ্যম আমাদের কাছে ছিল না। তাই রসূলল্লাহ (সাঃ) আমাদের সেগুলো সম্পর্কে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেনঃ কাউসার বলতে দু’টি জিনিস বুঝানো হয়েছে। একটি হচ্ছে “হাউজে কাউসার” এটি কিয়ামতের ময়দানে তাঁকে দান করা হবে। আর দ্বিতীয়টি “কাউসার ঝরণাধারা” এটি জান্নাতে তাঁকে দান করা হবে। এ দু’টির ব্যাপারে রসূলুল্লাহ থেকে এত বেশী হাদীস বর্ণিত হয়েছে এবং এত বিপুল সংখ্যক রাবী এ হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন যার ফলে এগুলোর নির্ভুল হবার ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহেরও অবকাশ নেই। হাউজে কাউসার সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনÑ هو حوض ترد عليه امتى يوم القيامة সেটি একটি হাউজ। আমার উম্মাত কিয়ামতের দিন তার কাছে থাকবে।” (মুসলিম, কিতাবুস সালাত এবং আবু দাউদ, কিতাবুস সুন্নাহ) এ হাউজটি কিয়ামতের দিন তাঁকে দেয়া হবে। এমন এক কঠিন সময়ে এটি তাঁকে দেয়া হবে যখন সবাই “আল আতশ” ‘আল আতশ’ অর্থাৎ পিপাসা, পিপাসা বলে চিৎকার করতে থাকবে সে সময় তাঁর উম্মত তাঁর কাছে এ হাউজের চারদিকে সমবেত হবে এবং এর পানি পান করবে। তিনি সবার আগে সেখানে পৌঁছবেন এবং তার মাঝ বরাবর জায়গায় বসে থাকবেন। তখন انا فرطكم على الحوض “আমি তোমাদের সবার আগে সেখানে পৌঁছে যাবো।” إِنِّى فَرَطٌ لَكُمْ ، وَأَنَا شَهِيدٌ عَلَيْكُمْ ، وَإِنِّى وَاللَّهِ لأَنْظُرُ إِلَى حَوْضِى الآنَ “আমি তোমাদের আগে পৌঁছে যাবো, তোমাদের জন্য সাক্ষ্য দেবো এবং আল্লাহর কসম, আমি এ মুহূর্তে আমার হাউজ দেখতে পাচ্ছি।” (বুখারী, কিতাবুল জানায়েয, কিতাবুল মাগাযী ও কিতাবুর রিকাক)। আনসারদেরকে সম্বোধন করে একবার রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন- إِنَّكُمْ سَتَلْقَوْنَ بَعْدِى أَثَرَةً فَاصْبِرُوا حَتَّى تَلْقَوْنِى ، وَمَوْعِدُكُمُ الْحَوْضُ “আমার পরে তোমরা স্বার্থবাদিতা ও স্বজনপ্রীতির পাল্লায় পড়বে। তখন তার ওপর সবর করবে, আমার সাথে হাউজে কাউসারে এসে মিলিত হওয়া পর্যন্ত।” (বুখারী, কিতাবু মানাকিবিল আনসার ও কিতাবুল মাগাযী, মুসলিম, কিতাবুল আমারাহ এবং তিরমিযী কিতাবুল ফিতান।) এর পর বলেন انا يوم القيمة عند عقر الحوض “কিয়ামতের দিন হাউজের মাঝ বরাবর থাকবো।” (মুসলিম কিতাবুল ফাজায়েল) হযরত আবু বারযাহ আসলামীকে (রা.) জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি কি হাউজ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে কিছু শুনেছেন। তিনি বলেন, -----বারবার শুনেছি। যে ব্যক্তি একে মিথ্যা বলবে আল্লাহ তাকে যেন তার পানি পান না করান।” (আবু দাউদ, কিতাবুস সুন্নাহ)।
উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ হাউজ সম্পর্কিত রেওয়ায়াত মিথ্যা মনে করতো। এমন কি সে হযরত আবু বারযাহ আসলামী (রাঃ) বারাআ ইবনে আযেব (রাঃ) ও আয়েদ ইবনে আমর (রাঃ) বর্ণিত রেওয়ায়াতগুলো অস্বীকার করলো। শেষে আবু সাবরাহ একটি লিপি বের করে আনলেন। এ লিপিটি তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আসের (রাঃ) মুখে শুনে লিখে রেখেছিলেন। তাতে রসূল (সাঃ) এর এ বাণী লেখা ছিলঃ الا ان موعد كم حوضى “জেনে রাখো, আমার ও তোমাদের সাক্ষাতের স্থান হচ্ছে আমার হাউজ।” (মুসনাদে আহমাদ, আবদুল্লাহ ইবনে আমার ইবনুল আসের রেওয়ায়তসমূহ)। এ হাউজের আয়তন সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীসে বিভিন্ন প্রকার বর্ণনা এসেছে। তবে অধিকাংশ রেওয়ায়াতে বলা হয়েছেঃ এটি আইলা (ইসরাঈলের বর্তমান বন্দর আইলাত) থেকে ইয়ামনের সান’আ পর্যন্ত অথবা আইল থেকে এডেন পর্যন্ত কিংবা আম্মান থেকে এডেন পর্যন্ত দীর্ঘ হবে। আর এটি চওড়া হবে আইলা থেক হুজকাহ (জেদ্দা ও রাবেগের মাঝখানে একটি স্থান) পর্যন্ত জায়গার সমপরিমাণ। (বুখারী, কিতাবুর রিকাক, আবু দাউদ তায়ালাসী৯৯৫ হাদীস,মুসনাদে আহমাদ, আবু বকর সিদ্দীক ও আবদুল্লাহ ইবনে ওমর বর্ণিত রেওয়ায়াতসমূহ, মুসলিম-কিতাবুত তাহারাত ও কিতাবুল ফাজায়েল, তিরমিযি--- আবওয়াবু সিফাতিল কিয়ামহ এবং ইবনে মাজাহ-কিতাবুয যুহুদ)।এ থেকে অনুমান করা যায়,বর্তমান লোহিত সাগরটিকেই কিয়ামতের দিন হাউজে কাউসারে পরিবর্তিত করে দেয়া হবে। তবে আসল ব্যাপার একমাত্র আল্লাহই ভালো জানে। একটি হাদীসে বলা হয়েছে- يشخب فيه ميزابان من الجنة এবং অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ يعت فيه ميزابان يمدانه من الجنة অর্থাৎ জান্নাত থেকে দু’টি খাল কেটে এনে তাতে ফেলা হবে এবং এর সাহায্যে থেকে তাতে পানি সরবরাহ হবে। (মুসলিম কিতাবুল ফাজায়েল) অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ يفتح نهر من الكوثر الى الحوض অর্থাৎ জান্নাতের কাওসার ঝরণাধারা থেকে একটি নহর এ হাউজের দিকে খুলে দেয়া হবে এবং তার সাহায্যে এতে পানি সরবরাহ জারী থাকবে (মুসনাদে আহমাদ, আবুদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বর্ণিত রেওয়ায়াতসমূহ)। এর পর মাওলানা মওদুদী (রঃ) লিখৈন- ’ইবনে মাজাহ এ ব্যাপারে যে হাদীস উদ্ধৃত করেছেন তার শব্দগুলো বড়ই হৃদয়স্পর্শী। তাতে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ أَلاَ وَإِنِّى فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ وَأُكَاثِرُ بِكُمُ الأُمَمَ فَلاَ تُسَوِّدُوا وَجْهِى أَلاَ وَإِنِّى مُسْتَنْقِذٌ أُنَاسًا وَمُسْتَنْقَذٌ أُنَاسٌ مِنِّى فَأَقُولُ يَا رَبِّ أُصَيْحَابِى. فَيَقُولُ إِنَّكَ لاَ تَدْرِى مَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ “সাবধান হয়ে যাও! আমি তোমাদের আগে হাউজে উপস্থিত থাকবো। তোমাদের মাধ্যমে অন্য উম্মাতদের মোকাবিলায় আমি নিজের উম্মাতের বিপুল সংখ্যার জন্য গর্ব করতে থাকবো। সে সময় আমার মুখে কালিমা লেপন করো না। সাবধান হয়ে যাও! কিছু লোককে আমি ছাড়িয়ে নেবো আর কিছু লোককে আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয়া হবে। আমি বলবো হে আমার রব! এরা তো আমার সাহাবী। তিনি বলবেন, তুমি জানো না তোমার পরে এরা কী অভিনব কাজ কারবার করেছে।” ইবনে মাজার বক্তব্য হচ্ছে, এ শব্দগুলো রসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর আরাফাত ময়দানের ভাষণে বলেছিলেন।
আমাদের কথাঃ আপনাদের বিবেকের আদলতে বিচার রইল ইনসাফের মানদন্ডে বিচার করে দেখবেন এই মৌলিক আক্বীদায় কোন একটি কথা বা বাক্য কি এমন আছে যেটি আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের খেলাফ বা ব্যাতিক্রম আছে!
শাফায়াত সম্পর্কে আক্বীদা ঃ মানুষ বিচার দিবসের ভয়াবহ বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে তাদের রবের নিকট সুপারিশ পেশ করার চেষ্টা করবে। শেষনবী তাদের জন্য সুপারিশ করবেন। কিয়ামতের দিন পাপীদের ক্ষমা করা ও পুণ্যবানদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য সুপারিশ করা হবে। নবী-রাসুল, ফেরেশতা ও নেককার ব্যক্তিরা সুপারিশ করার অনুমতি পাবে। কুরআন ও সিয়াম সুপারিশ করবে বলেও হাদিসে উল্লেখ আছে। যে ব্যক্তিদের প্রতি স্বয়ং আল্লাহ সন্তুষ্ট রয়েছেন, তাদের ছাড়া অন্য কারো জন্য কেউ সুপারিশ করবে না।
আল্লাহ ছাড়া কোন শাফায়াতকারী নেইঃ কাফের মুশরিকরা আল্লাহর সাথে কাউকে না কাউকে শরীক করে ফেলত এই বলে যে আল্লাহ তায়ালার সন্তানাদী আছেন তাঁর কন্যা সন্তান আছে ফেরেশতারা আরো অনেকেই আছেন যারা আল্লাহর কাছ থেকে সযপরারিশের অনুমোদন নিয়ে রেখেন। যেমন আজকাল অনেকেই দেব দেবেী অনেকেই পীর ফকীরকে তাই মনে করেন। আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে বলেন- وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمَنُ وَلَدًا سُبْحَانَهُ بَلْ عِبَادٌ مُكْرَمُونَ لا يَسْبِقُونَهُ بِالْقَوْلِ وَهُمْ بِأَمْرِهِ يَعْمَلُونَ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلا يَشْفَعُونَ إِلا لِمَنِ ارْتَضَى وَهُمْ مِنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ. ‘‘তারা বলে, ‘দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন।’ তিনি পবিত্র, মহান! তারা তো তাঁর সম্মানিত বান্দা। তারা আগে বেড়ে কথা বলে না, তারা তো তাঁর আদেশ অনুসারেই কাজ করে থাকে। তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা কিছু আছে তা তিনি অবগত। তিনি যাদের প্রতি সন্তুষ্ট তাদের ছাড়া আর কারো জন্য তারা সুপারিশ করে না এবং তারা তাঁর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্থ। সূরা আম্বিয়া: ২৬-২৯ আয়াত। তাদের এই ভ্রান্ত বাতিল ধারণার জবাবে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে করীমে সুস্পষ্ট বলেছেন যে কিয়ামাতের দিন কারো কোনো শাফায়াত কবুল করা হবে না, আল্লাহ ছাড়া কেউ শাফায়াতের অধিকার রাখবে না এবং আল্লাহ ছাড়া কোনো শাফায়াতকারী থাকবে না। এরশাদ হচ্ছে-وَاتَّقُوا يَوْمًا لا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلا يُقْبَلُ مِنْهَا شَفَاعَةٌ وَلا يُؤْخَذُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلا هُمْ يُنْصَرُونَ‘‘তোমরা সে দিনকে ভয় কর, যে দিন কেউ কারো কাজে আসবে না এবং কারো শাফায়াত (সুপারিশ) স্বীকৃত হবে না এবং কারো নিকট থেকে বিণিময়ও গ্রহণ করা হবেনা,এবং তারা কোন প্রকার সাহায্য পাবে না।’’ (সূরা বাকারা: ৪৮) এরশাদ হচ্ছে- وَاتَّقُوا يَوْمًا لا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلا يُقْبَلُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلا تَنْفَعُهَا شَفَاعَةٌ وَلا هُمْ يُنْصَرُونَ ”তোমরা সে দিনকে ভয় কর যে দিন কেউ কারো উপকার করবে না এবং কারো নিকট হতে কোন ক্ষতিপূরণ গৃহীত হবে না এবং কোন শাফায়াত কারো উপকারে লাগবে না এবং তারা কোন সাহায্যও পাবে না।’’ (সূরা বাকারা: ১২৩।) আরো এরশাদ হচ্ছে- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَنْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ يَوْمٌ لا بَيْعٌ فِيهِ وَلا خُلَّةٌ وَلا شَفَاعَةٌ ‘‘হে মু’মিনগণ, আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি তা হতে তোমরা ব্যয় কর সে দিন আসার পূর্বে- যে দিন ক্রয়-বিক্রয়, বন্ধুত্ব এবং শাফায়াত থাকবে না।’’ (সূরা বাকারা ২৫৪) এ ভাবে আরো অনেক আয়াতে আল্লাহ ছাড়া আর কারো সুপারিশ গ্রহণ করা হবেনা বলা হয়েছে।
আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে সুপারিশ গ্রহণ করা হবে ঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়ত তথা ইসলামের সহী আক্বীদা হলো আল্লাহ যাদেরকে সুপারিশ করার অনুমতি দেবেন তারা সুপারিশ করতে পারবেন এবং তাদের সুপারিশ গৃহিত হবে। এর পক্ষে কোরআনে দলীল আছে। এরশাদ হচ্ছে- مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلا بِإِذْنِهِ‘‘ কে সে যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করবে?’’(সূরা বাকারা: ২৫৫) আরো এরশাদ হচ্ছেÑ يُدَبِّرُ الأَمْرَ مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ ‘‘তিনি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর অনুমতি লাভ না করে সুপারিশ করার কেউ নেই।’’ (সূরা ইউনুস ৩) আল্লাহ তায়ালা বলেন- لا يَمْلِكُونَ الشَّفَاعَةَ إِلا مَنِ اتَّخَذَ عِنْدَ الرَّحْمَنِ عَهْدًا ‘‘শাফায়াতের মালিকানা তাদের কারো নেই। তবে ব্যতিক্রম সে ব্যক্তি যে দয়াময়ের প্রতিশ্রæতি গ্রহণ করেছে।’ (সূরা মরিয়ম ৮৭।) আরো এরশাদ হচ্ছে- يَوْمَئِذٍ لا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَرَضِيَ لَهُ قَوْلا ‘‘দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দিবেন ও যার কথা তিনি পছন্দ করবেন সে ব্যতীত কারো সুপারিশ সে দিন কোন কাজে আসবে না।’’ (সূরা তাহা: ১০৯ ) আর সূরা সাবা’র ২৩ নম্বার আয়াতে বলা হয়েছে وَلا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إِلا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ ‘‘যাকে অনুমতি দেয়া হয় সে ব্যতীত আল্লাহর নিকট কারো সুপারিশ কার্যকর হবে না।’’ এ রকম আরো অনৈক আয়াত আছে। হাদীসেও এর পক্ষে দলীল আছে।এর মধ্যে একটি হলো শাফায়াতে উজমা। (الشفاعة العظمى) বা মহোত্তম শাফা‘আত। এটা বিচার কার্য্য শুরুর জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করা বুঝানো হয়। বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে জানা যায় যে কিয়ামাতের দিন মানুষ বিভিন্ন নবী-রাসূলের কাছে গমন করে ব্যর্থ হয়ে সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর নিকট গমন করবেন। তিনি সমগ্র মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহর দরবারে শাফায়াত করবেন, মানুষদের বিচার শেষ করে দেওয়ার জন্য। এর পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর শাফায়াতে মহান আল্লাহ তাঁর উম্মাতের অনেক গোনাহগারকে ক্ষমা করবেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর শাফায়াতে অনেক পাপী মুসলিম জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। এ ছাড়াও উম্মাতে মুহাম্মাদীর অনেক নেককার মানুষ শাফায়াত করবেন। যেমন- সন্তানগণ তাদের পিতামাতাদের জন্য শাফায়াত করবে। কুরআন তার পাঠক ও অনুসারীদের জন্য শাফায়াত করবে। সিয়াম ও অন্যান্য ইবাদত শাফায়াত করবে বলে হাদীসে দলীল রয়েছে। কিন্তু কেউ যদি আল্লাহ থেকে বিমুখ থাকে, ঈমান-আক্বীদা বিশুদ্ধ না করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা না করে অলী আউলিয়াদের প্রতি প্রেম ভালোবাসার উপর ভিত্তি করে বসে থাকে যে তারা তাকে সুপারিশ করে জান্নাতে নিয়ে যাবেন তাহলে সেটা হবে ভ্রান্ত আক্বীদা। প্রত্যেককেই নিজেদের আমল নিজেই করতে হবে। এই করতে গিয়ে যদি ভুল ভ্রান্তির কারণে আটকা পড়ে যান তাহলেই কেবল আল্লাহর অনুমোদন ক্রমে তারা সুপারিশ করতে পারবেন।
আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদাঃ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের অনুসারীগণ সহীহ হাদীসে প্রমাণিত সকল প্রকারের শাফায়াতেই বিশ্বাস করেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, শাফয়াতের মালিকানা একমাত্র মহান আল্লাহরই। তিনি যার উপর সন্তুষ্ট হবেন তার জন্য তিনি দয়া করে শাফায়াতের ব্যবস্থা করে দিবেন। তিনি যার উপর সন্তুষ্ট থাকবেন তার জন্য তাঁর অনুমতিপ্রাপ্ত কেউ শাফায়াত করলে তিনি ইচ্ছা করলে তা কবুল করে গোনাহগার মুমিনকে ক্ষমা করতে পারেন। মুতাযিলাদের আক্বীদা মুসলমানদের মধ্যকার অনেক গুলো বাতিল ফিরকার একটি বাতিল ফিরক্বা হলো মুতাযিলা । তাদের আক্বীদা হলো ক্বেয়ামতের দিনে পাপিদের কোন সুপারিশকারী নেই এর দলীল হলো এই আয়াত গুলো। কিন্তু কাফের মুশরিকদের যারা ওহীর জ্ঞানের সাথে কিছু কল্পনা যোগ করে যে এই বিশ্বাস করত যে,আল্লাহর ফিরিশতাগণ,নবীগণ বা প্রিয়পাত্রগণ শাফা‘য়াতের ক্ষমতা ও অধিকার সংরক্ষণ করেন। মহান আল্লাহ তাদেরকে এ ধরনের ক্ষমতা ও অধিকার দিয়ে দিয়েছেন। তারা তাদের ইচ্ছামত যাকে ইচ্ছা সুপারিশ করে মুক্তি দিতে পারবেন। মহান আল্লাহ তাদের এই ভ্রান্ত বিশ্বাস খন্ডন করে জানিয়েছেন যে, শাফায়াতের মালিকানা, অধিকার ও ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর, এটা তারা বিশ্বাস করেনা বা মানে না। এটা কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে তাদের ভুল বলেই তারা বাতিল আক্বীদার উপর অটল রয়েছে। মু’তাযিলাগণ এই শাফায়াতে উযমা স্বীকার করে, কারণ তা তাদের মূলনীতির পরিপন্থী নয়। পাপী মুমিনের জন্য শাফায়াত বিষয়ক অন্যান্য আয়াত ও হাদীসকে তারা শাফায়াতে উযমা বলে ব্যাখ্যা করে।
মীযান, পুলসিরাত সম্পর্কে আক্বীদা ঃ আল্লাহ বিচার দিবসে মীযান স্থাপন করবেন, বান্দাহদের আমল মাঁপার ও তাদের কর্মের প্রতিদান প্রদানের জন্য। এর দুটি পাল্লা ও রশি রয়েছে। ইসলামী আক্বীদা বিশ্বাস অনুযায়ী পুলসিরাত হলো জাহান্নামের উপর স্থাপিত পুল, যা অন্ধকারাছন্ন ভয়ের পথ। এর উপর দিয়ে মানুষ জান্নাতের দিকে অতিক্রম করবে। কেউ অতি দ্রæত অতিক্রম করবে আবার কেউ অনেক ধীর গতিতে তাদের কর্ম অনুসারে। পুল সিরাতের দুই ধারে হুকের মত অসংখ্য কাঁটা থাকবে। পুল সিরাত হবে তরবারীর চেয়ে ধারালো, চুলের চেয়ে সূক্ষ¥ ও পিচ্ছিল জাতীয়। অনেকে মুখ থুবড়ে জাহান্নামের তলদেশে নিক্ষিপ্ত হবে। মুমিনেরা পুলসিরাত অতিক্রম করে কানত্বারাতে অবস্থান করবে। এখানে জান্নাতে যাওয়াার পূর্বে একে অপরের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করে পরিশুদ্ধ হবে। এরপর জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে।
জান্নাত-জাহান্নাম ঃ মুসলিমরা বিশ্বাস করে জান্নাত ও জাহান্নাম বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে এবং সর্বদা থাকবে। জান্নাতবাসীদের নি‘আমত শেষ হবে না,অনুরূপ জাহান্নামীদের মধ্যে যার ব্যাপারে আল্লাহ চিরস্থায়ী শাস্তির ফায়সালা করেছেন তার শাস্তি কখনও শেষ হবে না। ইসলামী আক্বীদা বিশ্বাস অনুসারে, জান্নাত হলো অতিথিশালা, যা আল্লাহ মুত্তাকীদের জন্য তৈরি করে রেখেছেন। সেখানে রয়েছে প্রবাহিত নদী, সুউচ্চ কক্ষ, মনোলোভা রমণীগণ। আরো রয়েছে এমন সব সামগ্রী যা কোনো দিন কোনো চক্ষু দেখে নি, কোনো কর্ণ শ্রবণ করে নি, আর কোনো মানুষের অন্তরেও কোনো দিন কল্পনায় আসে নি। জান্নাতে মুমিনদের জন্য সব চাইতে বড় নেয়ামত হলো আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখা। সবচেয়ে উন্নত ও উত্তম জান্নাত হল, জান্নাতুল ফিরদাউস আল-আ‘লা। এর ছাদ হলো আল্লাহর ‘আরশ। জান্নাতের সুগন্ধি চল্লিশ বৎসর দূরত্বের রাস্তা থেকে পাওয়া যাবে। জান্নাতের আটটি দরজা রয়েছে, প্রত্যেক দরজার পার্শ্বের দৈর্ঘ্য ‘মক্কা’ থেকে ‘হাজর’ এর দূরত্বের সমান। জান্নাতে নূন্যতম মর্যাদার অধিকারী যে হবে তার জন্য দুনিয়া ও আরো দশ দুনিয়ার পরিমাণ জায়গা হবে। জান্নাত ও জাহান্নাম সম্পর্কে কোরআনে বহু আলোচনা রয়েছে ।
অধ্যায় ৪ Ñ ইসমতে আম্বিয়াঃ
মাওলানা সায়িদ আবুল আলা মওদুদীর (রঃ) বক্তব্যঃ
মুজাহিদে মিল্লাত মজাদ্দিদে জামান আল্লামা সায়্যিদ মাওলানা মওদূদী (রাহ) তার বিখ্যাত গ্রন্থ “তাফহীমাত” দ্বিতীয় খন্ডের ৪৩ পৃষ্ঠায় হযরত দাউদ (আঃ) এর ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে লিখেছেন- “এবং এটি একটি সূ´ রহস্য যে, আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছে করে প্রত্যেক নবী থেকে কোন না কোন সময় তার হেফাজত উঠিয়ে দিয়ে দু-একটি ভুল-ত্রুটি হতে দিয়েছেন, যাতে মানুষ নবীদেরকে খোদা না বুঝে এবং জেনে নেয় যে, এরা খোদা নন বরং মানুষ।”
মাওলানার এই উক্তিটি কিন্তু অত্যন্ত চমকপ্রদ এবং নবীকে (সাঃ) ভুলের উর্দ্ধে রেখে আল্লাহর হেকমত প্রকাশ করেছেন মানুষের শিক্ষার জন্য। কিন্তু এই কথাটিকে কি ভাবে প্যঁচ লাগিয়ে উম্মাহর মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে তা সকলের ই সামনে। তাই আসুন ইসমতে আম্বিয়া সম্পর্কে কোরআন হাদীস এর বক্তব্য এবং এর আলোকে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা কি তা একটু পর্যালোচনা করি। সেই সাথে আমাদের আকাবীরে দেওবন্দের শীর্ষ ওলামায়ে কেরামদের মধ্যে যারা লেখালেখি করেছেন তাদের বক্তব্য ও উক্তি কি তা একটু পর্য্যালোচনা করি।
ইসমতে আম্বিয়া ঃ আভিধানিক ও পরিভাষিক সংজ্ঞা ঃ আভিধানিক অর্থ ঃ ইসমাত (العصمة) শব্দটি ‘আসামা’ (عَصَمَ) ক্রিয়ামূল থেকে গৃহীত,যার অর্থ নিষেধ করা, সংরক্ষণ করা বা হেফাযত করা,ইসমত বা বাঁচানো। এই দিক থেকে العاصم আল আসীম অর্থ সংরক্ষণকারী, হেফাযতকারী। الاعتصام অর্থ কোনো জিনিসকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা। ইসলামী পরিভাষায় ‘ইসমাত’বলতে বুঝানো হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো ব্যক্তিকে পাপ বা ভুল-ভ্রান্তি থেকে সংরক্ষণ করা। সাধারণত একে অভ্রান্ততা,নিষ্কলঙ্কত্ব,পাপাক্ষমতা বা নিষ্পাপত্ব (রহভধষষরনরষরঃু, রসঢ়বপপধনরষরঃু; ংরহষবংংহবংং) বলা হয়। ইসমাতুল আম্বিয়া عصمة الأنبياءঅর্থ ইসমতুল আম্বিয়া অর্থ হলো- গুনাহ ও পাপাচার থেকে নবীদেরকে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে সংরক্ষণ করা। (ঢ়ৎবাবহঃ, মঁধৎফ, ঢ়ৎড়ঃবপঃ)। এখানে গভীর ভাবে লক্ষণীয় বিষয় হলো যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সহ কোন আম্বিয়ায়ে কেরাম ই মাসুম বা স্বভাবগত ভাবে নিস্পাপ নয় বরং আল্লাহ তায়ালাই তাদেরকে নিস্পাপ রাখেন বা পাপাচার থেকে হেফাজত করেন। এই সুক্ষ বিষয়টি অনেকেই বুঝতে পারেন না অথবা বুঝেও না বুঝার ভান করে বিরোধিতার জন্য ইস্যু বানিয়ে অপপ্রচারে অসত্য প্রচারে মেতে উঠেন। দেখুন আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়ে কোরআনে এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) হাদীসে কি বলেছেন।
কোরআনের দলীলে নবীগণ নিষ্পাপঃ নবীগণ যে নিষ্পাপ,তা কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও বিশুদ্ধ হাদীছসমূহ দ্বারা এবং উম্মতের ঐক্যমত ও আকলী দলীলসমূহ দ্বারা প্রমাণিত আছে। এর পক্ষে যে আয়াত গুলো পেশ করা হয় তা হচ্ছেÑ (১) এরশাদ হচ্ছেÑ يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ অর্থাৎ- হে রাসূল, আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তা আপনি প্রচার করুন। যদি আপনি তা না করেন তাহলে আপনি আল্লাহর বার্তা প্রচার করলেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষদের (অনিষ্টতা) থেকে সংরক্ষণ করবেন। এই আয়াতে যে নির্দেশনা গুলো রয়েছে তা হলোÑ (ক) আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে, তাতে কোন সংযোজন-বিয়োজন না করেই তা মানুষের কাছে পৌছে দেয়া। (খ) কোন নিন্দুকের নিন্দাকে পরোয়া না করা। (গ) এই দায়িত্ব পালন না করলে ধরে নেয়া হবে যে আপনি আল্লাহর বার্তা পৌছাননি। (ঘ) এই দায়িত্ব পালন কালে নানাবিধ বাধাবিপত্তি আসবে এবং আপনার ক্ষতি করার চেষ্টা করা হবে। এ সময়ে আল্লাহ আপনাকে মানুষদের অনিষ্টতা থেকে থেকে সংরক্ষণ করবেন। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এই দায়িত্ব যথাযত ভাবে কোন সংজোযন বিয়োজন ছাড়াই পালন করেছেন। কোন কিছুই বাকী রাখেন নি বা গোপন করেন নি। এ প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি এই ধারণা পোষণ করে যে,নবী (সাঃ) কিছু জিনিস গোপন রেখেছেন, (প্রকাশ বা প্রচার করেননি), সে ব্যক্তি নিঃসন্দেহে মিথ্যাবাদী। (বুখারী ৪৮৫৫নং) এখানে আমাদের মুখ্য আলোচনা হলো وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ এই বাক্য নিয়ে, যেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন নবীকে (সাঃ) মানুষের অনিষ্ট থেকে হেফাজত করবেন। অর্থাৎ ইসমতের অর্থ হলো হেফাজত করা মানে হেফাজতের জিম্মাদারী আল্লাহর হাতে। মুফতি শফী (রঃ) তাফসীরে মাআরিফুল কোরআনে লিখেছেন এই আয়াতে তিনটি বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হয়েছে। (ক) মূল্যবোধ ও দায়ীত্ব সচেতনতা। (খ) দাওয়ত ও তাবলীগের দায়ীত্ব পালনে নির্ভিক থাকা। (গ) হতাশাকে প্রশ্রয় না দেয়া। আয়াতে সম্বোধন আল্লাহর রাসুল হলেও এর উদ্দেশ্য গোটা মানব জাতী যারা আল্লাহ রাসুলে বিশ্বাসী। তাই ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া যারা বা ইলমের অহীর উল্টরাধীকার যারা তাদেরকেই আল্লাহর এই বানীর ভিত্তিতে, মূল্যবোধ ও দায়ীত্ব সচেতন ও দাওয়ত-তাবলীগের দায়ীত্ব পালনে নির্ভিক থাকা এবং কোন কারণে ব্যর্থতা দেখা দিলেও বা চাপ বৃদ্ধি পেলেও হতাশ না হওয়ার দীক্ষা নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের তওে এগিয়ে যেতে হবে। দুঃখ জনক হলেও বলতে হচ্ছে যে আমরা ইয়াছিমুকা মিনাস নাস এর মধ্যে ইসমতে আম্বিয়ার মাসআলাই ঘাটি ঘাটি করছি বেশি কিন্তু এই আয়াতের স্প্রিট কি সেটা নিয়ে কোন ব্যস্থতা দেখা যায়না। এর মানে এই নয় যে আক্বীদার প্রয়োজন নেই । হ্যাঁ আক্বীদা বিশুদ্ধ হতেই হবে জীবনাচারে পাপ পঙ্কিলতা ঝেড়ে ফেলে ইবাদত বন্দেগীতে ঈমান আমলে আক্বীদা বিশুদ্ধ হতেই হবে। কিন্তু আমরা যদি ঈমানের ই গুরুত্ব না দেই তাহলে আক্বীদা কি জন্য?
(২) আল্লাহ তা’আলা শয়তানকে বলেছেন- اِنَّ عِبَادِىْ لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطنٌ (হে) ইবলীস,আমার বিশিষ্ট বান্দাহদের উপর তোমার কোন কর্তৃত্ব নেই। (৩) শয়তান নিজেই স্বীকার করেছিল- وَلَاُغْوِيَنهُمْ اَجْمَعِيْنَ اِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلِصِيْنَ (হে আল্লাহ, তোমার বিশিষ্ট বান্দাগণ ব্যতীত বাকী সবাইকে বিপথগামী করবো।এতে বোঝা গেল যে নবীগণ পর্যন্ত শয়তান যেতে পারে না। তাই সে তাঁদেরকে না পারে বিপথগামী করতে,না পারে কুপথে পরিচালনা করতে। (৪) হযরত ইউসুফ (আঃ) বলেছিলেন- مَاكَانَ لَنَا اَنْ نشْرِكَ بِاللهِ مِنْ شَيْئِ আমরা নবী সম্প্রদায়ের পক্ষে খোদার সাথে শিরক করাটা অশোভনীয়। (৫) হযরত শুয়াইব (আঃ) স্বীয় ক্বওমকে বলেছিলেন- مَااُرِيْدَ اَنْ اَخَالِفَكُمْ اِلى مَا اَنْهَا كُمْ (যেটা তোমাদের নিষেধ করি,সেটা নিজে করবো,এ ধরনের ধারণা আমি করি না।) বোঝা গেল যে নবীগণ শিরক ও গুনাহ করার ধারণাও কখনো করেন না। এটাই হচ্ছে নিষ্কলুষতার হকীকত। (৬) হযরত ইউসুফ (আঃ) বলেছেন-وَمَا اُبرى نَفْسِىْ اِنَّ النَّفْسَ لَاَمَّرَهٌ بِاالسُّوْءِ اِلَّا مَارَحِم رَبِّىْ ”আমি নিজেকে নির্দোষ মনে করি না। মানুষের মন অবশ্যই মন্দকর্ম প্রবণ,তবে যার প্রতি আল্লাহর দয়া হয়েছে।”এখানে এ রকম বলা হয়নি যে, আমার আত্মা মন্দ কর্মপ্রবণ,বরং বলেছেন-সাধারণ আত্মা জনসাধারণকে মন্দকর্মে অনুপ্রাণিত করে। কেবল ওসব আত্মাকে বিপথগামী করতে পারে না,যে গুলোর প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত রয়েছে।এগুলো হচ্ছে নবীগণের আত্মা।তাঁদের আত্মা তাঁদেরকে ধোঁকা দিতে পারে না (৭) আল্লাহতা’আলা ইরশাদ ফরমান- اِنَّ اللهُ اَصْطَفَى اَدَمَ وَنُوْحا وال اِبْرَاهِيْمَ وَالَ عِمْرَانَ عَلَى الْعلَمِيْنَ” আদমকে, নুহকে, ইব্রাহীমের বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে আল্লাহ তা’আলা বিশ্বজগতে প্রাধান্য দিয়েছেন।” এতে বোঝা গেল সমস্ত জগতের মধ্যে নবীগণ শ্রেষ্ঠ। জগতের মধ্যে নিষ্পাপ ফেরেশতাগণও রয়েছেন। আর ফেরেশতাদের বৈশিষ্ট হচ্ছে- لَا يَعْصُوْنَ اللهَ مَااَمَرَ هُمْ তাঁরা কখনও নাফরমানী করেন না। যদি নবীগণ গুণাহগার হন, তাহলে ফিরিশতাগণ নিশ্চয়ই নবীদের উর্ধে স্থান পেতেন। (৮) আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ ফরমান- لَايَنَالُ عَهْدِى الظّلِمِيْنَ আমার প্রতিশ্রæতি নবুয়তের সিলসিলা জালিমদের অর্থাৎ ফাসিকদের সাথে সংমিশ্রিত হবে না। এতে বোঝা গেল অনাচার ও নবুয়াত একত্রিত হতে পারে না। (৯) কুরআনে করীমে নবীদের উক্তি উদ্ধৃত করে ইরশাদ হচ্ছে-يَاقَوْمُ لَيْسَ بِىْ ضَلَالَةٌ وَّلكِنِّىْ رَسُوْلٌ مِّنْ رَّبِّ الْعلَمِيْنَ ”অর্থাৎ হে আমার কওম, আমার কাছে গুমরাহী বলতে কিছু নেই, আমি আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ।” এ আয়াতে لكنى শব্দ থেকে বোঝা গেল যে, গুমরাহী ও নবুয়াত একত্রিত করা যায় না। কেননা নবুয়াত হচ্ছে নূর আলো আর গুমরাহী হচ্ছে অন্ধকার। আলো-অন্ধকার একত্রিকরণ অসম্ভব। বস্তুত আয়াত গুলোতে নবী-রাসুলগনের বৈশিষ্ঠ উল্লেখ করা হয়েছে এবং শয়তান যে তাদের উপর প্রভাব ফেলতে পারেনা এটাই বলা হয়েছে। এর মানে এই নয় যে মানবীয় প্রবৃত্তি তাদের মধ্য থেকে লোপ পেয়ে গেছে। বরং নবীগনের আর সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য এটা বুঝানো হয়েছে যে সাধারণ মানুষ কোন গোনাহ করলে হয় তওবা করতে বিলম্ভ করে এবং এটা যে গোনাহ তা উপলব্ধি করতে অনেক সময়ই বিলম্ভ করে ফলেন কিন্তু নবী-রাসুলগণ সহজেই গোনাহর কাজ কোনটি তা তড়িত উপলব্ধি করতে পারেন। অনিচ্ছা কৃত কোন ত্রæটি হয়ে গেলেও এর উপর ক্ষণিকের জন্যও পড়ে থাকেন না বরং সাথে সাথেই সেটা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত কামনা করেন। আল্লাহ তায়ালা এ কারণে তাদের সম্মান ও মর্য্যাদা আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দেন। (১০) এরশাদ হচ্ছেÑ أُولَئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ مِنْ ذُرِّيَّةِ آَدَمَ وَمِمَّنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ وَمِنْ ذُرِّيَّةِ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْرَائِيلَ وَمِمَّنْ هَدَيْنَا وَاجْتَبَيْنَا অর্থাৎ-‘‘এরা নবীগণের অন্তর্ভুক্ত, যাদেরকে আল্লাহ অনুগ্রহ প্রদান করেছেন, তারা আদমের ও যাদেরকে আমি নূহের সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছিলাম তাদের বংশোদ্ভুত, ইবরাহীম ও ইসরাঈলের বংশোদ্ভুত ও যাদেরকে আমি পথ-নির্দেশ করেছিলাম ও মনোনীত করেছিলাম।’’ (সূরা মরিয়ম: ৫৮) এই আয়াত সহ আরো বিভিন্ন আয়াত থেকে জানা যায় যে, বিশেষভাবে পবিত্র ও নিষ্কলুষ বাছাই করা ব্যক্তিদেরকেই আল্লাহ নুবুওয়াত প্রদান করেছেন। যার মর্ম দাড়ায় এই পবিত্র আত্মা ও নিস্কলুষ হওয়া আল্লাহর ই অনুগ্রহ । আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া নিস্কলুসতা ও পবিত্র হওয়া সম্ভব নয়। (১১) নবী-রাসুলগন (আঃ) হলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে সু সংবাদ ও ভীতি প্রদানকারী তাই আল্লাহ তা‘আলা যাকে রিসালাতের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন, তিনিই হলেন রসূল তাকেঁ সকল প্রকার অনিষ্ট থেকে আল্লাহ তায়ালা হেফজত করেন। এটা অবশ্যই জেনে রাখা দরকার যে প্রত্যেক রসূলই নবী, কিন্তু প্রত্যেক নবী রসূল নন। তারা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে যা পৌঁছিয়ে দেন সে বিষয়ে তাদের নির্দোষিতা সু-সাব্যস্ত। নবী-রাসুলগন এই গুণে গুনান্বিত ও বৈশিষ্ট মন্ডিত বলেই আল্লাহ তায়ালা নবীর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ আল্লাহর হেফাজত ও অনুগ্রহ থাকার কারণে নবী-রসূলগণ (আঃ) মাহফুজ তাই আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে সংবাদ দেয়া এবং রেসালাতের তাবলীগ করার ব্যাপারে মাসুম (দোষ-ত্রুটিমুক্ত)। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে তারা যেসব সংবাদ প্রদান করেছেন, এক বাক্যে বিনা শর্তে তার প্রতি বিশ্বাস করা আবশ্যক। যেমন (১২) আল্লাহ তায়ালা বলেন,- قُولُوا آمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنزِلَ إِلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَىٰ وَعِيسَىٰ وَمَا أُوتِيَ النَّبِيُّونَ مِن رَّبِّهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ فَإِنْ آمَنُوا بِمِثْلِ مَا آمَنتُم بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوا وَّإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللَّهُ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ অর্থাৎ‘‘তোমরা বল- আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি, আমাদের জন্য যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি এবং যা ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও ইয়াকুবের সন্তানদের প্রতি যা নাযিল হয়েছিল তার প্রতি, মূসা, ঈসা এবং অন্যান্য নবীদেরকে তাদের রবের পক্ষ হতে যা দেয়া হয়েছে তার প্রতি। আমরা কারোর মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না। আমরা সবাই আল্লাহর অনুগত মুসলিম। তোমরা যেরূপ ঈমান এনেছো তারাও যদি সেরূপ ঈমান আনে, তাহলে নিশ্চয় তারা সুপথ পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তারা নিশ্চয়ই বিরুদ্ধাচারিতায় লিপ্ত। কাজেই তাদের মোকাবিলায় তোমাদের সহায়তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’’। (বাকারা: ১৩৬-) (১৩) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ অর্থাৎ-‘‘তোমাদের মুখমন্ডল পূর্ব বা পশ্চিম দিকে ফিরানোর মধ্যে কোনো ছাওয়াব নেই; বরং পূণ্য তার, যে ব্যক্তি আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ,কিতাব ও নবীগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে’’। (সূরা বাকারা: ১৭৭) (১৪) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, آَمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آَمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ لا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ অর্থাৎ-‘‘রসূল তার রবের পক্ষ থেকে তার উপর যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছে। মুমিনগণও তার প্রতি ঈমান এনেছে। তারা সবাই আল্লাহকে, তার ফেরেশতাদেরকে, তার কিতাবসমূহকে ও তার রসূলদেরকে বিশ্বাস করেছে এবং তাদের বক্তব্য হচ্ছে, আমরা আল্লাহর রসূলদের একজনকে অন্যজন থেকে আলাদা করি না। আর তারা বলেন, আমরা নির্দেশ শুনেছি এবং অনুগত হয়েছি। হে আমাদের প্রভু! আমরা গুনাহ মাফের জন্য তোমার কাছে প্রার্থনা করছি। আমরা তোমারই দিকে ফিরে যাবো’’। (সূরা বাকারা: ২৮৫) এর অনুকুলে সূরা নিসা’র ৬৯ সূরা আনআম এর ৮৪-৯০ সূরা মরিয়ম এর ৪১-৫৮ নম্বার আয়াত সমূহেও দলীল রয়েছে।
ইমাম আবু হানিফার (রঃ) অভিমতঃ ইসমতে আম্বিয়া প্রসঙ্গে ইমামামে আজম আবু হানিফা (রঃ) বলেন- اَلأَنْبِيَاءُ عَلَيْهِمُ السَّلاَمُ كُلُّهُمْ مُنَزَّهُوْنَ عَنِ الصَّغَائِرِ وَالْكَبَائِرِ وَالْكُفْرِ وَالْقَبَائِحِ، অর্থাৎ নবীগণ সকলেই সগীরা গোনাহ, কবীরা গোনাহ, কুফর ও অশালীন কর্ম থেকে পবিত্র ও বিমুক্ত ছিলেন। وَقَدْ كَانَتْ مِنْهُمْ زَلاَّتٌ وَخَطِيْئَاتٌ তবে কখনো কখনো সামান্য পদস্খলন ও ভুলত্রুটি তাঁদের ঘটেছে।وَمُحَمَّدٌ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَبِبُّهُ، وَعَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، وَصَفِيُّهُ وَنَقِيُّهُ، وَلَمْ يَعْبُدِ الصَّنَمَ وَلَمْ يُشْرِكْ بِاللهِ تَعَالَى طَرْفَةَ عَيْنٍ قَطُّ، وَلَمْ يَرْتَكِبْ صَغِيْرَةً وَلاَ كَبِيْرَةً قَطُّ. এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর নবী, তাঁর বান্দা, তাঁর রাসূল, তাঁর মনোনীত নির্বাচিত, তাঁর বাছাইকৃত। তিনি কখনো মূর্তির ইবাদত করেন নি এবং কখনোই এক পলকের জন্যও আল্লাহর সাথে শিরক করেন নি। তিনি কখনোই কোনো সগীরা বা কবীরা কোনো প্রকারের পাপে লিপ্ত হন নি। এর পর বলেছেন- وَأَفْضَلُ النَّاسِ بَعْدَ النَّبِيِّيْنَ عَلَيْهِمُ الصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ أَبُوْ بَكْرٍ الصِّدِّيْقُ ثُمَّ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ الْفَارُوْقُ ثُمَّ عُثْمَانُ بْنُ عَفَّانَ ذُوْ النُّوْرَيْنِ ثُمَّ عَلِيُّ بْنُ أَبِيْ طَالِبٍ الْمُرْتَضَى رِضْوَانُ اللهِ تَعَالَى عَلَيْهِمْ أَجْمَعِيْنَ، عَابِدِيْنَ ثَابِتِيْنَ عَلَى الْحَقِّ وَمَعَ الْحَقِّ كَانُوْا، نَتَوَلاَّهُمْ جَمِيْعاً وَلاَ نَذْكُرُ الصَّحَابَةَ إِلاَّ بِخَيْرٍ. নবীগণের (আঃ) পরে মানব জাতির মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন আবু বকর সিদ্দীক, তাঁর পরে উমর ইবনুল খাত্তাব আল-ফারূক, তাঁর পরে উসমান ইবনে আফ্ফান, তাঁর পরে আলী ইবনে আবী তালিব আল-মুরতাযা, রাজিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন, আল্লাহ তাঁদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট হন। তাঁরা আজীবন আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে, সত্যের উপরে ও সত্যের সাথে সুপ্রতিষ্ঠিত থেকেছেন। আমরা তাঁদের সকলকেই ভালবাসি ও ওলী হিসেবে গ্রহণ করি। আমরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কোনো একজন সাহাবীর বিষয়েও ভাল কথা ছাড়া কিছু বলি না। এর পর লিখেছেন- وَلاَ نُكَفِّرُ مُسْلِماً بِذَنْبٍ مِنَ الذُّنُوْبِ وَإِنْ كَانَتَ كَبِيْرَةً إِذَا لَمْ يَسْتَحِلَّهَا، وَلاَ نُزِيْلُ عَنْهُ اسْمَ الإِيْمَانِ، وَنُسَمِّيْهِ مُؤْمِناً حَقِيْقَةً وَيَجُوْزُ أَنْ يَكُوْنَ مُؤْمِناً فَاسِقاً غَيْرَ كَافِرٍ. আমরা কোনো মুসলিমকে কোনো পাপের কারণে কাফির বলি না, যদিও তা কোনো কবীরা গোনাহ হয়, যতক্ষণ না সে ব্যক্তি উক্ত পাপটিকে হালাল বলে বিশ্বাস করে। আমরা পাপের কারণে কোনো মুসলিমের ‘ঈমান’-এর নাম অপসারণ করি না। বরং আমরা তাকে প্রকৃতই মুমিন বলে আখ্যায়িত করি, সে কাফির না হয়ে একজন পাপী মুমিন হতে পারে। وَالصَّلاَةُ خَلْفَ كُلِّ بَرٍّ وَفَاجِرٍ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ جَائِزَةٌ সকল নেককার ও পাপী মুমিনের পিছনে সালাত আদায় বৈধ।
ইমাম নসফী (রঃ)
ইসমতে আম্বিয়া মাসআলার মূলনীতির উপর ঐকমত্যের পরও খুঁটিনাটি কিছু বিষয়ে আলিমদের মতভেদ রয়েছে। আল্লামা উমর ইবনে মুহাম্মাদ আন-নাসাফী (৫৩৭হি.) (রঃ) বলেন- كُلُّهُمْ كَانُوْا مُخْبِرِيْنَ مُبَلِّغِيْنَ عَنِ اللهِ تَعَالَى صَادِقِيْنَ نَاصِحِيْنَ لِلْخَلْقِ ‘‘তাঁরা সকলেই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সংবাদ প্রদান করেছেন এবং প্রচার করেছেন, সত্যবাদী ছিলেন, সৃষ্টির উপদেশদাতা ও কল্যাণকামী ছিলেন।’’ (আকাইদে নসফী পৃঃ ১৩৯)
তিনি আরো বলেছেন كُلُّهُمْ كَانُوْا مُخْبِرِيْنَ مُبَلِّغِيْنَ عَنِ اللهِ تَعَالَى صَادِقِيْنَ نَاصِحِيْنَ لِلْخَلْقِ ‘‘তাঁরা সকলেই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সংবাদ প্রদান করেছেন এবং প্রচার করেছেন, সত্যবাদী ছিলেন, সৃষ্টির উপদেশ দাতা ও কল্যাণকামী ছিলেন।’’ এ কথার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লামা সা’দ উদ্দীন তাফতাযানী (রঃ) (৭৯১হি) শরহে আকায়িদে নসফীতে বলেন: ‘‘এতে ইশারা করা হয়েছে যে,নবীগণ বিশেষভাবে শরীয়তের বিষয়ে,দ্বীনের আহকাম প্রচারের বিষয়ে ও উম্মাতকে নির্দেশনা প্রদানের বিষয়ে মা’সূম বা নির্ভুল ও সংরক্ষিত। এক্ষেত্রে তাঁরা ইচ্ছাকৃত কোনো ভুল করেন না সে বিষয়ে সকলেই একমত। অধিকাংশের মতে এক্ষেত্রে তাঁরা অনিচ্ছাকৃত বা বে খেয়ালেও কোনো ভুল করতে পারেন না।
আল্লামা তাফতাজানী (রঃ) এ কথার ব্যাখ্যায় আল্লামা সাদ উদ্দীন মাসউদ তাফতাজানী (রঃ) তার লিখিত “শারহে আকা’ঈদে নাসাফী”তে লিখেছেন- اِن الانبياء معصومون عن الكذب خصوصا فيما يتعلق بامر الشرائع وتبليغ الاحكام وارشاد الامه امّا عمادا فبا لا جماع واما سهوا فعند الاكثرين – وفى عصمتهم عن سائرالذنوب تفصيل وهوانهم অর্থাৎ নবীগন মিথ্যা হতে পবিত্র। বিশেষ করে শরীয়ত ও রিসালত প্রচারের সহিত সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির মধ্যে তারা মিথ্যা হতে সম্পূর্ন পবিত্র। ইচ্ছাকৃত মিথ্যা হতে পবিত্র হওয়ার ব্যপারে সকলেই একমত,তবে ভুলবশতঃ অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা হতে পবিত্র হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ আছে। অধিকাংশ আলেমদের মতে তারা এই প্রকার মিথ্যা হতেও পবিত্র। অপরাপর যাবতীয় গুনাহ হতে নবীগণ পবিত্র হওয়া সম্পর্কে আলোচনা আছে। উহা এই যে, তাঁরা কুফরী হতে সম্পূর্ন পবিত্র। অহি আসার পূর্বে হউক কিংবা পরে। এতে কারও মতভেদ নেই। অনুরূপভাবে তারা জমহুর বা অধিকাংশ উলামাদের নিকট ইচ্ছাকৃত কবীরা গুণাহ হতেও পবিত্র। উল্লেখ্য এই কিতাবটি এ উপমহাদেশের সরকারী, আধা সরকারী এবং কওমী মাদ্রাসাগুলোতে পড়ানো হয়। এর একটি ব্যাখ্যা গ্রন্থ বয়ানুল ফাওয়াঈদ নামে দারুল উলুম দেওবন্দের আক্বীদা বিভাগের উস্তাদ কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। সেখানেও এই ব্যাখ্যা সমর্থন করা হয়েছে। তবে মতভেদ রয়েছে এ কথার মধ্যে যে,কবিরা গুনাহ হতে পবিত্র থাকা ও বিরত থাকা কি বর্ণিত দলীলের দ্বারা প্রমানিত,না বিবেকের দ্বারা। আর ভুলবশতঃ কবীরা গুনাহ হওয়ার ব্যাপারে অধিকাংশ উলামাদের মত হল তা জায়েয ও সম্ভব আছে। ছগীরা গুনাহ জমহুর উলামাদের মতে নবীগন হতে ইচ্ছাকৃতও হতে পারে। কিন্তু জুব্বাই ও তার অনুসারীদের অভিমত এর বিপরিত। আর অনিচ্ছাকৃত ভুলের দ্বারা ছগীরা গুনাহ হওয়া সকলের ঐক্যমতে জায়েয আছে, কিন্তু যা ঘৃণিত স্বভাবের পরিচয় দেয় ঐ প্রকারের ছগীরা গোনাহ হয়নি। শরহে আকা’ঈদে নসাফী) আল্লামা তাফতাজানীর (রঃ) আলোচনা থেকে যে কথাগুলো স্পষ্ট বুঝা যায় তা হচ্ছেঃ- (এক) নবীরা সর্বাবস্থায় কুফরী হতে পবিত্র। (দুই) জমহুর উলামাদের মতে তারা ইচ্ছাকৃত কবীরা গুনাহ হতেও পবিত্র। কিন্তু ভুলবশতঃ কবীরা গুনাহ হতে পারে। (তিন) জমহুর উলামাদের মতে নবীদের থেকে ইচ্ছাকৃত ভাবে ছগীরা গুনাহ হতে পারে। (চার) সকল উলামাদের ঐক্যমতে নবীদের থেকে অনিচ্ছাকৃত ভাবে ছগীরা গুনাহ হতে পারে। (পাঁচ) মুসলিম উম্মাহর ইজমা এই যে, নবীগণ ওহী বা নুবুওয়াত লাভের পূর্বে ও পরে কুফরী থেকে সংরক্ষিত। (ছয়) অনুরূপভাবে অধিকাংশের মতে তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে কবীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়া থেকেও মা’সূম। (সাত) হাশাবিয়া সম্প্রদায় এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে। (আট) ইচ্ছাকৃত সগীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়ার বিষয়ে অধিকাংশের মত এই যে,তা সম্ভব। তবে- মুতাযিলী নেতা আল-জুবাঈ ও তাঁর অনুসারীরা এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে বলেছেন নবীগণের জন্য অনিচ্ছাকৃত বা ভুলক্রমে সগীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়া সকলের মতেই সম্ভব, তবে যে সকল সগীরা গোনাহ নীচতা প্রমাণ করে তা তাঁদের দ্বারা সম্ভব নয়,যেমন এক লোকমা খাদ্য চুরি করা,একটি দানা ওজনে কম দেওয়া, ইত্যাদি। আবু আলী মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব আল-জুবাঈ (৩০৩ হি)। তিনি মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের একজন প্রসিদ্ধ আলিম ও নেতা ছিলেন। মু’তাযিলাদের একটি সম্প্রদায়ের বা উপদলের নাম ‘জুবাইয়্যাহ’ যারা তার অনুসারী ছিলেন। (বাগদাদী, আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ. ১৮৩-১৮৪।)
- সগীরা গোনাহের ক্ষেত্রে মুহাক্কিক আলিমগণ শর্ত করেছেন যে,নবীগণকে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তাঁরা তা বর্জন করেন। এ মতভেদ সবই ওহী বা নুবুওয়াত প্রাপ্তির পরের অবস্থার সাথে সম্পর্কিত। নুবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে নবীগণ থেকে কবীরা গোনাহ প্রকাশ পাওয়া অসম্ভব বলে কোনো দলীল নেই।
- মু’তাযিলাগণ মত প্রকাশ করেছেন যে, নুবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বেও নবীগণ কর্তৃক কবীরা গোনাহ সংঘটিত হতে পারে না, কারণ এর ফলে জনগণের মধ্যে তাঁর প্রতি অভক্তি সৃষ্টি হয়,যা তাঁর অনুসরণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, ফলে নবী প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।
সত্য কথা এই যে, যে কর্ম তাঁদের প্রতি অভক্তি সৃষ্টি করে তা তাঁরা করতে পারেন না, যেমন, মাতৃগণের সাথে অনাচার, অশ্লীলতা ও নীচতা জ্ঞাপক সগীরা গোনাহ। শীয়াগণ মনে করেন যে, নবীগণ থেকে নুবুওয়াতের পূর্বে ও পরে কখনোই কোনো সগীরা বা কবীরা গোনাহ প্রকাশিত বা সংঘটিত হতে পারে না। তবে তারা তাকিয়্যাহ বা আত্মরক্ষামূলক ভাবে কুফর প্রকাশ সম্ভব বলেছে।’’( শরহে আকায়ীদে নসাফী পৃঃ ১৩৯-১৪০)।
মোল্লা আলী ক্বারী (রঃ) মোল্লা আলী কারী (রঃ) বলেন, ইবনুল হুমাম বলেছেন- আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অধিকাংশ আলিমের কাছে গ্রহণযোগ্য মত এই যে,নবীগণ কবীরা গোনাহ থেকে সংরক্ষিত, ভুলক্রমে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে একক সগীরা গোনাহ করে ফেলা থেকে সংরক্ষিত নন তাই কর্মের মধ্যে ভুল হওয়া সম্ভব। (মোল্লা আলী কারী- শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃঃ ১০৪-১০৫)। ইমাম আবূ হানীফার এ বক্তব্যের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শাইখ আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ মাগনীসাবী হানাফী‘শারহুল ফিকহিল আকবার’গ্রন্থে বলেন-ثم أشار الإمام الأعظم بقوله "وعبده" إلى فائدتين: أعني تشريف محمد (ﷺ) وحفظ الأمة عن قول النصارى. قال أبو القاسم سليمان الأنصاري: لما وصل محمد ﷺ إلى الدرجات العالية والمراتب الرفيعة في المعارج أوحى الله إليه অর্থাৎ-‘‘ইমাম আযম ‘তাঁর বান্দা’ কথাটি এখানে উল্লেখ করে দুটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন: (১) মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মর্যাদা প্রকাশ এবং (২) খৃস্টানদের মত কথা বলা থেকে উম্মাতকে রক্ষা করা।
আবুল কাসিম সুলাইমান আনসারী ঃ আবুল কাসিম সুলাইমান আনসারী (৫১১ হি) বলেন- যখন মুহাম্মাদ (সাঃ) মিরাজের সময় সুউচ্চ মর্যাদায় উন্নীত হলেন তখন আল্লাহ তাঁর কাছে ওহী প্রেরণ করেন: হে মুহাম্মাদ, তোমাকে কিভাবে মর্য্যাদার আসনে সমাসীন করবো? তিনি বলেন: হে আমার প্রতিপালক, আমাকে আপনার সাথে দাসত্বের সম্পর্কে সম্পর্কিত করে মর্যাদাময় করুন। তখন আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন: ‘‘পবিত্র তিনি যিনি তাঁর দাসকে (বান্দাকে) রজনীযোগে ভ্রমন করিয়েছেন...।’’(সূরা ইসরা (বনী ইসরাঈল) আয়াত ১)। উল্লেখ করা আবশ্যক যে আবুল কাসিম আনসারীর এ বক্তব্য ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রঃ) তাঁর পিতার সূত্রে তাঁর প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। (দ্রঃ তাফসীরে রাযী: মাফাতীহুল গাইব ২০/১১৭।) এজন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: ‘‘খৃস্টানগণ যেরূপ ঈসা ইবনে মরিয়ামকে বাড়িয়ে প্রশংসা করেছে তোমরা সেভাবে আমার বাড়িয়ে প্রশংসা করবে না। আমি তো তাঁর বান্দা মাত্র। অতএব তোমরা বলবে: আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।’’ (বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২৭১, ৬/২৫০৫; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৬/৪৭৮।) মাশারিক গ্রন্থে বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে এ হাদীসের অর্থ মর্ম হলো- যেভাবে খৃস্টানগণ ঈসা (আঃ)-এর প্রশংসায় সীমালঙ্ঘন করে কাফির হয়ে গিয়েছে তোমরা আমার নাত-প্রশংসায় এভাবে সীমালঙ্ঘন করো না। খৃস্টানগণ সীমালঙ্ঘন করে বলেছিল: তিনি আল্লাহর পুত্র। তোমরা আমার সম্পর্কে বল: তিনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল; যেন তোমরা তাদের মত না হও।’’ (ফিকহিল আকবার, পৃষ্ঠা ২২-২৩।)
ইমাম তাহাবী (রঃ) এ বিষয়ে ইমাম ত্বাহাবী (রঃ) বলেছনÑوإِنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ المصطَفى، ونبيُّه المجْتَبى، ورَسُولُهُ المُرْتَضَى وإنَّه خَاتِمُ الأنبياءِ، وإِمَامُ الأتْقِيَاءِ، وسيِّدُ المرسَلينَ، وحَبيبُ ربِّ العالَمين. وكُلُّ دَعْوى النُّبوةِ بَعدَهُ فَغَيٌّ وَهَوى. وَهُو المبعوثُ إلى عَامَّةِ الجِنِّ وكَافَّة الوَرَى بالحقِّ والهدى، وبالنُّور والضِّياء. অর্থাৎ-‘‘নিশ্চয়, মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর মনোনীত বান্দা, তাঁর নির্বাচিত নবী ও তাঁর সন্তোষভাজন রাসূল। তিনি সর্বশেষ নবী, সর্বকালের মুত্তাকীগণের ইমাম,রাসূলগণের নেতা এবং রাব্বুল আলামীনের একান্ত প্রিয়জন। তাঁর পরবর্তীকালে নবুওয়াতের সব দাবী ভ্রান্ত ও প্রবৃত্তিপ্রসূত। তিনি প্রেরিত হয়েছেন সমগ্র জিন ও মানবকুলের প্রতি সত্য, হেদায়ত, নূর ও আলো সহকারে।’’ (আকীদাতুত্বাহাবী পৃ. ৮-৯।)
ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রঃ) ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী তাঁর লিখিত “ইছমাতুল আম্বিয়া” নামক কিতাবে লিখেছেনÑ -والذى نقول: ان الانبياء عليهم الصلوٰة والسلام معصومون في زمان النبوة عن الكبائر واصغائر بالعمد امّا علٰى سبيل السهو فهوجائز - অর্থাৎ এবং আমরা যা বলি তা হচ্ছে যে, আম্বিয়ায়ে কিরাম নবুয়াত প্রাপ্তির সময় থেকে ইচ্ছকৃত কবীরা এবং ছগীরা গুণাহ থেকে পবিত্র। কিন্তু ভুল বশতঃ কবীরা ও ছগীরা গুণাহ হতে পারে। (পৃঃ২৮)। হযরত আদম (আঃ) এর ইছমত সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রঃ) বলেনÑ -وانما قلنا انه كان عاصيا لقوله تعاليٰ (وعصيٰ اٰدمُ ربّه فخويٰ ) وانما قلنا ان العاصي صا حب الكبيرة لوجهين: অর্থাৎ - এবং আমরা বলি যে, তিনি আছী (অবাধ্য) ছিলেন। কারন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন যে, “আদম (আঃ) তার রবের অবাধ্য হন অতঃপর পথ ভ্রষ্ট হন।“ আমরা আ’ছীকে দু’কারণে কবীরা গুনাহগার বলি। (এক) কোরআন শরীফের আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে,আদম (আঃ) শাস্তি প্রাপ্ত ছিলেন কারন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসুলের অবাধ্যতা করবে এবং তার নির্ধারিত সীমা লংঘন করবে তাকে দোজখে প্রবেশ করাবেন এবং ওখানে সে সদা সেখানে থাকবে। আর কবীরা গুনাহগার ঐ ব্যক্তিকেই বলা হয় যে, এমন কাজ করে,যে কাজের উপর তাকে শাস্তি দেওয়া যায়। (দুই) ইছয়ান এমন একটি খারাপ কাজের নাম যা কবীরা গুনাহগার ছাড়া অন্য কারও উপর প্রয়োগ করা হয়না। ( পৃ৩৬)।
আল্লামা আলুসী বোগদাদী (রঃ) ঃ আল্লামা আলুসী বাগদাদী (রঃ) তার বিখ্যাত তাফসীরে রুহুল মা’আনীতে লিখেনঃ-فان الصغائرالفيرا المشهره يا لخسه يحوزصدورها منهم محمدًَا بعدالبعثه عندالحمهور عليٰ مادكره العلامه التفتاراني – الثاني في شرح العقائد ويجوز صدورها سهوًَابا لاتفاق অর্থাৎ-জমহুর (অধিকাংশ) উলামাদের মতানুসারে নবুওয়াত প্রাপ্তির পরও নবীদের থেকে ইচ্ছাকৃত ভাবে ছগীরা গোনাহ হতে পারে। কিন্তু যা ঘৃণিত স্বভাবের পরিচয় দেয় ঐ ধরণের ছগীরা গুনাহ হতে পারেনা। আর অনিচ্ছাকৃত ভাবে ছগীরা সকলের ঐক্যমতে হতে পারে। আল্লামা তাফতাজানীও তার শারহে আকাঈ’দে নাসাফীতে এভাবে উল্লেখ করেছেন। (১৬/২৭৪) আল্লামা আলুসী কোরআন শরীফের আয়াত فعصيٰ اٰدمُ ربّه فغويٰ এর তাফসীর করতে গিয়ে বলেনঃ- طاهرالايٰة يدل عليٰ ان ما وقح منه كان من الكبائر وهو المفهوم من كلام الامام বাহ্যিক ভাবে আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, আদম (আঃ) থেকে যা সংগঠিত হয়েছিল তা কবীরা গুনাহ ছিল। ইমাম ফখরুদ্দীন রাযীর কথা থেকেও এমনটিই বুঝা যায়। (দেখুন পৃষ্ঠা নং ১৬/২৭৪)।
মুতাযিলাদের আক্বীদা ঃ মু’তাযিলাগণ মত প্রকাশ করেছেন যে,নুবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বেও নবীগণ কর্তৃক কবীরা গোনাহ সংঘটিত হতে পারে না; কারণ এর ফলে জনগণের মধ্যে তাঁর প্রতি অভক্তি সৃষ্টি হয়, যা তাঁর অনুসরণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, ফলে নবী প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। আবূ আলী মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব আল-জুবাঈ (৩০৩ হি)।তিনি মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের একজন প্রসিদ্ধ আলিম ও নেতা ছিলেন। মু’তাযিলাদের একটি সম্প্রদায়ের বা উপদলের নাম‘জুবাইয়্যাহ’ যারা তার অনুসারী ছিলেন।(বোগদাদী,আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক,পৃ.১৮৩-১৮৪।)
শিয়াদের আক্বীদা ঃ শিয়াগণ মনে করেন যে,নবীগণ থেকে নুবুওয়াতের পূর্বে ও পরে কখনোই কোনো সগীরা বা কবীরা গোনাহ প্রকাশিত বা সংঘটিত হতে পারে না। তবে তাকিয়্যাহ বা আত্মরক্ষামূলক কুফর প্রকাশ সম্ভব ।
হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী (রঃ)ঃ বয়ানুল কোরআনের লেখক হাকিমুত উম্মত আশরাফ আলী থানবী (রঃ) লিখেছেন লগজিশ বা লগজশ যার অর্থ অনিচ্ছাকৃত ভুল হতে পারে। আল্লাহ তায়ালা কখনো কখনো তাঁর অনুগ্রহ উঠিয়ে নিলে এমনটা হতে পারে। একই কথা মুফতি শফি (রঃ) মাআরিফুল কোরআনেও বলেছেন। আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানীও তাই লিখেছেন। তাফসীরে জালালাইন ও ফতহুল কাদীর সহ সকল তাফসীর গ্রন্থে যেটা লেখা হয়েছে মাওলানা মওদুদীদীও তাই লিখেছেন এবং এখতেলাফটা ফুটিয়ে তুলেছেন। এতে মাওলানা মওদুদীর অপরাধটা কি? পক্ষন্তরে মাওলানা মুফতি তকী উসমানী সাহেব ইসলাহী খুতবাত গ্রন্থের ৬ষ্ট খন্ডের ২২ পৃষ্টায় লিখেছেন হযরত ইউসুফ (আঃ) জুলায়খার দেখানো পাপের প্রভাবিত হয়েছিলেন। আহলুস সুন্নাতের কেউ কেউ অবশ্য নবীদের ক্ষেত্রে ভুল করাও অসম্ভব বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সঠিকতর বা সহীহ কথা এই যে, মানুষ কর্মের মধ্যে ভুল হওয়া সম্ভব।
মুফতি মোহাম্মদ শফী (রঃ) মুফতি মোহাম্মদ শফী (রাহ) তার লিখিত “মাজালিসে হাকীমুল উম্মত” নামক কিতাবে থানবী সাহেবের অভিমত উল্লেখ করে বলেন-"আল্লাহ তায়ালা নবীদেরকে তার নৈকট্যের যে উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন এবং তাদেরকে সমস্ত গুনাহ থেকে পবিত্র রেখেছেন, যেমন এটা তার রহমত ও নিয়ামত, এমনি ভাবে কোন কোন সময় নবীদের থেকে কোন কোন ব্যপারে ভুল ত্রুটি হওয়ার যে ঘটনা সমুহ কোরআন শরীফের মধ্যে উল্লিখিত হয়েছে এগুলোও প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তায়ালার হেকমত ও রহমত। এর মধ্যে এক বড় ফায়দা এটাও যে,মানুষের যেন নবীদের খোদা হোয়ার সন্দেহ না হয়। ভুলত্রুটি হওয়া এবং এর উপর আল্লাহতায়ালার সতর্ক করা এটাই পরিষ্কার করে দেয় যে, নবীরাও আল্লাহ তায়ালার বান্দাহ"। (পৃষ্ঠা ৬৫)
আমাদের কথাঃ সম্মানিত পাঠক বৃন্দ ঃ হযরত থানবী (রঃ) এর কথা গুলো মাওলানা মওদূদী (রাহ) এর কথা গুলোর সাথে মিলিয়ে দেখুন শব্দ ও অর্থগত দিক দিয়ে প্রায় মিলে যাচ্ছে। আমরা উল্লেখিত আলোচনা থেকে যে কথা গুলো স্পষ্টতঃ জানতে পারলাম সেগুলো হচ্ছে- (এক) আহলে সুন্নত ওয়াল জামা’য়াতের সকল উলামায়ে কেরাম এ কথার উপর একমত যে, নবীদের থেকে অনিচ্ছাকৃত ভাবে ছগীরা গুনাহ হতে পারে। (দুই) জমহুর উলামাদের মতানুসারে নবীদের থেকে ইচ্ছকৃতভাবেও ছগীরা গুনাহ হতে পারে। (তিন) জমহুর উলামাদের মতানুসারে নবীদের থেকে অনিচ্ছাকৃতভাবে কবীরা গুনাহ হতে পারে।
শায়খ আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ মাগনীসাবী (রঃ) ইমাম আবূ হানীফার (রঃ) এ বক্তব্যের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শাইখ আহমদ ইবন মুহাম্মাদ মাগনীসাবী হানাফী ‘শারহুল ফিকহিল আকবার’ গ্রন্থে বলেন: ثم أشار الإمام الأعظم بقوله "وعبده" إلى فائدتين: أعني تشريف محمد (ﷺ) وحفظ الأمة عن قول النصارى. قال أبو القاسم سليمان الأنصاري: لما وصل محمد ﷺ إلى الدرجات العالية والمراتب الرفيعة في المعارج أوحى الله إليه: يا محمد بمَ أشرِّفك؟ قال: يا رب بنسبتي إلى نفسك (إليك) بالعبودية، فأنزل فيه "سبحان الذي أسرى بعبده ليلاً"، فقال ﷺ: "لا تطروني كما أطري عيسى بن مريم، وقولوا: عبد الله ورسوله. كذا في المشارق. أي لا تتجاوزوا عن الحد في مدحي كما بالغ النصارى في مدح عيسى عليه السلام حتى كفروا فقالوا إنه ابن الله، وقولوا في حقي: إنه عبد الله ورسوله، حتى لا تكونوا أمثالهم". ‘‘ইমাম আযম ‘তাঁর বান্দা’ কথাটি এখানে উল্লেখ করে দুটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন: (১) মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মর্যাদা প্রকাশ এবং (২) খৃস্টানদের মত কথা বলা থেকে উম্মাতকে রক্ষা করা। আবুল কাসিম সুলাইমান আনসারী (৫১১ হি) বলেন-যখন মুহাম্মাদ (সাঃ) মিরাজের সময় সুউচ্চ মর্যাদায় উন্নীত হলেন তখন আল্লাহ তাঁর কাছে ওহী প্রেরণ করেন: হে মুহাম্মাদ, তোমাকে কিভাবে মর্যাদাম--ত করব? তিনি বলেন: হে আমার প্রতিপালক, আমাকে আপনার সাথে দাসত্বের সম্পর্কে সম্পর্কিত করে মর্যাদাময় করুন। তখন আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন: ‘‘পবিত্র তিনি যিনি তাঁর দাসকে (বান্দাকে) রজনীযোগে ভ্রমন করিয়েছেন...।’’এজন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: ‘‘খৃস্টানগণ যেরূপ ঈসা ইবনে মরিয়মকে বাড়িয়ে প্রশংসা করেছে তোমরা সেভাবে আমার বাড়িয়ে প্রশংসা করবে না। আমি তো তাঁর বান্দা মাত্র। অতএব তোমরা বলবে: আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।’’ মাশারিক গ্রন্থে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এ হাদীসের অর্থ: যেভাবে খৃস্টানগণ ঈসা (আঃ)-এর প্রশংসায় সীমালঙ্ঘন করে কাফির হয়ে গিয়েছে তোমরা আমার নাত-প্রশংসায় এভাবে সীমালঙ্ঘন করো না। খৃস্টানগণ সীমালঙ্ঘন করে বলেছিল: তিনি আল্লাহর পুত্র। তোমরা আমার সম্পর্কে বল: তিনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল; যেন তোমরা তাদের মত না হও।’’ (দ্রঃ-মাগনীসাবী,শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃষ্ঠা ২২-২৩। তাফসীর রাযী: মাফাতীহুল গাইব ২০/১১৭। সূরা ইসরা (বনী ইসরাঈল)। বুখারী, ৩/১২৭১, ৬/২৫০৫; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৬/৪৭৮।
আল্লামা দিলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (রঃ) বিশ্ববরেণ্য মুফাসসীরে কোরআন শহীদ আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী (রঃ) অত্যন্ত সুক্ষè একটি গভীর পান্ডিত্্যপূর্ণ কথা বলেছেন যে আল্লাহ তায়ালা আম্বিয়ায়ে কেরামকে আলমে আরওয়াহতে নবী হিসাবেই মনোনিত করেছেন এবং নবুওতির চরিত্র দিয়েই আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে প্রেরণ করেন। এ জন্যই আম্বিয়ায়ে কেরাম মাসুম বা বে গোনাহ নিস্পাপ।
ইসমতে আম্বিয়া সম্পর্কে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার (রঃ) ব্যাখ্যা
- নবীগণ রেসালতের দায়িত্ব পালনে ভুলের উর্দ্ধে # নবী-রাসুলগণ কবীরা গোনাহ থেকে মুক্ত এবং অপছন্দীয় ছগীরা গোনাহ থেকেও # অনিচ্ছাকৃত ভুল বা ছগীরা গোনাহর উপর স্থির থাকেন না। # তওবা করার নবীগনের বৈশীষ্ট।
অধিকাংশ আলেম যেখানে বলেছেন, নবীদের দ্বারা সগীরা গুনাহ হতে পারে, তাদের কথার উদ্দেশ্য হলো নবীগণের দ্বারা সগীরা গুনাহ হলেও তারা তার উপর অটল ও স্থির থাকেন না, বরং তওবা করেন। সুতরাং এতে তারা নবীদেরকে পূর্ণতার গুণাবলী ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা বিশেষিত করেন নি। কেননা সর্বশেষ আমলগুলোই ধর্তব্য। যারা বলে নবীগণ ছগীরা কিংবা কবীরা,কোনো গোনাহই করতে পারে না, তাদের কথা থেকে আবশ্যক হয় যে, নবীগণ তওবা করেন না.....। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ)
নবী-রসূলগণ গুনাহ থেকে পবিত্র কি না ঃ নবী-রসূলগণ গুনাহ ও পাপাচার থেকে পবিত্র কি না,এ মাসআলায় শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) আলেমদের মতভেদ বর্ণনা করার পর প্রাধান্যপ্রাপ্ত মতটি উল্লেখ করে বলেন, আলেমদের ঐক্যমতে নবীগণ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে সংবাদ দেয়া এবং রেসালাতের তাবলীগ করার ব্যাপারে মাসুম (দোষ-ত্রুটিমুক্ত)। তাই আল্লাহর পক্ষ হতে তারা যেসব সংবাদ প্রদান করেছেন, একবাক্যে তার প্রতি বিশ্বাস করা আবশ্যক। যেমন আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন-قُولُوا آمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنزِلَ إِلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَىٰ وَعِيسَىٰ وَمَا أُوتِيَ النَّبِيُّونَ مِن رَّبِّهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ فَإِنْ آمَنُوا بِمِثْلِ مَا آمَنتُم بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوا وَّإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللَّهُ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ অর্থাৎ- তামরা বলো, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি, আমাদের জন্য যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি এবং যা ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও ইয়াকুবের সন্তানদের প্রতি যা নাযিল হয়েছিল তার প্রতি, মূসা, ঈসা এবং অন্যান্য নবীদেরকে তাদের রবের পক্ষ হতে যা দেয়া হয়েছে তার প্রতি। আমরা কারোর মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না। আমরা সবাই আল্লাহর অনুগত মুসলিম। তোমরা যেরূপ ঈমান এনেছো তারাও যদি সেরূপ ঈমান আনে, তাহলে নিশ্চয় তারা সুপথ পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তারা নিশ্চয়ই বিরুদ্ধচারিতায় লিপ্ত। কাজেই তাদের মোকাবিলায় তোমাদের সহায়তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’’। (সূরা বাকারা: ১৩৬-১৩৭) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ অর্থাৎ- তামাদের মুখমন্ডল পূর্ব বা পশ্চিম দিকে ফিরানোর মধ্যে কোনো ছাওয়াব নেই, বরং পূণ্য তার, যে ব্যক্তি আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে’’। (সূরা বাকারা: ১৭৭) আল্লাহ তা‘আলা আরো আরো এরশাদ ফরমান-آَمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آَمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ لا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ অর্থাৎ- ‘‘রসূল তাঁর রবের পক্ষ থেকে তার উপর যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছে। মুমিনগণও তাঁর প্রতি ঈমান এনেছে। তারা সবাই আল্লাহকে, তার ফেরেশতাদেরকে, তার কিতাবসমূহকে ও তার রসূলদেরকে বিশ্বাস করেছে এবং তাদের বক্তব্য হচ্ছে, আমরা আল্লাহর রসূলদের একজনকে অন্যজন থেকে আলাদা করি না। আর তারা বলেন, আমরা নির্দেশ শুনেছি এবং অনুগত হয়েছি। হে আমাদের প্রভু! আমরা গুনাহ মাফের জন্য তোমার কাছে প্রার্থনা করছি। আমরা তোমারই দিকে ফিরে যাবো’’। (সূরা বাকারা: ২৮৫)
রিসালাতের উদ্দেশ্য মাসুম হওয়ার মাধ্যমেই অর্জিত হয় ঃ নবুওয়াত ও রিসালাতের উদ্দেশ্য মাসুম হওয়ার মাধ্যমেই অর্জিত হয়। কেননা নবী হলেন আল্লাহর পক্ষ হতে সংবাদ প্রদানকারী। আর আল্লাহ তায়া’লা যাকে রিসালাতের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন, তিনিই হলেন রসূল। সে হিসাবে প্রত্যেক রসূলই নবী, কিন্তু প্রত্যেক নবী রসূল নন। তারা আল্লাহ তা‘য়ালার পক্ষ হতে যা পৌঁছিয়ে দেন সে বিষয়ে তাদের নির্দোষিতা সুসাব্যস্থ। মুসলিমদের ঐক্যমতে এ ব্যাপারে ভুল হওয়া সম্ভব নয়।
নবীগণ ভুলত্রæটি থেকে পবিত্র কি নাা ঃ শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ) আরো বলেন, রিসালাতের তাবলীগ সম্পর্কিত বিষয় ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে নবীগণ ভুল-ত্রুটি থেকে পবিত্র কি না, এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তাদের পবিত্র হওয়ার বিষয়টি কি বিবেক-বুদ্ধির দলীল দ্বারা সাব্যস্ত ? না কি শরীয়তের দলীল দ্বারা সাব্যস্থ ? তারা আরো মতভেদ করেছেন যে, তারা কি কবীরা ও ছগীরা উভয় প্রকার গুনাহ থেকে পবিত্র? না কি কতক গুনাহ থেকে পবিত্র? না কি গুনাহর উপর স্থির থাকা হতে পবিত্র? না কি মূলতই গুনাহ করা থেকে পবিত্র? না কি আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে তারা যার তাবলীগ করেন সে ক্ষেত্রেই তারা ভুল-ভ্রান্তি থেকে পবিত্র? এমন কি নবুওয়াত প্রাপ্তির পর্বেও কুফুরী ও পাপাচার হতে তাদের পবিত্র হওয়া আবশ্যক কি না? -এ ব্যাপারেও আলেমগণ মতভেদ করেছেন।
নবী-রসূলগণ গোনাহর উপর স্থির থাকা থেকে পবিত্র ঃ অধিকাংশ আলেমের মতে নবী-রসূলগণ সর্বপ্রকার গোনাহর উপর স্থির থাকা থেকে পবিত্র। আলেমগণ ঐসব লোকের প্রতিবাদ করেছেন, যাদের মতে গুনাহর উপর নবী-রসূলদের স্থির থাকা সম্ভব। গুনাহর উপর নবীগণ স্থির থাকেন না, এমতটিই সালাফদের উক্তিসমূহ দ্বারা সমর্থিত। নবীগণ গুনাহর উপর স্থির থাকা হতে পবিত্র মর্মে মত পোষণকারীদের দলীলগুলো একত্রিত করলে প্রমাণিত হয় যে, তাদের কথাই সঠিক। আর যারা বলেছে, তারা গুনাহ থেকে পবিত্র নন তাদের দলীলগুলো সাব্যস্ত করে না যে, নবী-রসূলগণ গুনাহর উপর স্থির থাকতে পারেন। আর যাদের মতে নবীগণের দ্বারা গুনাহর কাজ হতেই পারে না, তাদের দলীল হলো নবীগণকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা জরুরী। তাদের কাজ-কর্মগুলোকে গুনাহ হিসাবে সাব্যস্ত করা হলে তাদেরকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা বৈধ নয়। আর এটি জানা কথা যে, নবীগণ যার উপর স্থির থাকেন এবং যা সাব্যস্ত করেন কেবল তাতেই তাদেরকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা বৈধ। যা থেকে তারা নিষেধ করেছেন কিংবা যা থেকে তারা ফিরে এসেছেন, তাতে তাদেরকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা বৈধ নয়। যেমন ঐসব আদেশ-নিষেধের ক্ষেত্রেই তাদের আনুগত্য করা আবশ্যক, যা রহিত করা হয়নি। সুতরাং যেসব আদেশ-নিষেধ রহিত করা হয়েছে, তার অনুসরণ করা তো দূরের কথা, সেগুলোকে পরবর্তীতে আদেশ বা নিষেধ হিসাবে গণ্য করা বৈধ নয়।
নবীগণ (আঃ) থেকে পাপাচার জঘন্য ব্যাপার ঃ নবীগণের পক্ষ হতে গোনাহর কাজ হওয়া অসম্ভব হওয়ার পক্ষে মত প্রকাশকারীদের আরেকটি দলীল হলো, তারা বলেন নবীদের মধ্যে পূর্ণতার গুণাবলী থাকা আবশ্যক। আর পাপাচার পূর্ণতার পরিপন্থি অথবা যাকে নবুওয়াতের মত বিরাট নিয়ামত দেয়া হয়েছে, তার থেকে পাপাচার প্রকাশিত হওয়া খুবই জঘন্য ব্যাপার অথবা বলা যায় যে, পাপাচারের কারণে মানুষ নবীদের থেকে দূরে সরে যেতে পারে বিধায় তাদের থেকে পাপাচার হওয়া মোটেই বৈধ নয়। তারা এমনি আরো আকলী বিবেক-বুদ্ধি প্রসূত দলীল পেশ করেছেন। আমরা তাদের জবাবে বলবো যে, গুনাহর উপর অটল থাকলে এবং তা থেকে ফিরে এসে তাওবা না করলে উপরোক্ত কথা ঠিক আছে। কিন্তু খাটি তাওবা করলে আল্লাহ তায়ালা যেহেতু তওবা কবুল করেন, তাই তাওবাকারীর মর্যাদা আল্লাহ তা‘য়ালার আগের চেয়ে আরো বাড়িয়ে দেন। যেমন কোনো কোনো সালাফ বলেছেন, দাউদ আলাইহিস সালাম তাওবা করার পর গুনাহ করার পূর্বের চেয়ে ভালো হয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন, তাওবা করা যদি আল্লাহ তায়ালার কাছে সর্বাধিক প্রিয় না হতো, তাহলে আল্লাহ তা‘আলার সর্বাধিক সম্মানিত বান্দা নবী-রসূলগণকে গুনাহ করার ফিতনায় ফেলতেন না।
নবীগণ (আঃ) কবীরা গোনাহ থেকে মাসুম ঃ শাইখুল ইসলাম (রঃ) আরো বলেন, কুরআন,সহীহ হাদীছ এবং কুরআনের পূর্বে যেসব আসমানী কিতাব নাযিল করা হয়েছে, তাতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, নবীগণ কবীরা গুনাহ থেকে মাসুম। কিন্তু তাদের পক্ষ হতে সগীরা গুনাহ হওয়া সম্ভব। কুরআন, সুন্নাহ এবং পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহে এ মতের সমর্থনে বর্ণিত দলীলসমূহ গণনা করে শেষ করা যাবে না। আর যারা বলেন যে, নবীগণ কবীরা ও সগীরা উভয় প্রকার গুনাহ থেকে সম্পূর্ণ রূপে নিষ্পাপ তারা জাহমীয়া, কাদরীয়া এবং দাহরীয়া সম্প্রদায়ের ন্যায় আল্লাহ তা‘য়ালার অতি সুন্দর নাম, সুউচ্চ গুনাবলী, তাক্বদীর এবং পুনরুত্থান দিবস সংক্রান্ত বক্তব্যগুলোর তাবীল করেছে। এগুলো কারামেতা বাতেনী সম্প্রদায়ের তাবীলের মতই, যা বিবেক-বুদ্ধির দলীল-প্রমাণ দ্বারা বাতিল প্রমাণিত হয় এবং এগুলো কুরআন-হাদীছের বক্তব্যকে নিজ স্থান থেকে সরিয়ে ফেলার শামিল। এদের কেউ কেউ নবীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে তাদেরকে মিথ্যায়ন করে ফেলে এবং তাদের প্রতি ঈমান আনয়ন করতে গিয়ে তাদের প্রতি কুফুরীতে লিপ্ত হয়।
আমরা নবীদের ইসমতের কথা উপরে উল্লেখ করেছি, তা কেবল আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাবলীগ করার ক্ষেত্রেই। আর এটি শরীয়তের দলীল, বিবেক-বুদ্ধির দলীল এবং ইজমা দ্বারা সাব্যস্থ। নবীগণ যেসব বিষয়ের তাবলীগ করেছেন, তারা যদি তার স্বীকৃতি প্রদান না করে এবং সেটার উপর সন্তুষ্ট না থাকে, তাহলে নবীদের রেসালত দ্বারা তারা মোটেই উপকৃত হবে না। কিন্তু তারা কেবল কুরআনের ঐসব বাক্য বুঝার চেষ্টা করে, যার অর্থ থেকে তারা মাহরুম হয়েছে অথবা তারা তাদের ঐসব মূর্খ লোকদের মতোই, যারা শুধু ধারণা ব্যতীত কিতাবের আর কোনো জ্ঞান রাখে না। যারা দাবি করে যে নবীগণ কবীরা ও সগীরা উভয় প্রকার গুনাহ থেকে পবিত্র, এ ক্ষেত্রে তাদের কথা যদি সঠিক হয়েও থাকে, তথাপিও তা দ্বারা উপকৃত হতে পারেনি। কেননা তাদের মতে নবীগণের রিসালাতের প্রতি তাদের কোনো প্রয়োজন নেই। রিসালাতের বিষয়টি যেহেতু তাদের ব্যতীত অন্যদের সাথে সম্পৃক্ত, তাই তাতে নাক গলানো তাদের উচিত নয়। মোটকথা তাদের কেউ আল্লাহর পক্ষ হতে বিনা দলীলেই নবীদের ব্যাপারে কথা বলে এবং নবীদের প্রতি সত্যায়ন ও তাদের আনুগত্য সম্পর্কিত ওয়াজিব বিষয়কে পরিহার করে। অথচ তাদের প্রতি ঈমান ও আনুগত্যই সৌভাগ্য অর্জনের মাধ্যম এবং এর বিপরীত করার মধ্যেই রয়েছে দুর্ভাগ্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, فَإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُم مَّا حُمِّلْتُمْ ‘‘কিন্তু তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও। তাহলে জেনে রাখো যে, রসূলের উপর যে দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সে জন্য রসূল দায়ী এবং তোমাদের উপর যে দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সে জন্য তোমরাই দায়ী’’। (সূরা আন নূর: ৫৪)
তওবাঃ সঃজ্ঞা ফজিলত ও তাৎপর্য্য
তওবার ফজিলত ঃ তওবার ব্যাপারে সহীহ হাদীছে এসেছে, নবী (সাঃ) ্রلَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ حِينَ يَتُوبُ إِلَيْهِ مِنْ أَحَدِكُمْ كَانَ عَلَى رَاحِلَتِهِ بِأَرْضِ فَلَاةٍ فَانْفَلَتَتْ مِنْهُ وَعَلَيْهَا طَعَامُهُ وَشَرَابُهُ فَأَيِسَ مِنْهَا فَأَتَى شَجَرَةً فَاضْطَجَعَ فِي ظِلِّهَا قَدْ أَيِسَ مِنْ رَاحِلَتِهِ فَبَيْنَا هُوَ كَذَلِكَ إِذَا هُوَ بِهَا قَائِمَةً عِنْدَهُ فَأَخَذَ بِخِطَامِهَا ثُمَّ قَالَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ اللَّهُمَّ أَنْتَ عَبْدِي وَأَنَا رَبُّكَ أَخْطَأَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ ‘‘বান্দা যখন আল্লাহর কাছে তাওবা করে, তখন তিনি তোমাদের ঐ ব্যক্তির চেয়েও অধিক খুশি হন, যে তার বাহনে আরোহন করে সফরে বের হলো। বাহনের উপরেই ছিল তার খাদ্য-পানীয় ও সফর সামগ্রী। মরুভূমির উপর দিয়ে সফর করার সময় বিশ্রামার্থে সে একটি বৃক্ষের নীচে অবতরণ করল। অতঃপর মাটিতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে দেখল তার বাহন কোথায় যেন চলে গেছে। সে নিরাশ হয়ে একটি গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর সে দেখতে পেলো, তার হারানো বাহনটি সমুদয় খাদ্য-পানীয়সহ মাথার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বাহনটির লাগাম ধরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে উঠলো, হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা, আমি তোমার প্রভু। অতি আনন্দের কারণেই সে এত বড় ভুল করে বসেছে।
তওবাকারীদের শাস্তি স্পর্শ করবেনা ঃ গোনাহকারীদের ব্যাপারে যেসব শাস্তির কথা বলা হয়েছে, তাওবাকারীগণকে তা স্পর্শ করতে পারবে না। সে যদি দ্রæত তওবা করে, তাহলে তার কোনো শাস্তি হবে না। কিন্তু তওবা করতে দেরী করলে গোনাহ করার পর থেকে তাওবা করার পূর্ব পর্যন্ত— তার অবস্থা অনুপাতে দোষারোপ ও শাস্তির সম্মুখীন হবে। নবীগণ তাওবা করতে বিলম্ব করতেন না। বরং দ্রæত তওবা করতেন, দেরী করতেন না এবং গোনাহর উপর স্থিরও থাকতেন না। তার গোনাহর উপর স্থির থাকা হতে সম্পূর্ণ পবিত্র। আর তাদের কেউ যদি তওবা করতে সামান্য বিলম্ব করেন, তাহলে মুছীবতে নিপতিত করে তার গুনাহকে মোচন করে দেন। যেমন করা হয়েছিল ইউনুস’র (আঃ) ক্ষেত্রে। প্রসিদ্ধ মতে নবুওয়াত প্রাপ্তির পরই তাকে পানিতে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। যারা বলেন নবুওয়াত পাওয়ার পূর্বে তাকে পানিতে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, তারা এ আলোচনার প্রতি মুখাপেক্ষী নয়। কুফুরী ও পাপাচার থেকে তাওবাকারী কখনো ঐ ব্যক্তি থেকে উত্তম হতে পারে,যে কুফুরী ও পাপাচারে একদম লিপ্ত হয়নি। গোনাহকারী যেহেতু নিষ্পাপ ব্যক্তি থেকে কখনো উত্তম হয়, তাই উত্তম ব্যক্তি নবুওয়াতের জন্য তার চেয়ে অধিক যোগ্য, যে ফযীলতের ক্ষেত্রে তার সমান নয়। আল্লাহ তা‘য়ালা ইউসুফের ভাইদের গুনাহর কথা কুরআনে উল্লেখ করেছেন। তারা ছিলেন নবীদের বংশের লোক।
তাক্বওয়া অবলম্বনকারীরা শয়তানের কু মন্ত্রণায় সতর্ক হয়ে যান ঃ আল্লাহ তায়ালা বলেন, إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُمْ مُبْصِرُونَ‘‘যারা তাকওয়ার পথ অবলম্বন করে তাদেরকে শয়তান যখন কুমন্ত্রণা দেয়, তখনই সতর্ক হয়ে যায় এবং তৎক্ষণাৎ তাদের চক্ষু খুলে যায়’’। (আরাফ: ২০১) শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ) বলেন, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে ঐসব লোকের সন্দেহের জবাব সুস্পষ্ট হলো, যারা বলে নবুওয়াতের পূর্বে গোনাহ থেকে পবিত্র না থাকলে আল্লাহ তায়ালা কাউকে নবী বানিয়ে পাঠান না। রাফেযী এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ও অনুরূপ কথা বলে থাকে। সেই সঙ্গে ঐসব লোকের জবাব সুস্পষ্ট হয়েছে, যারা বলেন যারা নবুওয়াতের পূর্বে ঈমানদার থাকে, আল্লাহ তায়ালা কেবল তাদেরকেই নবী হিসাবে প্রেরণ করেন। এ শ্রেণীর লোকেরা ধারণা করেন যে, গোনাহ থেকে তওবা করলেও সেটা বান্দার মর্যাদা কমিয়ে ফেলে। এটি তাদের ভুল ধারণা। সুতরাং যারা মনে করবেন যে, খাঁটি তওবা করার পরও গোনাহকারীর অসম্পূর্ণতা থেকে যায়, তারা বিরাট ভুলের মধ্যে রয়েছে।
প্রত্যেকের জন্যই তওবা করা আবশ্যক ঃ সুতরাং জানা গেল যে, শেষে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হওয়াই মূল্যায়নযোগ্য; শুরুতে অপূর্ণতা মূল্যায়নের বিষয় নয়। প্রত্যেক বান্দারই তওবা করা আবশ্যক। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্যই তাওবা করা আবশ্যক। আল্লাহ তায়ালা বলেন-لِّيُعَذِّبَ اللَّهُ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْمُشْرِكِينَ وَالْمُشْرِكَاتِ وَيَتُوبَ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا ‘‘পরিণামে আল্লাহ মুনাফেক পুরুষ, মুনাফেক নারী, মুশরেক পুরুষ ও মুশরেক নারীদেরকে শাস্তি দেবেন এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের তওবা কবুল করবেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়’’। (সূরা আহযাব: ৭৩) আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল করীমের যেখানেই কোনো নবী থেকে ভুল-ভ্রান্তি হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন, সেখানেই তার পক্ষ হতে তাওবা-ইসেত্মগফারের কথাও উল্লেখ করেছেন।
আম্বিয়া এ কেরামের দোয়া ইস্তেগফারঃ
হযরত আদম (আঃ) এর দোয়া:
আদম ও তার স্ত্রী হাওয়া (আঃ) দোয়াতে বলেছেন-رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের উপর যুলুম করেছি। তুমি যদি আমাদের ক্ষমা না করো এবং আমাদের প্রতি রহম না করো, তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যাবো’’। (সূরা আরাফ: ২৩)
হযরত নূহ (আঃ) এর দোয়া ঃ হযরত নূহ (আঃ) দোয়ায় বলেছিলেনÑ رَبِّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أَسْأَلَكَ مَا لَيْسَ لِي بِهِ عِلْمٌ وَإِلَّا تَغْفِرْ لِي وَتَرْحَمْنِي أَكُن مِّنَ الْخَاسِرِينَ হে আমার রব! যে সম্পর্কে আমার জ্ঞান নেই তা তোমার কাছে চাইবো, এ থেকে আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। তুমি যদি আমাকে মাফ না করো এবং আমার প্রতি রহম না করো তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে শামিল হয়ে যাবো’’। (সূরা হুদ: ৪৭) ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালাম তার দোয়ায় বলেছেনÑرَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ হে আমাদের রব! যেদিন হিসাব কায়েম হবে সেদিন আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং সমস্ত মুমিনদেরকে মাফ করে দিয়ো’’। (সূরা ইবরাহীম: ৪১) আল্লাহ তায়ালা তাঁর সম্পর্কে আরো বলেন যে তিনি বলেছেন-وَالَّذِي أَطْمَعُ أَن يَغْفِرَ لِي خَطِيئَتِي يَوْمَ الدِّينِ ‘‘আর তার কাছে আমি আশা করি, প্রতিদান দিবসে তিনি আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন’’। (সূরা শুআরা: ৮২)
মূসা (আঃ) এর দোয়া ঃ হযরত মুসা (আঃ) এই বলে দোয়া করেছিলেন যে-أَنتَ وَلِيُّنَا فَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا وَأَنتَ خَيْرُ الْغَافِرِينَ وَاكْتُبْ لَنَا فِي هَٰذِهِ الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ إِنَّا هُدْنَا إِلَيْكَ‘‘তুমিই তো আমাদের অভিভাবক। কাজেই আমাদের মাফ করে দাও এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করো। ক্ষমাশীলদের মধ্যে তুমিই শ্রেষ্ঠ। আর আমাদের জন্য এ দুনিয়ায় কল্যাণ লিখে দাও এবং আখিরাতেও। আমরা তোমার দিকে ফিরেছি’’। (সূরা আরাফ: ১৫৫) মূসা (আঃ) তাঁর দোয়য় আরো বলেছেন رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي فَغَفَرَ لَهُ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ ”হে আমার রব! আমি নিজের উপর যুলুম করেছি, আমাকে ক্ষমা করে দাও। তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন। তিনি ক্ষমাশীল মেহেরবান’’। (সূরা কাসাস: ১৬) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন-فَلَمَّا أَفَاقَ قَالَ سُبْحَانَكَ تُبْتُ إِلَيْكَ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُؤْمِنِينَ ‘‘অতঃপর যখন সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে মূসা বললো: আমি তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আমি তোমার কাছে তাওবা করছি এবং আমিই সর্বপ্রথম মুমিন’’। (আরাফ: ১৪৩)
দাউদ (আঃ) এর তওবা ঃ--- দাউদ (আঃ) এর তওবা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন-فَاسْتَغْفَرَ رَبَّهُ وَخَرَّ رَاكِعًا وَأَنَابَ فَغَفَرْنَا لَهُ ذَٰلِكَ وَإِنَّ لَهُ عِندَنَا لَزُلْفَىٰ وَحُسْنَ مَآبٍ ‘‘অতঃপর সে নিজের রবের কাছে ক্ষমা চাইলো এবং সিজদায় লুটিয়ে পড়লো এবং তার অভিমুখী হলো। তখন আমি তার ত্রুটি ক্ষমা করে দিলাম এবং নিশ্চয় আমার কাছে তার জন্য রয়েছে উচ্চ মর্যাদা ও শুভ পরিণাম’’। (সূরা সোয়াদ: ২৪-২৫) আল্লাহ তায়াালা আরো বলেন, قَالَ رَبِّ اغْفِرْ لِي وَهَبْ لِي مُلْكًا لَّا يَنبَغِي لِأَحَدٍ مِّن بَعْدِي إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ ‘সে বললো, হে আমার রব! আমাকে মাফ করে দাও এবং আমাকে এমন রাজত্ব দান করো যার অধিকারী আমার পরে অন্য কেউ হতে পারবেনা; নিশ্চয় তুমি মহাদাতা’’। (সূরা সোয়াদ: ৩৫)
ইউসুফ (আঃ) এর ঘটনা ঃ আল্লাহ তা‘য়ালা কুরআনে ইউসুফ (আঃ) এর কোনো গোনাহর কথা উল্লেখ করেন নি। এ জন্যই আল্লাহ তায়ালা তার ব্যাপারে গোনাহর জন্য উপযুক্ত কোনো তওবার কথা উল্লেখ করেন নি। বরং শুধু এতটুকু বলেছেন যে-كَذَٰلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاءَ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِينَ ‘‘মন্দকাজ ও অশ্লীলতা থেকে দূর রাখার জন্য এভাবে তাকে আমার নিদর্শন দেখিয়েছিলাম। তিনি ছিলেন আমার একনিষ্ঠ বান্দাহদের অন্তর্ভুক্ত’’। (সূরা ইউসুফ: ২৪) মর্ম হলো আল্লাহ তা‘য়ালা এখানে সংবাদ দিয়েছেন যে,তিনি তার থেকে মন্দকাজ ও অশ্লীলতা প্রতিহত করেছেন। এ কথা প্রমাণ করে যে, তার থেকে কোনো পাপাচার ও অশ্লীলতা প্রকাশিত হয়নি। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘য়ালার ঘোষণা হলোÑ وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا لَوْلَا أَن رَّأَىٰ بُرْهَانَ رَبِّهِ ‘‘মহিলাটি তার প্রতি আসক্ত হয়েছিল এবং ইউসুফও তার প্রতি আসক্ত হয়ে যেতো, যদি না তার রবের নিদর্শন প্রত্যক্ষ করতো’’। (সূরা ইউসুফ: ২৪) এখানে الهم শব্দটি এমন ইসমে জিনস বা শ্রেণীবাচক বিশেষ্য, যার অধীনে দু’টি প্রকার রয়েছে। যেমন ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ) বলেন, الهم দুই প্রকার। (১) মনের কল্পনা ও (২) সুদৃঢ় সংকল্প। সহীহ বুখারীতে আছে নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ্রإن العبد إذا هَمَّ بِسَيِّئَةٍ لم تكتب عليه وإذا تركها كتبت له حسنة وإن عملها كتبت له سيئة واحدة وإن تركها من غير أن يتركها لله لم تكتب له حَسَنَةً ولا سَيِّئَةًগ্ধ (بخارى:৬৪৯১ অর্থাৎ‘‘বান্দাহ পাপ কাজের ইচ্ছা করলেই গুনাহ লেখা হয় না। আর তা করার ইচ্ছা করার পর পরিত্যাগ করলে তাতে আল্লাহ তার জন্য একটি নেকী লিখে দেন। আর যদি সংকল্প করার পর তা বাস্তবে পরিণত করে, তাহলে মাত্র একটি গোনাহ লেখা হয়। আর যদি পাপ কাজটি ছেড়ে দেয় ঠিকই; কিন্তু আল্লাহর জন্য ছেড়ে দেয় না, তাতে তার জন্য নেকী লেখা হয় না, গোনাহও লেখা হয় না। ইউসুফ (আঃ) লাইহিস মনে মনে এমন চিন্তা করেছিলেন, যা তিনি আল্লাহর জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। এ জন্যই আল্লাহ তায়ালা এখলাসের কারণে তার থেকে মন্দ কাজ ও অশ্লীলতা দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। এমনটি তখনই হয়ে থাকে, যখন গোনাহর প্রতি আহবানকারী খারাপ চিন্তা মনের মধ্যে জাগ্রত হয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে এবং আল্লাহর জন্য অন্তরের এখলাস সেটার প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়ায়। ইউসুফ (আঃ) থেকে কেবল ছাওয়াব পাওয়ার যোগ্য সৎকর্মই সংঘটিত হয়েছিল।
লুত (আঃ) এর ঘটনা আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন-فَآَمَنَ لَهُ لُوطٌ وَقَالَ إِنِّي مُهَاجِرٌ إِلَى رَبِّي إِنَّهُ هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ‘‘অতঃপর ইবরাহীমের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলেন লুত। ইবরাহীম বললেন, আমি আমার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করছি। নিশ্চয় তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’’। (সূরা আনকাবুত: ২৬) লুত (আঃ) প্রথমে ইবরাহীম (আঃ) এর প্রতি ঈমান আনয়ন করলেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘য়ালা তাকে রসূল বানিয়ে তার জাতির নিকট প্রেরণ করলেন।
শোয়াইব (আঃ) এর ঘটনা ঃ শোয়াইব (আঃ) এর ঘটনায় আল্লাহ তায়লা বলেন, قَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا مِن قَوْمِهِ لَنُخْرِجَنَّكَ يَا شُعَيْبُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَكَ مِن قَرْيَتِنَا أَوْ لَتَعُودُنَّ فِي مِلَّتِنَا قَالَ أَوَلَوْ كُنَّا كَارِهِينَ قَدِ افْتَرَيْنَا عَلَى اللَّهِ كَذِبًا إِنْ عُدْنَا فِي مِلَّتِكُم بَعْدَ إِذْ نَجَّانَا اللَّهُ مِنْهَا وَمَا يَكُونُ لَنَا أَن نَّعُودَ فِيهَا إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّنَا وَسِعَ رَبُّنَا كُلَّ شَيْءٍ عِلْمًا عَلَى اللَّهِ تَوَكَّلْنَا رَبَّنَا افْتَحْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ قَوْمِنَا بِالْحَقِّ وَأَنتَ خَيْرُ الْفَاتِحِينَ ‘‘তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক প্রধানরা তাকে বললো, হে শোয়াইব! আমাদের ধর্মে তোমাদের ফিরে আসতেই হবে। অন্যথায় তোমাকে ও তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে আমাদের জনপদ থেকে বের করে দেবো। শোয়াইব জবাব দিলো- আমরা রাজি না হলেও কি আমাদের জোর করে ফিরিয়ে আনা হবে? তোমাদের ধর্ম থেকে আল্লাহ আমাদের উদ্ধার করার পর আবার যদি আমরা তাতে ফিরে আসি তাহলে আমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপকারী বিবেচিত হবো। আমাদের রব আল্লাহ যদি না চান, তাহলে আমাদের পক্ষে সে দিকে ফিরে যাওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়। আমাদের রবের জ্ঞান সমস্ত জিনিসকে ঘিরে আছে। আমরা তারই উপর নির্ভর করি। হে আমাদের রব! আমাদের ও আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে যথাযথভাবে ফায়সালা করে দাও এবং তুমি সর্বোত্তম ফায়সালাকারী’’। (সূরা আরাফ: ৮৮-৮৯) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِرُسُلِهِمْ لَنُخْرِجَنَّكُم مِّنْ أَرْضِنَا أَوْ لَتَعُودُنَّ فِي مِلَّتِنَا”শেষে কাফেররা তাদের রসূলদের বলে দিলো, হয় তোমাদের ফিরে আসতে হবে আমাদের মিল্লাতে আর নয়তো আমরা তোমাদের বের করে দেবো আমাদের দেশ থেকে’’। (সূরা ইবরাহীম: ১৩)
মুহাম্মাদ (সাঃ) কে তওবার নির্দেশ
সম্পর্কিত আয়াত সমূহ ও এর ব্যাখ্যাঃ
সুরা নাসর ৩ ঃ আল্লাহ তায়ালা আদম ও নূহ (আঃ) এর তওবা করা থেকে শুরু করে সর্বশেষ রসূল মুহাম্মাদ সাল্লাম পর্যন্ত সমস্ত নবীর তওবা করার কথা কুরআনে উল্লেখ করেছেন। মুহাম্মাদ (সাঃ) এর উপর সর্বশেষ যা নাযিল হয়েছে, তা হলো-إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ (১) وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا (২) فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّابًا অর্থাৎ যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে। আর মানুষকে আল্লাহর দীনে দলে দলে প্রবেশ করতে দেখতে পাবে। তখন তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসার সাথে পবিত্রতা ঘোষণা করো এবং তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাকারী (সূরা নাসর:১-৩)।
অতঃপর নবী করীম (সাঃ) এর ক্ষমা প্রার্থনার ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) অনেক আয়াত উল্লেখ করেছেন। অতঃপর তিনি বলেছেন, এ ব্যাপারে কুরআনের আয়াতগুলো খুব সুস্পষ্ট। যেমন রয়েছে সাহাবী, তাবেঈ এবং মুসলিম উম্মাহর আলেমদের অনেক বক্তব্য। কিন্তু বিরোধীগণ জাহমীয়া ও বাতেনী সম্প্রদায়ের লোকদের ন্যায় এ বক্তব্যগুলোর অপব্যাখ্যা করে থাকেন। এগুলোতে গভীরভাবে দৃষ্টি প্রদানকারী বুঝতে সক্ষম হবেন যে, এগুলো একদম বাতিল। এগুলো কালামকে স্বীয় স্থান থেকে সরিয়ে ফেলার মতই। যেমন তারা আল্লাহ তায়ালার এই বাণীর ব্যাপারে বলে থাকেন যে, ليغْفَرَ اللَّهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ ‘‘আল্লাহ যাতে তোমার আগের ও পরের সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেন’’, এখানে তার আগের গুনাহ বলতে আদমের গুনাহ এবং পরের গুনাহ বলতে তার উম্মতের গুনাহ উদ্দেশ্য। এ ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ বাতিল।
নবী-রসূলগণ গোনাহ থেকে মাসুম কি না, এ ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত কথা হলো, গুনাহ থেকে নবীগণের মাসুম বা পবিত্র হওয়ার বিষয়টি এ রকম যে, তাতে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যাতে তারা ভুল-ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। তাতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকা জরুরী। তাতে আরো কিছু বিষয় রয়েছে, তাতে তারা মাসুম কি না এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অর্থাৎ শুরু থেকেই তারা তা থেকে পবিত্র থাকার ব্যাপারে মতভেদ থাকলেও পরিশেষে তারা তা থেকে মাসুম হয়ে যান।
সুরা মুহাম্মাদ এর ১৯ নম্বার রাসুল (সাঃ) কে কুরআনের একাধিক আয়াতে তওবা (ইস্তেগফার) করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আবার কোথাও পূর্ববর্তি ও পরবর্তি গোনাহ মাফ করে দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। যেমন - সুরা মুহাম্মাদ এর ১৯ নম্বার আয়াতে এরশাদ হচ্ছেÑفَاعْلَمْ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا اللّٰهُ وَ اسْتَغْفِرْ لِذَنْۢبِكَ وَ لِلْمُؤْمِنِیْنَ وَ الْمُؤْمِنٰتِ١ؕ وَ اللّٰهُ یَعْلَمُ مُتَقَلَّبَكُمْ وَ مَثْوٰىكُمْ۠ অর্থাৎ- অতএব, হে নবী! ভাল করে জেনে নাও, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ইবাদাতের যোগ্য নয়। নিজের ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং মু’মিন নারী ও পুরুষদের জন্যও। আল্লাহ তোমাদের তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত এবং তোমাদের ঠিকানা সম্পর্কেও অবহিত।
সুরা আল ফাতহ আয়াত ২ সুরা আল ফাতহ এর ২য় নম্বার আয়াতে এরশাদ হচ্ছেÑ لِّیَغْفِرَ لَكَ اللّٰهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْۢبِكَ وَ مَا تَاَخَّرَ وَ یُتِمَّ نِعْمَتَهٗ عَلَیْكَ وَ یَهْدِیَكَ صِرَاطًا مُّسْتَقِیْمًاۙ অর্থাৎ ”যাতে আল্লাহ তোমার আগের ও পরের সব ত্রুটি-বিচ্যুতি মাফ করে দেন,তোমার জন্য তাঁর নিয়ামতকে পূর্ণতা দান করেন,তোমাকে সরল সহজ পথ দেখিয়ে দেন সুরা এ নাসর এর ৩য় আয়াতে এরশাদ হচ্ছে- فَسَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّكَ وَ اسۡتَغۡفِرۡهُ اِنَّهٗ كَانَ تَوَّابًا অর্থাৎ”তখন (শুকরিয়া আদায়ের উদ্দেশে) তুমি তোমার রবের পবিত্রতা সহ তাঁর প্রশংসা কর এবং ইস্তেগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) অবশ্যই তিনি তওবা কবুলকারী।” (তফসীরে উম্মুল কুরআন)
তাফসীরে তাবারী ঃ ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (রঃ) তাফসীরে তাবারীতে লিখেছেনÑ سالف ذنوبك وحادثها, وذنوب أهل الإيمان بك من الرجال والنساءঅর্থাৎ তোমার ও তোমার আহলে ইমান নারী পুরুষের গোনাহ থেকে তওবা কর। এর অনুকুলে আবু কুরাইব এর বর্ণিত এই হাদীসটিও তিনি উদ্ধৃত করেছেন যেখানে বলা হয়েছে যে وقد حدثنا أبو كُريب, قال: ثنا عثمان بن سعيد, قال: ثنا إبراهيم بن سليمان, عن عاصم الأحول, عن عبد الله بن سرجس, قال: " أكلت مع رسول الله صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّم , فقلت: غفر الله لك يا رسول الله, فقال رجل من القوم: أستغفر لك يا رسول الله, قال: نَعَمْ وَلَكَ, ثم قرأ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন আমার জন্যও ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে অতপর আল্লাহর রাসুল এই আয়াত তিলাওত করেন।
তাফসীরে কুরতুবীঃ ইমাম কুরতুবী (রঃ) বলেছেন- قوله تعالى : واستغفر لذنبك يحتمل وجهين : أحدهما : يعني استغفر الله أن يقع منك ذنب . الثاني استغفر الله ليعصمك من الذنوب এখানে দুটি কারণ হতে পারে এর একটি হলো নিজের গোনাহ আর আরেকটি হলো রাসুল নিজে মাসুম হওয়া সত্বেও তওবার নির্দেশ মানে উম্মতের গোনাহর জন্য ক্ষমা চাওয়া। তিনি তাবারী উদ্ধৃত হাদীসটি পেশ করেছেন। এখানেও গোনাহ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
তাফসীরে ইবনে কছীর তুমি জেনে রেখো যে, আল্লাহ তাআলাই সত্য মাবুদ। তিনি ছাড়া কোনই ইলাহ বা মাবুদ নেই। একথা দ্বারা আল্লাহ তা'আলা প্রকৃতপক্ষে স্বীয় অদ্বিতীয়তাদের সংবাদ দিয়েছেন। এর অর্থ এটা নয় যে, আল্লাহ পাক স্বীয় নবী (সঃ)-কে এটা জানার নির্দেশ দিচ্ছেন। এ জন্যেই এর উপর সংযোগ স্থাপন করে বলেন- তুমি তোমার ও মুমিন নর-নারীদের গোনাহর জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা কর।'
হাদীস ঃ সহীহ হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলতেনঃ وفي الصحيح أن رسول الله - صلى الله عليه وسلم - كان يقول : " اللهم اغفر لي خطيئتي وجهلي ، وإسرافي في أمري ، وما أنت أعلم به مني . اللهم اغفر لي هزلي وجدي ، وخطئي وعمدي ، وكل ذلك عندي " অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমার পাপ, আমার অজ্ঞতা, আমার কাজে আমার সীমালংঘন বা বাড়াাবাড়ী, প্রত্যেক ঐ জিনিস যা আপনি আমার চেয়ে বেশী জানেন, এগুলো আপনি ক্ষমা করে দিন! হে আল্লাহ! আপনি আমার অনিচ্ছাকৃত পাপ, ইচ্ছাকৃত পাপ, আমার দোষ-ত্রুটি এবং আমার কামনা-বাসনা ক্ষমা করে দিন! এগুলো সবই আমার মধ্যে রয়েছে।” এই মর্মে আরো একাধিক সহীহ হাদীস রয়েছে। অন্য সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ " يا أيها الناس ، توبوا إلى ربكم ، فإني أستغفر الله وأتوب إليه في اليوم أكثر من سبعين مرة হে লোকসকল! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ তা'আলার নিকট প্রত্যহ সত্তর বারেরও বেশী তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকি। আরেক বর্ণনায় আছেÑ عبد الله بن سرجس قال : أتيت رسول الله - صلى الله عليه وسلم - فأكلت معه من طعامه ، فقلت : غفر الله لك يا رسول الله ، فقلت : أستغفر لك ؟ فقال : " نعم ، ولكم " ، وقرأ : ( واستغفر لذنبك وللمؤمنين والمؤمنات ) ، ثم نظرت إلى نغض كتفه الأيمن أو : كتفه الأيسر - شعبة الذي شك - فإذا هو كهيئة الجمع عليه الثآليل . ”হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সারভাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি (একদা) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করি এবং তার সাথে তার খাদ্য হতে ভক্ষণ করি। তারপর আমি বলিঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন! তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ তোমাকেও মাফ করুন।” আমি বললামঃ আমি কি আপনার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করবো? তিনি উত্তরে বললেনঃ হ্যা, এবং তোমার নিজের জন্যেও করবে।” অতঃপর তিনি এ আয়াতটি পাঠ করলেন। ------------ যে হাদীসটি তাবারী ও কুরতুবী পেশ করেছেন।
তাফসীরে বগভী
ইমাম বগভী (রঃ) তফসীরে বগভীতৈ গোনাহ শব্দ ব্যবহার করে أمر بالاستغفار مع أنه مغفور له لتستن به أمته . নবীর নিজের ও উম্মতের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশের কথা বলেছেন। এবং তিনিও وإني لأستغفر الله في كل يوم مائة مرة. এই হাদীসটি সনদ সহ বর্ণনা করেছেন।
তাফসীরে সাদী ও তফসীরে বসীতঃ তাফসীরে সাদীতে আই বলা হয়েছে যে ভাবে তফসীরে বগভীতৈ গোনাহ শব্দ ব্যবহার করে أمر بالاستغفار مع أنه مغفور له لتستن به أمته . নবীর নিজের ও উম্মতের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশের কথা বলেছেন। এবং তিনিও وإني لأستغفر الله في كل يوم مائة مرة. এই হাদীসটি সনদ সহ বর্ণনা করেছেন। তফসীরে বসীতে ইবনে কছীরের মতই সকল দোয়া ইস্তেগফার উদ্ধৃত করেছেন। وفى الصحيح أن رسول الله - صلى الله عليه وسلم - كان يقول : " اللهم اغفر لى خطيئتى وجهلى ، وإسرافى فى أمرى ، وما أنت أعلم به منى . اللهم اغفر لى هزلى وجدى ، وخطئى وعمدى ، وكل ذلك عندى অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমার পাপ, আমার অজ্ঞতা, আমার কাজে আমার সীমালংঘন বা বাড়াাবাড়ী, প্রত্যেক ঐ জিনিস যা আপনি আমার চেয়ে বেশী জানেন, এগুলো আপনি ক্ষমা করে দিন! হে আল্লাহ! আপনি আমার অনিচ্ছাকৃত পাপ, ইচ্ছাকৃত পাপ, আমার দোষ-ত্রুটি এবং আমার কামনা-বাসনা ক্ষমা করে দিন! এগুলো সবই আমার মধ্যে রয়েছে।” এই মর্মে আরো একাধিক সহীহ হাদীস রয়েছে। এ তো গেলো প্রাচীন তাফসীর গুলোর কিছু উদ্ধৃতি তাই আধুনিক তাফসীরকারকদের কে কোন কথা লিখেছেন তা একটু দেখে নিই ।
তাফসীরে জালালাইন ঃ তাফসীরে জালালাইনে তওবার আদেশ সংক্রান্ত আদেশের ব্যখ্যায় বলা হয়েছে যে- ”আয়াতের অর্থ হলো আপনার প্রভুর প্রশংসার সাথে পবিত্রতা বর্ণনা করুন, আর তাঁর দরবারে গোনাহ সমূহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। কেননা তিনি গোনাহগারদের গোনাহ সমূহ ক্ষমা করে থাকেন।” এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো তাফসীরে জালালাইনেও গোনাহ সমুহের জন্য বলা হয়েছে। যদিও এর অনুবাদকরা বাংলায় অনুবাদ করতে এখানে গোনাহ না লিখে ত্রæটি বিচ্যুতি লিখতে পারতেন যেমনটা অন্যন্য অনুবাদকরা করেছেন। অথচ এটি অনুবাদ করেছেন আমাদের দেওবন্দী সলুকের ই ওলামায়ে কেরাম, যারা রাত দিন মাওলানা মওদুদির পেছনে পড়ে থাকেন এই বলে যে তিনি ইসমতে আম্বিয়া মানেন না, নবীদেরকে (আঃ) গোনাহগার বলেছেন ইত্যাদী। অথচ এটি তাদের চোখে পড়েনা।
আমাদের কথাঃ- জালালাইনের অনুবাদে মারাত্মক জালিয়াতীঃ তাফসীরে জালালাইন এর লেখক হলেন দুই জালাল উদ্দীন যদ্দরুণ এর নামকরণ করা হয়েছে জালালাইন বা দুই জালাল। তারা হলেন আল্লামা জালাল উদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ আল মহল্লী (রঃ) (১৩৮৯-১৪৫৯ খ্রি:) আরেকজন হলেন আল্লামা জালাল উদ্দীন আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর আস সুয়ূতী (রঃ) (১৪৪৫-১৫০৫ খ্রি;) শত শত বছরের পুরনো ইসলামের ইতিহাসে তাফসীরের জগতে বিখ্যাত এবং শত শত বছর ধরে ক্বওমী ও আলীয়া ধারার পাঠ্যতালিকাভ’ক্ত তাফসীরে জালালাইন এর আরবী উর্দূ ইংরেজী ফার্সি তুরকী,মালয়ী অনেক ভাষার ব্যাখ্যা গ্রন্থ অনুবাদ গ্রন্থ রয়েছে। এর মধ্যে উপমহাদেশে বিখ্যাত শরাহ বা ব্যাখ্যা গ্রন্থ হচ্ছে জালালাইন এবং আরবী শরাহ হচ্ছে মুয়াস্সার। বাংলায় এর একাধিক অনুবাদ রয়েছে এর মধ্যে ইসলামী ফাউন্ডেশনেরও অনুবাদ রয়েছে। আশ্চর্য্যের বিষয় হলো ঢাকার বাংলাবাজারস্থ ইসলামিয়া কুতুবখানা কর্তৃক প্রকাশিত ও ইসলামিয়া সম্পাদনা পর্ষদ কর্তৃক সম্পাদিত জালালাইনে লেখকবৃন্দ হিসাবে যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন আমাদের বাংলাদেশের হবীগঞ্জ সুনামগঞ্জ নারায়ণগঞ্জ আর ঢাকার চারজন আলেমের নাম যাদের সকলেই দেওবন্দী মসলকের আলেম। সম্ভবতঃ তারা অনুবাদক কিন্তু লেখক বৃন্দ হিসাবে পরিচয় দেয়া হয়েছে এর আগে জালালাইনের মুল লেখকদের নামও এসেছে কিন্তু লেখক হিসাবে পরিচয় দেয়া হয় নি। সেটিং এর বিভ্রাটও হতে পারে।
মাআরিফুল কোরআন আগের না জালালাইন আগের? তার চেয়েও আশ্চর্য্যরে বিষয় হলো পাচশত বছর আগের লেখা তাফসীরে জালালাইনের রেফারেন্স দেয়া হয়েছে গেলো শতাব্দীর তাফসীরে মাআরিফুল কোরআন দিয়ে। এখানেই শেষ নয় তাফসীরে মাআরিফুল কোরআনের মুল নুসখাতে যে সাব হেডিং বা শিরোনাম নেই এমন শিরোনাম দেয়া হয়েছে এবং মুল কিতাবে নেই এমন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। এসব কারসাজী জালিয়াতি দু নম্বারী কারবারসারবার দেখার কি কেউ নেই আমাদের দেওবন্দী ঘরোনায়? নাকি মওদুদী বিরোধিতায়ই সব হারাম হালাল হয় ?
তাফসীরে মাজহারী ঃ তাফসীরে মাজহারীতে আরিফবিল্লাহ আল্লামা ছানাউল্লাহ পানিপথি (রঃ) সুরা মুহাম্মাদ এর ১৯ নম্বার আয়াতে লিখেছেনÑ আপনি আপনার গোনার জন্য আপনার রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) মাসুম বা নিস্পাপ ছিলেন তাই তাঁর পক্ষে এমন কোন গোনাহ হয়নি যে তাঁকে গোনার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু এটা অবশ্যই সত্য যে বান্দাহ হিসাবে রবের ইবাদতির ষোলকনা হক্ব আদায় করে ইবাদতি ও জিম্মাদারী পালন করা কতটা কঠিন এবং তা কোন অবস্থাতেই সম্ভব নয় এটা ভাবা একজন রাসুলের জন্য ই মানায় কারণ এটা বিনয়ের সর্বোচ্চ স্তর যে স্তরে পৌছা কেবল নবীদের দ্বারাই সম্ভব।
বয়ানুল কোরআন বা তাফসীরে আশরাফী ঃ হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রঃ) লিখিত বয়ানুল কুরআন (বাংলায় অনুদিত তাফসীরে আশরাফীতে) সুরা মুহাম্মাদ এর ১৯ নম্বার আয়াতে তওবা সম্পর্কিত আদেশের প্রসঙ্গে একটি স্বতন্ত্র শিরোনাম হচ্ছে এ রকম যে ”আল্লাহ তায়ালার প্রতিশ্রæতি ও ভীতি প্রদর্শন স্মরণ করিয়া ঈমানের উপর সু দৃঢ় থাকা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করার আদেশ” এর পর পাপের ধরণ সম্পর্কে এবং তওবার কারণ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন- আপনি নিস্পাপ বিধায় আপনার দ্বারা কোন পাপ হইতে পারেনা এবং ইজতেহাদী কোন বিষয় ত্রæটি থাকলেও তা অপ্রকৃত পাপবলে গন্য হবে এবং তাতে ইবাদতও গন্য হবে। ----এর পর হযরত উম্মে মকতুম (রাঃ) এর ঘটনা উল্লেখ করে বলেছেন এখানে উম্মে মকতুমকে অবজ্ঞা করার বিষয়টি আল্লাহর কাছে অপসন্দনীয় হওয়াই আল্লাহ তায়ালা সুরা আবাসা নাযিল করে সকর্ত করে দিয়েছেন।আর উম্মতের দ্বারাতো আগের উম্মতের মতই নানা ধরনের গোনাহ হতেই পারে। তাই আপনি একা নয় বরং আপনার গোনাহগার নর-নারী উম্মতের হয়েও আপনি তওবা বা ক্ষমা প্রর্থনা করুন।
সুরা এ নাসর এর ৩ নম্বার আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে- ” হযরত রাসুল (সাঃ) কখনও কোন না জায়েজ কাজ করেন নাই । কিন্তু জায়েজ কাজ গুলির মধ্যেও আবার উত্তম অনুত্তম কাজের শ্রেণীভেদ থাকে। ঘটনাচক্রে হযরতের দ্বারা যে অনুত্তম জায়েজ কাজ অনুষ্ঠিত হইত, সেই কাজ গুলোর জন্যই তাঁহার প্রতি তওবার আদেশ ।” (সুরা এ নাসর ৩) এছাড়াও সুরা মুহাম্মাদ এর ১৯ নম্বার আয়াতে বিশদ আলোচনা আছে। এখানে লক্ষনীয় বিষয় হলো যে থানবী (রঃ) সুরা মুহাম্মাদের ১৯ নং আয়াতে উম্মে মকতুম (রাঃ) এর ঘটনা উল্লেখ পুর্বক অনুম্মম জায়েজ কাজ এবং অপ্রকৃত গোনাহ এবং সুরা এ নাসর এর ৩ নম্বার আয়াতে তওবার আদেশ সম্পর্কে বলেছেন হযরতের দ্বারা যে অনুত্তম জায়েজ কাজ হতো এর জন্য আল্লাহ তায়ালা তওবার নির্দেশ দিয়েছেন।
তাফসীরে উসমানী শায়খুল হাদীস আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী দেওবন্দী (রঃ) তাঁর তাফসীরে উসমানীতে সুরা মুহাম্মাদ এর ১৯ নম্বার আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন -” প্রত্যেকের গোনাহ তার মর্য্যাদা অনুপাতে হয়ে থাকে। কোন বিষয়ে সর্বেত্তোম দিকটির পরিবর্তে তুলনামুলক অনুত্তম দিকটি অবলম্ভন করা যদিও তা জায়েজ ও বৈধতার মধ্যেই পড়ে কোন কোন সময় নৈকট্যপ্রপ্ত ব্যাক্তিদের পক্ষে গোনাহ বলে বিবেচিত হয়। বলা হয়ে থাকে সাধারণ পুণ্যবানদের জন্য যা সওয়াবের কাজ তার কতক নৈকট্যপ্রপ্তদের জন্য কখনো ত্রæটি বিবেচিত হয়। হাদীসে আছে - وإني لأستغفر الله في كل يوم مائة مرة নবী করীম (সাঃ) দৈনিক একশত বার ইস্তেগফার করতেন। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো জালালাইন ও তাফসীরে উসমানীতে গোনাহ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অনুরূপ তাফসীরে উসমানী আশরাফীতে অনুত্তম জায়েজ কাজ এবং আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্তদের তুচ্ছ ত্রæটিটাও আল্লাহর কাছে বড় হিসাবেই বিবেচিত হয় এটাই বুঝানো হয়েছে। আর এ জন্যই তওবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে ।
সুরা ফাত্হ এর ২য় নম্বার আয়াতে মাগফেরাত সম্পর্কিত আয়াতে তিনি লিখেছেন- আল্লাহর রাসুল (সাঃ) কে চারটি মহাবিজয়ের সু সংবাদ প্রধান করাহয়েছে এখানে এর একটি হলো- গুফরানে যুনূব বা আল্লাহর দৃষ্টিতে ত্রæটি বলে পরিগণিত হতে পারে এমন সকল পূর্বাপর ত্রæটিসমূহ সর্বদার জন্য সম্পূর্ণরূপে মাফ করে দেয়া। সুরা এ নাসর এর ৩য় আয়াতের অনুবাদে লিখেছেন ’ এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবেন’ এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন নও মুসলিম বা ইসলামে নতুন করে দাখিল হওয়া আপনার উম্মতদের জন্য গোনাহ মাফ করানোর জন্য ক্ষমা চাইবেন।
মাআরিফুল কোরআন ঃ পাকিস্তানের গ্রান্ড মুফতি ও দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান মুফতি ও মুহাদ্দিস মুফতি শফি উসমানী (রঃ) এর তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন এর বাংলা অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ আলীয়া মাদ্রাসা পড়–য়া দেওবন্দী ঘরোনার আলেম আল্লামা মাওলানা মুহিউদ্দীন (রঃ) । তিনি সুরা মুহাম্মাদ এর ১৯ নম্বার আয়াতের অনুবাদে লিখেছেনÑ ” কাজেই জেনে রাখুন যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই ,আর ক্ষমা প্রার্থনা করুন আপনার ও মুমিন নর-নারীদের ত্রæটির জন্য, আল্লাহ তোমাদের গতি বিধি ও অবস্থান সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। এর ব্যাখায় তাফসীরে তাবারী ও মুয়াস্সার এর রেফারেন্সে বলা হয়েছে আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মাদ (সাঃ) কে সম্বাধন করে বলেছেন যে আপনি জেনে রাখুন আল্লাহ ব্যাতিত ইবাদতের উপযুক্ত কোন সত্য ইলাহ নেই। এখানে তওবার নির্দেশ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। সুরা আল ফাত্হ এর ২নম্বার আয়াতের অনুবাদে লিখেছেন- ’ যেন আল্লাহ আপনার অতীত ও ভবিষ্যত ত্রæটি সমূহ মার্জনা করেন এবং আপনার প্রতি তার অনুগ্রহ পূর্ণ করেন। আর আপনাকে সরল পথের হেদায়েত দেন, (পরের ৩নং আয়াত এর অনুবাদ) এবং আল্লাহ আপনাকে বলিষ্ঠ সাহায্য দান করেন। সুরা নাসর এর ৩নম্বার আয়াতের অনুবাদ করেছেন যে-’আপনি আপনার রবের প্রসংশা সহ তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন , এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন, নিশ্চয় তিনি তওবা কবুলকারী ।”
তাফসীরে আহসানুল বয়ান ঃ আহলে হাদীস পাকিস্তানের প্রখ্যাত ইসলামী স্কলার হাফিজ সালাহ উদ্দীন (রঃ) প্রণীত তাফসীরে আহসানুল বয়ান। সুরা মুহাম্মাদ এর ১৯ নম্বার আয়াতের বাখ্যায় এই তাফসীরে যা বলা হয়েছে তার সারসংক্ষেপ হলো- ’এই বিশ্বাসের উপর অটল ও দৃঢ় থাক। কেননা, এটাই তাওহীদ (একত্ব), আল্লাহর আনুগত্য এবং যাবতীয় কল্যাণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। আর এ থেকে বিচ্যুতি অর্থাৎ, শিরক ও অবাধ্যতা হল যাবতীয় অকল্যাণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এই আয়াতে নবী করীম (সাঃ)-কে তাঁর নিজের জন্যও এবং মু’মিনদের জন্যও ক্ষমা প্রার্থনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ক্ষমা প্রার্থনার গুরুত্ব ও ফযীলত অনেক। বহু হাদীসেও এর প্রতি বড়ই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। একটি হাদীসে নবী করীম (সাঃ) বলেছেন- وإني لأستغفر الله في كل يوم مائة مرة‘‘হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তওবা কর। কারণ, আমি দিনে সত্তরবারেরও বেশী তাঁর নিকট তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকি।’’ (বুখারী, দা’ওয়াত অধ্যায়) আয়াতের শেষাংশে যা বলাহয়েছে তার সার কথা হলো- দিনে তোমরা যেখানেই যাও এবং যা কিছু কর এবং রাতে যেখানেই বিশ্রাম নাও ও অবস্থান কর, মহান আল্লাহ তার সবকিছু জানেন। অর্থাৎ, তোমাদের দিবারাত্রির কোন কর্মতৎপরতা আল্লাহর নিকট গুপ্ত নয়। আল্লামা সৈয়দ সুলাইমান নদভী (রঃ) ঃ আল্লামা সৈয়দ সুলাইমান নদভী (রঃ) বলেছেন-মানুষ হিসেবে তাদের থেকেও ভুল ত্রুটি হতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তার ওহীর দ্বারা এ সমস্ত ভুল ত্রুটিরও সংশোধন করে থাকেন। (সিরতুন্নবী,৪/৭০)।
তাফসীরে উম্মুল কুরআন ঃ তাফসীরে উম্মুল কুরআনের লেখক এই গ্রন্থের লেখক মাওলানা আব্দুল হাই জেহাদী’র তাফসীরে উম্মুল কুরআনে বলা হয়েছেÑ এক, আল্লাহর রাসুল (সাঃ) তথা আম্বিয়া এ কেরাম মাসুম বা মাহফুজ এটা যেমন আল্লাহর ঘোষণা পবিত্র কোরআনে আর এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকী¡দা। তেমনি মুহাম্মাদ (সাঃ) সহ আম্বিয়ায়ে কেরামের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাবলিও কোরআনে ই উপস্থাপিত বিধায় এর কোন কোনটি কোরআনে ব্যবহৃত ভাষা অনুযায়ী বাহ্যিক দৃষ্টিতে গোনাহ’র বা পাপের অথবা অপরাধ বুঝা যায়। কিন্তু এটা কেবল আল্লাহর দৃষ্টিতে বান্দাহর দৃষ্টিতে নয়। এবং এটা বাহ্যত পাপ মনে হলেও ক্ষনিকের জন্য এ জাতীয় কোন ভুলের উপর নবী রাসুলগণ (আঃ) থাকেন নি বা তাদেরকে থাকতে দেয়া হয়নি আল্লাহ তায়ালা তা সংশোধন করে দিয়েছেন যেটা সাধারণ কোন মানুষের বেলায় হয়না। এটাই নবী-রাসুলগন আর সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য এবং দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবধান।
দুই , কোন নবী রাসুলগণ কর্তৃক ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত কোন ছগীরা কবীরা গোনাহ হয়নি নবুওতের আগে বা পরে। কিন্তু মানবীয় বৈশীষ্টের কারণে তড়িৎ কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কোন ত্রæটি বিচ্যুতি ঘটা অসম্ভব নয়। তবে এটাও সাধারণ মানুষের ভুলের মতো নয় এর মাঝেও আছে মানব জাতীর জন্য শিক্ষা ও আল্লাহর হেকমত। যেমন মুহাম্মাদ (সাঃ) কর্র্তক ফরজ গোছল ভ’লে গিয়ে ফজরের নামাজের ইমামতি শুরু করা অতপর নামাজ ছেড়ে গোসল করে এসে পুনরায় নামাজ পড়ানো। সাহাবী হযরত উম্মেহানী (রাঃ) কে ফিরিয়ে দেয়া, উম্মুল মুমিনীনদের তাওরিয়ার জবাবে মধুপান বর্জনের সিদ্ধান্ত নিতে যাওয়া, মুনাফিক সরদারের জানাজা পড়ানোর মনস্থ করা ইত্যাদী। এসব ভুল কে উম্মাহ ভুল বললেও মহা ভুল হবে। কারন এসব ঘটনা ইসলামী শরীয়তের অনিবার্য্য ও অপরিহার্য্য শিক্ষনীয় অংশ এবং মহান রবের হেকমত।
তিন; তৃত্বীয়ত তওবার নির্দেশ প্রসঙ্গে যে বিষয়টি সর্বাধিক আলোচিত সেটি হলো (ক) তওবার জন্য রাসুলকে সম্বোাধন করা হয়েছে রাসুলের মর্যাদা আরো বৃদ্ধির জন্য গোনাহ বা কেবল ভুল ত্রæটির জন্য নয়। সুরা আল ফাতহে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে অতীত ও ভবিষ্যতের ত্রæটি-বিচ্যুতি মাফ করে দেয়ার নিশ্চিত প্রতিশ্রæতি যদিও তেমন কোন ত্রæটি বিচ্যুতি নেই। কিন্তু আরো অধিক নৈকট্যটতা আর মর্য্যদা বৃদ্ধি ও জাগতিক এবং আত্মিক সুস্পষ্ট বিজয় বা সাফল্যতার আভাস ও তা পূর্ণ করা। সুরা এ নাসর এ দুনিয়ার সফরের ইতি হতে যাচ্ছে আখেরাতের প্রস্তুতির জন্য তাহমিদ তাসবীহ ও ইস্তেগফার সেই সাথে এখানে বিজয় সাফল্যতার পরবর্তি করণীয় শিক্ষা দেয়া উদ্দেশ্য (খ) উম্মাহকে দোয়া ইস্তেগফার ও বিনয় এবং দোয়ার আদব এবং সফলতার মূল শক্তি আল্লাহর কুদরত এই শিক্ষা দেয়ার জন্য (গ) গোটা কোরআন ই মুহাম্মাদ (সাঃ) এর প্রতি নাযিল হয়েছে বিধায় তিনি সাহেবে শরীয়ত। এ জন্য মুহাম্মাদ (সাঃ) কে সম্বোধন করা হলেও এর লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও শিক্ষা গোটা মানব জাতির জন্য। (ঘ) কুরআনে বর্ণিত শব্দ বাক্য ও ঘটনাবলির পরিবর্তন করা বা এর অর্থে ভিন্নতা ঘটানোর ক্ষমতা কোন মানুষের নেই কারণ কোরআনের প্রতিটি বর্ণ-বাক্য মহান রব্বুল আলামীনের। সুতরাং কোন বার্কে আল্লাহ তায়ালা পাপ বললে বা খাতা (ত্রæটি) বললে সেটা আল্লাহর ই কথা। মানুষের দৃষ্টি ভঙ্গির সাথে আল্লাহর দৃষ্টিভঙ্গির তুলনাকরাটাও কুফরি সুতরাং এ জাতীয় ঘটানা বা বাক্য বললেই যে এটা নবী কে মাসুম অস্বিকার করা হয়ে যায় নবীর প্রতি বিদ্ধেষ হয়ে যায় বিষয়টি এ রবকম নয়। আসল বিষয় হলো আপনি আমি আল্লাহ রসুলের জাত ও সিফাতের,তাদের শান -মান ও নির্দেশনার প্রতি আমাদের আস্থা,বিশ্বাস বা ঈমান আক্বীদা কতটা গভীর ও উচ্চমানের সেটাই দেখা। তাফসীরের উল্লেখযোগ্য প্রায় সবগুলো প্রাচীন ও আধূীনক কিতাবের সার কথা এটাই প্রতিয়মান হয়।
তাফহীমুল কোরআন যে তাফহীমুল কোরআনের তাফসীর তরজমা নিয়ে এতো মাতামাতি আসুন এবার সেই তাফসীরুল কোরআনের তরজমা তাফসীর নিয়ে একটু আলোচনা করি। সুরা মুহাম্মদ এর ১৯ নম্বার আয়াতের অনুবাদ হচ্ছে এ রকম। এরশাদ হচ্ছে- فَاعْلَمْ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا اللّٰهُ وَ اسْتَغْفِرْ لِذَنْۢبِكَ وَ لِلْمُؤْمِنِیْنَ وَ الْمُؤْمِنٰتِ١ؕ وَ اللّٰهُ یَعْلَمُ مُتَقَلَّبَكُمْ وَ مَثْوٰىكُمْ۠ অর্থাৎ-অতএব, হে নবী! ভাল করে জেনে নাও,আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ইবাদাতের যোগ্য নয়। নিজের ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং মু’মিন নারী ও পুরুষদের জন্যও। আল্লাহ তোমাদের তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত এবং তোমাদের ঠিকানা সম্পর্কেও অবহিত।
তাফসীর :
ইসলাম মানুষকে যেসব নৈতিকতা শিক্ষা দিয়েছে তার একটি হচ্ছে বান্দা তার প্রভুর ইবাদাত- বন্দেগী করতে এবং তাঁর দ্বীনের জন্য জীবনপাত করতে নিজের পক্ষ থেকে যত চেষ্টা-সাধনাই করুক না কেন, তার মধ্যে এমন ধারণা কখনো আসা উচিত নয় যে, তার যা করা উচিত ছিল তা সে করেছে। তার বরং মনে করা উচিত যে, তার ওপর তার মালিকের যে দাবী ও অধিকার ছিল তা সে পালন করতে পারেনি। তার উচিত সবসময় দোষ-ত্রুটি স্বীকার করে আল্লাহর কাছে এ দোয়া করা যে, তোমার কাছে আমার যে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অপরাধ হয়েছে তা ক্ষমা করে দাও। “হে নবী (সাঃ ) তোমার ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো” আল্লাহর এ আদেশের অর্থ এ নয় যে, নবী (সাঃ) জেনে বুঝে প্রকৃতই কোন অপরাধ করেছিলেন। নাউযুবিল্লাহ! বরং এর সঠিক অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর সমস্ত বান্দার মধ্যে যে বান্দা তার রবের বন্দেগী বেশী করে করতেন নিজের এ কাজের জন্য তাঁর অন্তরেও গর্ব ও অহংকারের লেশমাত্র প্রবেশ করতে পারেনি। তাঁর মর্যাদাও ছিল এই যে, নিজের এ মহামূল্যবান খেদমত সত্বেও তাঁর প্রভুর সামনে নিজের অপরাধ স্বীকারই করেছেন। এ অবস্থা ও মানসিকতার কারণেই রসূলুল্লাহ (সাঃ) সবসময় বেশী বেশী ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। আবু দাউদ, নাসায়ী এবং মুসনাদে আহমাদের বর্ণিত হাদীসে নবীর (সাঃ) এ উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে যে, وإني لأستغفر الله في كل يوم مائة مرة“আমি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে একশ’ বার ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকি।”
সুরা নাসর এর তাফসীর এরশাদ হচ্ছেÑفَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَ اسْتَغْفِرْهُ١ؔؕ اِنَّهٗ كَانَ تَوَّابًا۠ অর্থাৎ- তখন তুমি তোমার রবের হামদ সহকারে তাঁর তাসবীহ পড়ো এবং তাঁর কাছে মাগফিরাত চাও। অবশ্য তিনি বড়ই তওবা কবুলকারী। তাফসীর : وَ اسْتَغْفِرْهُ١ অর্থাৎ তোমার রবের কাছে দোয়া করো। তিনি তোমাকে যে কাজ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তা করতে গিয়ে তোমার যে ভুল-ত্রুটি হয়েছে তা যেন তিনি মাফ করে দেন। ইসলাম বান্দাকে এ আদব ও শিষ্টাচার শিখিয়েছে। কোন মানুষের দ্বারা আল্লাহর দ্বীনের যতবড় খিদমতই সম্পন্ন হোক না কেন, তাঁর পথে সে যতই ত্যাগ স্বীকার করুক না এবং তাঁর ইবাদাত ও বন্দেগী করার ব্যাপারে যতই প্রচেষ্টা ও সাধনা চালাক না কেন, তার মনে কখনো এ ধরনের চিন্তার উদয় হওয়া উচিত নয় যে, তার ওপর তার রবের যে হক ছিল তা সে পুরোপুরি আদায় করে দিয়েছে। বরং সব সময় তার মনে করা উচিত যে, তার হক আদায় করার ব্যাপারে যেসব দোষ-ত্রুটি সে করেছে তা মাফ করে দিয়ে যেন তিনি তার এ নগণ্য খেদমত কবুল করে নেন। এ আদব ও শিষ্টাচার শেখানো হয়েছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে। অথচ তাঁর চেয়ে বেশী আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা ও সাধনাকারী আর কোন মানুষের কথা কল্পনাই করা যেতে পারে না। তাহলে এক্ষেত্রে অন্য কোন মানুষের পক্ষে তার নিজের আমলকে বড় মনে করার অবকাশ কোথায়? আল্লাহর যে অধিকার তার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তা সে আদায় করে দিয়েছে এ অহংকার মত্ত হওয়ার কোন সুযোগই কি তার থাকে ? কোন সৃষ্টি আল্লাহর হক আদায় করতে সক্ষম হবে, এ ক্ষমতাই তার নেই। মহান আল্লাহর এ ফরমানে মুসলমানদের এ শিক্ষা দিয়েছেন যে, নিজের কোন ইবাদাত, আধ্যাত্মিক সাধনা ও দ্বীনি খেদমতকে বড় জিনিস মনে না করে নিজের সমগ্র প্রাণশক্তি আল্লাহর পথে নিয়োজিত ও ব্যয় করার পরও আল্লাহর হক আদায় হয়নি বলে মনে করা উচিত। এভাবে যখনই তারা কোন বিজয় লাভে সমর্থ হবে তখনই এ বিজয়কে নিজেদের কোন কৃতিত্বের নয় বরং মহান আল্লাহর অনুগ্রহের ফল মনে করবে। এ জন্য গর্ব ও অহংকারে মত্ত না হয়ে নিজেদের রবের সামনে দ্বীনতার সাথে মাথা নত করে হামদ, সানা ও তাসবীহ পড়তে এবং তাওবা ও ইস্তিগফার করতে থাকবে।
সুরা আল ফাতহ এর ২নম্বার আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন- অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় মাওলানা মওদুদির (রঃ) বক্তব্যের মর্মার্থ বুঝতে পারেন না কেবল তারাই শুধু অপব্যাখ্যা করেন। সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদি (রঃ) এর জ্ঞান, মর্যাদা ও খেদমতের তুলনায় নিজেদের অবস্থান একটু চিন্তা করে তারপর সমালোচনা করা উচিত। উপরোক্ত আয়াতে নবীকে (সাঃ) বলা হচ্ছে, তোমার গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করো। অত্যন্ত স্পষ্ট করে গোনাহ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ আমাদের আকাবীরে দেওবন্দ তাদের অনুবাদে সুস্পষ্টভাবে গোনাহ শব্দ লিখেছেন কিন্ত মওদুদী (রঃ) অনুবাদ করেছেন ভুলত্রুটি। নবীদের ইসমত সম্পর্কে নেতিবাচক কোন ধারণা নিতে চাইলে মওদূদী’ (রঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যা থেকেই নিতে পারতেন কিন্তু তিনি কি সেটা করেছেন ? তিনি কি লিখেছেন সেটা ভালো করে পড়লেই বুঝা যায় যে তিনি ইসমতে আম্বিয়া সম্পর্কে পাঠকদের কতটা স্বচ্ছ ধারণা দিয়েছেন। সূরা মুহাম্মাদের এই আয়াতে ব্যাখ্যায় তিনি লিখেন- . “ইসলাম মানুষকে যেসব নৈতিকতা শিক্ষা দিয়েছে তার একটি হচ্ছে বান্দা তার প্রভুর বন্দেগী ও ইবাদাত করতে এবং তাঁর দীনের জন্য জীবনপাত করতে নিজের পক্ষ থেকে যত চেষ্টা-সাধনাই করুক না কেন, তার মধ্যে এমন ধারণা কখনো আসা উচিত নয় যে, তার যা করা উচিত ছিল তা সে করেছে । তার বরং মনে করা উচিত যে, তার ওপর তার মালিকের যে দাবি ও অধিকার ছিল তা সে পালন করতে পারেনি । তার উচিত সবসময় দোষ-ত্রুটি স্বীকার করে আল্লাহর কাছে এ দোয়া করা যে, তোমার কাছে আমার যে ক্রুটি-বিচ্যুতি ও অপরাধ হয়েছে তা ক্ষমা করে দাও ।’’ ."হে নবী (সাঃ) তোমার ক্রুটি-বিচ্যুতির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো" আল্লাহর এ আদেশের অর্থ এ নয় যে, নবী ( সাঃ) জেনে বুঝে প্রকৃতই কোন অপরাধ করেছিলেন । (নাউযুবিল্লাহ!) বরং এর সঠিক অর্থ হচ্ছে , আল্লাহর সমস্ত বান্দার মধ্যে যে বান্দা তার রবের বন্দেগী বেশী করে করতেন নিজের এ কাজের জন্য তাঁর অন্তরেও গর্ব ও অহংকারের লেশমাত্র প্রবেশ করতে পারেনি । তাঁর মর্যাদাও ছিল এই যে, নিজের এ মহামূল্যবান খেদমত সত্ত্বেও তাঁর প্রভুর সামনে নিজের অপরাধ স্বীকারই করেছেন । এ অবস্থা ও মানসিকতার কারণেই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবসময় বেশী বেশী ক্ষমা প্রার্থনা করতেন । আবু দাউদ, নাসায়ী, এবং মুসনাদে আহমাদের বর্ণিত হাদীসে নবীর ( সাঃ) এ উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে যে, وإني لأستغفر الله في كل يوم مائة مرة "আমি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে একশ, বার ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকি"!
এর পরে আরো একটি আয়াতের দিকে তাকাতে পারেন যেটি সূরা ফাতেহ’র প্রথম আয়াতে বলা হচ্ছে- “হে নবী, আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি যাতে আল্লাহ তোমার আগের ও পরের সব ক্রটি-বিচ্যুতি মাফ করে দেন,তোমার জন্য তাঁর নিয়ামতকে পূর্ণতা দান করেন- সূরা ফাতেহ-১-২। এই আয়াতের অনুবাদের ক্ষেত্রেও দেওবন্দী হযরতগন গোনাহ শব্দ ব্যবহার করেছেন। অথচ মাওলানা মওদুদী (রঃ ) করেছেন ভুলত্রুটি! যেমন তিনি লিখেছেন- “যে পরিবেশ পরিস্থিতিতে একথাটি বলা হয়েছে তা মনে রাখলে স্পষ্ট বুঝা যায়, ইসলামের সাফল্য ও বিজয়ের জন্য রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নেতৃত্বের মুসলমানগণ বিগত ১৯ বছর ধরে যে চেষ্টা -সাধনা করে আসছিলেন তার মধ্যে যেসব ক্রুটি -বিচ্যুতি ও দুর্বলতা ছিলো এখানে সেসব ক্রুটি –বিচ্যুতি ও দুর্বলতা ক্ষমা করার কথা বলা হয়েছে । এসব ক্রুটি-বিচ্যুতি কি তা কোন মানুষের জানা নেই । বরং মানবীয় বিবেক-বুদ্ধি এ চেষ্টা -সাধনার মধ্যে কোন ক্রুটি ও অপক্কতা খুঁজে পেতে একেবারেই অক্ষম । কিন্তু আল্লাহ তা'আলার দৃষ্টিতে পূর্ণতার যে অতি উচ্চ মানদন্ড রয়েছে তার বিচারে ঐ চেষ্টা সাধনার মধ্যে এমন কিছু ক্রটি -বিচ্যুতি ছিল যার কারণে মুসলমানগণ আরবের মুশরিকদের বিরুদ্ধে এত দ্রæত চূড়ান্ত বিজয় লাভ করতে পারতেন না ।
আল্লাহ তা'য়ালার বাণীর তাৎপর্য হচ্ছে, তোমরা যদি ঐ সব ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে চেষ্টা সাধনা করতে তাহলে আবর বিজিত হতে আরো দীর্ঘ সময় দরকার হতো । কিন্তু এসব দুর্বলতা ও ক্রটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে কেবল নিজের মেহেরবানী দ্বারা আমি তোমাদের অপূর্ণতা দূর করেছি এবং হুদাইবিয়া নামক স্থানে তোমাদের জন্য সে বিজয় ও সফলতার দ্বার উন্মক্ত করে দিয়েছি যা স্বাভাবিকভাবে তোমাদের প্রচেষ্টা দ্বারা অর্জিত হতো না!. এখানে একথাটিও ভালভাবে উপলব্ধি করা দরকার যে, কোন লক্ষ ও উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যে দল চেষ্টা -সাধনা চালাচ্ছে তার ক্রুটি-বিচ্যুতির জন্য সে দলের নেতাকে সম্বোধন করা হয় । তার অর্থ এ নয় যে, ঐ সব ক্রুটি ও দুর্বলতা উক্ত নেতার ব্যক্তিগত ক্রুটি ও দুর্বলতা। গোটা দল সম্মিলিত ভাবে যে চেষ্টা-সাধনা চালায় ঐ সব ক্রুটি ও দুর্বলতা সে দলের সম্মিলিত চেষ্টা -সাধনার । কিন্তু নেতাকে সম্বোধন করে বলা হয়, আপনার কাজে এসব ক্রুটি -বিচ্যুতি বর্তমান । তা সত্বেও যেহেতু রসূলুল্লাহ (সাঃ) কে সম্বোধন করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর পূর্বাপর সব ক্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দিয়েছেন, তাই সাধারণভাবে এ শব্দগুলো থেকেএ বিষয়টিও বুঝা যায় যে, আল্লাহর কাছে তাঁর রসূলের সমস্ত ক্রুটি-বিচ্যুতি ( যা কেবল তাঁর উচ্চ মর্যদার বিচারে ক্রুটি -বিচ্যুতি ছিল) ক্ষমা করে দেয়া হয়েছিল।এ কারণে সাহাবায়ে কিরামের যখন নবীকে (সাঃ) ইবাদাতের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক রকমের কষ্ট করতে দেখতেন তখন বলতেন , আপনার পূর্বাপর সমস্ত ক্রুটি-বিচ্যুতি তো ক্ষমা করা হয়েছে । তারপরও আপনি এত কষ্ট করেন কেন৷ জবাবে নবী (সাঃ) বলতেনঃ "আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দাও হবো না৷"(আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ)।”
মওদুদীর উপর আনিত ভিত্তিহীন অভিযোগঃ যে কোন মওদূদী (রঃ) বিরোধী মুজাহিদ মুজতাহিদ (?!) বলে ফেলেন যে মওদূদী (রঃ) নবী (সঃ) কে গোনাহগার বলেছেন, তাকে তার ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব নোংরামীর কাতারে অনেক বড় বড় আলেম ওলামা মুফতি মুহাদ্দিস সাহেবানও জড়িয়ে পড়েছেন। আমি ততবড় আলেম না হলেও একজন লেখক হিসাবে অন্ধ আনুগত্য করতে গিয়ে জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যায় করেছি মাওলানা মওদুদীর বিরোধিতা করার পেছনে। মাওলানা মওদুদীর (রঃ) উপর আরোপিত অভিযোগের একটি বড় এবং প্রধান অভিযোগ হলো মাওলানা মওদুদী (রঃ) বলেছেন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে গোনাহ করেছেন তাই তিনি নিস্পাপ নন। (নাআউজুবিল্লাহ) আর এটা করেছেন তওবা সম্পর্কিত আয়াতগুলোর তাফসীরে বিশেষতঃ সুরা নাসর এর ৩ নম্বার আয়াতে। তাই রাসুলুল্লাহ কে সম্বোধন করে তওবা সম্পর্কিত আয়াত গুলোর তাফসীরে প্রচীন ও আধুনিক তাফসীর গুলোতে কি লিখা হয়েছে আর মাওলানা মওদুদী (রঃ) কি লিখেছেন তার একটা তুলনা মূলক উপস্থাপনা আপনাদের সামনে পেশ করছি। বিজ্ঞ পাঠক মহলই ইনসাফের মানদন্ডে বিচার করে দেখবেন মাওলানা মওদুদীর অপরাধটা কি আর তার ব্যাখ্যার সাথে পূর্ববর্তিদের তাফসীরের ধারাবাহিকতা নেই কি ভাবে? মাওলানা মওদুদীর (রঃ) তাফসীর ও তাঁর অন্যান্য রচনা বুঝতে হলে তাঁর সংশ্লিষ্ট আয়াতের সম্পর্কিত অন্যান্য আয়াতের তাফসীর এবং ব্যাখ্যার গভীরতা বুঝার অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা থাকা লাগবে। এটা কেবল ই মাওলানা মওদুদীর বেলায় ই নয় যে কোন উচ্চজ্ঞান সম্পন্ন লেখকের বেলায় ই সমান ভাবে প্রজোয্য। তাই সেই মা^ঁপের আলেম না হলে যে কেউ কি ভাবে বিজ্ঞ আহলে ইলমদের বিষয়ে লাগামহীম মন্তব্য করে পারে? এটা তো কোন আহলে ইলমের ব্যবহার হতে পারেনা। প্রকৃত অর্থে সে আলেম হলেও স্বভাবগত ভাবে প্রতিহিংসা পরায়ণ হিংসুটে যেমনটা ইবলিসের স্বভাব ছিল। ইবলিস আলেম ও আবেদ ছিল পাশাপাশি জবরদস্ত অহঙ্কারী বে আদবও ছিল বলেই তার পতন ঘটে।
সার কথাঃ সার কথা এই যে, আহলুস সুন্নাতের সকলেই একমত যে, নবীগণ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো নিষিদ্ধ কর্ম করতে পারেন না। তবে অসতর্কতা বা ভুলের কারণে যা ঘটে তা পদস্খলন বলে অভিহিত। শারহে আকাইদ আন-নাসাফিয়্যাহ, পৃ. ১৩৯ উম্মাহর ঐক্য ঃ তাই এ বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর ইজমা এই যে, নবীগণ ওহী বা নুবুওয়াত লাভের পূর্বে ও পরে কুফরী থেকে সংরক্ষিত। অনুরূপভাবে অধিকাংশের মতে তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে কবীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়া থেকেও মা’সূম। হাশাবিয়া সম্প্রদায় এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে।
মাওলানা মওদুদী (রঃ) যেটা বুঝাতে চেয়েছেনঃ মাওলানা মওদুদী (রঃ) সুরা নাসরের তাফসীরে যেটা বুঝাতে চেয়েছেন: তার সারমর্ম হলো: (এক) নবী করীম (সঃ) তার উপর অর্পিত দায়িত্ব আল্লাহর দৃষ্টিতে শতভাগ পূর্ণ করেছেন কিন্তু নবী করীম (সাঃ) কি নিজের মনের মধ্যে এই চিন্তা করবেন যে তিনি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব শতভাগ পূর্ণ করেছেন ? না, বরং বিনয়ের কারণে তিনি আল্লাহর কাছে এই ভাবে কাকুতি করবেন যে তার দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে কিছু না কিছু হলেও ভুল ত্রুটি হয়েছে আল্লাহ যেন সেগুলো মাফ করে দেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে আমরা অনেক সময় ঢের আইটেম দিয়ে মেহমানদারি করে তারপর মেহমানকে বলি কিছুই খাওয়াতে পারলাম না শুধুই কষ্ট দিলাম। এই কথা আমরা বিনয়ের কারণে বলি। নবী করীম (সঃ) কেও ঠিক সেই বিনয় ভাবের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই শিক্ষা এজন্য দেওয়া হয়েছে যেন উম্মতরা বুঝতে পারি যে নবী করীম (সঃ) তার উপর অর্পিত দায়িত্ব শতভাগ পূর্ণ করার পরেও, নিজের মধ্যে বড়ত্বের ভাব সৃষ্টি করার পরিবর্তে বিনয়ের শিক্ষা দিতে ক্ষমা চাইতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন সেখানে আমরা সাধারণ মুসলমান আমাদেরকেতো সর্বদা মনের মধ্যে অপূর্ণতার জন্য ক্ষমা চাওয়ার ভাব সৃষ্টি করতেই হবে।মওদুদী (রঃ) এটাই বুঝিয়েছেন। কিন্তু আপনারা যারা এটা বুঝেন নি যে এটা নবীজির (সাঃ) মনের ভাবটাই বলেছেন তারাই তাদের কপালে থাপচাচ্ছেন এই বলে যে মাওলানা মওদুদী বলেছেন নবুওতির দায়িত্ব পালনে ত্রæটি করেছেন। (নাআউযুবিল্লাহ।) (দুই) তওবা একটি ইবাদত,তাই আল্লাহ যদি তার হাবীব ও বান্দাহকে ভুলের কারণেই হোক আর মর্য্যাদা বৃদ্ধির জন্যই হোক অথবা উম্মতকে বিণয় শিক্ষা দেয়ার জন্য হোক তওবা ইস্তেগফার করার কথা বলেই থাকেন তাহলে এটা কি আল্লাহর জন্য অন্যায় হয়ে গেল? (নাআউযুবিল্লাহ) তাহলে কি আপনারা চান কোরআনের আয়াতের অর্থ আপনারা যেটা চাইবেন সে রকম ই করা হবে নাকি আয়াত থেকে এই শব্দ বা বাক্যই বাদ দেয়া হবে? ইয়াহুদী ও খৃষ্টান ধর্মগুরুরা তো তাই করেছিল। লজ্জা লাগে আপনাদের আলেম বলতে। কারণ প্রথম বাক্যটি হচ্ছে ”আল্লাহ তা’য়ালার নিকট কাতর কন্ঠে এই আবেদন করুন” আবেদনটি আল্লাহর কাছে করতে স্বয়ং আল্লাহ ই বলেছেন। মওদুদীতো বলেন নি! এ কথাটি আপনাদের দেমাগে ঢুকলোনা যে আল্লাহর কাছে আল্লাহর নবীগণ ছাড়া আর কোন সাধারণ উম্মত এতোটা কাতর কন্ঠে বা বিণয়ী হয়ে বলার যোগ্যতা রাখেন ? নাকি আপনারা মনে করেন লৌকীক দরবেশ ই বিণয়ী? দ্বিতীয় বাক্যটি হচ্ছে- ’ভুল ত্রুটি’ যেটা মানুষের ফিতরত বা স্বত্তাগত স্বভাব। সে শিশু হোক যুবক প্রৌঢ়া কিংবা বৃদ্ধ। আম্বিয়ায়ে কেরামও মানুষ কিন্তু নবুওতির জিম্মাদারী পাওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের চাইতে উচ্চাসনে ছিলেন তাই তাদেরকে সাধারণ মানুষের স্বভাব থেকে মাহফুজ রাখা হতো। তার মানে এই নয় যে সাধারণ মানুষ বা উম্মত ভুল করলে গোনাহ করলে করণীয় কি এটা শিক্ষা দেয়ার জন্যও ভুলের ও উর্দ্ধে রাখা হয়েছে। মাহফুজ রাখা হয়েছে তার প্রাণ সংহারের ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের হাত থেকে, এটাই ইসমত এর প্রকৃত অর্থ। এখানে এটাই শিক্ষা দেয়া হয়েছে এই কথাটি কেবল বুঝানোর জন্য বলা হয়েছে আর তাতেই আপনার মতিভ্রম এতোটাই বেড়ে গেলো যে জিলাফির প্যাচ লাগিয়ে পাবলিকের কাছে অমৃত বেচাকেনা শুরু করলেন?
কোরআনে বর্ণিত আম্বিয়ায়ে কেরামের কিছু ঘটনাবলী ঃ কোরআন শরীফে আম্বিয়ায়ে কেরামের এমন অনেক ঘটনার উল্লেখ আছে যে গুলো বাহ্যত আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় হয়নি বলে সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা সতর্ক করে দিয়েছেন। এটাই নবী-রাসুলগনের বৈশীষ্ট্য যে আল্লাহ তায়ালা ক্ষণিকের জন্যও নবী-রাসুলগনকে ভুলের উপর থাকতে দেননা যা সাধারণ মানুষের বেলায় হয় না। কুরআন শরীফে আমরা এর অনেক উদাহরণ দেখতে পাই।
আদম হাওয়ার (আঃ) নিষিদ্ধ গাছের ফল বক্ষন ঃ (এক) সুরা বাক্বারার ৩৫ নম্বার আয়াত থেকে পরবর্তি আয়াতে এরশাদ হচ্ছে- অর্থাৎ এবং আমি আদমকে হুকুম করলাম যে তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করতে থাকো এবং ওখানে যা চাও, যেখান থেকে চাও, পরিতৃপ্তিসহ খেতে থাকো, কিন্তু এই গাছের নিকটবর্তী হয়ো না। অন্যথায় তোমরা জালিমদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়বে।” অনন্তর শয়তান তাদের উভয়কে ওখান থেকে পদস্খলিত করেছিল।” কোনো নবী (আ.) জেনেশুনে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহপাকের হুকুমের পরিপন্থী কোনো কাজ করেননি। এ ত্রুটি ইজতেহাদগত ও অনিচ্ছাকৃত এবং তা ক্ষমাযোগ্য। (মাআরিফুল কোরআন)
(দুই) তাবুকের যুদ্ধের সময় কিছু সংখ্যক মুনাফিক কৃত্রিম ওজর পেশ করে রাসুলে করীম (সঃ) এর নিকট যুদ্ধে গমন হতে নিষ্কৃতি চেয়েছিল, রাসুল (সঃ) স্বীয় স্বভাবজাত নম্রতা-সহনশীলতার কারণে এরা মিথ্যা বাহানা করতেছে জেনেও তাদেরকে রুখছত দিয়ে দিলেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এটা পছন্দ না করে এরূপ নম্রতা সমীচীন নয় বলে সাথে সাথে ওহী দ্বারা সতর্ক করলেন-عفا الله عنك لم أذنت لهم حتىٰ يتبيّن لك الذين صدقواْ وتعلم الكٰذبين হে নবী, আল্লাহ তোমাকে মাফ করুন। তুমি কেন এ লোকদের অনুমতি দিলে? যদি না দিতে তা হলে তোমার নিকট সুস্পষ্ট হত যে, কোন লোকেরা সত্যবাদী, আর মিথ্যেবাদীদেরকেও জানতে পারতে। (সুরা-তওবা,আয়াত ৪৩)।
(তিন) আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই মুনাফিকের মৃত্যুর পর তার ছেলের অনুরোধে রাসুলে করীম (সঃ) ঐ মুনাফিকের জানাযার নামাজ পড়াতে উদ্যত হয়ে গেলেন। সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা ওহী দ্বারা তাকে সতর্ক করলেন এবং নামায পড়ানো থেকে বিরত রাখলেন এই বলে যে-ولا تصلِّ عليٰٓ أحد منهم مات ابدا ولا تقم عليٰ قبره انهم كفرواْبالله ورسولهِ وماتواْ وهم فسقون তাদের কোন লোক মরে গেলে তার জানাযা তুমি কখনই পড়বেনা তার কবরের পাশেও দাঁড়াবেনা। কেননা তারা আল্লাহ ও তার রাসুলের সাথে কুফরী করেছে। আর মরেছে তারা ফাসেক অবস্থায়। (সুরা-তাওবা,আয়াত৮৪)। (চার) রাসুলে করীম (সঃ) তার কোন স্ত্রীর মনস্তুুস্টির জন্য মধু পান না করার কসম করেন। হালাল খাদ্য গ্রহণ না করার কসম করা রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর জন্য শোভনীয় নয় এ কথা জানিয়ে আল্লাহ তায়ালা তাকে ওহী দ্বারা অবগত করলেন যে- ياآيّها النبىّ لم تحرِّم مآ أحلّ الله لك – تبتغى مرضات أزوٰجك – والله غفوررحيم হে নবী। আল্লাহ তায়ালা যা তোমার জন্য হালাল করেছেন তা তুমি কেন নিজের জন্য হারাম করলে। তুমি কি তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি চাইতেছ? আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা-তাহরীম,১)।
(পাঁচ) হযরত নূহ (আঃ) সেই ঐতিহাসিক তুফানের সময় তাঁর কাফের ছেলেকে রক্ষার জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন করলেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার কাছে তা পছন্দনীয় হল না, তাই সাথে সাথে ওহী নাযেল করে জানিয়ে দিলেন যে-قال يا نوح انّه ليس من اهلك انّه عمل غير صالح – فلا تسئلن ما ليس لك به علم – إنىّٓ أعظك أن تكون من الجٰهلين আল্লাহ তায়ালঅ বলেন: হে নূহ! সে তোমার পরিবারভুক্ত নয় । সে অসৎ কর্ম পরায়ণ। সুতরাং যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নাই, সে বিষয়ে আমাকে অনুরোধ করনা। আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে,তুমি অজ্ঞদের অন্তরর্ভুক্ত না হও। (সুরা-হূদ আয়াত ৪৬)। (ছয়) হযরত মুসা (আঃ) যখন এক ব্যক্তিকে হত্যা করে ফেলেছিলেন তখন নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন هذا من عمل الشيطان এটা শয়তানের কান্ড। এ ছাড়াও কোরআন শরীফে অনেক উদাহরণ রয়েছে। সুতরাং এর একথা ঠিক নয় যে,“এমতাবস্থায় কোন নবীই সত্যের মাপকাঠি হতে পারেন না এবং তাদের উপর কোন সময়ই ভরসা করা যায় না। কেননা তাদের প্রত্যেক হুকুমেই সন্দেহ থাকবে যে, হয়ত এটা হেফাজত উঠিয়ে নেওয়ার সময়ের”।
মওদুদীকে অপবাদ দিতে ইমাম আবু হানিফার ফতোয়া কাঁটছাট ঃ দুঃখ জনক ব্যাপার হলো কওমী মাদ্রাসার কিতাবে ইমাম আবু হানিফার (রঃ) ফতোয়া কাটছাট!! করা হয়েছে। আমাদের ক্বওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের উচ্চতর পাঠ্য বই "ইসলামি আকিদা ও ভ্রান্তমতবাদ" নামের বিশাল একটি বইয়ে, এর লেখক হযরত মাওলানা হেমায়েত উদ্দিন সাহেব ইমাম আবু হানিফার (রহ) বক্তব্য'র শেষ অংশ"বাদ দিয়েছেন মাওলানা মওদুদ কে (রঃ) অভিযুক্ত করার অসৎ উদ্দ্যেশ্যে?! যা বর্তমান সময়ের অনেক ওস্তাদও হয়তো জানেন না!! এভাবেই মিথ্যা সবক নিয়ে নবীন কওমী আলেম তৈরী হচ্ছেন, ফলশ্রুতিতে ইসলামী ঐক্যের পিঠে ছুরি চালানো হচ্ছে। আর ক্বওমী মাদ্রসাগুলোর বোর্ডপরীক্ষায় কাল্পনিক একটি ভৌতিক মতবাদের নাম নিয়ে ছাত্রদের মিথ্যাচার শেখানো হচ্ছে। অনুরূপ শরহে আকায়ীদে নসফী شرح عقائد نسفى কিতাবের বাংলা অনুবাদ-এর মধ্যে একটি অধ্যায় সংজোযন করেছেন জামায়াতে ইসলামীকে বাতিল প্রমান করতে,, যা ম‚ল কিতাবে নাই!! এটা আলাদাই করতে পারতেন। এ রকম কিতাব/বই তো আরো কম বেশী আশিটি বাজারে আছে। তাহলে ইমাম আবু হানীফার নামে এই টাটকা মিথ্যাচার কেন ? (হয়তো এসব ক্বওমী মাদ্রাসা বোর্ড কর্তৃপক্ষ খেয়াল করেন নি আর করলে ইচ্ছে করেই করেছেন বলে ধরে নেয়া যায়।) এটা কি প্রাতিষ্ঠানিক ফিতনার বীজ বপন নয়?
আমাদের কথা ঃ বিবেকের আদালতে বিচার (১) রাসুল (সাঃ) কে সম্বোধন করে তওবা ইস্তেগফার করার নির্দেশ সম্বলিত আয়াতের এ গুলো হলো মাওলানা মওদূদীর (রঃ) নিজের লিখিত ব্যাখ্যা। আমি তন্ন তন্ন করে প্রাচীণ ও আধুনিক তাফসীর গুলো মিলিয়ে এর বক্তব্য সারাংশ বিশ্লেষন করে দেখেছি যে প্রাচীণ তাফসীর গুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়েছে। এমনকি আমার কাছে মনে হয়েছে যে মাওলানা মওদুদী (রঃ) প্রাচীন তাফসীর গ্রন্থগুলোর কোন কোনটির হু বহু ই অনুবাদ করেছেন অথবা গুরুত্বপুর্ণ অংশগুলো ই কোর্ট করেছেন তবে সবগুলোর ই রেফারেন্স দিতে ভুলেননি। এরপরেও কেউ যদি আম্বিয়াদের (আঃ) বিশেষ করে হুজুর পাক (সঃ) কে মাওলানা মওদুদী কর্তৃক গোনাহগার বলার এমন আজগুবী অভিযোগটি নিজের মুখে উচ্চারণ করেন তাহলে ধরেই নিতে হবে তিনি মানসিক রোগী, নয়তো মওদূদী এলার্জিতে ভুগছেন। (২) প্রাচীণ তাফসীর ছাড়াও আরিফ বিল্লাহ আল্লামা ছানাউল্লাহ পানিপথি (রঃ) এর তাফসীরে মাজহারী, শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভী (রঃ) এর তাফসীরে আজিজয়িয়া, সহ আধুনিক তাফসীর গুলোর মধ্যে আমাদের আকাবীরে দেওবন্দের শীর্ষ আকাবীর আমাদের সরেতাজ ওলামায়ে কেরামদের তাফসীরের কোন কোনটিতে গোনাহ শব্দ উচ্চারণ বিশেষতঃ শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দীর (রঃ) তরজমামায়ে শায়খুল হিন্দ,হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানবীর (রাঃ) তাফসীরে আশরাফী, আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী (রঃ) এর তাফসীরে উসমানী প্রমুখ গোনাহ শব্দ উচ্চারণ করেছেন যা মাওলানা মওদুদী (রঃ) করেননি। তারা গোনাহর কিছু উদাহরণ পেশ করে এ গুলোকে অপ্রকৃত গোনাহ এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে গোনাহ বা অপরাধও বলেছেন কিন্তু মাওলানা মাওদুদী আল্লাহর দৃষ্টিতেও ত্রæটি বিচ্যুতি বলেছেন গোনাহ বলেননি। আল্লাহ তায়ালা সবই মাফ করে দিয়েছেন এবং নির্দেশটাকে নেতা হিসাবে নেতার প্রতি সম্বোধন করে জাতির গোনাহ এবং জাতির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজের মর্য্যাদা আরো সমুন্নত করার নবীজির ভাষায় কৃতজ্ঞ হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। মাওলানা মওদুদী (রঃ) তওবার নির্দেশকে উম্মতের জন্য বিণয়ী হওয়ার আদব,দোয়ার আদব,কোন সফলতাকে নিজের কৃতিত্ব না ভেবে আল্লাহর কুদরত ও নুসরত এর জন্য সম্ভব হয়েছে এই মনোভাব জাগ্রত করার শিক্ষা দেয়া হয়েছে বলেছেন। (৩) মাওলানা মওদুদী (রঃ) বলেছেন- রাসুলগন (আঃ) শুধু নসিহত প্রেরন করেন না, তারা নির্ভেজাল আনুগত্যও দাবি করেন! এ দাবী আল্লাহর হুকুম! এর প্রয়োজনে রাসুলদের (আঃ) জীবন এবং শিক্ষাকে নিষ্কলুষ রাখা হয় এবং তাদের নিস্পাপ হওয়াও জরুরী হয়ে পড়ে! ইসমতে আম্বীয়া সম্পর্কে মাওলানার আক্বিদা শুরু থেকেই স্বচ্ছ ছিলো!কোন কোন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, নবীরা ফেরেশতাদের মতো নিস্পাপ নয়! এই কথাটির ভাব না বুঝেই কিছু লোক লাফ দিয়ে উঠলেন যে, তিনি আম্বীয়াদের নিস্পাপ মনে করেন না! অথচ তিনি যা বলেছেন সেটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা ।
কোন মুমিনকে কাফের বলা জায়েজ নয় ? অপর দিকে--ইমাম আবু হানিফা (রঃ) বলেছেন --وَلاَ نُكَفِّرُ مُسْلِماً بِذَنْبٍ مِنَ الذُّنُوْبِ وَإِنْ كَانَتَ كَبِيْرَةً إِذَا لَمْ يَسْتَحِلَّهَا، وَلاَ نُزِيْلُ عَنْهُ اسْمَ الإِيْمَانِ، وَنُسَمِّيْهِ مُؤْمِناً حَقِيْقَةً وَيَجُوْزُ-- অর্থাৎ আমরা কোনো মুসলিমকে পাপের কারণে কাফির বলিনা, যদি তা কবীরাও হয়, যতক্ষণ না সে ব্যক্তি এই পাপকে হালাল বিশ্বাস করে। আমরা পাপের কারণে কোনো মুসলিমের ‘ঈমান’-এর নাম অপসারণ করি না। অথচ আমরা অহরহ-ই মোসলমানদেরকে,কারণে অকারণে কাফের গোমরাহ ফতোয়া দিয়েই যাচ্ছেন। ডাঃ জাকির নায়েকের মতো বিশ্ববরেণ্য দা'য়ী ইলাল্লøাহকেও ইহুদীর দালাল, এমনকি কাফের বলেছেন কেউ কেউ এবং অতীতে আমরাই আমাদের এক মুরব্বি আলেম, হাজার হাজার আলেমের উস্তাদ, যিনি আমাদের তওবার রাজনীতির আহŸান জানিয়েছিলেন, সেই হাফেজ্জি হুজুর (রঃ) ও শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রঃ) কেও কাফির ফতোয়া দিয়েছিলেন আমাদেরই আকাবীরে উলামা ! তারা এর রুজু না করেই দুনিয়ার সফর শেষ করে গেছেন। জানিনা এ জন্য আল্লাহর আদালতে আটকা পড়তে হয় কি না। আরেক দল হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবীকে (রঃ) কাফির ফতোয়া দিয়েছিলেন!! জানিনা তাদেরও কি অবস্থা হয় হাশরের মাঠে?
মাওলানা মওদুদী (রঃ) ও জামায়াতীদের নিয়ে প্রশ্ন “মওদূদী দস্তুর”
মাওলানা মওদূদী (রঃ) ইছমতে আম্বিয়া সম্পর্কে কোন কথা কোরআন হাদীস কিংবা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আ’ক্বীদার খেলাফ বলেন নি। সুতরাং এ কথা বা এই প্রশ্ন অত্যন্ত নিন্দনীয় অসত্য ও অবান্তর যে,মাওলানা মওদুদী (রঃ) ও জামায়াতে ইসলামীর লোকেরা মুসলমান কি না?!
“মওদূদী দস্তুর” নামক বইয়ে লেখা হয়েছে “এখন বলুন উপরুল্লেখিত আক্বীদা যা তাফহীমাতে উল্লেখিত আছে যা প্রত্যেক নবী সম্পর্কে, যাদের মধ্যে হযরত রাসুলুল্লাহও (সাঃ) আছেন, কতটুকু ইসলামের মূলনীতি ও আ’কীদার সাথে সামঞ্জস্যশীল? যাতে প্রত্যেক নবী থেকে ইছমত এবং হেফাজত উঠিয়ে নেওয়া এবং ইচ্ছে করে ভুল ত্রুটি করানো স্বীকার করা হয়েছে। এমতাবস্থায় কোন নবীই সত্যের মাপকাঠি থাকতে পারেন না। এবং কোন নবীর উপর সর্বদা ভরসাও করা যায় না। যে হুকুমই হোকনা কেন এতে এ সন্দেহ থাকবে যে, হয়ত এটা ইছমত ও হেফাজত উঠিয়ে নেওয়ার সময়ের। এখন বলুন এ মতভেদ মৌলিক না আংশিক এবং বলুন জামায়াতে ইসলামী এবং উহার প্রতিষ্ঠাতা মুসলমান কিনা ?” এই সমালোচনা থেকে ৩টি কথা স্পষ্ট । (এক) আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছে করে তার হেফাজত উঠিয়ে প্রত্যেক নবী থেকে ভুলত্রুটি হতে দিয়েছেন, এটা ইসলামী আক্বীদা বিরোধী। (দুই) এমতাবস্থায় কোন নবীই সত্যের মাপকাঠি হতে পারেন না এবং তাদের উপর কোন সময়ই ভরসা করা যায় না। কেননা তাদের প্রত্যেক হুকুমেই সন্দেহ থাকবে যে, হয়ত এটা হেফাজত উঠিয়ে নেওয়ার সময়ের। (তিন) মাওলানা মওদূদী ও জামায়াতে ইসলামীর লোকেরা মুসলমান নন।
ভিত্তিহীন অভিযোগ এই ভিত্তিহীন অভিযোগ গুলো মেনে নেয়া যায়না কারণÑ (এক) আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়া’তের সকল উলামায়ে কেরামের ঐক্যমত যে, ভুল বশতঃ নবীদের থেকে ছগীরা গুনাহ হতে পারে এবং জমহুর উলামাদের মতে ইচ্ছাকৃতভাবেও ছগীরা গুনাহ হতে পারে। এমতাবস্থায় যদি হেফাজত উঠানো না হয়, তবে বুঝা যাবে যে,একদিকে আল্লাহর হেফাজত আছে, আর অন্যদিকে নবীদের থেকে ভুল ত্রুটি তথা ছগীরা গুনাহ প্রকাশ পাচ্ছে যা অসম্ভব। এতে পরোক্ষ ভাবে আল্লাহ তায়ালা হেফাজতের উপর পুর্ণ সক্ষম নন বলে প্রকাশ পায়। (নাউজুবিল্লাহ) অতএব মানতেই হবে যে, যখনই নবীদের থেকে কোন ত্রুটি বিচ্যুতি প্রকাশ পায় তখন আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছে করে তার হেফাজত উঠিয়ে তা করতে দেন মানব জাতীকে শিক্ষা দেয়ার জন্য। (দুই) মুহাক্কেক বা নির্ভরযোগ্য উলামাদের মতানুসারে যখনই নবীদের থেকে কোন"লগজীস" হয় তখনই তাদেরকে অবহিত করা হয়। যাতে তারা এ থেকে বিরত থাকেন। আল্লামা তাফতাজানী ও আল্লামা আলুসী (রঃ) বলেছেন-لٰكن المحققين اشترطوا ان ينبهوا عليه মুহাক্কে’ক উলামাগন শর্ত করেছেন যে, তাদেরকে এর উপর (লগজিশের) যেন সতর্ক করা হয়। (রুহুল মা’আনী ১৬/ ২৭৪)।
’মওদুদী দস্তুর’ নামক বইয়ে আনিত এই অভিযোগ যদি মেনে নেয়া যায় তাহলে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) ইমাম ত্বাহাবী,ইমাম মাতুরিদী, ইমাম ইবনে তাইমিয়া,আল্লামা তাফতাজানী,আল্লামা আলুসী, ইমাম ফখরদ্দীন রাযী,হাকীমুল উম্মৎ মাওলানা আশরাফ আলী থানবী,মুফতি শফী রহিমাহুমুল্লাহ এমন কি আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়া’তের সমস্ত উলামায়ে কেরামদের অভিমত বা মতামত অকার্য্যকর নয় কি?
সাহাবা সমালোচার ভিত্তিহীন অভিযোগঃ অভিযোগ করা হয়ে থাকে মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা করেছেন। তিনি সাহাবায়ে কেরাম বিদ্ধেষী। এই অভিযোগের অসারতা প্রমাণের জন্য আমাদের কোন জবাব দেয়ার দরকার পড়েনা বরং মাওলানা মওদুদী (রঃ) সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে কেমন উচ্চতর ধারণা বিশ্বাস রাখতের তা তার লিখিত উক্তিই প্রমাণ করে। যেমন তিনি লিখেছেনÑ ১. সংস্কার সংশোধন এবং তাকওয়া ও পরহেজগারির দিক থেকে সাহাবারা এমন উচ্চতর শিখরে আরোহণ করতে পেরেছিলেন, পৃথিবীতে কোনো মানব সমাজ কখনো সে স্তরে পৌঁছাতে পারেনি। (রাসায়েল ও মাসায়েল, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-১১০) ২. তোমাদের মর্যাদা এত বেশি যে, আল্লাহর আরশের ধারক ফেরেশতারা এবং তার চারপাশে অবস্থানরত ফেরেশতারা পর্যন্ত তোমাদের সহযোগী। (তাফহীমুল কুরআন, সুরা গাফির, টীকা-৬) ৩. সাহাবাদের সাথে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করা আমার দৃষ্টিতে স্বয়ং ইসলাম ও রাসূল’র (সাঃ) সাথে দুশমনী করার সমতুল্য। (সাহাবায়ে কেরামদের মর্যাদা, পৃ.১০) ৪. সাহাবাদের নিন্দা করা এবং তাঁদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা জায়েয নেই। আল্লাহর অনুগ্রহে এ কাজ আমি কখনো আমার কোনো রচনায় করিনি। (রাসায়েল ও মাসায়েল, ৫ম খন্ড,১২৪) ৫. যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরামদের মন্দ বলে, আমার মতে সে কেবল ফাসিকই নয়, বরং তার ঈমানই সংশয়পূর্ণ। (রাসায়েল ও মাসায়েল, ৫খন্ড, পৃষ্ঠা-২১) ৬. রাসূল (সাঃ) এর সঙ্গী সাথী এমন যে, কেউ তাদের একবার দেখা মাত্রই বুঝতে পারবে যে তারা সৃষ্টির সেরা। কারণ, তাদের চেহেরায় আল্লাহ -ভীরুতার দীপ্তি সমুজ্জ্বল।(তাফহীমুল কুরআন, সূরা ফাতাহ, টীকা-৫৪) ৭. রাসূল (সাঃ) যে সৌভাগ্যবান লোকদের প্রশিক্ষণ দান করেছিলেন, মানবজাতির ইতিহাসে তাঁরা ছিলেন অতুলনীয়। এই সৌভাগ্যেবান পবিত্রাত্মার মনীষীদের একজন ছিলেন হযরত উমর (রাঃ)। (সাহাবায়ে কেরামদের মর্যাদা,পৃষ্ঠা-৩২) ৮. সালফে সালেহীনদের মধ্যে যদিও সাহাবীদের সংজ্ঞা নিয়ে মতপার্থক্য ছিল, কিন্তুু যে-কোনো সংজ্ঞানুযায়ী মুআবিয়া (রাঃ)-সাহাবীর মর্যাদা লাভ করেছিলেন। তার কোনো কোনো ব্যক্তিগত কাজ দেখার বিষয়,কিন্তুু সামগ্রিকভাবে তাঁর খেদমত ও পুরস্কার নিশ্চিত ব্যাপার। (সাহাবায়ে কেরামদের মর্য্যাদা পৃষ্ঠা-২২) ৯. হযরত মুআবিয়া (রাঃ) যথার্থই বিপুল গুনের অধিকারী ছিলেন। তার সাহাবী হওয়ার মর্যাদাও অতীব সম্মানার্থ। তিনি মুসলিম জাহানকে পুনরায় এক পতাকাতলে সমবেত করেন এবং বিশ্বে ইসলামের বিজয়ের গতি পূর্বের চেয়েও দ্রæত করেন। তাঁর এসব খেদমত অনস্বীকার্য। (খেলাফত ও রাজতন্ত্র,পৃষ্ঠা-১৫২)
আক্বীদা ঃ মুজিযা,কারামাত, ইসতিদরাজ ও জাদু সম্পর্কে
অলৌকিক (خوارق) বিষয়াদির প্রকারভেদ
প্রকৃতিগত উপায়-উপকরণের সাহায্য ব্যতীত মানুষের নিকট থেকে প্রকাশ পাওয়া সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম অলৌকিক বিষয়াদি (خوارق العادت) সাত প্রকার। যথা : মু‘জিযা, কারামাত, ইসতিদরাজ,মাউনাত,ইরহাস,ও ইহানত। (معجزة، كرامة، معونة إرهاص، استدراج، إهانة) ছয়টি বিষয়ের পৃথক পৃথক সংজ্ঞা উল্লেখ করা হচ্ছে, যাতে একটিকে অপরটি থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা সহজ হয়। যেমন শরহুল আকায়েদের ভাষ্যগ্রন্থ আন-নিবরাস (২৭২ পৃষ্ঠা)প্রণেতা আল্লামা আবদুল আযীয আল ফারহারী বলেন-أقسام الخوارق سبعة، أحدها : المعجزة من الأنبياء، ثانيها : الكرامة للأولياء، ثالثها : المعونة لعوام المؤمنين ممن ليس فاسقا ولا وليا، رابعها : الإرهاص للنبي قبل أن يبعث، كتسليم الأحجار على النبي صلى الله عليه وآله وسلم، وأدرجه بعضهم في الكرامة وبعضهم في المعجزة مجازا، خامسها : الاستدراج للكافر والفاسق المجاهر على وفق غرضه، سمي به لأنه يوصله بالتدريج إلى النار، سادسا : الإهانة للكافر والفاسق على خلاف غرضه كما ظهر عن مسيلمة الكذاب إذ تمضمض في ماء فصار ملحا، ومس عين الأعور فصار أعمى، سابعها : السحر لنفس شريرة تستعمل أعمالا مخصوصة بإعانة الشيطان، ومنهم من لا يعده خارقا لأن العادة جارية بظهوره عن كل من يزاول هذه الأعمال، والكهانة من السحر وهي الإخبار بما سمع من الجن. অর্থাৎ খাওয়ারিক মানুষের নিকট থেকে প্রকাশ পাওয়া সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম বিষয়াদি সাত প্রকার: ১. মু‘জিযা,যা নবীগণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ২. কারামত, যা ওলীদের নিকট থেকে প্রকাশ পায়। ৩. মাউনত যা ফাসেক বা ওলী নয় এমন সাধারণ মুমিনের নিকট থেকে প্রকাশ পায়। ৪. ইরহাস যা নবুওতপ্রাপ্তির পূর্বে নবীর নিকট থেকে প্রকাশ পায়। যেমন পাথর কর্তৃক নবী (সাঃ) কে সালাম করা। কেউ কেউ এটাকে কারামাতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, আর কেউ মু‘জিযার মধ্যে, মাজায স্বরূপ। ৫. ইসতিদরাজ যা কাফেরের অথবা প্রকাশ্য পাপাচারী ব্যক্তির নিকট থেকে তার উদ্দেশ্যের অনুকূলে প্রকাশ পায়। এটাকে এজন্য ইসতিদরাজ বলা হয় যে, এটা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ক্রমে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। ৬. ইহানত যা কাফের বা পাপাচারী ব্যক্তির নিকট থেকে তার উদ্দেশ্যের বিপরীতে প্রকাশ পায়। যেমন মুসায়লামা কাযযাবের (যে মিথ্যা নবুওতের দাবি করেছিল) নিকট থেকে প্রকাশ পেয়েছিল যখন সে একবার পানিতে কুলি নিক্ষেপ করলো, কিন্তু পানির লবণাক্ততা দূরীভূত হওয়ার পরিবর্তে আরও বেশি লবণাক্ত হয়ে যায়। (এমনিভাবে সে একবার কূপের পানি বৃদ্ধি করার জন্য কূপের পানিতে কুলি নিক্ষেপ করে ফলে কূপের পানি বৃদ্ধি পাওয়ার পরিবর্তে আরও শুকিয়ে যায়।) একবার এক ব্যক্তির কানা চোখ সুস্থ করার জন্য হাতের ছোঁয়া দেয়, ফলে তার উভয় চোখ অন্ধ হয়ে যায়। ৭. জাদু যা শয়তানের সাহায্যে কিছু বিশেষ কর্মকা- সম্পাদন বা কিছু উপায়-উপকরণ অবলম্বনের মাধ্যমে মন্দ প্রকৃতির লোকের নিকট থেকে প্রকাশ পায় এটাকে কেউ কেউ খাওয়ারিক অর্থাৎ সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রমী বিষয়াদির মধ্যে গণ্য করেননি। কারণ, যে কোনো ব্যক্তি উক্ত বিশেষ কর্মকাজ- সম্পাদন করে অথবা বিশেষ কিছু উপায়-উপকরণ অবলম্বন করে তার দ্বারা এরূপ ব্যতিক্রম কিছু প্রকাশ করা সম্ভব। আর কাহানাত (রাশি গণনা বা ভাগ্য গণনা) জাদুর অন্তর্ভুক্ত। কাহানাত হল জিনদের সাহায্যে অদৃশ্য বিষয়ের সংবাদ বলা। (আন নিবরাস, পৃ. ২৭২)
মুজিযা المعجزة কি ঃ মুজিজা المعجزة আরবী শব্দ এর অর্থ অভিভূতকারী। বস্তুত অলৌকিক কোনো কাজের পারিভাষিক শব্দরূপে মুজিজা শব্দটি ব্যবহৃত হয়। মুজিজা হলো নবী-রাসুলের নিজস্ব দাবীর সমর্থনে এমন অলৌকিক ও আশ্চর্য ঘটনা ঘটিয়ে দেখানো, যা নবী-রাসুল ব্যতীত অন্য কারও পক্ষে ঘটানো আদৌ সম্ভব নয়। নবী-রাসুলের (আঃ) বাইরে কামেল বুজুর্গদের মাধ্যমে অলৌকিক কার্য সম্পাদন হলে তাকে বলা হয় কারামাত। বলা হয়েছে যে- أولياء الله عز وجل هم المؤمنون المتقون، فكل مؤمن تقي، هو لله ولي، بقدر إيمانه وتقواه، فمن جمع بين الإيمان وفعل الأوامر وطاعة الرحمن والتقوى فهذا هو الولي، আল্লাহর ওলী তারাই যারা মুমিন মুত্তাক্বী তাদের ঈমানের পরিমাণ অনুযায়ী। যারা যত বেশী আমলে সালেহ করবে আল্লাহর আনুগত্য বেশী করেন তারাই ওলী। ( কারামাতুল আউলিয়া পৃঃ ৬২) পরিভাষাগত অর্থে, মুজিযার সংজ্ঞা হলো-المعجزة أمر خارق للعادة، داعية إلى الخير والسعادة، مقرونة بدعوى النبوة، قصد به إظهار صدق من ادعى أنه رسول من الله মু‘জিযা এমন বিষয়, যা অলৌকিক এবং সাধারণ ও চিরাচরিত নিয়মের ব্যতিক্রমরূপে প্রকাশ পায় এবং কল্যাণ ও সৌভাগ্যের প্রতি আহ্বান করে, যা নবুওতের দাবীর সাথে সংশ্লিষ্ট এবং তার দ্বারা এমন ব্যক্তির সত্যবাদিতা প্রকাশ করা উদ্দেশ্য, যিনি দাবী করেন যে, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত। নবী-রাসুল থেকে প্রকাশিত অলৌকিক বিষয়াবলিকে মুজিজা বলা হয়। আর নবী-রাসুল ব্যতীত অন্যদের থেকে প্রকাশিত অলৌকিক বা আশ্চর্যজনক ঘটনাকে কারামত বলা হয়। মুজেযা ও কারামতি আল্লাহ তায়ালার একান্ত অনুগ্রহ যা আল্লাহ তায়ালা ইসলামের প্রয়োজনে তার ইচ্ছামাফিক নবী-রাসুলদের এবং অলী আউলিয়াদের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। এটি ব্যক্তিবিশেষ কে দেখানো বা ক্ষমতা জাহির করার কোনো বিষয় নয়। কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আক্বীদা’ কিছু বিষয় হলো মুজিযা, কারামাত ও ইসতিদরাজ। আমরা এখানে এর সার সংক্ষেপ তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। মুজেযা হলো আরকানুল ঈমান এর একটি, যার সম্পর্ক নবী-রাসুলগনের সাথে সম্পর্কিত। দ্বিতীয়-তৃতীয় হিজরী শতাব্দী থেকে মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ নবীগণেরর অলৌকিক কর্মকে ‘মুজিযা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, কারণ নুবুওয়াতের চ্যালেঞ্জ হিসেবে কাফিরদের অক্ষমতা প্রকাশ করার জন্য আল্লাহ তাদের মাধ্যমে তা প্রকাশ করবেন। অনুরূপভাবে তাঁরা ওলীদের অলৌকিক কর্মকে ‘কারামত’ নামে আখ্যায়িত করেছেন, যেন মানুষ বুঝতে পারে যে, এরূপ অলৌকিক কর্ম ওলীর কোনো ক্ষমতা বা শক্তি নয়,বরং একান্তই আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘ইকরাম’ বা সম্মাননা মাত্র।(শারহু ফিকহুল আকবার, পৃষ্ঠা ১৩০-১৩৩ মোল্লা আলী কারী) কোরআনের ভাষায় এটাকে (الآية) ও বলা হয়। সকল নবী-রাসূল ই আয়াত বা মুজিযা প্রাপ্ত ছিলেন। (শারহু ফিকহিল আকবার, পৃ. ১৩০,আত-তা’রীফাত,পৃ. ২৮২) মুজিজা ও কারামত হলো নবী-রাসুল (আঃ) ও অলী আউলিয়াদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার একান্ত অনুগ্রহ। আল্লাহ তায়ালা ইসলামের প্রয়োজনে তার ইচ্ছামাফিক এই ক্ষমতা নবী-রাসুল (আঃ) বা অলী আউলিয়াদের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। এটি ব্যক্তি বিশেষকে দেখানো বা ক্ষমতা জাহির করার কোনো বিষয় নয়।
আল্লামা মীর সায়্যিদ শরীফ জুরজানী (রঃ) আল্লামা মীর সায়্যিদ শরীফ জুরজানী (রঃ) (৭৪০ হি.-৮১৬ হি.) মু‘জিযার সংজ্ঞায় বলেন المعجزة أمر خارق للعادة داعية إلى الخير والسعادة مقرونة بدعوى النبوة، قصد به إظهار صدق من ادعى أنه رسول من الله. মু‘জিযা এমন বিষয়,যা অলৌকিক বা সাধারণ ও চিরাচরিত নিয়মের ব্যতিক্রমরূপে প্রকাশ পায় এবং কল্যাণ ও সৌভাগ্যের প্রতি আহ্বান করে,যা নবুওতের দাবীর সাথে সংশ্লিষ্ট এবং তার দ্বারা এমন ব্যক্তির সত্যবাদিতা প্রকাশ করা উদ্দেশ্য, যিনি দাবি করেন যে,তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত। (আততা‘রীফাত,পৃষ্টা ২২৫)
আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রঃ)ঃ আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রঃ -৮৪৯ হি.-৯১১ হি.) মু‘জিযার সংজ্ঞা পেশ করেছেন এ ভাবে যে -أمر خارق للعادة، مقرون بالتحدي سالم عن المعارضة.মু‘জিযা এমন বিষয়, যা অলৌকিক বা সাধারণ ও চিরাচরিত নিয়মের ব্যতিক্রম, প্রতিদ্ব›িদ্ধতার আহ্বানযুক্ত এবং মোকাবিলার আশঙ্কামুক্ত। (আল ইতকান, খন্ড৪, পৃষ্ঠা৩০৩)
আল মু‘জামুল ওয়াসীতঃ আল মু‘জামুল ওয়াসীত অভিধানে মু‘জিযার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এ ভাবে-هي أمر خارق للعادة يظهره الله تعالى على يد النبي،تأييدا لنبوته،وما يعجز البشر أن يأتوا بمثله অর্থাৎ- মু‘জিযা عجز হল অলৌকিকভাবে প্রকাশিত সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম বিষয়, যা আল্লাহ তায়ালা কোনো নবীর মাধ্যমে প্রকাশ করেন, তাঁর নবুওতের প্রতি সমর্থন-দান বা তার নবুওতকে শক্তিশালী করার জন্য এবং যা মানুষকে তার অনুরূপ ব্যতিক্রমী বিষয় উপস্থাপন করতে অক্ষম করে দেয়।’
ইমাম কুরতুবী (রঃ) মুজিযার শর্তাবলী ঃ ইমাম কুরতুবী (রঃ) বলেছেন উপরুল্লেখিত সংজ্ঞা থেকে বোঝা যায় মু‘জিযার মধ্যে চারটি বৈশিষ্ট্য থাকা শর্ত,তাহলে তা মু‘জিযা বলে গণ্য হবে। শর্তগুলো হচ্ছে- (এক) অলৌকিক বা সাধারণ ও চিরাচরিত নিয়মের ব্যতিক্রম হওয়া। (দুই) কল্যাণ ও সৌভাগ্যের প্রতি আহ্বান করা। (তিন) নবুওতের দাবির সাথে সম্পৃক্ত হওয়া। (চার) যিনি নিজেকে আল্লাহর রাসূল বলে দাবী করেন, তার দাবীর সত্যতা প্রকাশ করা উদ্দেশ্য থাকা। মু‘জিযা নামকরণের কারণ : ইমাম কুরতুবী মুজিযার নামকরণ সম্পর্কে বলেন- سميت (أي المعجزة) معجزة لأن البشر يعجزون عن الإتيان بمثلها. মু‘জিযা-কে মু‘জিযা বলা হয়, কেননা, মানুষ এর অনুরূপ কিছু পেশ করতে অক্ষম হয়ে থাকে।’ (তাফসীরে কুরতুবী, মুকাদ্দিমা,পৃ. ৬৯)
মুজিযার প্রকার ভেদঃ মু‘জিযা দু’প্রকারÑ (এক) ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মু‘জিযা বা (معجزة حسية) যে মু‘জিযা উপলব্ধি করা যায়,তাকে معجزة حسية বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মু‘জিযা বলে। যেমন, মূসা (আঃ)এর লাঠি সাপে রূপান্তরিত হওয়া, তাঁর শ্বেত-শুভ্র হাত ইত্যাদি। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মু‘জিযাগুলো সাধারণত সাময়িক এবং অস্থায়ী হয়। যেমন মুসা (আঃ) এর লাঠি ও হাত শুভ্র হয়ে যাওয়া,সালেহ (আঃ) এর উষ্ট্রি। (দুই) (معجزة عقلية ) বা যুক্তিগ্রাহ্য মু‘জিযা । যে মু‘জিযা বাহ্যিক ইন্দ্রিয়শক্তি দ্বারা উপলব্ধি করা যায় না, বরং যুক্তি ও জ্ঞান দ্বারা অনুধাবন করা যায়, তাকে معجزة عقلية বা যুক্তিগ্রাহ্য মু‘জিযা বলা হয়। যেমন মহাগ্রন্থ কুরআনে কারীম। যুক্তিগ্রাহ্য মু‘জিযা সাধারণত চিরন্তন ও স্থায়ী হয়। যেমন কোরআনুল করীম সম্পর্কে আল্লাহর বানী- اِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ.‘আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং অবশ্য আমিই এর সংরক্ষক।’ (সূরা হিজর ৯)
হাদীসে এর অনুকুলে বিবরণ রয়েছে এ ভাবে যে- مَا مِنَ الأَنْبِيَاءِ نَبِيٌّ إِلَّا أُعْطِيَ مَا مِثْلهُ آمَنَ عَلَيْهِ البَشَرُ، وَإِنَّمَا كَانَ الَّذِي أُوتِيتُ وَحْيًا أَوْحَاهُ اللَّهُ إِلَيَّ، فَأَرْجُو أَنْ أَكُونَ أَكْثَرَهُمْ تَابِعًا يَوْمَ القِيَامَةِ. ‘নবীগণের মধ্যে প্রত্যেক নবীকে এমন নিদর্শন প্রদান করা হয়েছে, যার প্রতি মানুষ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করেছে, আর আমাকে যে নিদর্শন প্রদান করা হয়েছে তা হল ওহী, আল্লাহ তাআলা আমার নিকট তা প্রেরণ করেছেন। আমি আশা করি যে, আমি হব তাদের মধ্যে সর্বাধিক অনুসারীর অধিকারী।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫২) এই হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূূতী (রঃ) বলেছেন-‘বনী ইসরাঈলের নবীগণের অধিকাংশ মু‘জিযা ছিল ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য। কেননা সে যুগের মানুষের মেধা ছিল দুর্বল এবং তাদের সূক্ষ¥ বিষয় উপলব্ধি করার মতো জ্ঞান ছিল কম। আর এ উম্মতের সামনে প্রকাশিত নবী করীম (সাঃ) এর অধিকাংশ মু‘জিযা হল যুক্তিগ্রাহ্য। এর কারণ প্রথমত এই যে, এ উম্মতের মেধা ও বোধশক্তি পূর্ববর্তী উম্মতসমূহের তুলনায় প্রবল ও ঋদ্ধ। দ্বিতীয়ত এই ইসলামী শরীয়ত কিয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে। তাই এ উম্মতের জন্য যুক্তিগ্রাহ্য ও স্থায়ী মু‘জিযা প্রদান করা হয়েছে, যাতে জ্ঞানবান লোকেরা তা দেখতে পায়। (আলইতকান, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩০৩)
মুজিযা শব্দের ব্যবহার ঃ মুজিযা المعجزة শব্দটি আরবী ‘ইজায’ إعجاز শব্দ থেকে গৃহীত, যার অর্থ ‘অক্ষম করা’। মুজিযা অর্থ ‘অক্ষমকারী অলৌকিক নিদর্শন’’। নবীগণ তাঁদের নুবুওয়াতের দাবি প্রমাণ করতে যে সকল অলৌকিক কর্ম বা নিদর্শন প্রদর্শন করতেন সেগুলিকে মুজিযা বলা হয়। মুজিযা শব্দটি কুরআন-হাদীসে ব্যবহৃত হয় নি। কুরআন ও হাদীসে মুজিযা বুঝাতে ‘আয়াত’ الآية অর্থাৎ ‘চিহ্ন’ বলা হয়েছে। পরবর্তী যুগে আলিমগণ ‘মুজিযা’ পরিভাষাটি ব্যবহার করেন। হিজরী ২য় শতকেও এই শব্দটি পরিচিতি লাভ করেনি বলেই প্রতিয়মান হয়।কারণ ইমাম আবু হানিফাও (রঃ)‘মুজিযা’ বুঝাতে ‘আয়াত’শব্দটিই ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেন-والآيات ثابتة للأنبياء عليهم الصلاة والسلام، والكرامات للأولياء حق. وأما التي تكون لأعدائه مثل إبليس وفرعون والدجال مِمَّا رُوِيَ في الأخبار أنه كان ويكون لهم لا نسميها آيات ولا كرامات، ولكن نسميها قضاء حاجات لهم، وذلك لأن الله تعالى يقضي حاجات أعدائه استدراجا لهم وعقوبة لهم فيغترون به ويزدادون طغيانا وكفراً، وذلك كله جائز وممكن. ‘‘নবীগণের জন্য ‘আয়াত’ প্রমাণিত। এবং ওলীগণের জন্য কারামত সত্য। আর ইবলীস, ফিরাউন, দাজ্জাল ও তাদের মত আল্লাহর দুশমনদের দ্বারা যে সকল অলৌকিক কর্ম সাধিত হয়, যে সকল অলৌকিক কর্মের বিষয়ে কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, তাদের দ্বারা তা সংঘটিত হয়েছিল বা হবে, সেগুলিকে আমরা আয়াত বা কারামত বলি না, বরং এগুলিকে আমরা তাদের ‘কাযায়ে হাজাত’ বা প্রয়োজন মেটানো বলি। কারণ আল্লাহ তাঁর দুশমনদের প্রয়োজন মিটিয়ে দেন ‘ইসতিদরাজ’ হিসেবে তাদেরকে ক্রমান্বয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং তাদের শাস্তি হিসেবে। এতে তারা ধোঁকাগ্রস্ত হয় এবং আরো বেশি অবাধ্যতা ও অবিশ্বাসে নিপতিত হয়। এগুলি সবই সম্ভব।” (শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১৩০-১৩) তাই মুমিনগন এর এই বিশ্বাস থাকতে হবে যে, আল্লাহর নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ওহী ও মুজিজা লাভ করেছেন। আল্লাহর ইচ্ছায় ও নির্দেশে তাঁরা অনেক মুজিজা বা অলৌকিক কার্য প্রদর্শন করেছেন অবিশ্বাসীদেরকে বিশ্বাসের পথে আহবান করার জন্য। এ বিষয়ে কোরআন হাদীসে বহু দলীল রয়েছে। আমরা এখানে কিছু দলীল উপস্থাপন করছি। এটাই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা। " كرامات الأولياء حق باتفاق أئمة أهل الإسلام والسنة والجماعة ، وقد دل عليها القرآن في غير موضع ، والأحاديث الصحيحة والآثار المتواترة عن الصحابة والتابعين وغيرهم ، وإنما أنكرها أهل البدع من المعتزلة والجهمية ومن تابعهم অর্থাৎ কোরআন হাদীসের দলীলে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের ঐক্যমত্য আক্বীদা হলো আউলিয়ায়ে কেরামের কারামত সত্য। তবে মুতাজিলা ও তাদের অনুসারীরা এটা অস্বীকার করেন ।
অন্যান্য শব্দের ব্যবহার ঃ কোরআনে মুজেযা বুঝানোর জন্য বায়্যিনাহ শব্দেরও ব্যবহার হয়েছে যেমন-قَدْ جَآءَتْكُمْ بَیِّنَةٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ هٰذِهٖ نَاقَةُ اللهِ لَكُمْ اٰیَةً অর্থাৎ তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে স্পষ্ট নিদর্শন এসেছে। আল্লাহর এ উটনী তোমাদের জন্য একটি নিদর্শন।’ (সূরা আ‘রাফ ৭৩) নিদর্শন বোঝাতে ‘বুরহান’ শব্দেরও ব্যবহার করা হয়েছে কুরআনে কারীমে - যেমন فَذٰنِكَ بُرْهَانٰنِ مِنْ رَّبِّكَ اِلٰی فِرْعَوْنَ وَ مَلَاۡىِٕهٖ اِنَّهُمْ كَانُوْا قَوْمًا فٰسِقِیْنَ. এ দু’টি (লাঠি সাপে পরিণত হওয়া এবং হাত বগলের নিচ থেকে শুভ্র হয়ে বের হওয়া) তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রমাণ (তথা নিদর্শন) ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গের জন্য। নিশ্চয় তারা ছিল সত্যত্যাগী সম্প্রদায়। (সূরা কাসাস ৩২) নিদর্শন বোঝাতে কুরআনে কারীমে ‘সুলতান’ শব্দেরও ব্যবহার হয়েছে-تُرِیْدُوْنَ اَنْ تَصُدُّوْنَا عَمَّا كَانَ یَعْبُدُ اٰبَآؤُنَا فَاْتُوْنَا بِسُلْطٰنٍ مُّبِیْنٍ. আমাদের পিতৃপুরুষগণ যাদের ইবাদত করতো, তোমরা তাদের ইবাদত হতে আমাদেরকে বিরত রাখতে চাও, অতএব তোমরা আমাদের নিকট কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ (তথা নিদর্শন) উপস্থিত কর। (সূরা ইবরাহীম ১০)
বিশ্ব নবীর (সাঃ) মুজেযা ঃ বিশ্ব নবী হজরত মুহাম্মদও (সা.) ছিলেন অসংখ্য মোজেজার অধিকারী ছিলেন। মুহাম্মদ (সা.)-এর অলৌকিক ঘটনাসমূহ বলতে সেসব অতিপ্রাকৃত তথা সূত্রবিহীন ঘটনাবলিকেই বোঝানো হয়, যেগুলো নবীজির জীবদ্দশায় সংঘটিত হয়েছে। তবে নবীজির মোজেজার প্রকৃত সংখ্যা কত, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। এ প্রসঙ্গে ইমাম বায়হাকী বলেন, হুজুর (সাঃ) এর মুজিজা ছিল এক হাজার। ইমাম নববী’র (রঃ) মতে, মুজিজা হলো ১ হাজার ২০০। আবার অনেক মনীষী বলেন, মুজিজা ছিল ৩ হাজার। এর মধ্যে কোরআন হলো বড় মুজেযা। এ ছাড়া আছে মেরাজের ঘটনা এবং চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করার ঘটনা। নবী আগমনের ধারা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মুজিজাও বন্ধ হয়ে গেছে।
মুজেযার উদ্দেশ্য ঃ মুজিজা মূলত নবী-রাসুলের সত্যতা প্রমাণের জন্য আল্লাহর সাক্ষ্য। বিষয়টি এভাবেও বলা যায়, যিনি নিজেকে আল্লাহর নবী দাবি করেন, তার সত্যতা প্রমাণ করাই মুজিজার উদ্দেশ্য। আল্লাহ তায়ালা নবী ও রাসুলদের বিভিন্ন মোজেজা দান করেছেন। যেমন: মুসা (আ.)-এর লাঠি সাপ হয়ে যেত, ঈসা (আঃ) মৃতকে জীবিত করতে পারতেন। হজরত সুলাইমান (আঃ) বাতাসকে বশীকরণ করতে পারতেন। তিনি পাখি ও পিঁপড়ার ভাষাও বুঝতেন,জিনদের দিয়ে কাজ করাতেন।
মুজেযা ও কারামতের পার্থক্য ঃ নবী-রাসুল থেকে প্রকাশিত অলৌকিক বিষয়াবলিকে মুজিজা বলা হয়। আর নবী-রাসুল ব্যতীত অন্যদের থেকে প্রকাশিত অলৌকিক বা আশ্চর্যজনক ঘটনাকে কারামত বলা হয়। মুজিজা মূলত নবী-রাসুলের সত্যতা প্রমাণের জন্য আল্লাহর সাক্ষ্য। বিষয়টি এভাবেও বলা যায়, যিনি নিজেকে আল্লাহর নবী দাবী করেন, তার সত্যতা প্রমাণ করাই মুজিজার উদ্দেশ্য। আল্লাহ তায়ালা নবী ও রাসুলদের বিভিন্ন মোজেজা দান করেছেন। যেমন: মুসা (আ.)-এর লাঠি সাপ হয়ে যেত, ঈসা (আ.) মৃতকে জীবিত করতে পারতেন। হজরত সুলাইমান (আঃ) বাতাসকে বশীকরণ করতে পারতেন। তিনি পাখি ও পিঁপড়ার ভাষাও বুঝতেন। জিনদের দিয়ে কাজ করাতেন। মুজেযা ও কারামতের পার্থ্যক্য সম্পর্কে কারামাতুল আউলিয়া গ্রন্থে বলা হয়েছেÑ والفرق بين المعجزة والكرامة: أن المعجزة آية من آيات النبوة والرسالة، وهي أمر خارق للعادة مقرون بالتحدي في بعض الأحيان، وأما الكرامة فللأولياء، وهي ظهور الأمر الخارق للعادة على أيديهم وليس على سبيل التحدي، بل يجريه الله تعالى كرامة لهم.মুজেযা ও কারামতের পার্থক্য হলো যে মুজেযা হচ্ছে নবুওত ও রেসালতের আয়াত বা আলামত সমূহের একটি। এটা এমন এক অলৌকিকতা যেটা মানবীয় চিন্তা শক্তিরও বাইরে ইলমেরও বাইরে। কারামতও এমনই তবে এটা ওলীআল্লাহদের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট বটে কিন্তু এটাও কোন মানুষের দ্বারা ঘটানো সম্ভব নয় বরং আল্লাহ তায়ালারই ইচ্ছায় ঘটানো হয়ে থাকে। যেমন কোরআনে হযরত মরিয়ম (আঃ) এর কিচ্ছা এসেছে যেখানে বলা হয়েছেÑ كلما دخل عليها زكريا المحراب وجد عندها رزقا قال يا مريم أنى لك هذا قالت هو من عند الله إن الله يرزق من يشاء بغير حساب হযরত জাকারিয়া (আঃ) মেহরাবে অমৌসুমী ফল-ফলাদী দেখে জাকারিয়া (আঃ) বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন এ গুলো কি? মারয়ম (আঃ) জবাব দিলেন এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে রিজেক,আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছে পর্যাপ্ত রিজেক দিতে পারেন। (সুরা আল- ইমরান ৩৭) অনুরূপ হযরত সারা (আঃ) কে যখন বৃদ্ধবয়সে হযরত ইসহাক (আঃ) এর জন্মের খবর দেয়া হয় তখন তিনি বিস¥য়ের হাসিতে ফেটে পড়েন। এই ঘটনাও কোরআনে সুরা এ হুদ এর আয়াতে এসেছে এ ভাবে যার বিবরণ তাফসীরের কিতাবে আছে। কারামাতুল আউলিয়া গ্রন্থে বলা হয়েছে Ñ وامرأته قائمة فضحكت فبشرناها بإسحاق ومن وراء إسحاق يعقوب আবার আসহাবে কাহফের ঘটনাও কোরআনে আছে। অনুরূপ আল্লামা মোবারকপুরী (রঃ) তিরমিজীর ব্যাখ্যাগ্রন্থে সাহাবায়ে কেরামের কোন কোন সাহাবাকে ফেরেশতাগন সালাম করতেন বলে উল্লেখ করে অনেকগুলো কারামতির ঘটনা উপস্থাপন করেছেন হাদীসের দলীলে। যেমন তিনি বলেনÑ وقال المباركفوري في شرح الترمذي: "عمران بن حصين.. كان من علماء الصحابة وكانت الملائكة تسلم عليه". وكان سلمان وأبو الدرداء رضي الله عنهما يأكلان في صحفة فسبحت الصحفة أو سبح ما فيها. وخبيب بن عدي رضي الله عنه كان أسيرا عند المشركين بمكة، وكان يؤتى بعنب يأكله وليس بمكة عنبة. وأبو مسلم الخولاني كما قال عنه الذهبي وابن عساكر এ সব ঘটনা থেকে সুস্পষ্ট বুঝা যায় আল্লাহর মায়ার বান্দাহ বা ওলীআল্লাহ যারা এবং আল্লাহর বিশেষ বান্দাহ যারা বা নবী রাসুল গনের জন্য কারামত ও মুজেযা আল্লাহর পক্ষ থেকেই একটি নিদর্শন তাই এর প্রতি ঈমান রাখতে হবে। তবে আক্বীদা হবে সহী আর সহী আক্বীদা হলো এ রকম যে এটা হলো কারামতির বেলায় প্রকৃত ওলীআল্লাহদের মাধ্যমে হয়ে থাকে এতে তাদের নিজেদের কোন হাত থাকেনা আর ওলীআল্লাহ তারাই যারা ঈমানের দাবীর আলোকে তাক্বওয়া ভিত্তিক জীবন ঘটন করেন। আল্লাহর ফরজ রাসুলের (সাঃ) আদর্শ বাদ দিয়ে ওলীআল্লাহ দাবীকরা ভন্ড।
আল কুরআনে আম্বিয়ায়ে কেরামের মুজেযা আলোচনা ঃ
সুরা রা’দ এর ৩৮ নম্বার আয়াতে বলা হয়েছেÑ وَمَا كَانَ لِرَسُولٍ أَنْ يَأْتِيَ بِآَيَةٍ إِلا بِإِذْنِ اللَّهِ لِكُلِّ أَجَلٍ كِتَابٌ আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কোনো নিদর্শন (মুজিযা) উপস্থিত করা কোনো রাসূলের কাজ নয়। প্রত্যেক বিষয়ে নির্ধারিত কাল লিপিবদ্ধ। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে- وَمَا كَانَ لِرَسُولٍ أَنْ يَأْتِيَ بِآَيَةٍ إِلا بِإِذْنِ اللَّهِ আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো রাসূলই কোনো নিদর্শন (মু’জিযা) আনতে পারেন না। (সূরা গাফির৭৮ আয়াত।)
এ বিষয়ে মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন- لَئِنْ جَاءَتْهُمْ آَيَةٌ لَيُؤْمِنُنَّ بِهَا قُلْ إِنَّمَا الآَيَاتُ عِنْدَ اللَّهِআপনি বলুন, অলৌকিক নিদর্শনাবলী তো একান্তই আল্লাহর কাছে।’’ (সূরা আনআম ১০৯ )।
আরো এরশাদ হচ্ছেÑوَقَالُوا لَوْلا نُزِّلَ عَلَيْهِ آَيَةٌ مِنْ رَبِّهِ قُلْ إِنَّ اللَّهَ قَادِرٌ عَلَى أَنْ يُنَزِّلَ آَيَةً وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لا يَعْلَمُونَ ‘‘তারা বলে, ‘তার প্রতিপালকের নিকট থেকে তার নিকট কোনো নিদর্শন অবতীর্ণ হয় না কেন?’ বল, ‘নিদর্শন নাযিল করতে আল্লাহ সক্ষম’, কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না।’’ (সূরা আন‘আম: ৩৭)।
সূরা আনকাবুতের ৫০ নম্বার আয়াতে এরশাদ হচ্ছেÑ وَقَالُوا لَوْلا أُنْزِلَ عَلَيْهِ آَيَاتٌ مِنْ رَبِّهِ قُلْ إِنَّمَا الآَيَاتُ عِنْدَ اللَّهِ وَإِنَّمَا أَنَا نَذِيرٌ مُبِينٌ ‘‘এবং তারা বলে: তার কাছে তার প্রভুর পক্ষ থেকে অলৌকিক নিদর্শনসমূহ প্রেরণ করা হোক। আপনি বলুন: অলৌকিক নিদর্শনাবলী তো একমাত্র আল্লাহরই কাছে এবং আমি তো শুধু একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী।’’আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- وَيَقُولُونَ لَوْلا أُنْزِلَ عَلَيْهِ آَيَةٌ مِنْ رَبِّهِ فَقُلْ إِنَّمَا الْغَيْبُ لِلَّهِ فَانْتَظِرُوا إِنِّي مَعَكُمْ مِنَ الْمُنْتَظِرِينَ ‘‘তারা বলে,‘তার প্রতিপালকের নিকট থেকে তার নিকট কোনো নিদর্শন অবতীর্ণ হয় না কেন?’বল,‘গাইব (অদৃশ্যের জ্ঞান) তো কেবল আল্লাহরই আছে। সুতরাং তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমি তোমাদের সাথে প্রতীক্ষা করছি।’’(সূরা ইউনূস: ২০) আরো এরশাদ হচ্ছেÑقُلْ إِنِّي عَلَى بَيِّنَةٍ مِنْ رَبِّي وَكَذَّبْتُمْ بِهِ مَا عِنْدِي مَا تَسْتَعْجِلُونَ بِهِ ‘‘বল, ‘আমি আমার প্রতিপালকের স্পষ্ট প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত; অথচ তোমরা তা প্রত্যাখ্যান করেছ, তোমরা যা সত্বর চাচ্ছ (মুজিযা, শাস্তি) তা আমার নিকট নেই। (সূরা আন‘আম ৫৭) এ সকল আয়াত ও অন্যান্য আয়াতে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ইচ্ছা মুজিযা প্রদর্শন করেছেন। কুরআন কারীমে নবীগণের অনেক মুজিযার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- নূহ (আঃ)-এর নৌকার মুজিযা, ইবরাহীম (আঃ)-এর অগ্নিকুন্ডে নিরাপদ থাকার মুজিযা, মূসা (আঃ)-এর লাঠি ও অন্যান্য মুজিযা, ঈসা (আঃ)-এর মৃতকে জীবিত করা ও অন্যান্য মুজিযা, মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করা, ইসরা, মিরাজ ও অন্যান্য মুজিযা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন হাদীসে এ বিষয়ে অনেক কিছু বলা হয়েছে। এগুলো বিশ্বাস করা মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব যা সহী আক্বীদার অংশবিশেষ।
ওলীআল্লাহ ঃ মর্যাদা ও কারামতি ঃ নবীগণের মুজিযা বা আয়াত ব্যাখ্যার প্রসঙ্গে ইমামগণ আরো দু প্রকারের ‘অলৌকিক’ কর্মের আলোচনা করেছেন: (১) ওলীগণের কারামত ও (২) কাফির বা পাপীদের ইসতিদরাজ। কারণ এগুলির বাহ্যিক প্রকাশ অনেকটা এক রকম হলেও ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলির মধ্যে পার্থক্য অনেক। যেন কোনো মুমিন অজ্ঞতার কারণে যে কোনো অলৌকিক কর্মকেই মুজিযা বা কারামত বলে মনে না করে এজন্য তারা মুজিযার ব্যাখ্যার সাথে কারামাত ও ইসতিদরাজের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। ‘ওলী’ শব্দটি আরবী (الـوِلايَـة، والـوَلايَـة بكسر الواو وفتحها) বেলায়াত বা ওয়ালায়াত শব্দ থেকে গৃহীত, যার অর্থ নৈকট্য, বন্ধুুত্ব বা অভিভাবকত্ব (পষড়ংবহবংং, ভৎরবহফংযরঢ়, মঁধৎফরধহংযরঢ়)। ‘বেলায়াত’ অর্জনকারীকে ‘ওলী’ বা ‘ওয়ালী’ (الولي) বলা হয়। ওলী অর্থ নিকটবর্তী,বন্ধু, সাহায্যকারী, অভিভাবক ইত্যাদি। বেলায়ত ধাতু থেকে নির্গত ‘ওলী’ অর্থেরই আরেকটি সুপরিচিত শব্দ ‘মাওলা’ (المولى)।‘মাওলা’ অর্থও অভিভাবক,বন্ধু,সঙ্গী ইত্যাদি (সধংঃবৎ, ঢ়ৎড়ঃবপঃড়ৎ, ভৎরবহফ, পড়সঢ়ধহরড়হ)। ইসলামী পরিভাষায় ‘ওলী’ ও ‘মাওলা’ শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়েছে। উত্তরাধিকার আইনের পরিভাষায় ও রাজনৈতিক পরিভাষায় এ সকল শব্দ বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত। তবে বেলায়ত বা ওলী শব্দদ্বয় সর্বাধিক ব্যবহৃত (ولاية الله) ‘আল্লাহর বন্ধুত্ব’ ও (ولي الله) ‘আল্লাহর বন্ধু’ অর্থে। ওলীআল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধুদের পরিচয় দিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-أَلا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلا هُمْ يَحْزَنُونَ الَّذِينَ آَمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ অর্থাৎ-‘‘জেনে রাখ! নিশ্চয় আল্লাহর ওলীগণের কোনো ভয় নেই এবং তঁরা চিন্তাগ্রস্তও হবে না- যারা ঈমান এনেছে এবং যারা আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে আত্মরক্ষা করে চলে বা তাকওয়া অবলম্বন করে।’’ (সূরা ইউনূস: ৬২-৬৩)
শিরক ও কুফর মুক্ত বিশ্বাস এর নাম ঈমান যার ভিত্তি তাওহীদ ও রিসালাতের প্রতি বিশ্বাস । ‘‘তাকওয়া’’ শব্দের অর্থ আত্মরক্ষা করা। যে কর্ম বা চিন্তা করলে মহান আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন সেই কর্ম বা চিন্তা বর্জনের নাম তাকওয়া। মূলত সকল হারাম, নিষিদ্ধ ও পাপ বর্জনকে তাকওয়া বলা হয়। এখানে আমরা দেখছি যে, দুটি গুণের মধ্যে ওলীর পরিচয় সীমাবদ্ধ। ঈমান ও তাকওয়া। এই দু’টি গুণ যার মধ্যে যত বেশি ও যত পরিপূর্ণ হবে তিনি বেলায়াতের পথে তত বেশি অগ্রসর ও আল্লাহর তত বেশি ওলী বা প্রিয় বলে বিবেচিত হবেন। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, প্রত্যেক মুসলিমই আল্লাহর ওলী। ঈমান ও তাকওয়ার গুণ যার মধ্যে যত বেশি থাকবে তিনি তত বড় ওলী।
এর অনুকুলে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে যে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বলেছেন-وعن أبي هريرة رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: إن الله قال: من عادى لي وليا فقد آذنته بالحرب অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন যে যারা আল্লাহর ওলীদের সাথে আদাওতি বা শত্রæতা রাখে তাদেরকে আল্লাহর সাথে যুদ্ধ করার ঘোষণা দিয়ে দাও। (বোখারী,৫/২৩৮৪।) হাদীসের সনদকে গরীব বলেছেন অনেকে। وليا : أصل الموالاة القرب وأصل المعاداة البعد ، والمراد بولي الله كما قال الحافظ ابن حجر আর ওলীর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এ ভাবে যে যারা মন্দ কাজ বর্জন করে নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার সর্বাত্বক চেষ্টা করে কোন ফরজ ওয়াজিব তো নয়ই কোন সুন্নাহ মুস্তাহাব আমলও যার ছুটেনা। আর আদাওতি বা শত্রæতা পোষণের অর্থ বলা হয়েছে عادى : آذى وأبغض وأغضب بالقول أو الفعل .অন্তরে শত্রæতা পোষণ করে কথায় কাজে অসম্মান করে এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে। আর যুদ্ধের জন্য আহবান করার অর্থ হলো Ñ آذنته بالحرب : آذن بمعنى أعلم وأخبر এ বিষয়ে জানা এবং অন্যদের জানানো যে অলিআল্লাহদের সাথে শত্রæতা পোষণ ও তাদের সাথে কথায় ও কাজে খারাপ আচরণ করলে আল্লাহ কতটুকু রাগান্বিত হন। সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে ঈমানের দৃঢ়তার পাশাপাশি আমলে সালেহ ছাড়া কেউ ওলী হতে পারেনা। এখন যারা ফরজ ওয়াজিব সুন্নাহর ধারে কাছেও না গিয়ে কেবল পোষাকী ও স্থান কেন্দ্রীক ও গদ্দিনশীন ওলী দাবী করে বা ওলী বনে বসে আছেন তাদের ব্যাপারে এই আয়াত ও হাদীস কার্য্যকর কি না নিজেই ভেবে দেখবেন।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃ)ঃ ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) বলেন -ويستوي المؤمنون كلهم في المعرفة واليقين والتوكل والمحبة والرضا والخوف والرجاء والإيمان في ذلك ويتفاوتون فيما دون الإيمان في ذلك كله.‘‘মারিফাত (পরিচয় লাভ), ইয়াকীন (বিশ্বাস),তাওয়াক্কুল (নির্ভরতা),মুহাব্বত (ভালবাসা), রিযা (সন্তুষ্টি),খাওফ (ভয়),রাজা (আশা) এবং এ সকল বিষয়ের ঈমান-এর ক্ষেত্রে মুমিনগণ সকলেই সমান। তাদের মর্যাদার কমবেশি হয় মূল ঈমান বা বিশ্বাসের অতিরিক্ত যা কিছু আছে তার সবকিছুতে।’’ (শারহু ফিকহিল আকবার, মোল্লা আলী ক্বারী (রঃ) পৃ. ১৫৪-১৫৭)
ইমাম তাহাবী (রঃ) ঃ ইমাম তাহাবী (রঃ) ও অন্যান্য ইমামগণ উল্লেখ করেছেন যে, ঈমান ও মা’রিফাতের দিক থেকে সকল মুমিনই সমান। এজন্য বেলায়াতের কমবেশি হয় মূলত নেক আমলে। যার নেক আমল ও সুন্নাহ অনুযায়ী যত বেশি তিনি তত বড় ওলী। ইমাম তাহাবী (রঃ) বলেন- المؤمنون كلهم أولياء الرحمن، وأكرمهم عند الله أطوعهم وأتبعهم للقرآن ‘‘সকল মুমিন করুণাময় আল্লাহর ওলী। তাঁদের মধ্য থেকে যে যত বেশি আল্লাহর অনুগত ও কুরআনের অনুসরণকারী সে ততবেশি আল্লাহর নিকট সম্মানিত। ইমাম আবু হানীফা (রঃ) একই মত ব্যক্ত করেছেন। (শরহে আকীদাতুত্তাহাবী প ৩৫৭-৩৬২) ইমাম তাহাবী (রাহ) আরো বলেন-الإيمان واحد وأهله في أصله سواء والتفاضل بينهم بالخشية والتقي، ومخالفة الهوي وملازمة الأولى ‘‘ঈমান একই,এবং ঈমানদারগণ এর মূলে সবাই সমান। তবে, আল্লাহর ভয়, তাক্বওয়া,কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচারণ এবং সর্বদা উত্তম কর্ম সম্পাদনের অনুপাতে তাদের মধ্যে স্তর ও মর্যাদাগত প্রভেদ হয়ে থাকে।’’ (মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, আবূ জাফর তাহাবী, পৃ. ১৪।)
কারামত (الكرامة) কারামত (الكرامة) শব্দটির অর্থ ‘ভদ্রতা’, ‘সম্মান’, ‘সম্মাননা’, ‘সম্মান-চিহ্ন’ (হড়নরষরঃু, ফরমহরঃু, ৎবংঢ়বপঃ, সধৎশ ড়ভ যড়হড়ঁৎ, ঃড়শবহ ড়ভ বংঃববস)। ঈমান ও তাকওয়ার অধিকারী ফরয ও নফল ইবাদত পালনকারী কোনো ব্যক্তি থেকে যদি কোনো অলৌকিক কর্ম প্রকাশিত হয় তাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘কারামাত’ বলা হয়। কুরআন কারীমে এরূপ অলৌকিক কর্মকেও আয়াত বলা হয়েছে। পূর্ববর্তী যুগের একজন ‘ওলী’-র পদস্খলন সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন: وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آَتَيْنَاهُ آَيَاتِنَا فَانْسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ ‘‘তাদেরকে সেই ব্যক্তির বৃত্তান্ত পড়ে শুনাও যাকে আমি ‘আয়াত’ বা অলৌকিক নির্দশন দিয়েছিলাম, অতঃপর সে তা থেকে বিচ্যুত হয় এবং শয়তান তার পিছনে লাগে,আর সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়।’’ (সূরা আ’রাফ: ১৭৫) এ আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি যে,কারামত কোনো পদমর্যাদা নয় এবং কারামত স্থায়ী পদমর্যাদার দলিল নয়। একজন নেককার মানুষ কারামত লাভের পরেও বিভ্রান্ত হতে পারেন। ‘কারামত’ প্রকাশিত হওয়া ওলী হওয়ার প্রমাণ নয়, বরং ঈমান ও তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকাই ওলী হওয়ার প্রমান। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য, অনুসরণ ও তাকওয়ার উপর টিকে থাকা ও অনবরত ফরয ও নফল ইবাদত পালন করতে থাকাই ওলীআল্লাহ হওয়ার পরিচয়। ওলামায়ে কেরাম ওলীদের অলৌকিক কর্মকে ‘কারামত’ নামে আখ্যায়িত করেছেন হিজরী তৃত্বীয় শতাব্দীর দিকে, যেন মানুষ বুঝতে পারেন যে,এরূপ অলৌকিক কর্ম ওলীর কোনো ক্ষমতা বা শক্তি নয়, বরং একান্তই আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘ইকরাম’ বা সম্মাননা মাত্র। (শারহু ফিকহুল আকবার, পৃ. ১৩০,আত-তা’রীফাত,পৃ. ২৮২) তবে এটা মনে রাখতে হবে যে যেন তেন ভাবে বর্ণিত বর্ণনাকারীর বর্ণনায় কারামতের ঘটনার বিশ্বাস করা অনিবার্য্য তো নয়ই বরং তা বিশ্বাস করতে বারণ করা হয়েছে। (কারামাতুল আউলিয়া পৃষ্ঠা ১০৩) পরিভাষিক অর্থে কারামত হলো-الكرامة : هي ظهور خارق للعادة غير مقارن لدعوى النبوة من قِبَلِ شخص مؤمن صالح ولي من أولياء الله تعالى কোনো মুমিন মুত্তাকী ও আল্লাহর ওলীর নিকট থেকে অলৌকিকভাবে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম কোনো কিছু প্রকাশ পাওয়াকে কারামত বলে।
কারমাত আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া সম্মাননা মাত্র ঃ সাহাবা যুগে কারামতি ঃ নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত, ২৩ হিজরীর প্রথম দিকে হযরত ওমর (রাঃ) মসজিদে নাবাবীতে জুমুআর খুতবা প্রদান কালে উচ্চস্বরে বলে উঠেন: (يا سارية، الجبلَ) ‘‘হে সারিয়া, পাহাড়।’’সে সময়ে মুসলিম সেনাপতি সারিয়া ইবনু যুনাইম পারস্যের এক যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করছিলেন। তিনি যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার উপক্রম করছিলেন।এমতাবস্থায় তিনি ওমরের (রাঃ) এ বাক্যটি শুনতে পান এবং পাহাড়ের আশ্রয়ে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেন। (তারীখ ই তাবারী, ২/৫৫৩-৫৫৪; আল-ই’তিকাদ,বাইহাকী,পৃষ্টা ৩১৪,আল-ইসাবা ইবনু হাজার, ৩/৫-৬ আল-মাকাসিদ, সাখাবী, পৃ. ৪৬৮ কাশফুল খাফা,আজলূনী, ২/৫১৪-৫১৫) এ ঘটনায় ওমর (রাঃ)এর এই ঘটনা থেকে একটি কারামতের প্রকাশ পায়। তিনি হাজার মাইল দূরের যুদ্ধ ক্ষেত্রের অবস্থা ‘অবলোকন’ করেছেন, মুখে নির্দেশনা দিয়েছেন এবং সে নির্দেশনা সারিয়া শুনতে পেয়েছেন। এ কারামতের অর্থ হলো, মহান আল্লাহ তাঁর এ মহান ওলীকে এ দিনের এ মুহূর্তে এ বিশেষ ‘সম্মাননা’ প্রদান করেন, তিনি দূরের দৃশ্যটি হৃদয়ে অনুভব করেন, নির্দেশনা দেন এবং তাঁর নির্দেশনা আল্লাহ সারিয়ার কাছে পৌঁছে দেন। এর অর্থ এ নয় যে, ওমর (রাঃ)-এর হাজার মাইল দূরের সব কিছু অবলোকন করার অলৌকিক ক্ষমতা ছিল, অথবা তিনি ইচছা করলেই এভাবে দূরের কিছু দেখতে পেতেন বা নিজের কথা দূরে প্রেরণ করতে পারতেন। এ বছরেরই শেষে ২৩ হিজরীর যিলহজ্জ মাসের ২৭ তারিখে ফজরের সালাত আদায়ের জন্য যখন উমার (রা) তাকবীরে তাহরীমা বলেন, তখন তাঁরই পিছেন চাদর গায়ে মুসল্লীরূপে দাঁড়ানো আল্লাহর শত্রু আবূ লু’লু লুকানো ছুরি দিয়ে তাঁকে বারংবার আঘাত করে। তিনি অচেতন হয়ে পড়ে যান। চেতনা ফিরে পেলে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আমাকে কে আঘাত করল? তাঁকে বলা হয়, আবূ ল’লু। তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, আমাকে কোনো মুসলিমের হাতে শহীদ হতে হলো না। এর কয়েকদিন পর তিনি ইন্তেকাল করেন। (আল-বিদায়া ৭/১৩০-১৩৮ ইবনে কসীর) এখানে দেখা যাচ্ছে যে, মহান আল্লাহ প্রথম ঘটনায় হাজার মাইল দূরের অবস্থা ওমরকে দেখিয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনায় পাশে দাঁড়ানো শত্রুর বিষয়ে তাঁকে জানতে দেন নি। কারণ‘কারামত’কখনোই ক্ষমতা নয়,কারমাত আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া সম্মাননা।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) বলেছেন: ‘‘ওলীগণের কারামত সত্য।’’এ কথার মর্ম হলো ওলীগণ থেকে অলৌকিক কর্ম প্রকাশ পাওয়া সম্ভব। যদি কোনো বাহ্যত নেককার মুমিন মুত্তাকী মানুষ থেকে কোনো অলৌকিক কার্য প্রকাশ পায় তাহলে তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত সম্মাননা বা কারামত বলে বুঝতে হবে। অনুরূপভাবে যদি কোনো নেককার বুযুর্গ মানুষ থেকে কোনো অলৌকিক কার্য প্রকাশিত হয়েছে বলে বিশুদ্ধ সূত্রে জানা যায় তবে তা সত্য বলে বিশ্বাস করতে হবে। তা অস্বীকার করা বা অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেয়া মু‘তাযিলী ও অন্যান্য বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের আক্বীদা। কুরআন কারীমের বিভিন্ন স্থানে নবী ছাড়াও অন্যান্য মুমিন মুত্তাকী মানুষের অলৌকিক কর্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন হাদীসে এরূপ অনেক কারামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম তাহাবী (রঃ) ইমাম তাহাবী (রঃ) বলেন-لا يفصل أحدا من الأولياء على أحد من الأنبياء عليهم السلام، ونقول: نبي واحد أفضل من جميع الأولياء. ونؤمن بماجاء من كراماتهم وصح عن الثقات من رواياتهم. ‘‘আমরা কোনো ওলীকে কোনো নবীর উপর প্রাধান্য দেই না। বরং আমরা বলি: একজন নবী সকল ওলী থেকে শ্রেষ্ঠ। তাদের যে সকল কারামত নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্থ রাবীদের মাধ্যমে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে তা আমরা বিশ্বাস করি।’’ (মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ,পৃ.১৯।)
ইসতিদরাজ কি ঃ ‘ইসতিদরাজ’ শব্দটি আরবী ‘দারাজ’ (درَج) ক্রিয়ামূল থেকে গৃহীত, যার অর্থ চলা,হাঁটা,অগ্রসর হওয়া,ক্রমান্বয়ে এগোনো ইত্যাদি।‘দারাজাহ’ (الدرجة) অর্থ ধাপ বা পর্যায়। ইসতিদরাজ (الاستدراج) অর্থ ক্রমান্বয়ে এগিয়ে নেওয়া,ক্রমান্বয়ে উপরে তোলা বা নিচে নামান,ক্রমান্বয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে দেওয়া ইত্যাদি (ঞড় সধশব ধফাধহপব মৎধফঁধষষু, ঢ়ৎড়সড়ঃব মৎধফঁধষষু, ঃড় বহঃরপব, ঃবসঢ়ঃ, ষঁৎব রহঃড় ফবংঃৎঁপঃরড়হ)। কোনো পাপী বা অবিশ্বাসী ব্যক্তি থেকে কোনো অলৌকিক কর্ম প্রকাশিত হলে তাকে ইসলামের পরিভাষায় ‘ইসতিদরাজ’ বলা হয়। ইসতিদরাজের ব্যখ্যায় ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) বলেছেন:‘‘বরং এগুলিকে আমরা তাদের কাযায়ে হাজাত বা প্রয়োজন মেটানো বলি। কারণ আল্লাহ তাঁর দুশমনদের প্রয়োজন মিটিয়ে দেন তাদেরকে ক্রমান্বয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং তাদের শাস্তি হিসেবে।’’ পরিভাষিক অর্থে ইসতিদরাজ এর সংজ্ঞা হলো- الاستدراج : ظهور أمر خارق للعادة من قِبَلِ من لا يكون مؤمنا ولا صالحا، بل من قِبَلِ الكافر أو الفاسق المجاهر على وفق غرضه. سمي به لأنه يوصله بالتدريج إلى النار.মুমিন বা মুত্তাকী নয়; বরং কাফের অথবা প্রকাশ্য ফাসেক কোনো ব্যক্তির নিকট থেকে অলৌকিকভাবে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম বিস্ময়কর কিছু প্রকাশ পাওয়াকে ইসতিদরাজ বলে, যা তার দাবির অনুকূলে হয়। ইসতিদরাজ বলা হয় এ জন্য যে,এটা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে জাহান্নামের পথে নিয়ে যাবে।
ফেরাসত তিন প্রকারঃ মোল্লা আলী কারী (রঃ) ঃ মোল্লা আলী কারী (রঃ) বলেন: ‘‘ফিরাসাত তিন প্রকার। (১) ঈমানী ফিরাসাত। এর কারণ আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত নূর যা আল্লাহ তার বান্দার অন্তরে নিক্ষেপ করেন। হঠাৎ অনুভূতি হিসেবে তা মানুষের অন্তরে হামলা করে, যেমন সিংহ তার শিকারের উপরে হামলা করে। .... (২) রিয়াযত বা অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জিত ফিরাসাত। এ প্রকারের ফিরাসাত অর্জিত হয় ক্ষুধা, রত্রি-জাগরণ, নির্জনবাস ইত্যাদির মাধ্যমে। কারণ মানুষের নফস যখন জাগতিক সম্পর্ক ও সৃষ্টির সাথে যোগাযোগ থেকে বিমুক্ত হয় তখন তার বিমুক্তির মাত্রা অনুসারে তার মধ্যে অন্তর্দিষ্টি ও কাশফ সৃষ্টি হয়। এ প্রকার ফিরাসাত কাফির ও মুমিন উভয়েরই হতে পারে। এ প্রকার কাশফ বা ফিরাসাত ঈমান বা বেলায়াত প্রমাণ করে না। এর দ্বারা কোনো কল্যাণ বা সঠিক পথও জানা যায় না।... (৩) সৃস্টিগত ফিরাসাত। এ হলো চিকিৎসক ও অন্যান্য পেশার মানুষের ফিরাসাত যারা সৃষ্টিগত আকৃতি থেকে প্রকৃতি ও আভ্যন্তরীন অবস্থা অনুমান করতে পারেন।’’ (শারহু ফিকহুল আকবার, পৃ. ১৩২-১৩৩)
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, সকল অলৌকিক কর্মই কারামত নয় এবং কোনো অলৌকিক কর্ম কারো বেলায়াতের বা ওলী হওয়ার প্রমাণ নয়, কারণ একই প্রকার অলৌকিক কর্ম মুত্তাকী মুমিন থেকেও প্রকাশিত হতে পারে এবং ফাসিক বা কাফির থেকেও প্রকাশিত হতে পারে। ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো অলৌকিক কর্ম কোনো মানুষের বেলায়াত তো দূরের কথা, ঈমানেরও প্রমাণ নয়। বরং মানুষের ঈমান, তাকওয়া, আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের (সাঃ) আনুগত্য ও সদা সর্বদা ফরয ও নফল ইবাদত পালন করাই ওলায়ত বা বেলায়তের প্রমাণ। যদি এরূপ ব্যক্তি থেকে কোনো অলৌকিক কর্ম প্রকাশিত হয় তবে তাকে কারামত বলা হবে। আর যদি কোনো ব্যক্তির ঈমান, তাকওয়া বা ইত্তিবায়ে সুন্নাত না থাকে কিন্তু তিনি বিভিন্ন অলৌকিক কর্ম সম্পাদন করেন তবে তাকে ইসতিদরাজ বলা হবে।
অবস্থা ভেদে মুজেযা ও কারামতি প্রদান করা হয় ঃ মুসার (আঃ) মুজেযা লাঠিঃ আমাদের নবী বিশ্বনবী রহমতুল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর সবচেয়ে বড় মুজিযা হলো কুরআনুল কারীম । প্রত্যেক নবীর গোত্রের অবস্থা অনুপাতেই তাঁর মুজিযা হয়ে থাকে। এ জন্যই ফেরাউন সম্প্রদায়ের মধ্যে যখন যাদু বিদ্যা ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করলো, তখন মূসা (আঃ) এর এমন একটি লাঠি নিয়ে আসলেন,যা যাদুকরেরা ব্যবহার করতো। কিন্তু মূসা (আঃ) যাদুকরদের সাপ সদৃশ সব লাঠি গিলে ফেললো। এতে যাদুকররা ক্লান্ত হয়ে গেলো এবং বিস্মিত হলো। তারা বিশ্বাস করে নিলো যে,মূসা (আঃ) যা নিয়ে এসেছেন, তা সত্য-সঠিক, এটা যাদু নয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন-فَأَلْقَىٰ مُوسَىٰ عَصَاهُ فَإِذَا هِيَ تَلْقَفُ مَا يَأْفِكُونَ فَأُلْقِيَ السَّحَرَةُ سَاجِدِينَ قَالُوا آمَنَّا بِرَبِّ الْعَالَمِينَ رَبِّ مُوسَىٰ وَهَارُونَ অর্থাৎ‘‘তারপর মূসা নিজের লাঠিটি নিক্ষেপ করলেন। সে তাদের বানোয়াট কীর্তিগুলো গ্রাস করতে থাকলো। তখন সকল যাদুকর সিজদাবনত হয়ে পড়লো এবং বলে উঠলো, আমরা রাববুল আলামীনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম। মূসা ও হারুনের রবের প্রতি’’। (সূরা শুআরা ৪৬-৪৮)।
ঈসার (আঃ) মুজেযা মৃতকে জীবিত করা ঃ ঈসা’র (আঃ) যুগে যখন ডাক্তারী বিদ্যা ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছিল, তখন তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন মুজিযা নিয়ে আসলেন, যা দেখে সে যুগের ডাক্তারগণ দিশেহারা হয়ে গেলেন। তিনি মৃতদেরকে জীবিত এবং জটিল ও কঠিন রোগ ভালো করতেন। যেমন জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে সুস্থ করতেন এবং মাটি দিয়ে পাখির আকৃতি বানিয়ে তাতে ফুঁ দিলেই তা আল্লাহর অনুমতিতে পাখি হয়ে যেতো। এতে ডাক্তারদের বিবেক-বুদ্ধি হয়রান হয়ে গেলো এবং তারা স্বীকার করে নিলো যে,এগুলো আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতেই। অনুরূপ হযরত শুয়াইব (আঃ) এর মুজেযা ছিল উষ্ট্রি।
মুহাম্মাদ (সাঃ) এর প্রধান মুজেযা কুরআন ঃ এ দিকে আরবরা যখন ফাসাহাত ও বালাগাত তথা বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় বাগপটুতা ও উচ্চাঙ্গের সাহিত্যিক মান দিয়ে ভাষণ-বক্তৃতা দেয়ায় পারদর্শিতা অর্জন করেছিল, তখন আল্লাহ তা‘য়ালা আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জন্য এমন সাহিত্যিক মান সম্পন্ন কুরআনুল করীম দান করলেন, যার ভাষাগত মান তাদের কথা-বার্তা ও ভাষণ-বক্তৃতায় ব্যবহৃত বাক্যসমূহের বহু উর্ধ্বে এবং যার সম্মুখ অথবা পশ্চাৎ হতে বাতিল প্রবেশ করতে পারে না। আর এ কুরআন হলো সর্বযুগের চিরন্তন মুজিযা। আল্লাহ তা‘য়ালা সর্বযুগের সমস্ত মানুষের জন্য সর্বশেষ আসমানী রিসালাত হিসাবে কুরআনুল কারীমকে একটি উজ্জ্বল মুজিযা বানিয়েছেন। প্রত্যেক যামানার লোকেরা কুরআনের মুজিযা প্রত্যক্ষ করছে এবং সেটা তেলাওয়াত করছে। তারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছে যে, কুরআন প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহর কালাম। এটি কোনো মানুষের কালাম নয়। আল্লাহ তা‘য়ালা মানুষ ও জিনকে কুরআনের অনুরূপ একটি কিতাব অথবা কুরআনের সূরার অনুরূপ দশটি সূরা কিংবা সেটার সূরার অনুরূপ একটি সূরা রচনা করে নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ করেছেন এই বলে যে- وَإِن كُنتُمْ فِي رَيْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلَىٰ عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّن مِّثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَاءَكُم مِّن دُونِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَঅর্থাৎ আর আমি আমার বান্দার উপর যা নাযিল করেছি, যদি তোমরা সে সম্পর্কে সন্দেহে থাক, তবে তোমরা তার মত একটি সূরা নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সাক্ষীসমূহকে ডাক; যদি তোমরা সত্যবাদী হও। (বাকারা ২৩) মুহাম্মাদ (সাঃ) কে নবী হিসাবে প্রেরণ করার পর থেকে আজ পর্যন্ত কুরআনের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ভবিষ্যতেও ইসলামের শত্রæরা কখনো কুরআনের অনুরূপ একটি কিতাব কিংবা কুরআনের সূরার ন্যায় একটি সূরা রচনা করে আনতে পারবেনা। যদিও ইতিহাসের প্রত্যেক যুগেই রসূল (সাঃ) ও দীন ইসলামের শত্রæর সংখ্যা প্রচুর।
আল্লাহ তা‘য়ালা আরো বলেন- কুরআনের এই চ্যালেঞ্জ এখনো বিদ্যমান রয়েছে এটা কিয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। আল্লাহ তা‘য়ালা আরো বলেন- أَمْ يَقُولُونَ تَقَوَّلَهُ بَل لَّا يُؤْمِنُونَ فَلْيَأْتُوا بِحَدِيثٍ مِّثْلِهِ إِن كَانُوا صَادِقِينَ তারা কি বলে যে, এ ব্যক্তি নিজেই কুরআন রচনা করে নিয়েছে? প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে তারা ঈমান গ্রহণ করতে চায় না। তাদের এ কথার ব্যাপারে তারা যদি সত্যবাদী হয় তাহলে এ বাণীর মত একটি বাণী তৈরি করে আনুক’’। (সূরা তুর: ৩৩-৩৪) অর্থাৎ- فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا وَلَن تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ এমনটি وَلَن تَفْعَلُوا ‘‘কিন্তু তোমরা যদি এমনটি না করো আর নিঃসন্দেহে কখনই তোমরা এটা করতে পারবে না, তাহলে ভয় করো সেই আগুনকে,যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর’’। এখানে لن অব্যয় দ্বারা ভবিষ্যতে তাদের ক্ষমতা অর্জিত হওয়াকে নাকচ করা হয়েছে। ( ইবনে তাইমিয়া (রঃ) বাকারা ২৪ )
জাদুর সংজ্ঞা ঃ
আলমুজামুল ওয়াসীত নামক অভিধানগ্রন্থে সেহের سحر বা জাদুর সংজ্ঞা বলা হয়েছে: السحر : كل أمر يخفى سببه ويتخيل على غير حقيقته،ويجري مجرى التمويه والخداع، وكل ما لطف مأخذه ودق. ‘জাদু বলা হয় এমন কোনো বিষয় কে, যার উপায়-উপকরণ বা কার্যকারণ গোপন থাকে এবং যা তার আপন বস্তুুর অবস্থার বিপরীত অনুভূত হয় এবং যা মন্দকে শোভনরূপে প্রদর্শন ও প্রতারণার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। আর যার উৎস সূক্ষ্ম ও দুর্বোধ্য হয় তাকেও سحر অর্থাৎ জাদু বলা হয়।
মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান (রঃ) মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান (রঃ). (মৃত্যু ১৩৯৫ হিঃ) বলেন,السحر بالكسر ما يستعان في تحصيله بالتقرب إلى الشياطين مما لا يستقل به الإنسان، وإطلاقه على ما يفعله من الحيل حقيقة لغوية يعني ما يلعب بالعقول من الأمور العجيبة ولا يستظهر عليها بالشياطين অর্থাৎ- السحر শব্দটি س হরফে যের যোগে পঠিত হয়। سحر মানে জাদু, যা অর্জনের জন্য শয়তান তথা জিন্নাতের নৈকট্যের সাহায্য নেয়া হয় এমন ক্ষেত্রে, যা মানুষ স্বতন্ত্রভাবে করতে পারে না। আর নানা রকমের বুদ্ধিগত কলাকৌশলকে জাদু বলা হয়,যা এ শব্দটির একটি স্বতন্ত্র আভিধানিক অর্থ। অর্থাৎ,বুদ্ধিগত কলাকৌশলের মাধ্যমে যেসব অদ্ভুত কর্মকান্ডে শয়তান তথা জিন্নাতের সাহায্য নেয়া হয় না। (আত তারীফাতুল ফিকহিয়্যাহ পৃষ্ঠা ৩২০)
মু‘জিযা ও জাদুর পার্থক্য মু‘জিযা ও জাদুর উল্লিখিত পার্থক্যসমূহ দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এ দুটির একটি অপরটি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। সুতরাং এতদুভয়ের মধ্যে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, মু‘জিযা এবং জাদু ছাড়াও আরও কিছু অলৌকিক কর্মকান্ড রয়েছে, যা মানুষের নিকট থেকে প্রকাশ পেতে পারে। মু‘জিযাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে বুঝার জন্য অন্যান্য অলৌকিক বিষয়গুলোর পরিচয় লাভ করা এবং সেগুলোর সাথে মু‘জিযার পার্থক্য নির্ণয় করা। আল্লামা বদরে আলম মিরাঠী রাহ. (মৃত্যু ১৩৮৫ হি./১৯৬৫ ঈ.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা এ জগৎকে সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে ভাল-মন্দের সংমিশ্রণে পয়দা করেছেন। একদিকে নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতা পয়দা করেছেন তো অপরদিকে শয়তান সৃষ্টি করেছেন। এমনিভাবে একদিকে আম্বিয়ায়ে কেরামের পবিত্র জামাত পয়দা করেছেন। তার বিপরীতে দাজ্জালের দল সৃষ্টি করেছেন। নবুওতের বিপরীতে রাশিগণনা ও জাদু সৃষ্টি করে নবুওতের বিপরীত অবস্থান পূর্ণ করেছেন। ভাল ও মন্দের এসব পরস্পর বিপরীত শক্তির মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনো সামঞ্জস্য ছিল না, কিন্তু বিভ্রান্তির এ জগতের অনেকেই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে। যেমন হযরত মূসা ও ঈসা (আঃ) কে তাদের যুগের প্রতিপক্ষ কাফের সম্প্রদায় জাদুকর বলেছে, অনুরূপ আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কেও মক্কার কাফেররা জাদুকর বলেছে। তাই মু‘জিযা ও জাদুর আপন আপন পরিচয়, প্রকাশকারী সত্তা এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বিবেচনায় একটি অপরটি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যেমন : ১. মু‘জিযার প্রকাশ হয় আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় যার হাতে মু‘জিযা প্রকাশ পায় এতে তার কোনো দখল থাকে না। পক্ষান্তরে জাদুুর প্রকাশ ঘটে শিরক সম্বলিত কালামের রিপুগত অভিনিবেশ এবং নানা রকম মন্দ আত্মার সাহায্যে। ২. মু‘জিযা যাদের নিকট থেকে প্রকাশ পায় তারা হলেন, পরিচ্ছন্ন ও নিষ্কলুষ গুণাবলীর অধিকারী, আর জাদুকরেরা হয়ে থাকে দুরাত্মার অধিকারী। ৩. যাদের নিকট থেকে মু‘জিযা প্রকাশ পায় তাদের পরিণতি হল কামিয়াবী ও সফলতা, আর জাদুকরদের পরিণতি হল ব্যর্থতা ও ক্ষতিগ্রস্থতা। ৪. মু‘জিযা প্রকাশ করা মহান আল্লাহ তায়ালার কাজ এবং আল্লাহ তায়ালার নিদর্শন, আর জাদু হল জাদুকরের নিজের বানানো খেলা। ৫. মু‘জিযা নবী ও রাসূলের ইচ্ছাধীন নয় যে, তারা ইচ্ছা করলেই তা দেখাতে পারবেন, পক্ষান্তরে জাদু জাদুকরের ইচ্ছাধীন। যখনই সে চায় তা দেখাতে পারে। (তরজমানুস সুন্নাহ, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ৬২-৬৩,আহকামুল কুরআন, আল্লামা যফর আহমদ উসমানী (মৃত্যু ১৩৯৪ হিঃ) খন্ড ১, পৃ. ৩৯-৪০) আহকামুল কুরআন ইমাম জাস্সাস খন্ড ১,পৃ. ৪৯- এর বরাতে) ৭. মু‘জিযা প্রকৃতিগত উপকরণের মধ্যস্থতা ব্যতীত সরাসরি আল্লাহ তাআলার কাজ, আর জাদু অদৃশ্য প্রকৃতিগত উপকরণের সাহায্যে সংঘটিত হয়। অদৃশ্য উপকরণের কথা জানা থাকলে জাদু আর বিস্ময়কর থাকে না, আর জানা না থাকলে বিস্ময়কর মনে হয়। ৮. জাদুকর যদি নবুওতের দাবি করে তবে তার জাদু কাজ করে না, তাই তার নিকট থেকে বিস্ময়কর কিছু প্রকাশ পাবে না। সুতরাং নবুওতের দাবির সাথে জাদু কখনো চলে না। এটা এজন্য নয় যে, তা যুক্তিগতভাবে অসম্ভব; বরং এর কারণ এই যে, জাদুকর যদি নবুওতের মিথ্যা দাবি করে তখন যাতে মানুষ বিভ্রান্তির শিকার না হয়, এজন্য আল্লাহ তায়ালা তার হাতে চিরাচরিত নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু প্রকাশ করেন না। (তাফসীরে কাবীর,খন্ড ৩,পৃষ্ঠা ২৩২,আহকামুল কুরআন, যফর আহমদ উসমানী,(রঃ) খন্ড ১,পৃষ্ঠা ৪০, মাআরিফুল কুরআন,মুফতী শফী,(রঃ) খ. ১, পৃ. ২৬৭-২৬৮
আল্লামা রমজান ইবনে মুহাম্মাদ আফান্দী (রঃ.) (মৃত্যু ৯৭৯ হিঃ) বলেন, মু‘জিযা ও জাদু একটি অপরটি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সুতরাং এতে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই। উভয়ের মধ্যে কয়েকটি পার্থক্য রয়েছে। যেমন : এক.জাদুবিদ্যা অর্জনের জন্য কোনো জাদুকরের শিষ্যত্ব লাভ করতে হয় এবং তার নিকট থেকে জাদুর শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। জাদু প্রদর্শনে শিষ্য কখনও গুরুর চেয়ে অধিক দক্ষ হতে পারে। পক্ষান্তরে মু‘জিযা কারও শিষ্যত্ব গ্রহণ করে বা কারও নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে অর্জন করা যায় না। মু‘জিযার প্রকাশ ঘটানো সম্পূর্ণ আল্লাহ তায়ালার কর্ম, যা তিনি তাঁর মনোনীত নবী-রাসূলের মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকেন। দুই. জাদুর প্রকাশ কারও আবদার মোতাবেক হয়না; বরং জাদুকরের বিদ্যা অনুযায়ী হয়। সুতরাং যে কয়টি বিষয়ে তার জাদুবিদ্যা আছে, কেবল সেগুলোই সে প্রকাশ করতে সক্ষম। তার বিদ্যার বাইরে কোনো কিছু সে প্রদর্শন করতে পারে না। পক্ষান্তরে মু‘জিযার প্রকাশ আল্লাহর ইচ্ছায় আবদারকারীদের যে কোনো আবদার মোতাবেক হতে পারে। কেননা মু‘জিযা মানুষের সীমিত বিদ্যা বা শক্তির আওতাধীন নয় বরং আল্লাহর শক্তির অধীন। তিনি আবদারকারীদের যে কোনো আবদার বাস্তবায়ন করতে সক্ষম। যেমন, পাথর থেকে উটনী বের করা, আঙ্গুলের ইশারায় চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করা ইত্যাদি। তিন. মু‘জিযার মাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া ফলগুলো প্রকৃত ও বাস্তব। যেমন সামান্য খাবার দ্বারা অনেক মানুষের পেটভরে আহার করা, সামান্য পানি দ্বারা অনেক মানুষের অযু ও পানীয়ের প্রয়োজন পূর্ণ হওয়া। কিন্তু জাদু তার বিপরীত। জাদুর মাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া ফলগুলো প্রকৃত ও বাস্তব নয় বরং জাদু হল দৃষ্টি ও কল্পনার ভ্রম সৃষ্টি মাত্র, যার প্রকাশ নির্দিষ্ট সময় ও স্থান ব্যতীত সম্ভব হয়না। (আল-মাজমূআতুস সানিয়্যাহ আলা শারহিল আকাইদিন নাসাফিয়্যা, রামাজান আফান্দীর হাশিয়া ৫৪৫)
জাদু দুই প্রকার : জাদু ও ম্যাজিক এক. বিস্ময়কর বা সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম কোনো কথা বা কর্মকান্ডের প্রকাশ, যা তন্ত্র-মন্ত্র, কুফরী-কালাম বা শয়তান ও জিনের সাহায্যে হয়ে থাকে। এরূপ জাদু শিরক বা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। দুই. এমন কিছু বিস্ময়কর কর্মকান্ডের প্রকাশ, যা কিছু অদৃশ্য উপায়-উপকরণের সাহায্যে অথবা বুদ্ধিগত কলাকৌশলের সাহায্যে হয়ে থাকে। এটা সমাজে জাদু নামে পরিচিত হলেও মূলত এর নাম ভোজভাজি, ভোজবিদ্যা, ইন্দ্রজালবিদ্যা, ভেল্কিবাজি, ম্যাজিক ইত্যাদী। এটা শরীয়তের দৃষ্টিতে শিরক বা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত না হলেও কাজ বা পেশা হিসেবে প্রশংসনীয় নয়। এটা অনর্থক ক্রিয়াকলাপের অন্তর্ভুক্ত,যা বর্জনীয়। এটাকে যদি প্রতারণার অবলম্বনরূপে গ্রহণ করা হয় তবে তা অবশ্যই কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত হবে।
অলৌকিকতার বাকী তিন প্রকার হচ্ছেÑ (৪)মাউনতের সংজ্ঞা المعونة : أمر خارق للعادة غير مقارن لدعوى النبوة من قِبَلِ عامة المؤمنين تخليصا لهم من المحن والبلايا কোনো সাধারণ মুমিন ব্যক্তিকে কঠিন দুরাবস্থা ও বিপদ থেকে রক্ষার প্রয়োজনে আল্লাহর পক্ষ থেকে অলৌকিকভাবে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম কোনো বিষয় প্রকাশ পাওয়াকে মাউনত বলে। (৫) ইরহাসের সংজ্ঞা : الإرهاص : أمر خارق للعادة يظهر من نبي من أنبياء الله تعالى قبل دعوى نبوته (وهو من قبيل الكرامات، فإن الأنبياء قبل النبوة لا يقصرون عن درجة الأولياء) কোনো নবী নবুওতপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বে তাঁর থেকে প্রকাশ পাওয়া অলৌকিক বা সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম বিষয়কে ইরহাস বলে। (এটা কারামাতের পর্যায়ভুক্ত। কেননা,কোনো নবী নবুওতপ্রাপ্তির পূর্বে ওলীর চেয়ে কম মর্যাদার থাকেন না।) (৬) ইহানতের সংজ্ঞা: الإهانة : ما يظهر من الكافر أو الفاسق خارقا للعادة على خلاف غرضهকাফের অথবা ফাসেক ব্যক্তির নিকট থেকে তার উদ্দেশ্যের বিপরীতে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম বিস্ময়কর যা কিছু প্রকাশ পায় তাকে ইহানত (লাঞ্ছনা) বলে।
প্রসঙ্গ ঃ খেলাফত ও মলুকিয়ত জাষ্টিস গোলাম আল্লামা গোলাম আলীর পর্য্যালোচনা ঃ খেলাফতের পতন ও রাজতন্ত্রের উত্থান ইতিহাস। আক্বীদার কিতাবও নয় মওদুদী আক্বীদার ইমামও নয়। মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) এর উপর যত অভিযোগ অনুযোগ এর বেশীর ভাগ ই ’খেলাফত ও মলুকিয়ত’ কিতাব লেখা নিয়ে। অথচ একটি সহজ কথা বুঝে নিলেই হয় যে এটা কোন আক্বীদার কিতাক নয় মাওলানা মওদুদী (রঃ) আমাদের ফিক্বহ বা আক্বায়ীদ এর ইমামও নয়। এই কিতাবটি মূলত লেখা হয়েছে খেলাফত আর মলুকিয়ত বা ইসলামী খেলাফত বিশেষতঃ খোলাফা এ রাশেদার বিশেষত্ব নিয়ে। সেই সাথে এই খেলাফত ব্যববস্থা পতনের ইতিহাস ও পরিণতি সম্পর্কে। সবিশেষ এই হৃত খেলাফত পুন:রুদ্ধারে মোসলমানদের উদ্ভুদ্ধ করা রাজতন্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক করা। খেলাফতের পতন ও রাজতন্ত্রের উত্থান এর ঐতিহাসিক বিবরণ লেখতে গেলে অবশ্যই ঐতিহাসিক বিবরণ সংগ্রহ করতে হবে। আর ঐতিহাসিক বিবরণ এর বর্ণনাকারী বা ইতিহাসের লেখকগনের নিজস্ব একটিা আদর্শ-চিন্তা -চেতনা লালনের ব্যপার থাকতে পারে। এতে ভুলের বা তথ্যগত ভুলভ্রান্তিও থাকতে পারে। এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার কে ঈমান আক্বীদার সাথে জড়িয়ে বিশাল গীতা রচনার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। অথচ আমরা জীবন ভর বংশনুক্রমিক ভাবে এটাই করে যাচ্ছি যে খেলাফতের পতন ও রাজতন্ত্রের উত্থানের ইতিহাসকে আক্বীদার লেবেল পরিয়ে একদিকে ইসলামী আন্দোলন বাধাগ্রস্থ করছি অন্য দিকে ইসলামী রাজনীতিকে নির্বসনে দেয়ার প্রানান্তকর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি যার পুরোটাই অসত্য ভিত্তিহীন ও অজ্ঞতা প্রসুত প্রতিহিংসা পরায়ণ।
এ বিষয়ে মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদীর (রঃ) অত্যন্ত বিশ্বস্থ ও উপমাদেশের একজন খ্যাতনামা শরয়ী আদালতের বিচারক আল্লামা মালিক গোলাম আলী ( জাষ্টিস গোলাম আলী) (রঃ) এর "খেলাফাত ও রাজতন্ত্র গ্রন্থের উপর অভিযোগের পর্যালোচনা" একটি দলিলভিত্তিক ও তথ্যনির্ভর বক্তব্য সম্বলিত একটি বই এর কথা এখানে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। এটা জানা কথা যে খেলাফত ও রাজতন্ত্র দুইটি পৃথক শাসনব্যবস্থা।
হযরত আলী (রাঃ) হেদায়াতপ্রাপ্ত চার খলিফার অন্যতম ঃ আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা হলো হযরত আলী (রাঃ) খোলাফায়ে রাশেদীন তথা হেদায়াতপ্রাপ্ত চার খলিফার অন্যতম। যাদের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللَّهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَة. (رواه أبو داود، والترمذي وقال : حديث حسن صحيح). ‘‘আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতি এবং (খলিফার) কথা শোনার ও তার আনুগত্য করার উপদেশ দিচ্ছি; যদিও তোমাদের উপর কোন নিগ্রো বা আফ্রিকার কৃষ্ণকায় অধিবাসী রাষ্ট্রনেতা হয়। (স্মরণ রাখ) তোমাদের মধ্যে যে আমার পর জীবিত থাকবে, সে অনেক মতভেদ বা অনৈক্য দেখবে। সুতরাং তোমরা আমার সুন্নত ও সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদ্বীনের আদর্শকে আঁকড়ে ধরবে এবং তা দাঁত দিয়ে মজবূত করে ধরে থাকবে। আর তোমরা দ্বীনে নব উদ্ভাবিত কর্মসমূহ (বিদ‘আত) থেকে বেঁচে থাকবে। কারণ, প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা"। (সুনান আবূ দাউদ ৪৬০৭, জামে তিরমিযী,২৬৭৫; ইবনে মাজাহ ৪২, মুসনাদে আহমদ, ১৬৬৯৪, ১৬৬৯৫; দারেমী ৯৫)” আফসোস ও পরিতাপের বিষয় হলো সুপথপ্রাপ্ত খলিফা হযরত আলী (রাঃ) এর সাথে বিদ্রোহকারীদের পক্ষ নিয়ে হযরত আলী ও হযরত হাসান হোসাইনের রক্তের প্রতি অবজ্ঞা কি ভাবে সহ্য করা যায়। ইনসাফ তো হলো এটাই যেটা মাওলানা মওদুদী (রঃ) বলেছেন যে সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে আমাদের পক্ষপাতিত্বের সুযোগ নেই। অথচ খেলাফতের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সাফাই গেয়ে কি ভাবে সহী আক্বীদার দাবীদার হন ? তা আমাদের বুঝে আসেনা।
রাজতন্ত্র ও খেলাফতের পার্থক্য ঃ আওলাদে রাসুল সায়্যিদ আবুল আ'লা মওদুদী (রঃ) তাঁর 'খেলাফত ও রাজতন্ত্র' গ্রন্থে 'খেলাফত' ও 'রাজতন্ত্র' এ দুটোর সুস্পষ্ট পার্থক্য তুলে ধরেছেন। ইসলামী খেলাফত কিভাবে রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হলো, সে ইতিহাস তিনি বর্ণনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে কার কি ভূমিকা ছিল- সে কথাও তিনি তুলে ধরেছেন- অকাট্য দলিল দিয়ে। আর এ জাতীয় বিশ্লেষণের কাজ তিনিই প্রথম করেন নি, বহু ইসলামী মনীষীও এ কাজ করে গেছেন। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের নেতা, স্বপ্নদ্রষ্টা, রূপকার ও বিংশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আল্লামা সায়্যিদ আবুল আ'লা মওদুদী (রঃ) এর 'খেলাফাত ও রাজতন্ত্র' গ্রন্থ প্রকাশ হতেই 'তিনি সাহাবীর বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন' বলে কিছু ওলামায়ে কেরাম আদাজল খেয়ে তাঁর বিরুদ্ধে জবানী ও কলমী জিহাদ শুরু করেন। অথচ তাঁরা নিজেরাই ইসলামী শক্তির মোকাবেলায় হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তি কংগ্রেসের পক্ষে জোটবদ্ধ। তারা মাওলানা মওদুদীর বিরোধীতা করতে গিয়ে আদল, ন্যায়নীতি ও ইনসাফের কোন প্রকার তোয়াক্কা করেননি। নিজের অন্ধ বিশ্বাসের আঘাত লাগাটাকেই তারা যথেষ্ট মনে করেছে। আমীরুল মু'মিনীন খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত আলী (রাঃ) এর প্রতি বিদ্বেষের কারণে এবং হযরত মুয়াবিয়ার প্রতি অন্ধ ভক্তির কারণে আবার কিছু লোক খেলাফত ও রাজতন্ত্রের সুস্পষ্ট পার্থক্য মুছে ফেলে হযরত মুয়াবিয়া কে খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত আলী (রাঃ) এর সমকক্ষতায় দাড় করাতে চান। আবার অনেকেই হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) কে মহানায়ক বানাতে গিয়ে খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত আলী (রাঃ) কে খলনায়ক বানিয়ে ফেলেন। (নাউযূবিল্লাহ) তৎকালের স্বৈর শাসক আইয়ুব খানের খিলাফতকে (!) শানদার করার কাজে নিয়োজিত কোন কোন মুফতি ও তার পরিবারের সন্তানও এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি অনেকটা অন্ধতা, বিদ্বেষ ও একপেশে ভাবধারা নিয়ে আল্লামা মওদুদী (রঃ) এর 'খেলাফাত ও রাজতন্ত্র' গ্রন্থের বিরুদ্ধে আইয়ুব খানের আল বালাগ পত্রিকায় লিখতে থাকেন। পরে সেসব 'ইতিহাসের কাঠগড়ায় হযরত মুয়াবিয়া' নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশ হয়। পরবর্তীতে সেই বইয়ের সহযোগিতা নিয়েই 'আল্লাহ নিজেই সাহাবীদের দিয়ে যিনা করাইছেন' এমন কুফুরী আকিদা লালনকারীর জন্ম বাংলাদেশেও হয়। এরাই আবার মাওলানা মওদুদীকে সাহাবা বিদ্ধেষী বলে।
জাষ্টিস ত্বক্বী উসমানী’র (হাফিঃ) জবাবে জাষ্টিস মালিক গোলাম আলী (রঃ) ঃ আল্লামা মওদুদী (রঃ) এর যোগ্য উত্তরসূরী ও ব্যক্তিগত সহকারী আল্লামা মালিক গোলাম আলী (পরে পাকিস্তান শরীয়া কোর্টের জাস্টিস) কুরআন, হাদীস, তাফসীর, তারীখ, আকিদা, শরাহ, রিজাল শাস্ত্র, ফিকাহ শাস্ত্রসহ পঞ্চাশাধিক কিতাবাদি মোতায়ালা করে মাসিক 'তরজুমানুল কুরআন' পত্রিকায় ত্বকী উসমানী সাহেবের বক্তব্যের দলিল-আদিল্লা ভিত্তিক পর্যালোচনা প্রকাশ করতে থাকেন। ত্বকী উসমানী সাহেব তার কিছু কিছু বক্তব্যের সমালোচনা মূলক জবাব পুনরায় আল বালাগ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। আল্লামা জাস্টিস মালিক গোলাম আলী সাহেব সেগুলোরও অকাট্য দলিল, তথ্য ও তত্বভিত্তিক জবাব প্রদান করেন কিন্তু মুফতি ত্বক্বী সাহেব আর কোন জবাব দেননি। অবশেষে আল্লামা জাস্টিস মালিক গোলাম আলী সাহেবের এসব জবাবী পর্যালোচনাই 'খেলাফাত ও মুলুকিয়াত পর এতেরাজ কা তাজকিয়া' নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ করে 'খেলাফাত ও রাজতন্ত্র গ্রন্থের উপর অভিযোগের পর্যালোচনা' নামকরণ করা হয়। এর পৃষ্ঠা প্রায় সাড়ে পাঁচশত। যারা খিলাফত ও রাজতন্ত্র বিষয়ে যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞানার্জন করতে চান, যারা রাজতন্ত্র প্রবর্তকদের ভ্রান্তি অবহিত হতে চান, যারা আল্লামা মওদুদী (রঃ) এর 'খেলাফাত ও রাজতন্ত্র' গ্রন্থের উপর দলিল ভিত্তিক ধারণা অর্জন করতে চান সর্বোপরি যারা আল্লামা মওদুদী (রঃ) এর ব্যাপারে সঠিক ধারণা পেতে চান এবং যারা বিভ্রান্তির জবাব দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে চান, তাদের জন্য এ কিতাবটি একটি অকাট্য দলিলিক হাতিয়ারের কাজ দেবে।
কিতাবটি মুফতী ত্বকী উসমানী সাহেবের জবাবে রচিত হলেও যারা 'খেলাফাত ও রাজতন্ত্র' গ্রন্থের উপর ধূয়া তুলে আল্লামা মওদুদী (রঃ) কে সাহাবী বিদ্বেষী বলে মিথ্যা অপবাদ দেন, তাদের প্রত্যেকের দাঁতভাঙা জবাব রয়েছে এই বইয়ে। (কপি সংগ্রহ অন লাইন লাইব্রেরী)
কোরআনের বিবরণে আদম (আঃ) এর নিষিদ্ধ ফল বক্ষণ দেখুন সুরা ত্বাহা'র ১২১ নম্বার আয়াতে এরশাদ হচ্ছে-فَاَكَلَا مِنْهَا فَبَدَتْ لَهُمَا سَوْاٰتُهُمَا وَ طَفِقَا یَخْصِفٰنِ عَلَیْهِمَا مِنْ وَّرَقِ الْجَنَّةِ١٘ وَ عَصٰۤى اٰدَمُ رَبَّهٗ فَغَوٰى۪ۖ অর্থাৎ-শেষ পর্যন্ত দু’জন (স্বামী-স্ত্রী) সে গাছের ফল খেয়ে বসলো। ফলে তখনই তাদের লজ্জাস্থান পরস্পরের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়লো এবং দু’জনই জান্নাতের পাতা দিয়ে নিজেকে ঢাকতে লাগলো। আদম নিজের রবের নাফরমানী করলো এবং সে সঠিক পথ থেকে সরে গেল।" প্রশ্ন হলো যারা বলেন মাওলানা মওদুদী ইসমতে আম্বিয়া মানেন না,একজন মাওলানা তাফহীমূল কোরআন হাতে নিয়ে দেখিয়েছেন যে- সুরা ত্বাহা'র ১২১ নম্বার আয়াতের ব্যাখ্যায় মাওলানা মওদুদী' আদম আঃ এর সমালোচনা করে বলেছেন যে আদম (আঃ) শয়তানের ধোকায় প্রভাবিত হয়ে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে জান্নাত থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। অপরদিক রাসায়েল ও মাসায়েলে তিনি বলেছেন আদম (আঃ) নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে তিনি আল্লাহর আদেশ লঙ্গন করার পাপ করেছেন। আপনি কি এটাকে নবীর (আঃ) সমালোচনা মনে করেন না ? পর্যালোচনা ঃ বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ায় আগে আপনার বিবেকের আদালতে জিজ্ঞেস করে পাঠক যারা তারাও বলুন তো وَ عَصٰۤى اٰدَمُ رَبَّهٗ فَغَوٰى۪ۖ এই বাক্যটি কার ? যার অর্থ ” আদম নিজের রবের নাফরমানী করলো এবং সে সঠিক পথ থেকে সরে গেল।" এবার দেখুন মাওলানা মওদুদীর লেখা তাফহীমুল কোরআন সহ কোন তাফসীরে কি লেখা হয়েছে।
তাফহীমুল কুরআন: আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফহীমুল কোরআনে যা বলা হয়েছে তা হলোÑ”এখানে আদম (আঃ) এর মাধ্যমে যে মানবিক দুর্বলতার প্রকাশ ঘটেছিল তার প্রকৃতি স্বরূপ অনুধাবন করা উচিত। ----------শয়তানের হিংসা ও শত্রুতার জ্ঞানও তিনি সরাসরি লাভ করেছিলেন। আল্লাহ তাঁকে হুকুম দেবার সাথে সাথেই বলে দিয়েছিলেন, এ হচ্ছে তোমার শত্রæ তোমাকে নাফরমানী করতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করবে ফলে এজন্য তোমাকে এ ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। শয়তান তাঁর সামনে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল যে, আমি তাকে পথভ্রষ্ট করতঃ এবং তার শিকড় উপড়ে ফেলবো। এসব সত্বেও শয়তান যখন তার সামনে স্নেহশীল উপদেশ দাতা ও কল্যাণকামী বন্ধুর বেশে এসে তাঁকে একটি অপেক্ষাকৃত উন্নত অবস্থার (চিরন্তন জীবন ও অন্তীন শাসন কর্তৃত্ব) লোভ দেখালো তখন তার লোভ দেখানোর মোকাবিলায় তিনি নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারলেন না। তার পা পিছলে গেলো। অথচ এখানে আল্লাহর প্রতি তাঁর বিশ্বাসে কোন পার্থক্য দেখা দেয়নি এবং তাঁর ফরমান আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়, এ ধরনের কোন ভাবনাও তার মনে জাগেনি। শয়তানী লালসাবৃত্তির আওতাধীনে যে একটি তাৎক্ষণিক আবেগ তাঁর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল তা তাঁকে ভুলের মধ্যে নিক্ষেপ করলো এবং আত্মসংযমের বাঁধন ঢিলে হবার সাথে সাথেই তিনি আনুগত্যের উন্নত স্থান থেকে গোনাহের নিম্নপংকে নেমে গেলেন।
(৩) প্রশ্ন হলো কুরআন, তাওরাত জবুর ইঞ্জিলে বর্ণিত এই ঘটনা যা মুসলিম ও বুখারী সংকলিত হাদীসের বরাতে হযরত মূসা ও আদম (আঃ)এর মধ্যকার কথোপকথন এসেছে সেটা কি ঐ ছিদ্রান্বেষনকারী বিকৃতকারী মৌলভী সাহেবরা অস্বীকার করেন? (৪) দেওবন্দী ওলামায়ে কেরামের লেখা তাফসীর গ্রন্থ সহ দুনিয়ার প্রাচীণ তাফসীর গুলোর এমন একটি তাফসীর কি দেখাতে পারবেন যেখানে তাফহীমূল কোরআন এর ব্যাখ্যার বিপরীত কোন বাখ্যা বা তাফহীমূল কোরআন এর চাইতে মার্জিত ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে?!
প্রাচীন তাফসীর সমূহের বিবরণÑ তাফসীরে কুরতুবী (৫) এবার দেখুন সুরা ত্বাহা'র এই আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রাচীন তাফসীর গুলোতে কি বলা হয়েছে। তাফসীরে কুরতুবীতে বলা হয়েছে এখানে ৭টি মাসআলা আছে- যেমন-الاول القول في ذنوب الأنبياء قال بعض المتأخرين من علمائنا الثانية : قال القاضي أبو بكر بن العربي ------------الذي عذره الله سبحانه وتعالى وتاب عليه وغفر له এখানে ذنوب এর অর্থ কি নেয়া হবে গোনাহ বা পাপ ছাড়া। এর পর বলা হয়েছে وتاب عليه وغفر له আল্লাহর কাছে তওবা করেন এবং আল্লাহ মাফ করেন।.------الثالثة : روى الأئمة واللفظ عن أبي هريرة عن النبي - صلى الله عليه وسلم - قال : احتج آدم وموسى فقال موسى : يا آدم أنت أبونا خيبتنا وأخرجتنا من الجنة ، فقال آدم : يا موسى اصطفاك الله - عز وجل এই কাজের পেছনে আল্লাহর হেকমত রয়েছে। কারণ তিনি তো আদম (আঃ) কে পৃথিবীতে প্রেরণের জন্য ই নির্বাচিত করেছিলেন। -الرابعة : وأما من عمل الخطايا ولم تأته المغفرة -----الخامسة : قوله تعالى : فغوى أي ففسد عليه عيشه ، حكاه النقاش واختاره القشيري . وسمعت شيخنا الأستاذ المقرئ أبا جعفر القرطبي يقول فغوى ففسد عيشه بنزوله إلى الدنيا ، والغي الفساد السادسة : قال القشيري أبو نصر قال قوم يقال : عصى آدم وغوى ولا يقال له عاص ولا غاو ---------------قلت : هذا حسن . قال الإمام أبو بكر بن فو ر الله تعالى : كان هذا من آدم قبل النبوة ، ودليل ذلك قوله تعالى : ثم اجتباه ربه فتاب عليه وهدى এই ঘটনাতো নবুওতির আগে ঘটেছিল। তওবা করলে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা (ও হেদায়েত দান ) করেন। তাফসীরে তাবারী ঃ
ইবনে জারীর তাবারি লিখেছেন- يقول تعالى ذكره: فأكل آدم وحوّاء من الشجرة التي نُهيا عن الأكل منها، وأطاعا أمر إبليس، وخالفا أمر ربهما. শয়তানের আদেশে রবের কথার বিপরীতে ফল বক্ষন করেন।وقوله ( وَعَصَى آدَمُ رَبَّهُ فَغَوَى ) يقول: وخالف أمر ربه، فتعدّى إلى ما لم يكن له أن يتعدّى إليه، من الأكل من الشجرة التي نهاه عن الأكل منها .বে বৃক্ষের কাছে যেতে আল্লাহ নিষেধ করেছিলেন তা লঙ্ঘন করলেন।
তাফসীরে ইবনে কছীর ঃ তাফসীরে ইবনে কছীরে বলা হয়েছে যে তাদেরকে নিষিদ্ধ গাছের প্রতি আকৃষ্ট বা প্ররোচিত করা হলে রবের আদেশ লঙ্ঘন করে ফল বক্ষন করেন। فلما ذاق الشجرة سقط عنه لباسه ، এর পর বলেছেন আল্লাহ তায়ালা আদমকে (আঃ) ডাক দিলেন -----অতপর তওবা করলেন ------আল্লাহ মাফ করলেন।
তাফসীরে বগভীঃ ইমাম বগভী রঃ কুরতুবী ও তাবারির অনুরূপ লিখে বলেছেনوعصى آدم ربه ) بأكل الشجرة ، ( فغوى ) يعني فعل ما لم يكن له فعله . وقيل : أخطأ طريق الجنة وضل حيث طلب الخلد بأكل ما نهي عن أكله ، فخاب ولم ينل مراده .----- قال ابن الأعرابي أي فسد عليه عيشه ، وصار من العز إلى الذل ، ومن الراحة إلى التع এখানে ভ্রষ্ট বা পদস্খলন ঘটে বলা হয়েছে।
তাফসীরে সাদী ও বসীতঃ كما قالوإن الأسباب التي حملت آدم على الأكل من الشجرة، أن إبليس أقسم له بالله إنه له ناصح، فصدقه آدم- عليه السلام- لاعتقاده أنه لا يمكن لأحد أن يقسم بالله كاذبا، والمؤمن غر كريم، والفاجر خب لئيم كما جاء في الحديث الشريف. আল্লাহর সাথে এটা শয়তানের চ্যালেঞ্জ ছিল তাই সে তার চ্যালেঞ্জ রক্ষা করেছে । আল্লাহু ও তাঁর ওয়াদা রক্ষা করে আদম হাওয়া কে মাফ করে দিয়েছেন। এ গুলোতো মাওলানা মাওদুদীর লেখা তাফসীর নয়। তাহলে তাহলে কেবল মাওলানা মওদুদীর প্রতি কেন অঙ্গুলি নির্দেশনাঃ
তাফসীরে উসমানীঃ তাফসীরে উসমানী হলো দেওবন্দী প্রখ্যাত আলেম ও হাদীস তাফসীর বিশারদ আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী (রঃ) লিখেছেন---আর আদম স্বীয় রবের আদেশ অমান্য করলেন, ফলে পদচ্যুত হলেন। সুরা আরাফের ২২ নম্বার আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন-” এ ভাবে তাদেরকে সে ধোকা দিয়ে (বৃক্ষের ফল খাওয়ানোর প্রতি) আকৃষ্ট করল। -----অর্থাৎ শয়তানের ধোকার প্রভাবে আল্লাহর আদেশ লঙ্গন করলেন।
তাফসীরে মা’আরেফুল কোরআন ঃ আয়াতে ব্যবহৃত غوی শব্দটির অনুবাদ ওপরে 'পথভ্রান্ত করা হয়েছে। কোন কোন মুফাসসির বলেন, এর অর্থ, তার জীবনটা বিপর্যস্ত হয়ে গেল। কারণ, দুনিয়াতে অবতরণ করার অর্থই হচ্ছে, জীবন দুর্বিষহ হওয়া।(কুরতুবী) প্রশ্ন হলো এখানে আদম (আঃ) কি অপরাধটা করলেন ? এটাতো শয়তানের প্ররোচনার প্রভাব ই। শয়তান এটাই তো চ্যালেঞ্জ করেছিল। আল্লাহ তায়ালাও তার ওয়াদা রক্ষা করে আদম হাওয়াকে (আঃ) মাফ করে দিয়ে শয়তানের চক্রান্ত নিস্ফল করে দিয়েছেন। আর আদমের আর অন্যান্য মুফাস্সিরদের লেখায় আর মওদুদীর লেখায় ব্যবধানটি কি আপনারাই বিকের আদালতে ইনসাফের মানদন্ডে বিচার করে বলুন।
হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর নিষ্পাপত্ব মওদূদীর (রঃ) বক্তব্য ঃ হযরত ইউসুফ (আঃ) কে তাঁর ভাইদের থেকে যারা কিনেছিল,তা সে ক্রেতা যাত্রীদলের লোক হোক বা তাদের কাছ থেকে যারা কিনেছিল তারা হোক, শেষ পর্যন্ত তারা তাঁকে মিসর নিয়ে গেল এবং সেখানে তাঁকে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে দিল। মিসরে তাঁকে যে ব্যক্তি কিনেছিল, সে ছিল দেশের অর্থমন্ত্রী। সেকালে তার উপাধি ছিল ‘আযীয’। আযীয তার স্ত্রীকে গুরুত্ব দিয়ে বলল, সে যেন ইউসুফ (আঃ) এর প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখে। বর্ণিত আছে,তার স্ত্রীর নাম ছিল ‘যুলায়খা’। আশ্চর্য কি যে, সে বড় হয়ে আমাদের কাজে আসবে কিংবা আমরা তাঁকে পুত্ররূপেই গ্রহণ করে নিব। কথিত আছে যে,তাঁদের সন্তান-সন্ততি ছিল না, তাই সে এ কথা বলেছিল।
ইউসুফ (আঃ) আযীযে মিসরের গৃহে সুখে-শাস্তিতে বাস করতে লাগলেন। ইতিমধ্যেই তিনি এ পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন যে, যে মালিকের ঘরে তথা যুলায়খার ঘরে ইউসুফ (আঃ) বাস করতেন, সে তার প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে পড়ল এবং তার সাথে স্বীয় কু বাসনা চরিতার্থ করার জন্য ফুসলাতে লাগল এবং গৃহের সব দরজা বন্ধ করে দিল এবং তাঁকে বলতে লাগলঃ এদিকে এসো, তোমাকেই বলছি। وَرَاوَدَتۡهُ الَّتِیۡ هُوَ فِیۡ بَیۡتِهَا عَنۡ نَّفۡسِهٖ وَغَلَّقَتِ الۡاَبۡوَابَ وَقَالَتۡ هَیۡتَ لَك অর্থাৎ যে নারীর ঘরে সে থাকত, সে তাকে ফুসলানোর চেষ্টা করল এবং সবগুলো দরজা বন্ধ করে দিল ও বলল, এসে পড়। (সূরা ইউসুফ-২৩) ইউসুফ (আঃ) যখন নিজেকে চতুর্দিক থেকে বেষ্টিত দেখলেন, তখন পয়গাম্বরসুলভ ভঙ্গিতে সর্বপ্রথম আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। তিনি শুধু নিজ ইচ্ছা ও সংকল্পের ওপর ভরসা করেননি। এটা জানা কথা যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর আশ্রয় লাভ করে, তাকে কেউ বিশুদ্ধ পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। قَالَ مَعَاذَ اللّٰهِ اِنَّهُ رَبِّیۡۤ اَحۡسَنَ مَثۡوَایَ ؕ اِنَّهُ لَا یُفۡلِحُ الظّٰلِمُوۡنَ অর্থাৎ ইউসুফ বলল, আল্লাহর পানাহ! তিনি আমার মনিব। তিনি আমাকে ভালোভাবে রেখেছেন। সত্য কথা হচ্ছে, যারা জুলুম করে তারা কৃতকার্য হয় না। (সূরা ইউসুফ-২৩) ইজ্জতের মালিক আল্লাহ। তিনি এ সৎ যুবককে এহেন অগ্নি পরীক্ষায় দৃঢ়পদ রাখলেন। এর আরও বিবরণ নিম্নোক্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে وَلَقَدۡ هَمَّتۡ بِهِ ۚ وَهَمَّ بِهَا لَوۡلَاۤ اَنۡ رَّاٰ بُرۡهَانَ رَبِّهٖ ؕ کَذٰلِكَ لِنَصۡرِفَ عَنۡهُ السُّوۡٓءَ وَالۡفَحۡشَآءَ ؕ اِنَّهُ مِنۡ عِبَادِنَا الۡمُخۡلَصِیۡنَ অর্থাৎ যুলায়খা তো পাপ কাজের কল্পনায় বিভোরই ছিল, ইউসুফ (আঃ)-এর মনেও মানবিক স্বভাববশত কিছু কিছু অনিচ্ছাকৃত ঝোঁক সৃষ্টি হতে যাচ্ছিল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা ঠিক সেই মুহূর্তে স্বীয় যুক্তি-প্রমাণ ইউসুফ (আঃ)-এর সামনে তুলে ধরেন, যদ্দরুন সেই অনিচ্ছাকৃত ঝোঁক ক্রমবর্ধিত হওয়ার পরিবর্তে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল এবং তিনি মহিলার নাগপাশ ছিন্ন করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগলেন। (সূরা ইউসুফ-২৪) আয়াতে هَمَّ শব্দটি (কল্পনা অর্থে) যুলায়খা ও ইউসুফ (আঃ) উভয়ের প্রতি সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে-وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا একথা সুনিশ্চিত যে, যুলায়খার কল্পনাটা ছিল পাপকাজের কল্পনা। এতে ইউসুফ (আঃ) সম্পর্কেও এ ধরনের ধারণা হতে পারত। কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের সর্বসম্মত অভিমত অনুযায়ী এটা নবুয়ত ও রিসালাতের পরিপন্থী। কেননা, সকল মুসলিম মনীষীই এ বিষয়ে একমত যে, পয়গম্বরগণ সর্বপ্রকার সগীরা ও কবীরা গুনাহ থেকে পবিত্র থাকেন। তাঁদের দ্বারা কোনো ধরনের গুনাহ ইচ্ছা, অনিচ্ছা বা ভুলবশত কোনরূপেই হতে পারে না। কারণ আল্লাহ তায়ালার হেফাজতের পর্দা ইসমত সর্বদাই তাঁদের সাথে থাকে। পয়গাম্বরগণের পবিত্রতার এ বিষয়টি কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত হওয়া ছাড়াও তাঁদের যোগ্যতার প্রশ্নেও জরুরী। কেননা, যদি পয়গাম্বরগণের দ্বারা গুনাহ সংঘটিত হওয়ার আশংকা থাকে, তবে তাঁদের আনীত ধর্ম ও ওহীর প্রতি আস্থার কোন উপায় থাকে না এবং তাঁদেরকে প্রেরণ ও তাঁদের প্রতি গ্রন্থ অবতারণের কোন উপকারিতাও অবশিষ্ট থাকে না। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক পয়গাম্বরকেই গুনাহ থেকে পবিত্র রেখেছেন।
তাই সাধারণভাবে এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত ও নিঃসন্দিগ্ধ হওয়া গেছে যে, ইউসুফ (আঃ)-এর মনে যে কল্পনা ছিল তা পাপ পর্যায়ের ছিল না। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা এই যে,আরবী ভাষায় هَمَّ শব্দটি দু’অর্থে ব্যবহৃত হয়। এক. কোন কাজের ইচ্ছা ও সংকল্প করে ফেলা। দুই. শুধু অন্তরে ধারণা ও অনিচ্ছাকৃত ভাব উদয় হওয়া। প্রথমোক্ত প্রকারটি পাপের অন্তর্ভুক্ত এবং শাস্তিযোগ্য। হ্যাঁ, যদি ইচ্ছা ও সংকল্পের পর একমাত্র আল্লাহর ভয়ে কেউ এ গুনাহ স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে, তবে হাদীসে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা এ গুনাহর পরিবর্তে তার আমলনামায় একটি পুণ্য লিপিবদ্ধ করে দেন। দ্বিতীয় প্রকার অর্থাৎ শুধু অন্তরে ধারণা ও অনিচ্ছাকৃত ভাব উদয় হওয়া এবং তা কার্যে পরিণত করার ইচ্ছা মোটেই না থাকা। যেমন, গ্রীষ্মকালীন রোযায় পানির দিকে স্বাভাবিক ও অনিচ্ছাকৃত ঝোঁক প্রায় সবারই জাগ্রত হয় অথচ রোযা অবস্থা হওয়ার ফলে তা পান করার ইচ্ছা মোটেই জাগ্রত হয় না। এই প্রকার কল্পনা মানুষের ইচ্ছাধীন নয় এবং এ জন্য কোন শাস্তি বা গুনাহ নেই। সহীহ বুখারীর হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন- আল্লাহ তায়ালা আমার উম্মতের এমন পাপচিন্তা ও কল্পনা ক্ষমা করে দিয়েছেন, যা সে কার্যে পরিণত করে না। (কুরতুবী) বুখারী ও মুসলিমে আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর রেওয়ায়তে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উক্তি বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদেরকে বলেনঃ আমার বান্দা যখন কোন সৎ কাজের ইচ্ছা করে, তখন শুধু ইচ্ছার কারণে তার আমলনামায় একটি নেকি লিখে দাও। যদি সে সৎ কাজটি সম্পন্ন করে, তবে দশটি নেকি লিপিবদ্ধ কর। পক্ষান্তরে যদি কোন পাপকাজের ইচ্ছা করে, অতঃপর আল্লাহর ভয়ে তা পরিত্যাগ করে, তখন পাপের পরিবর্তে তার আমলনামায় একটি নেকি লিখে দাও এবং যদি পাপ কাজটি করেই ফেলে, তবে একটি গুনাহই লিপিবদ্ধ কর । (ইবনে কাসীর)
তফসীর কুরতুবীতে উপরোক্ত দু’অর্থে هَمَّ শব্দের ব্যবহার প্রমাণ করা হয়েছে এবং এর সমর্থনে আরবদের প্রচলিত বাকপদ্ধতি ও কবিতার সাক্ষ্য বর্ণনা হয়েছে। এতে বোঝা গেল যে, আয়াতে যদিও هَمَّ শব্দটিকে যুলায়খা ও ইউসুফ (আঃ) উভয়ের প্রতি সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে, তবুও উভয়ের هَمَّ অর্থাৎ কল্পনার মধ্যে ছিল বিরাট পার্থক্য। প্রথমটি গুনাহর অন্তর্ভুক্ত এবং দ্বিতীয়টি অনিচ্ছাকৃত ধারণা, যা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত নয়। কুরআনের বর্ণনাভঙ্গিও এ দাবির পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। কেননা, উভয়ের কল্পনা যদি একই প্রকার হতো, তবে এ ক্ষেত্রে تثنيه তথা দ্বিবাচক পদ ব্যবহার করে وَلَقَدْ هَمَّا বলা হতো, যা সংক্ষিপ্ত ছিল। কিন্তু এটা ছেড়ে উভয়ের কল্পনা পৃথক পৃথক বর্ণনা করে وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا বলা হয়েছে। যুলায়খার কল্পনার সাথে তাকিদের শব্দ لَقَدْ যোগ করা হয়েছে এবং ইউসুফ (আঃ)-এর هَمَّ ও কল্পনার সাথে তা যোগ করা হয়নি। এতে বোঝা যায় যে, এ বিশেষ শব্দটির মাধ্যমে এ কথাই বুঝানো উদ্দেশ্য যে, যুলায়খার কল্পনা এবং ইউসুফ (আঃ)-এর কল্পনা ছিল ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির। সহীহ মুসলিমের হাদীসে বলা হয়েছেঃ যখন ইউসুফ (আঃ) এ পরীক্ষার সম্মুখীন হন, তখন ফেরেশতারা আল্লাহ তা’য়ালার সমীপে আরয করলেনঃ আপনার এ খাঁটি বান্দা পাপচিন্তা করছে অথচ সে এর কুপরিণাম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত আছে। আল্লাহ তা’য়ালা বললেনঃ অপেক্ষা কর। যদি সে এ গুনাহ করে ফেলে, তবে যেরূপ কাজ করে, তদ্রূপই তার আমলনামায় লিখে দাও; আর যদি সে বিরত থাকে, তবে পাপের পরিবর্তে তার আমলনামায় নেকি লিপিবদ্ধ কর। কেননা,সে একমাত্র আমার ভয়ে স্বীয় খাহেশ পরিত্যাগ করেছে। এটা খুব বড় নেকি। (কুরতুবী) মোটকথা এই যে, ইউসুফ (আঃ)-এর অন্তরে যে কল্পনা অথবা ঝোঁক সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিছক অনিচ্ছাকৃত ধারণার পর্যায়ে ছিল। এটা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত নয়। অতঃপর এ ধারণার বিপক্ষে কাজ করার দরুন আল্লাহ তা’য়ালার কাছে তাঁর মর্যাদা আরও বেড়ে গেছে। পরবর্তী বাক্য হচ্ছে এই لَوْلَا أَنْ رَأَى بُرْهَانَ رَبِّهِ -এখানে এর جزاء উহ্য রয়েছে। অর্থ এই যে,যদি তিনি পালনকর্তার প্রমাণ অবলোকন না করতেন, তবে এ কল্পনাতেই লিপ্ত থাকতেন। পালনকর্তার প্রমাণ দেখে নেওয়ার কারণে অনচ্ছিাকৃত কল্পনা ও ধারণাও অন্তর থেকে দূর হয়ে গেল। স্বীয় পালনকর্তার যে প্রমাণ ইউসুফ (আঃ)-এর দৃষ্টির সামনে এসেছিল, তা কি ছিল কুরআনে পাক তা ব্যক্ত করেনি। এ কারণেই এ সম্পর্কে তফসীরবিদগণ নানা মত ব্যক্ত করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, সাঈদ ইবনে জুবায়র, মুহাম্মদ ইবনে সিরীন, হাসান বসরী প্রমুখ বলেছেনঃ আল্লাহ তাআলা মুজিযা হিসাবে এ নির্জন কক্ষে হযরত ইয়াকুব (আঃ)-এর চিত্র এভাবে তাঁর সম্মুখে উপস্থিত করে দেন যে, তিনি হাতের অঙ্গুলি দাঁতে চেপে তাঁকে হুশিয়ার করেছেন। কেউ কেউ বলেনঃ ইউসুফ (আঃ)-এর দৃষ্টি ছাদের দিকে উঠতেই সেখানে কুরআনে পাকের এ আয়াত লিখিত দেখলেনঃ وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا অর্থাৎ ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়োনা। কেননা,এটা খুবই নির্লজ্জতা,(আল্লাহর শাস্তির কারণ) এবং (সমাজের জন্য) অত্যন্ত মন্দ পথ।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলেন, كَذَلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاءَ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِينَ অর্থাৎ আমি ইউসুফ (আঃ)-কে এ প্রমাণ এজন্য দেখিয়েছি, যাতে তার কাছ থেকে মন্দ কাজ ও নির্লজ্জতাকে দূরে সরিয়ে দেই। (সূরা ইউসুফ-২৪) এখানে ‘মন্দ কাজ’ বলে সগীরা গুনাহ এবং ‘নির্লজ্জতা’ বলে কবীরা গুনাহ বুঝানো হয়েছে। (মাযহারী) এখানে একটি প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, মন্দ কাজ ও নির্লজ্জতাকে ইউসুফ (আঃ)-এর কাছ থেকে সরানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং ইউসুফ (আঃ)-কে মন্দ কাজ ও নির্লজ্জতা থেকে সরানোর কথা বলা হয়নি। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ইউসুফ (আঃ) নবুয়তের কারণে এ গুনাহ থেকে নিজেই দূরে ছিলেন কিন্তু মন্দ কাজ নির্লজ্জতা তাঁকে আবেষ্টন করার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু আমি এর জাল ছিন্ন করে দিয়েছি। কুরআনে পাকের এ ভাষাও সাক্ষ্য দেয় যে, ইউসুফ (আঃ) কোন সামান্যতম গুনাহেও লিপ্ত হননি এবং তাঁর মনে যে কল্পনা জাগরিত হয়েছিল, তা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত ছিল না। নতুবা এখানে এভাবে ব্যক্ত করা হতো যে, আমি ইউসুফকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে দিলাম; এভাবে বলা হতো না যে, গুনাহকে তাঁর কাছ থেকে সরিয়ে দিলাম। কেননা, ইউসুফ আমার মনোনীত বান্দাদের একজন। এখানে مُخْلَصِينَ শব্দটি লামের যবরযোগে مخلص -এর বহুবচন। এর অর্থ মনোনীত। উদ্দেশ্য এই যে,ইউসুফ (আঃ) আল্লাহ তা’য়ালার এ সব বান্দার অন্যতম, যাদেরকে স্বয়ং আল্লাহ রিসালতের দায়িত্ব পালন ও মানবজাতির সংশোধনের জন্য মনোনীত করেছেন। এমন লোকদের চারপাশে আল্লাহর পক্ষ থেকে হেফাযতের পাহারা ইসমত বিদ্যমান থাকে, যাতে তাঁরা কোন মন্দ কাজে লিপ্ত হতে না পারেন। স্বয়ং শয়তানও তার বিবৃতিতে একথা স্বীকার করেছে যে, আল্লাহর মনোনীত বান্দাদের ওপর তার কলাকৌশল অচল। শয়তানের উক্তি ছিল فبعزتك وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ অর্থাৎ আপনার ইযযত ও শক্তির কসম, আমি সব মানুষকে সরল পথ থেকে বিচ্যুত করব, তবে যেসব বান্দাকে আপনি মনোনীত করেছেন, তাদেরকে ছাড়া। (সূরা সোয়াদ ৮২-৮৩)
কোন কোন কিরাআতে এ শব্দটি مُخْلَصِينَ লামের যের-যোগেও পঠিত হয়েছে। মুখলিস ঐ ব্যক্তি, যে আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য আন্তরিকতার সাথে করে, এতে কোন পার্থিব ও প্রবৃত্তিগত উদ্দেশ্য, সুখ্যাতি ইত্যাদির প্রভাব থাকে না। এমতাবস্থায় আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে,যে ব্যক্তিই স্বীয় কর্ম ও ইবাদতে আন্তরিক হয়, পাপ থেকে বেঁচে থাকার ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা তাকে সাহায্য করেন। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা দু’টি শব্দ سوء ও فَحْشَاء ব্যবহার করেছেন। প্রথমটির শাব্দিক অর্থ মন্দ কাজ এবং এর দ্বারা সগীরা গুনাহ বোঝানো হয়েছে। فَحْشَاء শব্দের অর্থ নির্লজ্জতা। এর দ্বারা কবীরা গুনাহ বোঝানো হয়েছে। এর দ্বরা বোঝা গেল যে, আল্লাহ তা’আলা ইউসুফ (আঃ)-কে সগীরা ও কবীরা উভয় প্রকার গুনাহ থেকেই মুক্ত রেখেছেন। এ থেকে আরও বোঝা গেল যে, কুরআনে ইউসুফ (আঃ)-এর প্রতি যে هم অর্থাৎ কল্পনা শব্দটিকে সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে, তা নিছক অনিচ্ছাকৃত ধারণার পর্যায়ে ছিল,যা কবীরা ও সগীরা কোন প্রকারের গুনাহেরই অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং তা ক্ষমার্হ। (তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, মুফতী শফী উসমানী (রঃ)।
এতো কিছুর পরেও হযরত ইউসুফ (আঃ) ব্যাপারে মওদূদী সাহেবের কথা লক্ষ করুন, যে হযরত ইউসুফ (আঃ) বলেছিলেন, اجعلني على خزائن الأرض অর্থাৎ "আমাকে মিশরের খাজানাসমূহের তত্ত¡াবধায়ক নিযুক্ত করে দেন।" কুরআনের আয়াতটির এ অর্থই মুসলমানগণ নিয়ে থাকেন।
মাওলানা মওদুদীর উপর অভিযোগঃ
কিন্তু মওদূদী সাহেব বলেছেন,- یہ محض وزیر مالیات کے منصب کا مطالبہ نہیں تھا۔ جیسا کہ بعض لوگ سمجھتے ہیں بلکہ یہ ڈکٹیٹرشپ کا مطالبہ تھا اور اس کے نتیجے میں سیدنا یوسف علیہ اسلام کو جو پوزیشن حاصل ہوئی وہ قریب قریب وہی پوزیشن تھی جو اس وقت اٹلی میں مسولینی کو حاصل ہےূ (ابوالاعلی مودودی، تفہیمات، جلد دوم، نئی دہلی: مرکزی مکتبہ اسلامی پبلشرز، طبع اول: مارچ ۱۹۹۹ عیسائی، صفحہ ۱۲۲) অর্থাৎ এটা কেবল অর্থ মন্ত্রীর গদী লাভের দাবী ছিল না, যদিও কেউ কেউ এটাই মনে করে থাকেন বরঞ্চ এটা ছিল সর্বাধিনায়ক ও সার্বভৌম শাসকের পদের দাবী। এর ফলে হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম যে পদমর্যাদা ও ক্ষমতা লাভ করলেন, তা বর্তমানে ইতালীতে মুসোলিনী যে পদমর্যাদায় আসীন, তার প্রায় অনুরূপ। (নির্বাচিত রচনাবলী ২য় খন্ড সায়্যিদ আবুল আলা মওদূদী, অনুবাদ: মাওলানা আকরাম ফারুক এবং মাওলানা আবদুস শহীদ নাসিম, আধুনিক প্রকাশনী ঢাকা, ১ম প্রকাশঃ অক্টোবর ১৯৯১, পৃষ্ঠা ১৫১)
অভিযোগ হলোÑ উরপঃধঃড়ৎংযরঢ় বা 'একনায়কত্ব' শব্দটি কতই না আপত্তিকর ও অবমাননাসূচক! তাছাড়া বিশ্বের ইতিহাসে মুসোলিনি হচ্ছে হিটলারের মত একজন জালিম একনায়ক স্বৈরাচারী এবং তার বন্ধু। এমন নিকৃষ্ট ব্যক্তির সাথে মানবতার চূড়ান্ত পদমর্যাদায় আসীন মহান নবীকে তুলনা করা চরম ধৃষ্টতা বৈ অন্য কিছু নয়।
পর্যালোচনা ঃ এখানে মাওলানা মাওদুদীর (রঃ) ছিদ্রান্বেষণ না করে নিজেদের অজ্ঞতার বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত বলে আমরা মনে করি। কারণ উরপঃধঃড়ৎংযরঢ় শব্দটির অর্থ তখন ই স্বৈরাচার বা এক নায়ক হবে যখন কোন মানুষ পদ-পদবী পেয়ে বা ক্ষমতার ম্যান্ডেড পেয়ে স্বেচ্ছাচারি হয়ে যায়। এখানে সেই অর্থে আনা হয়নি বরং একজন নবী হিসাবে সমকালীন জাতীর আল্লাহ প্রদত্ত একচ্ছত্র নেতা হিসাবে তাঁর কর্তৃত্ব স্বীকার করিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে বলেছেন। উরপঃধঃড়ৎংযরঢ় শব্দের অভিধানিক অর্থ ও পরিভাষিক অর্থ তালাশ করলেই তো পরিস্কার হয়ে যায়। সুতরাং নিজের বিবেকের আদালতে বিচার করে ইনসাফের মানদন্ডে বলুন এই অভিযোগ কতটা সত্য ও জ্ঞানী সুলভ।
হযরত আদম (আ:) এর সমালোচনার অভিযোগঃ পর্যালোচনা দেখুন সুরা ত্বাহা'র ১২১ নম্বার আয়াতে এরশাদ হচ্ছে-فَاَكَلَا مِنْهَا فَبَدَتْ لَهُمَا سَوْاٰتُهُمَا وَ طَفِقَا یَخْصِفٰنِ عَلَیْهِمَا مِنْ وَّرَقِ الْجَنَّةِ١٘ وَ عَصٰۤى اٰدَمُ رَبَّهٗ فَغَوٰى۪ۖ অর্থাৎ-শেষ পর্যন্ত দু’জন (স্বামী-স্ত্রী) সে গাছের ফল খেয়ে বসলো। ফলে তখনই তাদের লজ্জাস্থান পরস্পরের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়লো এবং দু’জনই জান্নাতের পাতা দিয়ে নিজেকে ঢাকতে লাগলো। আদম নিজের রবের নাফরমানী করলো এবং সে সঠিক পথ থেকে সরে গেল।"
আপনারা যারা বলেন মাওলানা মওদুদী ইসমতে আম্বিয়া মানেন,অথচ একজন মাওলানা তাফহীমূল কোরআন হাতে নিয়ে দেখিয়েছেন যে- সুরা ত্বাহা'র ১২১ নম্বার আয়াতের ব্যাখ্যায় মাওলানা মওদুদী' আদম (আঃ) এর সমালোচনা করে বলেছেন যে আদম (আঃ) শয়তানের ধোকায় প্রভাবিত হয়ে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে জান্নাত থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। অপরদিক রাসায়েল ও মাসায়েলে তিনি বলেছেন আদম (আঃ) নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে তিনি আল্লাহর আদেশ লঙ্গন করার পাপ করেছেন। আপনি কি এটাকে নবীর (আঃ) সমালোচনা মনে করেন না ?
পর্যালোচনা ঃ বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ায় আগে আপনার বিবেকের আদালতে জিজ্ঞেস করে পাঠক যারা তারাও বলুন তো وَ عَصٰۤى اٰدَمُ رَبَّهٗ فَغَوٰى۪ۖ এই বাক্যটি কার ? যার অর্থ ” আদম নিজের রবের নাফরমানী করলো এবং সে সঠিক পথ থেকে সরে গেল।" এবার দেখুন মাওলানা মওদুদীর লেখা তাফহীমুল কোরআন সহ কোন তাফসীরে কি লেখা হয়েছে।
তাফহীমুল কুরআন: আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফহীমুল কোরআনে যা বলা হয়েছে তা হলোÑ”এখানে আদম (আঃ) এর মাধ্যমে যে মানবিক দুর্বলতার প্রকাশ ঘটেছিল তার প্রকৃতি স্বরূপ অনুধাবন করা উচিত। ----------শয়তানের হিংসা ও শত্রুতার জ্ঞানও তিনি সরাসরি লাভ করেছিলেন। আল্লাহ তাঁকে হুকুম দেবার সাথে সাথেই বলে দিয়েছিলেন, এ হচ্ছে তোমার শত্রæ তোমাকে নাফরমানী করতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করবে ফলে এজন্য তোমাকে এ ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। শয়তান তাঁর সামনে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল যে, আমি তাকে পথভ্রষ্ট করতঃ এবং তার শিকড় উপড়ে ফেলবো। এসব সত্বেও শয়তান যখন তার সামনে স্নেহশীল উপদেশ দাতা ও কল্যাণকামী বন্ধুর বেশে এসে তাঁকে একটি অপেক্ষাকৃত উন্নত অবস্থার (চিরন্তন জীবন ও অন্তীন শাসন কর্তৃত্ব) লোভ দেখালো তখন তার লোভ দেখানোর মোকাবিলায় তিনি নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারলেন না। তার পা পিছলে গেলো। অথচ এখানে আল্লাহর প্রতি তাঁর বিশ্বাসে কোন পার্থক্য দেখা দেয়নি এবং তাঁর ফরমান আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়, এ ধরনের কোন ভাবনাও তার মনে জাগেনি। শয়তানী লালসাবৃত্তির আওতাধীনে যে একটি তাৎক্ষণিক আবেগ তাঁর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল তা তাঁকে ভুলের মধ্যে নিক্ষেপ করলো এবং আত্মসংযমের বাঁধন ঢিলে হবার সাথে সাথেই তিনি আনুগত্যের উন্নত স্থান থেকে গোনাহের নিম্নপংকে নেমে গেলেন। (৩) প্রশ্ন হলো কুরআন, তাওরাত জবুর ইঞ্জিলে বর্ণিত এই ঘটনা যা মুসলিম ও বুখারী সংকলিত হাদীসের বরাতে হযরত মূসা ও আদম (আঃ)এর মধ্যকার কথোপকথন এসেছে সেটা কি ঐ ছিদ্রান্বেষনকারী বিকৃতকারী মৌলভী সাহেবরা অস্বীকার করেন? (৪) দেওবন্দী ওলামায়ে কেরামের লেখা তাফসীর গ্রন্থ সহ দুনিয়ার প্রাচীণ তাফসীর গুলোর এমন একটি তাফসীর কি দেখাতে পারবেন যেখানে তাফহীমূল কোরআন এর ব্যাখ্যার বিপরীত কোন বাখ্যা বা তাফহীমূল কোরআন এর চাইতে মার্জিত ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে?!
প্রাচীন তাফসীর সমূহের বিবরণÑ
তাফসীরে কুরতুবী (৫) এবার দেখুন সুরা ত্বাহা'র এই আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রাচীন তাফসীর গুলোতে কি বলা হয়েছে। তাফসীরে কুরতুবীতে বলা হয়েছে এখানে ৭টি মাসআলা আছে- যেমন-الاول القول في ذنوب الأنبياء قال بعض المتأخرين من علمائنا الثانية : قال القاضي أبو بكر بن العربي ------------الذي عذره الله سبحانه وتعالى وتاب عليه وغفر له এখানে ذنوب এর অর্থ কি নেয়া হবে গোনাহ বা পাপ ছাড়া। এর পর বলা হয়েছে وتاب عليه وغفر له আল্লাহর কাছে তওবা করেন এবং আল্লাহ মাফ করেন।. ------الثالثة : روى الأئمة واللفظ عن أبي هريرة عن النبي - صلى الله عليه وسلم - قال : احتج آدم وموسى فقال موسى : يا آدم أنت أبونا خيبتنا وأخرجتنا من الجنة ، فقال آدم : يا موسى اصطفاك الله - عز وجل এই কাজের পেছনে আল্লাহর হেকমত রয়েছে। কারণ তিনি তো আদম (আঃ) কে পৃথিবীতে প্রেরণের জন্য ই নির্বাচিত করেছিলেন। -الرابعة : وأما من عمل الخطايا ولم تأته المغفرة -----الخامسة : قوله تعالى : فغوى أي ففسد عليه عيشه ، حكاه النقاش واختاره القشيري . وسمعت شيخنا الأستاذ المقرئ أبا جعفر القرطبي يقول فغوى ففسد عيشه بنزوله إلى الدنيا ، والغي الفساد السادسة : قال القشيري أبو نصر قال قوم يقال : عصى آدم وغوى ولا يقال له عاص ولا غاو ---------------قلت : هذا حسن . قال الإمام أبو بكر بن فو ر الله تعالى : كان هذا من آدم قبل النبوة ، ودليل ذلك قوله تعالى : ثم اجتباه ربه فتاب عليه وهدى এই ঘটনাতো নবুওতির আগে ঘটেছিল। তওবা করলে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা (ও হেদায়েত দান ) করেন।-------
তাফসীরে তাবারীঃ ইবনে জারীর তাবারি লিখেছেন- يقول تعالى ذكره: فأكل آدم وحوّاء من الشجرة التي نُهيا عن الأكل منها، وأطاعا أمر إبليس، وخالفا أمر ربهما. শয়তানের আদেশে রবের কথার বিপরীতে ফল বক্ষন করেন।وقوله ( وَعَصَى آدَمُ رَبَّهُ فَغَوَى ) يقول: وخالف أمر ربه، فتعدّى إلى ما لم يكن له أن يتعدّى إليه، من الأكل من الشجرة التي نهاه عن الأكل منها .বে বৃক্ষের কাছে যেতে আল্লাহ নিষেধ করেছিলেন তা লঙ্ঘন করলেন। তাফসীরে ইবনে কছীর তাফসীরে ইবনে কছীরে বলা হয়েছে যে তাদেরকে নিষিদ্ধ গাছের প্রতি আকৃষ্ট বা প্ররোচিত করা হলে রবের আদেশ লঙ্ঘন করে ফল বক্ষন করেন। فلما ذاق الشجرة سقط عنه لباسه ، এর পর বলেছেন আল্লাহ তায়ালা আদমকে (আঃ) ডাক দিলেন -----অতপর তওবা করলেন ------আল্লাহ মাফ করলেন। তাফসীরে বগভীঃ ইমাম বগভী রঃ কুরতুবী ও তাবারির অনুরূপ লিখে বলেছেনوعصى آدم ربه ) بأكل الشجرة ، ( فغوى ) يعني فعل ما لم يكن له فعله . وقيل : أخطأ طريق الجنة وضل حيث طلب الخلد بأكل ما نهي عن أكله ، فخاب ولم ينل مراده .----- قال ابن الأعرابي أي فسد عليه عيشه ، وصار من العز إلى الذل ، ومن الراحة إلى التع এখানে ভ্রষ্ট বা পদস্খলন ঘটে বলা হয়েছে।
তাফসীরে সাদী ও বসীতঃ كما قالوإن الأسباب التي حملت آدم على الأكل من الشجرة، أن إبليس أقسم له بالله إنه له ناصح، فصدقه آدم- عليه السلام- لاعتقاده أنه لا يمكن لأحد أن يقسم بالله كاذبا، والمؤمن غر كريم، والفاجر خب لئيم كما جاء في الحديث الشريف. আল্লাহর সাথে এটা শয়তানের চ্যালেঞ্জ ছিল তাই সে তার চ্যালেঞ্জ রক্ষা করেছে । আল্লাহু ও তাঁর ওয়াদা রক্ষা করে আদম হাওয়া কে মাফ করে দিয়েছেন। এ গুলোতো মাওলানা মাওদুদীর লেখা তাফসীর নয়। তাহলে তাহলে কেবল মাওলানা মওদুদীর প্রতি কেন অঙ্গুলি নির্দেশনাঃ
তাফসীরে উসমানীঃ তাফসীরে উসমানী হলো দেওবন্দী প্রখ্যাত আলেম ও হাদীস তাফসীর বিশারদ আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী (রঃ) লিখেছেন---আর আদম স্বীয় রবের আদেশ অমান্য করলেন, ফলে পদচ্যুত হলেন। সুরা আরাফের ২২ নম্বার আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন-” এ ভাবে তাদেরকে সে ধোকা দিয়ে (বৃক্ষের ফল খাওয়ানোর প্রতি) আকৃষ্ট করল। -----অর্থাৎ শয়তানের ধোকার প্রভাবে আল্লাহর আদেশ লঙ্গন করলেন।
তাফসীরে মা’আরেফুল কোরআন ঃ আয়াতে ব্যবহৃত غوی শব্দটির অনুবাদ ওপরে 'পথভ্রান্ত করা হয়েছে। কোন কোন মুফাসসির বলেন, এর অর্থ, তার জীবনটা বিপর্যস্ত হয়ে গেল। কারণ, দুনিয়াতে অবতরণ করার অর্থই হচ্ছে, জীবন দুর্বিষহ হওয়া।(কুরতুবী) প্রশ্ন হলো এখানে আদম (আঃ) কি অপরাধটা করলেন ? এটাতো শয়তানের প্ররোচনার প্রভাব ই। শয়তান এটাই তো চ্যালেঞ্জ করেছিল। আল্লাহ তায়ালাও তার ওয়াদা রক্ষা করে আদম হাওয়াকে (আঃ) মাফ করে দিয়ে শয়তানের চক্রান্ত নিস্ফল করে দিয়েছেন। আর আদমের আর অন্যান্য মুফাস্সিরদের লেখায় আর মওদুদীর লেখায় ব্যবধানটি কি আপনারাই বিকের আদালতে ইনসাফের মানদন্ডে বিচার করে বলুন।
হযরত ইউসুফ (আঃ) এর নিষ্পাপত্ব ও মাওলানা মওদূদী ঃ হযরত ইউসুফ (আঃ) কে তাঁর ভাইদের থেকে যারা কিনেছিল,তা সে ক্রেতা যাত্রীদলের লোক হোক বা তাদের কাছ থেকে যারা কিনেছিল তারা হোক, শেষ পর্যন্ত তারা তাঁকে মিসর নিয়ে গেল এবং সেখানে তাঁকে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে দিল। মিসরে তাঁকে যে ব্যক্তি কিনেছিল, সে ছিল দেশের অর্থমন্ত্রী। সেকালে তার উপাধি ছিল ‘আযীয’। আযীয তার স্ত্রীকে গুরুত্ব দিয়ে বলল, সে যেন ইউসুফ (আঃ) এর প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখে। বর্ণিত আছে,তার স্ত্রীর নাম ছিল ‘যুলায়খা’। আশ্চর্য কি যে, সে বড় হয়ে আমাদের কাজে আসবে কিংবা আমরা তাঁকে পুত্ররূপেই গ্রহণ করে নিব। কথিত আছে যে,তাঁদের সন্তান-সন্ততি ছিল না, তাই সে এ কথা বলেছিল।
ইউসুফ (আঃ) আযীযে মিসরের গৃহে সুখে-শাস্তিতে বাস করতে লাগলেন। ইতিমধ্যেই তিনি এ পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন যে, যে মালিকের ঘরে তথা যুলায়খার ঘরে ইউসুফ (আঃ) বাস করতেন, সে তার প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে পড়ল এবং তার সাথে স্বীয় কু বাসনা চরিতার্থ করার জন্য ফুসলাতে লাগল এবং গৃহের সব দরজা বন্ধ করে দিল এবং তাঁকে বলতে লাগলঃ এদিকে এসো, তোমাকেই বলছি। وَرَاوَدَتۡهُ الَّتِیۡ هُوَ فِیۡ بَیۡتِهَا عَنۡ نَّفۡسِهٖ وَغَلَّقَتِ الۡاَبۡوَابَ وَقَالَتۡ هَیۡتَ لَك অর্থাৎ যে নারীর ঘরে সে থাকত, সে তাকে ফুসলানোর চেষ্টা করল এবং সবগুলো দরজা বন্ধ করে দিল ও বলল, এসে পড়। (সূরা ইউসুফ-২৩) ইউসুফ (আঃ) যখন নিজেকে চতুর্দিক থেকে বেষ্টিত দেখলেন, তখন পয়গাম্বরসুলভ ভঙ্গিতে সর্বপ্রথম আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। তিনি শুধু নিজ ইচ্ছা ও সংকল্পের ওপর ভরসা করেননি। এটা জানা কথা যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর আশ্রয় লাভ করে, তাকে কেউ বিশুদ্ধ পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। قَالَ مَعَاذَ اللّٰهِ اِنَّهُ رَبِّیۡۤ اَحۡسَنَ مَثۡوَایَ ؕ اِنَّهُ لَا یُفۡلِحُ الظّٰلِمُوۡنَ অর্থাৎ ইউসুফ বলল, আল্লাহর পানাহ! তিনি আমার মনিব। তিনি আমাকে ভালোভাবে রেখেছেন। সত্য কথা হচ্ছে, যারা জুলুম করে তারা কৃতকার্য হয় না। (সূরা ইউসুফ-২৩) ইজ্জতের মালিক আল্লাহ। তিনি এ সৎ যুবককে এহেন অগ্নি পরীক্ষায় দৃঢ়পদ রাখলেন। এর আরও বিবরণ নিম্নোক্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে وَلَقَدۡ هَمَّتۡ بِهِ ۚ وَهَمَّ بِهَا لَوۡلَاۤ اَنۡ رَّاٰ بُرۡهَانَ رَبِّهٖ ؕ کَذٰلِكَ لِنَصۡرِفَ عَنۡهُ السُّوۡٓءَ وَالۡفَحۡشَآءَ ؕ اِنَّهُ مِنۡ عِبَادِنَا الۡمُخۡلَصِیۡنَ অর্থাৎ যুলায়খা তো পাপ কাজের কল্পনায় বিভোরই ছিল, ইউসুফ (আঃ)-এর মনেও মানবিক স্বভাববশত কিছু কিছু অনিচ্ছাকৃত ঝোঁক সৃষ্টি হতে যাচ্ছিল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা ঠিক সেই মুহূর্তে স্বীয় যুক্তি-প্রমাণ ইউসুফ (আঃ)-এর সামনে তুলে ধরেন, যদ্দরুন সেই অনিচ্ছাকৃত ঝোঁক ক্রমবর্ধিত হওয়ার পরিবর্তে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল এবং তিনি মহিলার নাগপাশ ছিন্ন করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগলেন। (সূরা ইউসুফ-২৪) আয়াতে هَمَّ শব্দটি (কল্পনা অর্থে) যুলায়খা ও ইউসুফ (আঃ) উভয়ের প্রতি সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে-وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا একথা সুনিশ্চিত যে, যুলায়খার কল্পনাটা ছিল পাপকাজের কল্পনা। এতে ইউসুফ (আঃ) সম্পর্কেও এ ধরনের ধারণা হতে পারত। কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের সর্বসম্মত অভিমত অনুযায়ী এটা নবুয়ত ও রিসালাতের পরিপন্থী। কেননা, সকল মুসলিম মনীষীই এ বিষয়ে একমত যে, পয়গম্বরগণ সর্বপ্রকার সগীরা ও কবীরা গুনাহ থেকে পবিত্র থাকেন। তাঁদের দ্বারা কোনো ধরনের গুনাহ ইচ্ছা, অনিচ্ছা বা ভুলবশত কোনরূপেই হতে পারে না। কারণ আল্লাহ তায়ালার হেফাজতের পর্দা ইসমত সর্বদাই তাঁদের সাথে থাকে। পয়গাম্বরগণের পবিত্রতার এ বিষয়টি কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত হওয়া ছাড়াও তাঁদের যোগ্যতার প্রশ্নেও জরুরী। কেননা, যদি পয়গাম্বরগণের দ্বারা গুনাহ সংঘটিত হওয়ার আশংকা থাকে, তবে তাঁদের আনীত ধর্ম ও ওহীর প্রতি আস্থার কোন উপায় থাকে না এবং তাঁদেরকে প্রেরণ ও তাঁদের প্রতি গ্রন্থ অবতারণের কোন উপকারিতাও অবশিষ্ট থাকে না। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক পয়গাম্বরকেই গুনাহ থেকে পবিত্র রেখেছেন। তাই সাধারণভাবে এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত ও নিঃসন্দিগ্ধ হওয়া গেছে যে, ইউসুফ (আঃ)-এর মনে যে কল্পনা ছিল তা পাপ পর্যায়ের ছিল না। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা এই যে,আরবী ভাষায় هَمَّ শব্দটি দু’অর্থে ব্যবহৃত হয়। এক. কোন কাজের ইচ্ছা ও সংকল্প করে ফেলা। দুই. শুধু অন্তরে ধারণা ও অনিচ্ছাকৃত ভাব উদয় হওয়া। প্রথমোক্ত প্রকারটি পাপের অন্তর্ভুক্ত এবং শাস্তিযোগ্য। হ্যাঁ, যদি ইচ্ছা ও সংকল্পের পর একমাত্র আল্লাহর ভয়ে কেউ এ গুনাহ স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে, তবে হাদীসে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা এ গুনাহর পরিবর্তে তার আমলনামায় একটি পুণ্য লিপিবদ্ধ করে দেন। দ্বিতীয় প্রকার অর্থাৎ শুধু অন্তরে ধারণা ও অনিচ্ছাকৃত ভাব উদয় হওয়া এবং তা কার্যে পরিণত করার ইচ্ছা মোটেই না থাকা। যেমন, গ্রীষ্মকালীন রোযায় পানির দিকে স্বাভাবিক ও অনিচ্ছাকৃত ঝোঁক প্রায় সবারই জাগ্রত হয় অথচ রোযা অবস্থা হওয়ার ফলে তা পান করার ইচ্ছা মোটেই জাগ্রত হয় না। এই প্রকার কল্পনা মানুষের ইচ্ছাধীন নয় এবং এ জন্য কোন শাস্তি বা গুনাহ নেই। সহীহ বুখারীর হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন- আল্লাহ তায়ালা আমার উম্মতের এমন পাপচিন্তা ও কল্পনা ক্ষমা করে দিয়েছেন, যা সে কার্যে পরিণত করে না। (কুরতুবী) বুখারী ও মুসলিমে আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর রেওয়ায়তে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উক্তি বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদেরকে বলেনঃ আমার বান্দা যখন কোন সৎ কাজের ইচ্ছা করে, তখন শুধু ইচ্ছার কারণে তার আমলনামায় একটি নেকি লিখে দাও। যদি সে সৎ কাজটি সম্পন্ন করে, তবে দশটি নেকি লিপিবদ্ধ কর। পক্ষান্তরে যদি কোন পাপকাজের ইচ্ছা করে, অতঃপর আল্লাহর ভয়ে তা পরিত্যাগ করে, তখন পাপের পরিবর্তে তার আমলনামায় একটি নেকি লিখে দাও এবং যদি পাপ কাজটি করেই ফেলে, তবে একটি গুনাহই লিপিবদ্ধ কর । (ইবনে কাসীর)
তফসীর কুরতুবীতে উপরোক্ত দু’অর্থে هَمَّ শব্দের ব্যবহার প্রমাণ করা হয়েছে এবং এর সমর্থনে আরবদের প্রচলিত বাকপদ্ধতি ও কবিতার সাক্ষ্য বর্ণনা হয়েছে। এতে বোঝা গেল যে, আয়াতে যদিও هَمَّ শব্দটিকে যুলায়খা ও ইউসুফ (আঃ) উভয়ের প্রতি সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে, তবুও উভয়ের هَمَّ অর্থাৎ কল্পনার মধ্যে ছিল বিরাট পার্থক্য। প্রথমটি গুনাহর অন্তর্ভুক্ত এবং দ্বিতীয়টি অনিচ্ছাকৃত ধারণা, যা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত নয়। কুরআনের বর্ণনাভঙ্গিও এ দাবির পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। কেননা, উভয়ের কল্পনা যদি একই প্রকার হতো, তবে এ ক্ষেত্রে تثنيه তথা দ্বিবাচক পদ ব্যবহার করে وَلَقَدْ هَمَّا বলা হতো, যা সংক্ষিপ্ত ছিল। কিন্তু এটা ছেড়ে উভয়ের কল্পনা পৃথক পৃথক বর্ণনা করে وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا বলা হয়েছে। যুলায়খার কল্পনার সাথে তাকিদের শব্দ لَقَدْ যোগ করা হয়েছে এবং ইউসুফ (আঃ)-এর هَمَّ ও কল্পনার সাথে তা যোগ করা হয়নি। এতে বোঝা যায় যে, এ বিশেষ শব্দটির মাধ্যমে এ কথাই বুঝানো উদ্দেশ্য যে, যুলায়খার কল্পনা এবং ইউসুফ (আঃ)-এর কল্পনা ছিল ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির। সহীহ মুসলিমের হাদীসে বলা হয়েছেঃ যখন ইউসুফ (আঃ) এ পরীক্ষার সম্মুখীন হন, তখন ফেরেশতারা আল্লাহ তা’য়ালার সমীপে আরয করলেনঃ আপনার এ খাঁটি বান্দা পাপচিন্তা করছে অথচ সে এর কুপরিণাম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত আছে। আল্লাহ তা’য়ালা বললেনঃ অপেক্ষা কর। যদি সে এ গুনাহ করে ফেলে, তবে যেরূপ কাজ করে, তদ্রূপই তার আমলনামায় লিখে দাও; আর যদি সে বিরত থাকে, তবে পাপের পরিবর্তে তার আমলনামায় নেকি লিপিবদ্ধ কর। কেননা,সে একমাত্র আমার ভয়ে স্বীয় খাহেশ পরিত্যাগ করেছে। এটা খুব বড় নেকি। (কুরতুবী) মোটকথা এই যে, ইউসুফ (আঃ)-এর অন্তরে যে কল্পনা অথবা ঝোঁক সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিছক অনিচ্ছাকৃত ধারণার পর্যায়ে ছিল। এটা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত নয়। অতঃপর এ ধারণার বিপক্ষে কাজ করার দরুন আল্লাহ তা’য়ালার কাছে তাঁর মর্যাদা আরও বেড়ে গেছে।
পরবর্তী বাক্য হচ্ছে এই لَوْلَا أَنْ رَأَى بُرْهَانَ رَبِّهِ -এখানে এর جزاء উহ্য রয়েছে। অর্থ এই যে,যদি তিনি পালনকর্তার প্রমাণ অবলোকন না করতেন, তবে এ কল্পনাতেই লিপ্ত থাকতেন। পালনকর্তার প্রমাণ দেখে নেওয়ার কারণে অনচ্ছিাকৃত কল্পনা ও ধারণাও অন্তর থেকে দূর হয়ে গেল। স্বীয় পালনকর্তার যে প্রমাণ ইউসুফ (আঃ)-এর দৃষ্টির সামনে এসেছিল, তা কি ছিল কুরআনে পাক তা ব্যক্ত করেনি। এ কারণেই এ সম্পর্কে তফসীরবিদগণ নানা মত ব্যক্ত করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, সাঈদ ইবনে জুবায়র, মুহাম্মদ ইবনে সিরীন, হাসান বসরী প্রমুখ বলেছেনঃ আল্লাহ তাআলা মুজিযা হিসাবে এ নির্জন কক্ষে হযরত ইয়াকুব (আঃ)-এর চিত্র এভাবে তাঁর সম্মুখে উপস্থিত করে দেন যে, তিনি হাতের অঙ্গুলি দাঁতে চেপে তাঁকে হুশিয়ার করেছেন। কেউ কেউ বলেনঃ ইউসুফ (আঃ)-এর দৃষ্টি ছাদের দিকে উঠতেই সেখানে কুরআনে পাকের এ আয়াত লিখিত দেখলেনঃ وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا অর্থাৎ ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়োনা। কেননা,এটা খুবই নির্লজ্জতা,(আল্লাহর শাস্তির কারণ) এবং (সমাজের জন্য) অত্যন্ত মন্দ পথ। অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলেন, كَذَلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاءَ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِينَ অর্থাৎ আমি ইউসুফ (আঃ)-কে এ প্রমাণ এজন্য দেখিয়েছি, যাতে তার কাছ থেকে মন্দ কাজ ও নির্লজ্জতাকে দূরে সরিয়ে দেই। (সূরা ইউসুফ-২৪) এখানে ‘মন্দ কাজ’ বলে সগীরা গুনাহ এবং ‘নির্লজ্জতা’ বলে কবীরা গুনাহ বুঝানো হয়েছে। (মাযহারী) এখানে একটি প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, মন্দ কাজ ও নির্লজ্জতাকে ইউসুফ (আঃ)-এর কাছ থেকে সরানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং ইউসুফ (আঃ)-কে মন্দ কাজ ও নির্লজ্জতা থেকে সরানোর কথা বলা হয়নি। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ইউসুফ (আঃ) নবুয়তের কারণে এ গুনাহ থেকে নিজেই দূরে ছিলেন কিন্তু মন্দ কাজ নির্লজ্জতা তাঁকে আবেষ্টন করার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু আমি এর জাল ছিন্ন করে দিয়েছি। কুরআনে পাকের এ ভাষাও সাক্ষ্য দেয় যে, ইউসুফ (আঃ) কোন সামান্যতম গুনাহেও লিপ্ত হননি এবং তাঁর মনে যে কল্পনা জাগরিত হয়েছিল, তা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত ছিল না। নতুবা এখানে এভাবে ব্যক্ত করা হতো যে, আমি ইউসুফকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে দিলাম; এভাবে বলা হতো না যে, গুনাহকে তাঁর কাছ থেকে সরিয়ে দিলাম। কেননা, ইউসুফ আমার মনোনীত বান্দাদের একজন। এখানে مُخْلَصِينَ শব্দটি লামের যবরযোগে مخلص -এর বহুবচন। এর অর্থ মনোনীত। উদ্দেশ্য এই যে,ইউসুফ (আঃ) আল্লাহ তা’য়ালার এ সব বান্দার অন্যতম, যাদেরকে স্বয়ং আল্লাহ রিসালতের দায়িত্ব পালন ও মানবজাতির সংশোধনের জন্য মনোনীত করেছেন। এমন লোকদের চারপাশে আল্লাহর পক্ষ থেকে হেফাযতের পাহারা ইসমত বিদ্যমান থাকে, যাতে তাঁরা কোন মন্দ কাজে লিপ্ত হতে না পারেন। স্বয়ং শয়তানও তার বিবৃতিতে একথা স্বীকার করেছে যে, আল্লাহর মনোনীত বান্দাদের ওপর তার কলাকৌশল অচল। শয়তানের উক্তি ছিল فبعزتك وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ অর্থাৎ আপনার ইযযত ও শক্তির কসম, আমি সব মানুষকে সরল পথ থেকে বিচ্যুত করব, তবে যেসব বান্দাকে আপনি মনোনীত করেছেন, তাদেরকে ছাড়া। (সূরা সোয়াদ ৮২-৮৩) কোন কোন কিরাআতে এ শব্দটি مُخْلَصِينَ লামের যের-যোগেও পঠিত হয়েছে। মুখলিস ঐ ব্যক্তি, যে আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য আন্তরিকতার সাথে করে, এতে কোন পার্থিব ও প্রবৃত্তিগত উদ্দেশ্য, সুখ্যাতি ইত্যাদির প্রভাব থাকে না। এমতাবস্থায় আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে,যে ব্যক্তিই স্বীয় কর্ম ও ইবাদতে আন্তরিক হয়, পাপ থেকে বেঁচে থাকার ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা তাকে সাহায্য করেন। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা দু’টি শব্দ سوء ও فَحْشَاء ব্যবহার করেছেন। প্রথমটির শাব্দিক অর্থ মন্দ কাজ এবং এর দ্বারা সগীরা গুনাহ বোঝানো হয়েছে। فَحْشَاء শব্দের অর্থ নির্লজ্জতা। এর দ্বারা কবীরা গুনাহ বোঝানো হয়েছে। এর দ্বরা বোঝা গেল যে, আল্লাহ তা’আলা ইউসুফ (আঃ)-কে সগীরা ও কবীরা উভয় প্রকার গুনাহ থেকেই মুক্ত রেখেছেন। এ থেকে আরও বোঝা গেল যে, কুরআনে ইউসুফ (আঃ)-এর প্রতি যে هم অর্থাৎ কল্পনা শব্দটিকে সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে, তা নিছক অনিচ্ছাকৃত ধারণার পর্যায়ে ছিল, যা কবীরা ও সগীরা কোন প্রকারের গুনাহেরই অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং তা ক্ষমার্হ। (তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, মুফতী শফী উসমানী (রঃ)।
এতকিছুর পরেও হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের ব্যাপারে মওদূদী সাহেবের কদর্যতা লক্ষ করুন ঃ হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম বলেছিলেন, اجعلني على خزائن الأرض অর্থাৎ "আমাকে মিশরের খাজানাসমূহের তত্ত¡াবধায়ক নিযুক্ত করে দেন।" কুরআনের আয়াতটির এ অর্থই মুসলমানগণ নিয়ে থাকেন।
মাওলানা মওদুদীর উপর অভিযোগঃ কিন্তু মওদূদী সাহেব বলেছেন,- یہ محض وزیر مالیات کے منصب کا مطالبہ نہیں تھا۔ جیسا کہ بعض لوگ سمجھتے ہیں بلکہ یہ ڈکٹیٹرشپ کا مطالبہ تھا اور اس کے نتیجے میں سیدنا یوسف علیہ اسلام کو جو پوزیشن حاصل ہوئی وہ قریب قریب وہی پوزیشن تھی جو اس وقت اٹلی میں مسولینی کو حاصل ہےূ (ابوالاعلی مودودی، تفہیمات، جلد دوم، نئی دہلی: مرکزی مکتبہ اسلامی پبلشرز، طبع اول: مارچ ۱۹۹۹ عیسائی، صفحہ ۱۲۲) অর্থাৎ এটা কেবল অর্থ মন্ত্রীর গদী লাভের দাবী ছিল না, যদিও কেউ কেউ এটাই মনে করে থাকেন বরঞ্চ এটা ছিল সর্বাধিনায়ক ও সার্বভৌম শাসকের পদের দাবী। এর ফলে হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম যে পদমর্যাদা ও ক্ষমতা লাভ করলেন, তা বর্তমানে ইতালীতে মুসোলিনী যে পদমর্যাদায় আসীন, তার প্রায় অনুরূপ। (নির্বাচিত রচনাবলী ২য় খন্ড সায়্যিদ আবুল আলা মওদূদী, অনুবাদ: মাওলানা আকরাম ফারুক এবং মাওলানা আবদুস শহীদ নাসিম, আধুনিক প্রকাশনী ঢাকা, ১ম প্রকাশঃ অক্টোবর ১৯৯১, পৃষ্ঠা ১৫১)
অভিযোগ হলোÑ উরপঃধঃড়ৎংযরঢ় বা 'একনায়কত্ব' শব্দটি কতই না আপত্তিকর ও অবমাননাসূচক! তাছাড়া বিশ্বের ইতিহাসে মুসোলিনি হচ্ছে হিটলারের মত একজন জালিম একনায়ক স্বৈরাচারী এবং তার বন্ধু। এমন নিকৃষ্ট ব্যক্তির সাথে মানবতার চূড়ান্ত পদমর্যাদায় আসীন মহান নবীকে তুলনা করা চরম ধৃষ্টতা বৈ অন্য কিছু নয়। পর্যালোচনা ঃ এখানে মাওলানা মাওদুদীর ছিদ্রান্বেষণ না করে নিজেদের অজ্ঞতার বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত বলে আমরা মনে করি। কারণ উরপঃধঃড়ৎংযরঢ় শব্দটির অর্থ তখন ই স্বৈরাচার বা এক নায়ক হবে যখন কোন মানুষ পদ-পদবী পেয়ে বা ক্ষমতার ম্যান্ডেড পেয়ে স্বেচ্ছাচারি হয়ে যায়। এখানে সেই অর্থে আনা হয়নি বরং একজন নবী হিসাবে সমকালীন জাতীর আল্লাহ প্রদত্ত একচ্ছত্র নেতা হিসাবে তাঁর কর্তৃত্ব স্বীকার করিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে বলেছেন। উরপঃধঃড়ৎংযরঢ় শব্দের অভিধানিক অর্থ ও পরিভাষিক অর্থ তালাশ করলেই তো পরিস্কার হয়ে যায়। সুতরাং নিজের বিবেকের আদালতে বিচার করে ইনসাফের মানদন্ডে বলুন এই অভিযোগ কতটা সত্য ও জ্ঞানী সুলভ।
ইউনুস (আঃ) এর ঘটনা ও মাওলানা মওদুদীর বক্তব্য ঃ পবিত্র কুরআনের সূরা মু'মিন বা গাফির এর ৫৫ সূরা মুহাম্মদ এর ১৯ নম্বার আয়াত সমূহে আল্লাহ তায়ালা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে লক্ষ্য করে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ ।”এবং তওবা কর তোমার গোনাহ থেকে ” এটা হলো সমস্ত অনুবাদক ও তাফসীর কারকদের ভাষা। পক্ষান্তরে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী (রঃ) 'গুনাহ' শব্দ ব্যবহার না করে বলেছেন وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ অর্থাৎ "নিজের ভুল-ত্রুটির জন্য মাফ চাও/ক্ষমা প্রার্থনা করো।" (তাফহীমুল কুরআন) এর পর ইসমতে আম্বিয়া মাসআলায় মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) এর বক্তব্যের সার সংক্ষেপ হলো - ১. মাসুম বা নিষ্পাপত্ব একমাত্র নবীদেরই বৈশিষ্ট্য। (রাসায়েল ও মাসায়েল ৫/১৯৮) ২. নবীগণের মাসুম বা পাপমুক্ত হওয়াটা নিঃসন্দেহে একটি মৌলিক বিষয়। (রাসায়েল ও মাসায়েল ৩/৬১) ৩. আমি নবী ছাড়া অন্য কাউকে মাসুম বা নিষ্পাপ মনে করি না। (রাসায়েল ও মাসায়েল ১/২৮৯)
তাফসীরে তাবারী ও কুরতুবী ঃ তাফসীরে তাবারী ও কুরতুবীতে বলা হয়েছেÑ (১) তওবা কর নিজের এবং উম্মতের গোনাহ’র জন্য।(২) وقيل : لذنب نفسك على من يجوز الصغائر على الأنبياء তোমার নিজের গোনাহ’র জন্য যে সব ছোট খাটো গোনাহ আম্বিয়ায়ে কেরামের হয়ে থাকে। (৩) فاستغفر الله من ذنب صدر منك قبل النبوة নবুওতির পূর্বে সংঘঠিত গোনাহর জন্য তওবা কর।তাবারীর মতে يقول وسله غفران ذنوبك وعفوه لك عنه এর মূল কথা হলো তোমার গোনাহ থেকে ক্ষমা চাও আমার ওয়াদা আছে ক্ষমা করার।
তাফসীরে ইবনে কছীর ঃ তফসীরে ইবনে কছীরে বলা হয়েছে واستغفر لذنبك هذا تهييج للأمة على الاستغفار এটা উম্মতের গোনাহর জন্য উম্মতের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়া। তাফসীরে বগভীঃ তাফসীরে বগভীতৈ বলা হয়েছেÑ واستغفر لذنبك هذا تعبد من الله ليزيده به درجة وليصير سنة لمن بعده এটাও আল্লাহর ইবাদতির একটি অংশ যার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বান্দাহদের মর্য্যাদা বৃদ্ধি করেন। তাফসীরে সাদীঃ তাফসীরে সাদীতে বলা হয়েছে وبالاستغفار الذي فيه دفع المحذور ইস্তেগফার বা তওবা অপরিচ্ছনতা দুর করে পরিচ্ছন্নতা আনায়ন করে,ত্রæটি বিচ্যুতি দুর করে।
তফসীরে ওসিত ঃ তাফসীরে ওসীতে বলা হয়েছে- واستغفر لِذَنبِكَ فإن استغفارك هذا وأنت المصعوم من كل ما يغضبنا - يجعل أمتك تقتدى بك فى ذلك অর্থাৎ আপনি মাসুম কিন্তু তওবা তাদের পক্ষ থেকে সমূহ ত্রæটি বিচ্যুতি থেকে। ইমাম রাজী (রঃ) বলেছেন - قوله - تعالى واستغفر لِذَنبِكَ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন তুমার গোনাহ থেকে তওবা কর। এর অর্থ হলো- ما ملخصه واعلم أن مجامع الطاعات তওবা বিশেষ পরিভাষা মানে ইওস্তগফার আল্লাহর জিকির ও ইবাদতির মধ্যেই পড়ে। তফসীরে মুয়াস্সারে বলা হয়েছে واستغفر لذنبك، ودُمْ على تنزيه ربك
তরজমায়ে শায়খুল হিন্দ ঃ শাইখুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী (রঃ) তাঁর 'তরজমায়ে কুরআন' গ্রন্থে, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী দেওবন্দী (রঃ) তাঁর 'তাসহীলু বায়ানিল কুরআন' গ্রন্থে, মুফতি মুহাম্মদ শফী উসমানী দেওবন্দী (রঃ) 'মা'আরেফুল কুরআন' গ্রন্থে وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ এর অনুবাদ করেছেন এভাবে, "(হে নবী) তুমি তোমার নিজ গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো। হোছাইন আহমদ মদনী (রঃ) বলেন-معصوموں سے اگر چه قصدا گناه نهیں هوسکتا مگر غلط فہمی سے بسا اوقات ان سے بڑے سے بڑ گناه هو جا تاہے. অর্থাৎ“মাসুমের দ্বারা যদিও ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো পাপ কার্য হতে পারেনি, কিন্তু ভুল বুঝাবুঝিতে অনেক সময়েই তাঁদের দ্বারা বড় বড় পাপ (কবীরা গুনাহ) কার্য হয়ে গেছে। (মাকতুবাতে শায়খুল ইসলাম ১/২৫৯ ও মালফুজাতে শায়খুল ইসলাম ১/৪৭) পক্ষান্তরে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী (রঃ) 'গুনাহ' শব্দ ব্যবহার না করে বলেছেন وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ অর্থাৎ "নিজের ভুল-ত্রুটির জন্য মাফ চাও/ক্ষমা প্রার্থনা করো।" (তাফহীমুল কুরআন)
সুরা এ নাসর এর فَسَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّكَ وَاسۡتَغۡفِرۡهُؕ اِنَّهٗ كَانَ تَوَّابًا. এ আয়াতের অনুবাদে সায়্যিদ আবুল আ'লা মওদুদী (রাহঃ) বলেন, "তুমি তোমার রবের হামদ সহকারে তাঁর তাসবীহ পড় এবং তাঁর কাছে মাগফিরাত চাও। অবশ্য তিনি বড়ই তাওবা কবুলকারী।" (তাফহীমুল কুরআন, সূরা নাসর ১১০/৩) এখানেও ইস্তেগফার বলেছেন গোনাহ বলেন নি। অন্য দিকে শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী (রঃ) এ আয়াতের অনুবাদে বলেন,"তুমি স্বীয় রবের পবিত্রতা ঘোষণা করো প্রশংসার সাথে ও তাঁর নিকট গুনাহের জন্য প্রার্থনা করো। (তরজমায়ে শায়খুল হিন্দ সূরা নাসর )
শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মদানী (রঃ)
হোছাইন আহমদ মদনী (রঃ) বলেন-معصوموں سے اگر چه قصدا گناه نهیں هوسکتا مگر غلط فہمی سے بسا اوقات ان سے بڑے سے بڑ گناه هو جا تاہے. অর্থাৎ“মাসুমের দ্বারা যদিও ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো পাপ কার্য হতে পারেনি, কিন্তু ভুল বুঝাবুঝিতে অনেক সময়েই তাঁদের দ্বারা বড় বড় পাপ (কবীরা গুনাহ) কার্য হয়ে গেছে। কিন্তু বাহ্যত সেগুলো পাপ কাজ বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সেগুলো পাপ নয় । কাজেই সেগুলো প্রকৃত পাপ কাজ বলা যেতে পারে না। যেমন, উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে যে,হযরত মুসা (আ) তদীয় ভ্রাতা হযরত হারুণ (আঃ) এর চুল ও দাড়ি ধরে টেনেছিলেন। এ কাজটি দ্বারা একজন নবী, যিনি তাঁর বড় ভাইও ছিলেন তাঁকে অপমান করা হয়েছে। এ কাজ অন্যের দ্বারা সংঘটিত হলে কুফরী বরং মারাত্মক ধরণের কুফরী বলে বিবেচিত হতো। অনুরূপ হযরত মুসা (আঃ) তাওরাত লিখিত পাথর ফলক ছুড়ে মেরেছিলেন। যেমন পবিত্র কুরআনে আছে- ﻭَﻟَﻤَّﺎ ﺭَﺟَﻊَ ﻣُﻮﺳَﻰٰٓ ﺇِﻟَﻰٰ ﻗَﻮْﻣِﻪِۦ ﻏَﻀْﺒَٰﻦَ ﺃَﺳِﻔًﺎ ﻗَﺎﻝَ ﺑِﺌْﺴَﻤَﺎ ﺧَﻠَﻔْﺘُﻤُﻮﻧِﻰ ﻣِﻦۢ ﺑَﻌْﺪِﻯٓۖ ﺃَﻋَﺠِﻠْﺘُﻢْ ﺃَﻣْﺮَ ﺭَﺑِّﻜُﻢْۖ ﻭَﺃَﻟْﻘَﻰ ﭐﻟْﺄَﻟْﻮَﺍﺡَ ﻭَﺃَﺧَﺬَ ﺑِﺮَﺃْﺱِ ﺃَﺧِﻴﻪِ ﻳَﺠُﺮُّﻩُۥٓ ﺇِﻟَﻴْﻪِۚ .অর্থাৎ মূসা নিজ জাতির নিকট ফিরে এসে রাগাম্বিত বিক্ষুদ্ধ অবস্থায় বলল, আমার চলে যাওয়ার পর তোমরা কত নিকৃষ্ট প্রতিনিধিত্ব করেছ, তোমরা তোমাদের প্রভুর নির্দেশের পূর্বেই কেন তাড়াহুড়া করতে গেলে? অতঃপর সে (তাওরাত লিখিত) ফলকগুলি ফেলে দিল এবং স্বীয় ভাইয়ের মস্তক (চুল) ধরে নিজের দিকে টানতে লাগল। (সআ'রাফ ১৫০)
আল্লাহর কিতাবকে তাও আবার সেই কিতাব যা স্বয়ং তাঁর উপরেই নাযিল করা হয়েছিল তা ছুড়ে মারা নিঃসন্দেহে বড় পাপ কাজ। যদি মাসূম নবীগণ বড় বড় অপরাধমূলক কার্যে লিপ্ত হয়ে পড়তে পারেন তবে যারা মাসূম বা নিষ্পাপ নয় তারা যত বড় গুণি (ব্যাক্তিই) হোক না কেন তারা তা পারবেন না।"(মাকতুবাতে শায়খুল ইসলাম ১/২৫৯ ও মালফুজাতে-- শায়খুল ইঃ ১/৪৭)
হযরত হুসাইন আহমদ মদনী (রঃ) হযরত মূসা (আঃ) সম্পর্কে আরো বলেন-"মূসা (আঃ) এর হাতে 'কিবতী'র নিহত হওয়া নছলী আসাবিয়াত তথা বংশীয় পক্ষপাতিত্বের কারণে হয়েছিল।"(মাকতুবাতে শাইখুল ইসলাম ১/২৪৩-২৪৪; তাফহীমুল মাসাইল ১/৩১৫) এখানে মদনী (রঃ) হযরত মূসা (আঃ) কে স্বজনপ্রীতি ও বংশীয় পক্ষপাতিত্বের দোষে অভিযুক্ত করেছেন। একজন শ্রেষ্ঠ নবীর নামে 'নছলী আসাবিয়াত' শব্দ প্রয়োগ করা অপরাধ ও সম্পূর্ণ হারাম। কারণ, আসাবিয়াত অন্যায় ও জুলুম। নবী জুলুম করতে পারে না।
হাদীসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে আসাবিয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا الْعَصَبِيَّةُ قَالَ أَنْ تُعِينَ قَوْمَكَ عَلَى الظُّلْمِ "হে আল্লাহর রাসূল! আসাবিয়ত কী? তিনি (সাঃ) বললেন, নিজের কওমকে তার অন্যায়-অবিচারের বিষয়ে সাহায্য করা।’(সুনানে আবু দাউদ,হাদীস ৫১১৯) আরেক হাদীসে আছে- لَيْسَ مِنَّا مَنْ دَعَا إِلَى عَصَبِيَّةٍ وَلَيْسَ مِنَّا مَنْ قَاتَلَ عَلَى عَصَبِيَّةٍ وَلَيْسَ مِنَّا مَنْ مَاتَ عَلَى عَصَبِيَّةٍ. ঐ ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আসাবিয়তের দিকে ডাকে, সেও আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আসাবিয়তের কারণে লড়াই করে এবং সে-ও নয়, যে আসাবিয়তের উপর মৃত্যুবরণ করে।(সুনান আবু দাউদ, হাদীস ৫১২১)
আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, فَلَوْلَا كَانَتْ قَرْيَةٌ آمَنَتْ فَنَفَعَهَا إِيمَانُهَا إِلَّا قَوْمَ يُونُسَ لَمَّا آمَنُوا كَشَفْنَا عَنْهُمْ عَذَابَ الْخِزْيِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَمَتَّعْنَاهُمْ إِلَىٰ حِينٍ. সুতরাং এমন কোন দৃষ্টান্ত আছে কি যে, একটি জনবসতি চাক্ষুষ আযাব দেখে ঈমান এনেছে এবং তার ঈমান তার উপকারে এসেছে ইউনুসের কওম ছাড়া? তারা যখন ঈমান এনেছিল তখন আমি তাদের ওপর থেকে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনার আযাব হটিয়ে দিয়েছিলাম এবং আমি তাদেরকে একটি সময় পর্যন্ত ভোগ করতে দিলাম। (সূরা ইউনুস ৯৮) এ আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করে হুসাইন আহমদ মাদানী বলেন- "আযাব দেখার পর ঈমান আনলে এ ঈমান উপকারে আসেনা। ইউনুস (আ) এর সম্প্রদায় কেবল এর ব্যাতিক্রম। এর কারণ হচ্ছে এই যে, তাদের উপরে মূলত আযাবই আসেনি। বরং হযরত ইউনুস (আ) এর জলদবাজীর প্রেক্ষিতে আযাবের আকার পরিদৃষ্ট হয়েছিল।" (মালফুজাতে শাইখুল ইসলাম ১/৪৪, মাকতুবাতে শাইখুল ইসলাম ১/৮৩) এখানে মাদানী (রঃ) হযরত ইউনুস (আঃ) কে জলদবাজ বললেন। নাউযূবিল্লাহ!
মুহতারাম পাঠক! দেখুন, দেওবন্দীদের আধ্যাত্মিক রাহবর শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী কত আপত্তিকর ভাষায় নবীগণ (আঃ) এর সমালোচনা করেছেন?। তিনি বাহ্যত নবীদের মাসূম বলেছেন আর কার্যত তাদেরকে বড় বড় পাপ ও অপরাধ মূলক কাজে লিপ্ত বলে কড়া সমালোচনা করেছেন। দেওবন্দী আকাবীরগণ নবী রাসুলদের ভুল-ত্রুটির জন্য কড়া সমালোচনা করেন,গুনাহগার বলেন আর একচাটিয়া ভাবে সব দোষ মওদুদীর (রঃ) নামে চাপিয়ে দেন। এটা কি ইনসাফের খেলাফ নয়?
সূরাঃ মুহাম্মাদ আয়াতঃ ১৯ এরশাদ হচ্ছে- فَاعۡلَمۡ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا اللّٰهُ وَ اسۡتَغۡفِرۡ لِذَنۡۢبِكَ وَ لِلۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتِ অতএব জেনে রাখ, নিঃসন্দেহে আল্লাহ ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। তুমি ক্ষমা চাও তোমার ও মুমিন নারী-পুরুষদের ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য। আল্লাহ তোমাদের গতিবিধি এবং নিবাস সম্পর্কে অবগত রয়েছেন।
আলোচ্য আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, আপনি জেনে রাখুন, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ ইবাদতের যোগ্য নয়। অর্থাৎ, এই বিশ্বাসের উপর অটল ও দৃঢ় থাক। কেননা, এটাই তাওহীদ (অদ্বিতীয়বাদ), আল্লাহর আনুগত্য এবং যাবতীয় কল্যাণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। আর এ থেকে বিচ্যুতি অর্থাৎ, শিরক ও অবাধ্যতা হল যাবতীয় অকল্যাণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এই আয়াতে নবী করীম (সাঃ)-কে তাঁর নিজের জন্যও এবং মু’মিনদের জন্যও ক্ষমা প্রার্থনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ক্ষমা প্রার্থনার গুরুত্ব ও ফযীলত অনেক। বহু হাদীসেও এর প্রতি বড়ই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। একটি হাদীসে নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘‘হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তওবা কর। কারণ, আমি দিনে সত্তরবারেরও বেশী তাঁর নিকট তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকি।’’ (বুখারী, দা’ওয়াত অধ্যায়)
মুফতি তাকি উসমানী ঃ
এই আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসীরে মুফতি তকী উসমানী (হাফিঃ) লিখেছেনÑ মহানবী (সাঃ) মাসূম ছিলেন। তাঁর দ্বারা গুনাহের কোন কাজ হতেই পারত না। তবে তাঁর কোন কোন রায় সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা জানিয়েছেন যে, তা তাঁর উচ্চ মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না (যেমন বদর যুদ্ধের বন্দীদের সম্পর্কে তাঁর গৃহীত সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিলনা।তাছাড়া মানবীয় স্বভাব অনুযায়ী কখনও কখনও তাঁর দ্বারা নামাযের রাকাআত ইত্যাদিতেও ভুল হয়ে গেছে। এ জাতীয় বিষয়কেই এ আয়াতে ‘ত্রুটি-বিচ্যুতি’ শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে এর দ্বারা প্রকৃতপক্ষে তাঁর উম্মতকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, মহানবী (সাঃ) গুনাহ নয় এমন ছোট-ছোট বিষয়ের কারণেও যখন ইস্তিগফার করতেন তখন তাঁর উম্মতের তো তাওবা ইস্তিগফারে অনেক বেশি যতœবান থাকা উচিত, যেহেতু তাদের দ্বারা ছোট-বড় গুনাহ হর-হামেশাই হয়ে থাকে।
ফেরাকে বাতিলা ফতোয়া নিজেই বাতিলঃ ১) জামায়াতে ইসলামী কোন ধর্মীয় দিক-নির্দেশনা দেয়ার মাজহাব,মানহাজ বা সলুক মনে নয় বরং ইসলামের মুল ভিত্তি কোরআন সুন্নাহর আদর্শ ভিত্তিক একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্টার প্রচেষ্ঠারত একটি রাজনৈতীক দল। এটা জামায়াতে ইসলামীরর আদর্শ ও লক্ষ সম্পর্কে তাদের গঠনতন্ত্রে বর্ণিত বিবরণ থেকে আমার পঠিত অভিজ্ঞতা। এটাকে জামায়াতের নিজস্ব বা দলীয় বকÍব্য মনে করার কোন সুযোগ নেই। তাই তাদেরকে কোন ধর্মীয় ফেরকায় শামিল করে ফতোয়ারোপ করাকে ধর্মের নাম নিয়ে অধর্মী অজ্ঞতা ও মুর্খতা বলা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। কারণ এরা ধর্মের বিধি-বিধান সম্পর্কে জ্ঞান রাখে বলে বিশ্বাস করা যায় না।কারণ এখতেলাফের বিষয়টি থাকে ইসলাহী এখলাস ও দরদ মাখা। পক্ষান্তরে মতবিরোধ থাকে এখলাস ও ইসলাহ হীন জেদ ক্ষোভ ও প্রতিহিংসা ভরা,যেটা আজকাল চলছে। ২) আমাদের জানা মতে জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতীক দল তারা নিজেরাই ইসলামী শরীয়ত মেনে চলতে চেষ্টা করে দলের মধ্যকার আহলে ইলিমদের পরামর্শ অনুযায়ী মজলিসে শুরার সিদ্ধান্তের আলোকে রাজনৈতীক কর্মসূচী পালন করে এবং দলীয় নেতাকর্মীদের ইসলামের আদর্শে আদর্শিত করার লক্ষ্যে একটি উন্মোক্ত বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে স্ব-শিক্ষিত আদর্শ নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে। এ জন্য তাদের রয়েছে একটি ভ্রাম্যমান উন্মুক্ত বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয়। রয়েছে একটি দীর্ঘ সিলেবাস যেখানে কুরআন হাদীস, আক্বীদা, ফিক্বাহ শিক্ষা দেয়া হয়। নিয়মিত ক্লাশ (টিসি) নিয়ে এর পর বাহ্যিক ও গোপনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ই সদস্যদের গুণগত মান নির্ণয় করা হয়। ৩) মুজাদ্দিদে জামান রাহবরে মিল্লাত সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) যেহেতু একজন ইসলামী চিন্তাবিদ, রাজনৈতীক নেতা, আদর্শের সৈনিক,বাতিলের বিরুদ্ধে কুরআন সুন্নাহর আলোকে লেখক গবেষক,কুরআন ও হাদীসের আলোকে তাগুতী শক্তির মোকাবেলায় ইসলাম কে একটি শক্তির রূপকার,হারানো খেলাফতের পুনঃরুদ্ধারের একজন দিকপাল। তাই তার কথায়,কাজে,চিন্তা-চেতনায় ভুল ভ্রান্তি থাকাটাই স্বাভাবিক যেহেতু তিনি অহীপ্রাপ্ত নয়। এ ছাড়াও হক্বের পক্ষে থাকলে বাতিলের শাখা প্রশাখায় থাকা বাতিলের সংঘ, প্রশ্রয় দেয়া ,বিশেষত; তাগুতি শক্তি ও লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়াদ্বীন বলে একজাতি তত্ব ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে জায়েজ করে দেয়ার পক্ষে যারা কাজ করেন তাদের তো একটু জ্বালা বেশি বাড়ার ই কথা। এই সব মিলিয়ে মাওলানা মওদুদীকে গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট বলা কোন শরয়ী আইনের ফতোয়া নয়। দৃষ্টি ভঙ্গির ভিন্নতার কারণে ভিন্নমত পোষনের বা এখতেলাফের বিষয়টি একটি স্বীকৃত বিষয় যতক্ষন না তা মতবিরোধে রূপ নেয়। এখতেলাফ কে মতবিরোধ বা সংঘাতে নেয়ার একটা সহজ উপায় হলো সীমা লঙ্গন করা। যেমন কাউকে গোমরা কাফির বাতিল বলা। ৪) ফেরাকে বাতিলা নামক বইটি আদিয়ান্ত পড়লে বুঝা যায় যে ফেরাকে বাতিলা নিজেই একটি বাতিল। কারণ এই বইয়ে মোটামোটি ক্বওমী দেওবন্দী ছাড়া আর কোন ধর্মীয় ফেরক্বাকে আস্ত ছাড়া হয়নি। যেমন-
জৌনপুরী ফেরক্বা বাতিল ঃ এই ইসলামী আক্বীদা বিশ্বাস ও ভ্রান্ত মতবাদ বা ফেরাকে বাতিলা গ্রন্থে বাংলাদেশে তথা উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে পীর আউলিয়াদের ভুমিকা অগ্রগন্য। এর মধ্যে জৌনপুরী সিলসিলা উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করেছে । বদরপুরী সর্ষিনা,চুনতি,ফুলতলী সহ বেরিলে সিলসিলাও আছে। সবাইকেই মোটামোটি বাতিল, গোমরাহ, বিদাতী হিসাবে দেখানো হয়েছে।
পৃথিবীর প্রাচীনতম ধমর্, হিন্দু ধমর্ ঃ মজার ব্যাপার হলো হিন্দু ধর্মের 'আকীদা বিশ্বাস' কে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম ধর্ম ও তাদের ধর্মীয় গ্রন্থাদীর খুঁটি নাটি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে তাদের প্রচলিত গুরু দক্ষিণা প্রথার প্রশংসা করা হয়েছে। তবে বাতিল ধর্মের অন্তর্ভুক্ত দেখানো হয়েছে শিরোনামে। মুলত এটা হিন্দুদের দাবী আর তাদের দাবীটাই এখানে ফুটিয়ে তুলা হয়েছে কার স্বার্থে তা বিজ্ঞজনের বিবকের কাছে বিচারের ভার রইল। মুশরিকদের আবার আক্বীদা কিসের এবং প্রতিমা পুজারীরা কি ভাবে পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্মমত হয় তা কি কারো বুঝে আসে? না খোদ হিন্দু ধর্মাবলম্ভিরা এই দাবী করেন না এর পক্ষে কোন দলীল তারা দিয়েছেন ?
রাজতন্ত্র ও ইমাম হোসাইন (রাঃ)
আরো তেলেসমাতির ব্যাপার হলো এজিদী তন্ত্রের একটা ডামি হলো রাজতন্ত্র। এই বইয়ে অত্যন্ত দরদী ভাষায় রাজতন্ত্রের প্রকারভেদ ও ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে এটাকে পৃথিবীর আদি শাসনব্যবস্থা হিসাবে দেখানো হয়েছে যা কোন রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও ইতিহাস সমর্থন করেনা ইসলামতো নয় ই। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো এজিদকে বাঁচাতে গিয়ে ইমাম হোসাইন (রাঃ) কে জঘন্য ভাষায় আক্রমণ করে বলা হয়েছে যে-" হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এজিদকে পরামর্শের ভিত্তিতে পরবর্তী শাসক মনোনীত করেছিলেন যা ইসলাম সম্মত। এ জন্য কোন সাহাবাই এর বিরোধীতা করেন নি। হযরত হোসাইন (রাঃ) নিজেকে খেলাফতের যোগ্য ও উত্তম উত্তরাধিকার মনে করাতেই ব্যথয় ঘটে এবং তিনি জেহাদ/যুদ্ধের নিয়ত ছাড়াই কুফায় যান।---(নাআউযুবিল্লাহ)
অথচ ক্বওমী আলীয়া ও কলেজের ইসলামের ইতিহাস গ্রন্থে আছে যে অসুস্থ মুয়াবিয়া (রাঃ) কে বে মালুম রেখে নগদ অর্থ ও উপটৌকন দিয়ে মুয়াবিয়ার (রাঃ) সামনে এনে বিশিষ্টজনদের মতামত গ্রহণ করে তাকে মুয়াবিয়ার (রাঃ) স্থলাভিসিক্ত করার জন্য। অথচ মুয়াবিয়া (রাঃ) হাসান (রাঃ) কে পরবর্তি খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব দিতে ছিলেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। হাসান (রাঃ) কে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। এর পরও কিছু আলেম বয়ানে বলে থাকেন এবং এই বইয়েও বলা হয়েছে যে এজিদ ধার্মিক ছিল। অথচ ক্বওমী মাদ্রাসার আলীয়া দুওম ছুওম জামায়াতের তারিখে মিল্লাত খেলাফতে বনী উমাইয়্যাহ অধ্যায়ে আছে এজিদ বানর নিয়ে খেলা করতো এবং মদ্য ও নারী নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। একই কথা লিখেছেন মুফতি এ আজম মুফতি শফি (রঃ) এতে কি প্রমাণিত হয়না যে অসাবধানতাবশত হোক আর ইচ্ছা করে হোক এই বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা যে গুলো আক্বীদা বিনাশি তা এই বইতে স্থান পেয়েছে। যা শিক্ষা দেয়া হচ্ছে কোমলমতি ছাত্রদের যা থেকে আহলে বায়ত সহ অন্যান্য সম্মানিত সাহাবায়ে কেরামের প্রতি ছাত্রদের নেতিবাচক ধারণার এবং কারবালার ঘটনায় এজিদের নির্দোষিতা ও ইমাম হোসাইন (রাঃ) এর অযোগ্যতার কথাই প্রকাশিত হচ্ছে। এটা কি কোন সাহাবা প্রেমিক কেন কোন মোসলমানের ই সহ্য করার কথা নয়। বইটি আদ্যপান্ত পড়ে এর গুরুত্ব ও এ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানিক বিদ্যা দানের প্রয়োজনীয়তা বা এর পাঠদানকে একেবারে অমুলক অর্থহীন অন্তসার শুন্য বলা যায় না বটে। কিন্তু এটি সিলেবাসভুক্ত করার মতো কোন বই নয়। কারণ এতে তথ্য ও তত্বগত ভুলে ভরা, প্রতিহিংসা মুলক ও অন্ধ সলুকপ্রীতিতে ভরা। এ রকম ভিন্ন মত সম্বলিত ও ভিন্ন চিন্তার দলীল খন্ডন মুলক বই কিতাব একটি প্রাচীন ধারা কিন্তু এর ভাষা ও দলীল এবং দলীল খন্ডনের ধরণ এ রকম নয় বরং মার্জিত ও বিনয়ী এবং উদ্ধৃত দলীলের চাইতে বহুগুন শক্তিশালী ও পরিপক্ষ। পক্ষান্তরে এই বইয়ে বাতিল আক্বিদা ও বাতিল ধর্মমতের বিপক্ষে বাতিল হওয়ার পক্ষে শক্তিশালী কোন দলীর নেই কেবল গায়ের জোরে কথার মারপ্যচে বলে দেয়া হয়েছে এরা বেদাতি এরা ভ্রান্ত। এমনকি প্রতিপক্ষের কোন দলীলও এখানে নেই যা দেখে দলীলের অসারতা প্রমান করা যায়। কোমলমতি ছাত্রদের এখানেই ব্রেইন ওয়াস করে অসত্য প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। তাই এই বইটিকে অন্তত পাঠ্যতালিকাভ’ক্ত না রাখাটাই উত্তম ।
নবীগণনের সমালোচনা ঃ কার দায় কার ঘাড়ে দেখুন কার ভাষা কেমন জামায়াত বিরোধী কিছু ওলামায়ে কেরাম বলে থাকেন,ইসমতে আম্বিয়া (আঃ) মাসআলায় দেওবন্দীদের আকিদা হচ্ছে-নবীগণ মাসুম বা গুনাহ থেকে পবিত্র এবং তাঁরা সমালোচনার উর্ধ্বে। পক্ষান্তরে মাওলানা মওদুদী (রঃ) নবীদের গুনাহগার বলেন এবং নবীগণের সমালোচনা করেন তাই তিনি আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত বহির্ভূত ও পথভ্রষ্ট। (নাআউজুবিল্লাহ) বস্তুত এসব অভিযোগ মাওলানা মওদুদীর (রঃ) বিরুদ্ধে একটা অসত্য অপবাদ বৈ কিছু নয়। কারণ আম্বিয়া এ কিরাম বা সম্মানিত নবীদের মাসুম বা নিষ্পাপ হওয়া বিষয়ে সায়্যিদ আবুল আ'লা মওদুদী (রঃ) তাঁর আক্বীদা পরিষ্কার করে বলেছেন- ১. মাসুম বা নিষ্পাপত্ব একমাত্র নবীদেরই বৈশিষ্ট্য। (রাসায়েল ও মাসায়েল ৫/১৯৮) ২. নবীগণের মাসুম বা পাপমুক্ত হওয়াটা নিঃসন্দেহে একটি মৌলিক বিষয়। (রাসায়েল ও মাসায়েল ৩/৬১) ৩. আমি নবী ছাড়া অন্য কাউকে মাসুম বা নিষ্পাপ মনে করি না। (রাসায়েল ও মাসায়েল ১/২৮৯) মজার বিষয় হল, জামায়াত বিরোধী যে সব ওলামায়ে কেরাম সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী (রাহঃ) এর বিরুদ্ধে অসত্য অপবাদ দেন তাদের দেখা জানা ও পড়া উচিত ছিল এ ব্যাপারে আমাদের আকাবীর ও আসলাফ ডশ বলেছেন কি লিখেছেন। দেখুন-
শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী (রঃ) পবিত্র কুরআনের সূরা মু'মিন এর ৫৫ নং আয়াত এবং সূরা মুহাম্মদ এর ১৯ নং আয়াতে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) কে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন- وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ । শাইখুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী (রঃ) তাঁর 'তরজমায়ে কুরআন' গ্রন্থে,বলেছেন তোমার গোনার জন্য তওবা কর।! অনুরূপ সূরা নাসরে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, فَسَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّكَ وَاسۡتَغۡفِرۡهُؕ اِنَّهٗ كَانَ تَوَّابًا. এ আয়াতের অনুবাদে সায়্যিদ আবুল আ'লা মওদুদী (রঃ) বলেন, "তুমি তোমার রবের হামদ সহকারে তাঁর তাসবীহ পড়ো এবং তাঁর কাছে মাগফিরাত চাও। অবশ্যই তিনি বড়ই তাওবা কবুলকারী।" (তাফহীমুল কুরআন, সূরা নাসর ১১০/৩)
.মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রঃ) মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রঃ) তাঁর 'তাসহীলু বায়ানিল কুরআন' গ্রন্থে, وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ এর অনুবাদ করেছেন এভাবে, "(হে নবী) তুমি তোমার নিজ গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো। অনুরূপ সূরা নাসরে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, فَسَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّكَ وَاسۡتَغۡفِرۡهُؕ اِنَّهٗ كَانَ تَوَّابًا. এ আয়াতের অনুবাদে সায়্যিদ আবুল আ'লা মওদুদী (রঃ) বলেন, "তুমি তোমার রবের হামদ সহকারে তাঁর তাসবীহ পড়ো এবং তাঁর কাছে মাগফিরাত চাও। অবশ্যই তিনি বড়ই তাওবা কবুলকারী।" (তাফহীমুল কুরআন, সূরা নাসর ১১০/৩)
কুতবে আলম সৈয়দ হুসাইন আহমদ মদানী (রঃ) আমাদের দেওবন্দীদের সরেতাজ, আওলাদে রাসুল শায়খুল হাদীস কুতবে আলম সৈয়দ হুসাইন আহমদ মদানী (রঃ) বলেন-معصوموں سے اگر چه قصدا گناه نهیں هوسکتا مگر غلط فہمی سے بسا اوقات ان سے بڑے سے بڑ گناه هو جا تاہے. “মাসুমের দ্বারা যদিও ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো পাপ কার্য হতে পারেনি, কিন্তু ভুল বুঝাবুঝিতে অনেক সময়েই তাঁদের দ্বারা বড় বড় পাপ (কবীরা গুনাহ) কার্য হয়ে গেছে। কিন্তু বাহ্যত সেগুলো পাপ কাজ বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সেগুলো পাপ নয় । কাজেই সেগুলো প্রকৃত পাপ কাজ বলা যেতে পারে না। যেমন, উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে যে, হযরত মুসা (আ) তদীয় ভ্রাতা হযরত হারুণ (আঃ) এর চুল ও দাড়ি ধরে টেনেছিলেন (আ'রাফ১৫০)। এ কাজটি দ্বারা একজন নবী, যিনি তাঁর বড় ভাইও ছিলেন তাঁকে অপমান করা হয়েছে। এ কাজ অন্যের দ্বারা সংঘটিত হলে মারাত্মক ধরণের কুফরী বলে বিবেচিত হতো। অনুরূপ হযরত মুসা (আ) তাওরাত লিখিত পাথর ফলক ছুড়ে মেরেছিলেন। যেমন পবিত্র কুরআনে আছে-ﻭَﻟَﻤَّﺎ ﺭَﺟَﻊَ ﻣُﻮﺳَﻰٰٓ ﺇِﻟَﻰٰ ﻗَﻮْﻣِﻪِۦ ﻏَﻀْﺒَٰﻦَ ﺃَﺳِﻔًﺎ ﻗَﺎﻝَ ﺑِﺌْﺴَﻤَﺎ ﺧَﻠَﻔْﺘُﻤُﻮﻧِﻰ ﻣِﻦۢ ﺑَﻌْﺪِﻯٓۖ ﺃَﻋَﺠِﻠْﺘُﻢْ ﺃَﻣْﺮَ ﺭَﺑِّﻜُﻢْۖ ﻭَﺃَﻟْﻘَﻰ ﭐﻟْﺄَﻟْﻮَﺍﺡَ ﻭَﺃَﺧَﺬَ ﺑِﺮَﺃْﺱِ ﺃَﺧِﻴﻪِ ﻳَﺠُﺮُّﻩُۥٓ ﺇِﻟَﻴْﻪِۚ .মূসা নিজ জাতির নিকট ফিরে এসে রাগাম্বিত বিক্ষুদ্ধ অবস্থায় বললঃ আমার চলে যাওয়ার পর তোমরা কত নিকৃষ্ট প্রতিনিধিত্ব করেছ, তোমরা তোমাদের প্রভুর নির্দেশের পূর্বেই কেন তাড়াহুড়া করতে গেলে? অতঃপর সে (তাওরাত লিখিত) ফলকগুলি ফেলে দিল এবং স্বীয় ভাইয়ের মস্তক (চুল) ধরে নিজের দিকে টানতে লাগল। (সূরা আ'রাফ ১৫০) আল্লাহর কিতাবকে তাও আবার সেই কিতাব যা স্বয়ং তাঁর উপরেই নাযিল করা হয়েছিল তা ছুড়ে মারা নিঃসন্দেহে বড় পাপ কাজ। যদি মাসূম নবীগণ বড় বড় অপরাধমূলক কার্যে লিপ্ত হয়ে পড়তে পারেন তবে যারা মাসূম বা নিষ্পাপ নয় তারা যত বড় গুণিই (ব্যাক্তি) হোক কেন তারা তা পারবেন না।"(মাকতুবাতে শায়খুল ইসলাম ১/২৫৯ ও মালফুজাতে শায়খুল ইসলাম ১/৪৭) এখানে লক্ষ করুন যে হুসাইন আহমদ মদানী (রঃ) বাহ্যত কত আপত্তিকর ভাষায় নবীগণ এর সমালোচনা করেছেন বলেই প্রতিয়মান হয়। অথচ তিনিই নবীদের মাসূম বলেছেন আর কার্যত ভাবে তাদেরকে বড় বড় পাপ ও অপরাধ মূলক কাজে লিপ্ত বলেছন যা পরস্পর বিরোধী বলেই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এখানে একটি কথা লক্ষণীয় যে তিনি বলেছেন এ গুলো পাপ তথা কবীরা গোনাহ মনে হচ্ছে তার মানে তিনি গোনাহ বলেন নি গোনাহ হিসাবে গন্যও করা যায় না। আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী (রঃ) হযরত মূসা (আ) সম্পর্কে আরো বলেনঃ "মূসা (আ) এর হাতে 'কিবতী' এর নিহত হওয়া নছলী আসাবিয়াত তথা বংশীয় পক্ষপাতিত্বের কারণে হয়েছিল।"(মাকতুবাতে শাইখুল ইসলাম ১/২৪৩-২৪৪; তাফহীমুল মাসাইল ১/৩১৫) এখানে মাদানী সাহেব হযরত মূসা (আ) কে স্বজনপ্রীতি ও বংশীয় পক্ষপাতিত্বের দোষে অভিযুক্ত করেছেন। একজন শ্রেষ্ঠ নবীর নামে 'নছলী আসাবিয়াত' শব্দ প্রয়োগ করা অমার্জনীয় অপরাধ ও সম্পূর্ণ হারাম। কারণ, আসাবিয়াত অন্যায় ও জুলুম। নবী জুলুম করতে পারেন না। হাদীসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, لَيْسَ مِنَّا مَنْ دَعَا إِلَى عَصَبِيَّةٍ وَلَيْسَ مِنَّا مَنْ قَاتَلَ عَلَى عَصَبِيَّةٍ وَلَيْسَ مِنَّا مَنْ مَاتَ عَلَى عَصَبِيَّةٍ. ঐ ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আসাবিয়তের দিকে ডাকে, সেও আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আসাবিয়তের কারণে লড়াই করে এবং সে-ও নয়, যে আসাবিয়তের উপর মৃত্যুবরণ করে।(সুনান আবু দাউদ, হাদীস ৫১২১) অপর বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে আসাবিয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا الْعَصَبِيَّةُ قَالَ أَنْ تُعِينَ قَوْمَكَ عَلَى الظُّلْمِ "হে আল্লাহর রাসূল! আসাবিয়ত কী? তিনি (সাঃ) বললেন, নিজের কওমকে তার অন্যায়-অবিচারের বিষয়ে সাহায্য করা।’(সুনান আবু দাউদ,হাদীস ৫১১৯)
আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-فَلَوْلَا كَانَتْ قَرْيَةٌ آمَنَتْ فَنَفَعَهَا إِيمَانُهَا إِلَّا قَوْمَ يُونُسَ لَمَّا آمَنُوا كَشَفْنَا عَنْهُمْ عَذَابَ الْخِزْيِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَمَتَّعْنَاهُمْ إِلَىٰ حِينٍ.সুতরাং এমন কোন দৃষ্টান্ত আছে কি যে, একটি জনবসতি চাক্ষুষ আযাব দেখে ঈমান এনেছে এবং তার ঈমান তার উপকারে এসেছে ইউনুসের কওম ছাড়া? তারা যখন ঈমান এনেছিল তখন আমি তাদের ওপর থেকে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনার আযাব হটিয়ে দিয়েছিলাম এবং আমি তাদেরকে একটি সময় পর্যন্ত ভোগ করতে দিলাম। (সূরা ইউনুস ৯৮) এ আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করে হযরত হুসাইন আহমদ মদনী (রঃ) বলেন-"আযাব দেখার পর ঈমান আনলে এ ঈমান উপকারে আসেনা। ইউনুস (আঃ) এর সম্প্রদায় কেবল এর ব্যাতিক্রম। এর কারণ হচ্ছে এই যে, তাদের উপরে মূলত আযাবই আসেনি। বরং হযরত ইউনুস (আঃ) এর জলদবাজীর (তাড়াহুড়ার) প্রেক্ষিতে আযাবের আকার পরিদৃষ্ট হয়েছিল।" (মালফুজাতে শাইখুল ইসলাম ১/৪৪, মাকতুবাতে শাইখুল ইসলাম ১/৮৩) এখানে মাদানী (রঃ) হযরত ইউনুস (আঃ) কে জলদবাজ বা তড়িৎকর্মা বললেন নি ?। (নাউযূবিল্লাহ!)
মুফতি মুহাম্মদ শফী দেওবন্দী (রঃ) মুফতি মুহাম্মদ শাফী দেওবন্দী (রাহঃ) 'মা'আরেফুল কুরআন' গ্রন্থে وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ এর অনুবাদ করেছেন এভাবে, "(হে নবী) তুমি তোমার নিজ গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো। অনুরূপ সূরা নাসরে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, فَسَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّكَ وَاسۡتَغۡفِرۡهُؕ اِنَّهٗ كَانَ تَوَّابًا. এ আয়াতের অনুবাদে সায়্যিদ আবুল আ'লা মওদুদী (রঃ) বলেন, "তুমি তোমার রবের হামদ সহকারে তাঁর তাসবীহ পড়ো এবং তাঁর কাছে মাগফিরাত চাও। অবশ্যই তিনি বড়ই তাওবা কবুলকারী।" (তাফহীমুল কুরআন, সূরা নাসর ১১০/৩) সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী (রঃ) পক্ষান্তরে সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী (রঃ) 'গুনাহ' শব্দ বর্জন করে وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ এর অনুবাদ করেছেন এভাবে, "নিজের ভুল-ত্রুটির জন্য মাফ চাও/ক্ষমা প্রার্থনা করো।" (তাফহীমুল কুরআন) অনুরূপ সূরা নাসরে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, فَسَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّكَ وَاسۡتَغۡفِرۡهُؕ اِنَّهٗ كَانَ تَوَّابًا. এ আয়াতের অনুবাদে সায়্যিদ আবুল আ'লা মওদুদী (রঃ) বলেন, "তুমি তোমার রবের হামদ সহকারে তাঁর তাসবীহ পড়ো এবং তাঁর কাছে মাগফিরাত চাও। অবশ্যই তিনি বড়ই তাওবা কবুলকারী।" (তাফহীমুল কুরআন, সূরা নাসর ১১০/৩) শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী এ আয়াতের অনুবাদে বলেন, "তুমি স্বীয় রবের পবিত্রতা ঘোষণা করো প্রশংসার সাথে ও তাঁর নিকট গুনাহের জন্য প্রার্থনা করো। (তরজমায়ে কুরআন পৃঃ ৭৮৯, সূরা নাসর ১১০/৩) এবার বলেন, নবীদের গুনাহগার কারা মনে করেন, আল্লামা মওদুদী (রাহঃ) না কি জামায়াত বিরোধীগণ?
চরমোনাইর আক্বীদা ? চরমোনাই পীর সাহেবেরা সর্বদা নিজেদেরর দেওবন্দী ঘরোনার আলেম বলে দাবী করেন এবং আমাদের দেশে বর্তমানে যারা দেওবন্দীদের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করেন তারাও তা স্বীকার করেন। সেই দেওবন্দী ঘরোনার মরহুম পীর মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ এছহাক (বর্তমান পীরের দাদা হুজুর পীর কেবলা) তার লিখিত 'আশেক মাশুক বা এস্কে এলাহী' বইয়ে নবীকে গুনাহগার ও পাপী বলেছেন। দেখুন পীর সাব চরমোনাই লিখেছেন, "বাবা আদম (আঃ) খাইলেন গন্দম শয়তান দিল ধোঁকা। আছমান সকল ভেদ করিয়া পাঠাইলেন এই জঙ্গলে, পাপে না ছাড়িলো আমার বাবা (আদম) কে, তিনশত বৎসর কাইন্দালেন ময়দানে; তখন হইতে হুকুম হইল কান্দ জারে জার, শত গুনাহ করে কান্দ আরাফাত মাঝার!" (আশেক মাশুক বা এস্কে এলাহী, পৃঃ ২৮; লাইন ১৯-২৪) দেখুন,এখানে তিনি নবী আদম (আঃ) কে শুধু পাপী বা গুনাহগার বলেই ক্ষান্ত হননি বরং শত গুনাহ করে আরাফাত ময়দানে কেঁদেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। এতকিছুর পরেও নাকি তাদের আকিদা সহীহ আর আমাদের আকিদা খারাপ!
আমাদের কথা ঃ দেখুন আমাদের দেওবন্দীদের রাহবর হযরত হুসাইন আহমদ মদানী (রঃ) কোন ভাষায় নবীগণ (আঃ) এর ঘটনা বিবৃত করেছেন। তিনি বাহ্যত নবীদের মাসূম বলেছেন আর কার্যত তাদেরকে বড় বড় পাপ ও অপরাধ মূলক কাজে লিপ্ত বলে কড়া সমালোচনাও করেছেন। আমাদের মনে হয় এ জন্যই মাওলানা মওদুদী (রঃ) গোনাহ বা পাপ না বলে ত্রæটি বিচ্যুতি বলেছেন। আমাদের আকাবীর এ দেওবন্দ নবী রাসুলদের ভুল- ত্রæটির জন্য কড়া সমালোচনা করেন, গুনাহগার বলেন আর সব দোষ আল্লামা মওদুদীর (রঃ) নামে চাপিয়ে দেন। এটা কি মারাত্মক জুলুম নয়? আমাদের কথা হলো আমরা এখানে কারো ভুল ধরছি না বা আমাদের আকাবীর ও আসলাফদের ছিদ্রান্বেষণ করছিনা। বরয় এটাই বলতে চাইছি যে সকলের ই উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন ব্যাতিক্রম শব্দ চয়নে। এখানে দেখাযাচ্ছে মাওলানা মওদুদী (রঃ) শব্দচয়নে গোনাহ ব্যবহার না করে ত্রæটি বিচ্যুতি বলেছেন যা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে কিন্তু গোনাহ অপরাধ হিসাবে গন্য হয়। তাহলে নবী সমালোচক নবী বিদ্বেষী কাকে বলবেন আর বলা উচিত নাকি এই ধরণের মানসিকতা পরিহার করাই উচিত। আর বড়দের প্রতি সম্মান ও মর্য্যাদার দৃষ্টি ভঙ্গি রাখা উচিত???
অদ্ভুত কথা ঃ আবুল আ'লা নামটিই শিরক!? জাষ্টিস আল্লামা গোলাম আলী (রঃ)/ শায়খুল হাদীস শায়খ ইসহাক আল মাদানী আবুল আলা শিরক হলে মাওলানা শিরক নয় কেন ?ঃ মাওলানা আব্দুল হাই জেহাদী
ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয় আবুল আলা নামটিই শিরক। দেখুন আবুল আলা অর্থ কি আর ব্যাখ্যা দেয়া হয় কি। অভিযোগ করা হয় মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী’র (রাঃ) আবুল আলা নামটিই নাকি শিরক। বলা হয়, আবুন শব্দের অর্থ পিতা আর আ'লা হলো আল্লাহর নাম। আবুল আ‘লা (اَبُو الْأَعْلٰي)। অর্থ : সর্বমহান সত্তার বাবা বা আল্লাহর পিতা। (নাউজুবিল্লাহ) প্রকৃত অর্থে আ'লা الْأَعْلٰي শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো-সম্মানিত, বিজয়ী, মর্যাদাশীল, উচ্চতর। সাবেক জাষ্টিস আল্লামা গোলাম আলী (রঃ) বলেছেন- ”বাস্তবতা হলো কোন শিক্ষিত ও যুক্তিগ্রাহী মানুষের কাছ থেকে এটা আশা করা যায় না যে,একজন মানুষের নাম সম্পর্কে অনর্থক আপত্তি তুলবে অথবা সুস্থ মস্তিষ্কের এ জাতীয় আপত্তিকে বিবেচনার যোগ্য মনে করবে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, কিছু কিছু অজ্ঞ লোক নিজেদের লেখায় ও বক্তৃতায় অন্যান্য আপত্তিসমূহের পাশাপাশি নাম সম্পর্কেও আপত্তি তোলার এক অভিযান শুরু করেছে। এভাবে সরলমতি জনসাধারণকে এ কথা বিশ্বাস করানোর চেষ্টা চলছে যে,আ'লা অর্থ আল্লাহ। তাই যে ব্যক্তির নাম আবুল আ'লা,সে নিজেকে আল্লাহর পিতা বলে দাবী করছে, (নাউযুবিল্লাহ)। এটি এমন এক ঘৃণ্য তৎপরতা যে, আজ পর্যন্ত আমরা একে বিবেচনার মধ্যেই আনিনি। আমরা সু´ বুদ্ধি সম্পন্ন লোকদের ওপর আস্থা রেখেছিলাম যে,তারা নিজেরাই এই অপকর্মকে ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যান করবে। কিন্তু এখন ব্যাপারটা এতদূর গড়িয়েছে যে, এই নামের প্রকৃত তাৎপর্য যথাযথভাবে স্পষ্ট করে দেয়া সমীচীন মনে হচ্ছে, যাতে আপত্তিকারীদের অজ্ঞতা, দূরভিসন্ধি নস্যাৎ করে দেয়া যায়।”
” সর্বপ্রথম যে কথাটা জানানো প্রয়োজন তা হলো এই যে,আবুল আ'লা কোনো উপনাম নয়, বরং মাতাপিতার রাখা মূল নাম। মওদূদী পরিবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হযরত আবুল আ'লা মওদূদী (রহঃ) এর নামে এই নাম রাখা হয়েছে। ৯৩৫ হিজরীতে ওফাতপ্রাপ্ত এই মহাপুরুষ সিকান্দার লোদীর শাসনামলে ভারতে এসেছিলেন। তিনি ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত মহাপুরুষদের একটি প্রখ্যাত ধারার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। নিজে তো একজন বড় আলেম ছিলেনই, তদুপরি তাঁর যুগে আলেম ও পরহেজগার ব্যক্তিবর্গের প্রাচুর্যও ছিল। এ নামটিতে যদি আপত্তিকর কিছু থাকতো, তাহলে সে যুগের আলেমগণ ও সুফী সাধকগণ আপত্তি তুলতেন এবং পরবর্তীকালে এই নাম ঐ পরিবারে আর কখনো রাখা হতোনা। তথাপি বিষয়টির পর্যালোচনা এখনো করা যেতে পারে যে, বাস্তবিকই আ'লা আল্লাহ তায়ালার সুন্দরতম নামসমূহের অন্তর্ভুক্ত কিনা এবং আবুল আ'লা নাম রাখা জায়েয কিনা?
’আলা’ আল্লাহর নাম নয়’ঃ হাদীসে আল্লাহ তায়ালার ৯৯টি নাম রয়েছে বলে ব্যাপক জনশ্রæতি রয়েছে এবং হাদীসেও তা বর্ণিত আছে। তিরমিজী শরীফের কিতাবুদ দাওয়াত নামক অধ্যায়ে এ ধরনের সকল হাদীস একত্রিত করা হয়েছে। এসব হাদীসের একটি হযরত আবু হুয়াররা কর্তৃক বর্ণিত। এ হাদীসে পুরো ৯৯টি নামের উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু তার ভেতরে আ'লা নামটি নেই। ইবনে মাজার কিতাবুদ দোয়ার মধ্যে আল্লাহ নামের বিবরণ সম্বলিত আবু হুয়াররা বর্ণিত হাদীসেও 'আল-আ'লা' নামটি নেই। কুরআন শরীফে রবের বিশেষণ হিসাবে 'আল-আ'লা' এসেছে বটে, কিন্তু একাকী শুধু 'আ'লা' শব্দটিকে আল্লাহর সুন্দরতম গুণবাচক নামসমূহের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। শুধুমাত্র 'আল-আ'লা' শব্দ তো আল্লাহর নাম হিসাবে ব্যবহৃত হয়ইনি, এমনকি আলী বা আল-আলী শব্দদ্বয়ও একাকীভাবে আল্লাহর জন্য ব্যবহৃত হয়নি বরং আল্লাহ ছাড়া অন্যদের জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন-قوما عالين جنة عالية عاليها سافلها ইত্যাদি। আ'লা শব্দটা আলীরই তুলনাবাচক পদ। আলী অর্থ উঁচু আর আ'লা অর্থ অপেক্ষাকৃত উঁচু বা সর্বোচ্চ। সুতরাং যে ব্যক্তি শুধু আলা বা আ'ল আ'লা শব্দ বলে তা দ্বারা আল্লাহ তায়ালাকে বুঝাতে চায় এবং এ শব্দটি আল্লাহর নামের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবী করে, সে একেবারেই একটা অযৌক্তিক ও দলিল প্রমাণবিহীন দাবী করে। কেননা কুরআন ও হাদীসে কোথাও শুধুমাত্র আল-আ'লা বলে আল্লাহ তায়ালাকে বুঝানো হয়নি।
তথাপি যেহেতু কোনো কোনো আলিমের মতে আল্লাহর সুন্দরতম নাম ৯৯টিতে সীমাবদ্ধ নয়। তাই আল আলী বা আল আ'লাকে যদি আল্লাহর গুণবাচক নামের অন্তর্ভুক্ত ধরে নেয়াও হয়, তবুও এ নাম বা শব্দ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বেলায় ব্যবহার করা নিষিদ্ধ নয়। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে স্বয়ং হযরত মূসা (আঃ) কে বলেন, لا تَخَفْ إِنَّكَ أَنْتَ الْأَعْلَى "অর্থাৎ তুমি ভয় পেওনা-তুমিই শ্রেষ্ঠ।” (ত্বাহা-৬৮) মুমিনদেরকে বলেন-وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ - "তোমরাই শ্রেষ্ঠ হবে, যদি তোমরা মুমিন হও।" (আল ইমরান-১৩৯)। তিনি আরো বলেন- وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ وَاللهُ مَعَكُمْ - "তোমরাই শ্রেষ্ঠ এবং আল্লাহ তোমাদের সাথে আছেন।" (মুহাম্মদ-৩৫)। হাদীসে আল্লাহ তায়ালার আসমায়ে হুসনা বা সুন্দরতম নামসমূহের যে বিবরণ রয়েছে তাতে মাত্র কয়েকটি নাম ওলামা ও মুহাদ্দিসগণের মতে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য তা ব্যবহার করা যায়না। সেই নাম ক'টি হলো আল্লাহ, আররহমান, আস্সাব্বুহ, আল কুদ্দুস। এগুলো ছাড়া বাদবাকী প্রায় সব ক'টি গুণবাচক নামই আল্লাহ এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যদের জন্য ব্যবহার করা যায়। কুরআন, হাদীস ও আরবী সাহিত্যে এরূপ প্রচুর উদাহরণ রয়েছে, যাতে এই শব্দগুলো আল্লাহ ও আল্লাহ ছাড়া অন্যান্যের ক্ষেত্রে সমানভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আররহীম । (দয়ালু) আল মালিক, (রাজা) আলমুমিন (নিরাপত্তাদাতা,) আল মুহাইমিন (আধিপত্য বিস্তারকারী), আল আযীয (পরাক্রমশালী), আল মুতাকাব্বির (অহংকারী), আল আলীমু (মহাজ্ঞানী), আসসামীয়ু (শ্রোতা), আলবাছীর (দ্রষ্টা), আলহাসীব (হিসাব গ্রহণকারী), আল ওয়াদুদ (প্রেমময়), আররউফ (স্নেহময়) এবং এ ধরনের আরো বহু গুণবাচক নাম রয়েছে, যা খোদ কুরআনুল কারীমে আল্লাহর জন্য ও অন্যদের জন্য সমানভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে- إِنَّهُ عَلَى حَلِيمٌ إِنَّ اللهَ كَانَ عَلِيًّا كَبِيرًا এখানে যে আলী শব্দটি রয়েছে, তা আল্লাহর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, আবার ওটা একজন সাহাবীরও নাম। এ নাম যদি কোনোভাবেও আপত্তিকর হতো, তবে রসূল (সঃ) অবশ্যই তা পাল্টে দিতেন। কেননা যে কোনো বিচারে অপছন্দীয় বা নাজায়েয হওয়ার বহু নাম তিনি পাল্টে দিয়েছেন। ছয়টি বৃহৎ হাদীস গ্রন্থের একাধিক রাবী (বর্ণনাকারী) আবু আলী উপনামে খ্যাত। বুআলী সিনা ও বুআলী কলন্দর শব্দ তো সর্বজনবিদিত। বু-আলী আবু আলীর সংক্ষিপ্ত রূপ। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ এরূপ কথা বলে নিজের মূর্খতা প্রকাশ করেনি যে, যেহেতু আলী আল্লাহর নাম, সুতরাং যে ব্যক্তি আলী নাম রাখে, সে নিজেকে আল্লাহ বলে দাবী করে। আর যে ব্যক্তি আবু আলী নাম রাখে, সে আল্লাহর পিতা হবার দাবীদার। হাকিম শব্দটাও আল্লাহর সুন্দরতম নামসমূহের অন্তর্ভুক্ত, আবার তা একজন সাহাবীরও নাম। মালেক আল্লাহরও নাম, আবার জনৈক ফেরেশতারও নাম। আবার হাদীস ও ফেকাহ শাস্ত্রের একজন শীর্ষস্থানীয় ইমামের নামও মালেক। আমাদের প্রাচীন মহাপুরুষদের অনেকেই আবু মালেক, আবু হাকীম,আবু বাছীর প্রভৃতি কুনিয়াত বা উপনাম দ্বারা পরিচিত। এ সমস্ত নাম ও উপনাম যদি জায়েয ও শুদ্ধ হয়ে থাকে এবং যারা এসব নাম ও উপনাম রেখেছিলো, তারা যদি আল্লাহ আল্লাহর বাপ হবার দাবীদার না হয়ে থাকে, তাহলে কোন্ আহম্মক এ কথা বলতে বা স্বীকার করতে পারে যে, একমাত্র আবুল আ'লা নামধারী ব্যক্তিটিই নিজেকে আল্লাহর পিতা বলে দাবী করেছে? মূর্খতা, অজ্ঞতা ও অর্বাচীনতার একটা সীমা থাকা চাই। তাছাড়া প্রত্যেক আরবী জানা ব্যক্তি এবং ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানে কিছুমাত্র দখল রাখে এমন লোক মাত্রেই জানে যে, সাহাবায়ে কেরাম ও অন্যান্য প্রাচীন মহাপুরুষদের মধ্যে অসংখ্য ব্যক্তি এরূপ রয়েছেন, যাদের নাম ও উপনামের অর্থ সহজবোধ' নয়। এসব নামের মধ্যে কয়েকটি নিম্নে দেয়া হলোÑ আবু বকর, আবু বকরা, আবু মাহযুরা, আবু সালাবা, আবু জানদাল,অবু বাহর, আবু ইয়াকতান, আবু হানীফা,আবুল আবরাদ, আবুল আহওয়াস, আবু আওয়াম, আবুল আসবাত, আবুল আশহাব,আবুল বুখতারী,আবু সাওর,আবু তাওবা, আবু যুরয়া, আবুল ফারজ ইত্যাদি। মোটকথা, এমন নাম শত শত রয়েছে, যার প্রকৃত অর্থ কি তা কেউ জানেনা, কেউ কেউ এসব নামের প্রকৃত অর্থ জানবার চেষ্টা করেছে, তবে এসব চেষ্টা কৃত্রিমতা মুক্ত নয়। এখন যারা জিজ্ঞাসা করে যে, আবুল আ'লার অর্থ কি, আমি তাদের কাছে জানতে চাই যে, প্রাচীন মহাপুরুষদের যে কয়টি নাম আমি এখানে উল্লেখ করেছি, এগুলো কিনা আপনারা কখনো পড়েছেন বা জানতে পেরেছেন? কুনিয়ত হিসাবে হামেশাই ব্যবহৃত হয়ে আসছে ঃ কুনিয়াত জাতীয় উপনামে 'আবু' শব্দটির অর্থ যে সব সময় পিতা হয়না,তা আরবী ভাষায় একেবারে অজ্ঞ না হলে যে কেউ বুঝতে পারে। হযরত আবু বকরের সন্তনদের ভেতরে কারো নাম বকর ছিলনা। অনুরূপ ইমাম আবু হানিফার কোনো ছেলে বা মেয়ের নাম হানিফা ছিলনা। অনেক সময় আবু শব্দটা অধিকারী "মালিক" বা 'ওয়ালা' অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন হযরত আবু হুরায়রার একটা ছোট বিড়াল ছিল (হুরায়রা অর্থ ছোট বিড়াল এবং আবু অর্থ ওয়ালা। আবু হুরায়রা অর্থ ছোট বিড়াল ওয়ালা।) এ জন্য তিনি এই নামে খ্যাত হয়ে যান। এর অর্থ বিড়ালওয়ালা বিড়ালের বাপ নয়। হযরত আলী (রাঃ) একবার মসজিদের উদোম মাটির মেঝেতে শুয়েছিলেন। তা দেখে রসূল (সঃ) তাকে স্নেহবশত 'আবু তুরাব' বলে ডাকেন। এ দ্বারা মাটির বাপ নয় বরং ধূলোমাটি মাখানো ব্যক্তিকে বুঝায়। উজর বা আজরা কখনো কখনো কুমারী অর্থে ব্যবহৃত হয়। কুমারীকে যে বিয়ে করে তাকে আবু উজর বলা হয়। সুতরাং আবু উজর অর্থ কুমারীর পিতা নয়-স্বামী। হাদীসশাস্ত্রীয় অভিধানের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ "আননিহায়া ফি গরিবিল হাদীস ওয়াল আসর" এর লেখক আল্লামা ইবনুল আসীর আল জাযরীর উপনাম হলো আবুস্ সায়াদাত অর্থাৎ সায়াদাত তথা সৌভাগ্যের অধিকারী বা প্রত্যাশী সৌভাগ্যের পিতা নয়। আবুল বরকাত ও আবুল হাসানাত শব্দের অর্থ বরকত ও সায়াদাতের পিতা বলা কেবল কোনো অজ্ঞ লোকের পক্ষেই সম্ভব। মাওলানা আবুল আ'লা মওদূদী শুধু পাকিস্তানেই পরিচিত নয় বরং আল্লাহর মেহেরবানীতে আরব জাহানের সকল শ্রেণীর মানুষ তার নাম ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাধারা সম্পর্কে পুরোপুরিভাবে ওয়াকিফহাল। বড় বড় জ্ঞানীগুণী, পন্ডিত ব্যক্তিবর্গ তার নাম প্রতিনিয়ত শোনেন, পড়েন, লেখেন ও উচ্চারণ করেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো আরবী ভাষাভাষী পন্ডিত ব্যক্তি তার নাম সম্পর্কে কোনো আপত্তি তোলেননি। শুধুমাত্র আমাদের দেশেরই কিছু অচেনা, অখ্যাত ও অহংকারী লোক নিজেদের জ্ঞানের বহর দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন। নিছক জিদ, হঠকারিতা, হিংসা ও ঈর্ষার বশেই তারা এরূপ নিম্নমানের অভিযোগ নিজেদের বক্তৃতা ও লেখার মাধ্যমে অবাধে প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। এরপর যদি কেউ এসব লোকের অন্যান্য অভিযোগের গুরুত্ব দেয়, তবে সেটা সেই ব্যক্তিরই আহম্মকী ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের পক্ষে এটা সম্ভব নয় যে, প্রতিনিয়ত তারা এক একটা আজে বাজে অভিযোগ রটাবে এবং আমরা তার জবাব দিয়ে নিজেদের সময় নষ্ট করতে থাকবো। (তরজমানুল কুরআন, নভেম্বর-১৯৭০) অবিকল ব্যাখ্যা করেছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত শায়খুল হাদীস শায়খ ইসহাক আল মাদানীও । আমাদের কথাঃ আমাদের প্রশ্ন হলো আবুল আলা শিরক হলে আমরা যে হমেশাই আমাদের নামের আগে মাওলানা লেখি এটা শিরক নয় কেন? আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত ও আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী যে আমিও আমার অনেক গুলো লেখায় অনেক বক্তৃতায় আবুল আলা নামটির অর্থ ’আল্লাহর বাপ’ বলে শিরক ফতোয়া দিয়েছি শুনার শুনার। আল্লাহ যেন আমার এই ভুলকে মাফ করে দেন। সেই সাথে বিজ্ঞ পাঠকদের বিবেকের আদলতে বিচার রইল আপনারাই ইনসাফের মানদন্ডে বিবেকের আদালতে বিচার করে বলুন এই অভিযোগটি সত্য না ভিত্তিহীন প্রতিহিংসা শুলভ? আমি আমার ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছি এবং স্বীকার করছি যে এটা একটি ভিত্তিহীন অজ্ঞতা প্রসুত প্রতিহিংসা মুলক অভিযোগ।
তানক্বীদ কি ঃ
প্রশ্ন মাওলানা মওদুদী (রঃ) পুরস্কার বলেছেন যে রাসুল (ছাড়া আর কেউ সমালোচনার উর্দ্ধে নয়। এ কথা বলে কি সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনাকে ভেধ করেন নি? এর পরও কি আপনি বলবেন যে মাওলানা মওদুদীর আক্বীদা সহী আছে? সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা কি জায়েজ? উত্তরঃ আপনার পশ্নের আরো সংশোধনী প্রয়োজন ছিল। কারণ মাওলানা মওদুদী এ কথা বলেন নি। জামায়াতে ইসলামের গঠনতন্ত্রে আছে -رسول خدا کے سوا کسی کو تنقید سے بالاتر نہ سمجھے অর্থাৎ”রাসুল (সাঃ) ছাড়া আর কেউ যাছাই বাছাইর উর্দ্ধে গন্য করা যাবেনা।” অনেকে অভিযোগ করেন যে মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা জায়েজ করতে এটা বলেছেন বা লিখেছেন। প্রথমতঃ কথাটি মাওলানা মওদুদী (রঃ) লিখেন নি বলেনও নি বরং সমকালীন খ্যাতনামা অনেক অলেম ওলামাই এই দস্তুর বা গঠনতন্ত্র তৈরী করেছেন অনেকেই অনেক বছর ধরে এই কথা দেখেছেন পড়েছেন তখন কিন্তু এই প্রশ্ন উঠেনি।
গঠনতন্ত্র প্রণয়রনকারীরা যথার্থই বলেছেন যে- رسول خدا کے سوا کسی کو تنقید سے بالاتر نہ سمجھے অর্থাৎ ”রাসুল সাঃ ছাড়া আর যে কারো কথা যাচাই বাচাই করা ছাড়া গ্রহণ করা যাবেনা।” এটা কোরআনের কথা এবং এটাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা যে,রাসুল (সাঃ) ছাড়া আর কারো কথা তানক্বীদের বাইরে নয়। এখানে তানক্বীদ দ্বারা কি বুঝিয়েছেন এটা না বুঝেই অনেকে নিজেদের আত্মপ্রচারে ¯্রােতের তালে বলে যাচ্ছেন যে মাওলানা মওদুদী এ কথা বলে সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনার সুযোগ করে দিয়েছেন। মুলত এরা তানক্বীদ এর অর্থই বুঝেননা আর সমালোচনার অর্থও বুঝেন না বলেই মনে হয়। অথবা বুঝেই না বুঝার ভান করে শুনার শুনা বলছেন।
কুরআনের দলীলে তানক্বীদ- এরশাদ হচ্ছে-يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ إِن جَآءَكُمْ فَاسِقٌۢ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوٓا۟ أَن تُصِيبُوا۟ قَوْمًۢا بِجَهَٰلَةٍ فَتُصْبِحُوا۟ عَلَىٰ مَا فَعَلْتُمْ نَٰدِمِينَ অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ,যদি কোন ফাসিক তোমাদের কাছে কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে নাও। এ আশঙ্কায় যে, তোমরা অজ্ঞতাবশত কোন কওমকে আক্রমণ করে বসবে, ফলে তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে।”সুরা হুজরাত ৬ এই আয়াত নাযিলের সংক্ষিপ্ত বিবরণ হলো এই যে- বনি মুস্তালিক গোত্রের সরদার,উন্মুল মুমিনিন জুয়াইরিয়া (রাঃ)এর পিতা হারেস ইবনে দ্বিরার বলেন- ---আমি ইসলাম গ্রহণ করে বললাম আমি স্বগোত্রে ফিরে গিয়ে তাদেরকেও ইসলাম ও যাকাত প্রদানের দাওয়াত দেব। যারা আমার কথা মানবে এবং যাকাত দেবে আমি তাদের যাকাত একত্রিত করে আমার কাছে জমা রাখব। আপনি অমুক মাসের অমুক তারিখ পর্যন্ত কোন দূত আমার কাছে প্রেরণ করবেন, যাতে আমি যাকাতের জমা অর্থ তার হাতে সোপর্দ করতে পারি। -------দুত আসতে বিলম্ব দেখে আমরা রাসুলের খেদমতে যাওয়ার মনস্থ করলাম। এদিকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নির্ধারিত তারিখে ওলিদ ইবনে ওকবা (রাঃ) কে যাকাত গ্রহণের জন্য পাঠিয়ে দেন। কিন্তু পথিমধ্যে ওলিদ ইবনে ওকবা (রাঃ) এর মনে ধারণা জাগে যে,এই গোত্রের লোকদের সাথে তার পুরাতন শত্রæতা আছে। কোথাও তারা তাকে পেয়ে হত্যা করে ফেলে কি না। -----এই ভয়ের কথা চিন্তা করে তিনি সেখান থেকেই ফিরে আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে গিয়ে বলেন যে, তারা যাকাত দিতে অস্বীকার করেছে এবং আমাকে হত্যা করারও ইচ্ছা! করেছে। এই খবরে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) অসন্তুষ্ট হয়ে যুদ্ধের জন্য খালেদ ইবনে ওয়ালীদ (রাঃ) এর নেতৃত্বে একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। ---------অতঃপর হারেস রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সামনে উপস্থিত হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন- তুমি কি যাকাত দিতে অস্বীকার করেছ এবং আমার দূতকে হত্যা করতে চেয়েছ? হারেস বললেন- কখনই নয়, সে আল্লাহর কসম,যিনি আপনাকে সত্য পয়গামসহ প্রেরণ করেছেন, সে আমার কাছে যায়নি এবং আমি তাকে দেখিওনি, তাই আমরা আপনার খেদমতে উপস্থিত হয়েছি।।----------তাই আমরা খেদমতে উপস্থিত হয়েছি। হারেস বলেন, এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সূরা হুজুরাতের আলোচ্য আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (মুসনাদে আহমাদ: ৪/২৭৯, ৩/৪৮৮) লক্ষনীয় বিষয় হলো এখানে খবরদানকারী ব্যাক্তি একজন সাহাবী ছিলেন ওলীদ ইবনে উক্বকা । এতদসত্বেও আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসুলকে নির্দেশ দিয়েছেন যাছাই বাছাই না করে কোন সিদ্ধান্ত না নিতে।
রাসুল ছাড়া আর কারো কথা ওহীর কথা নয় এরশাদ হচ্ছে- وَ مَا یَنۡطِقُ عَنِ الۡهَوٰی আর সে মনগড়া কথা বলে না।” একমাত্র আল্লাহর রাসুল সম্পর্কেই বলা হয়েছে যে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) অহী ব্যতীত মনোক্তি কোন কথা বলেননা। তাই আল্লাহর রাসুলের কথা ছাড়া আর কারো কথাই যাছাই বাছাই ছাড়া গ্রহণ না করার আদেশ আল্লাহ’র ই এটা মওদুদীর বা জামায়াতে ইসলামীর কথা নয় । এই ইলিম সম্ভবতঃ তাদের নেই অথবা তানক্বীদ অর্থ কেবল সমালোচনা নয় যাছাই বাছা হয়। সমালোচনাও কোন না জায়েজ বিষয় নয় এটাও জানেন না। সুতরাং মাওলানা মওদুদী (রঃ) সমালোচনা জায়েজ ফতোয়া দিয়েছেন এই অভিয়োগ অমুলক ভিত্তিহীন ই নয় অজ্ঞতারও বহি প্রকাশ।
ইমাম মালিক (রঃ) শুধু তাই নয় আক্বীদা ও ফিক্বহের ইমামগন এই মাসআলায় কি বলেছেন একটু দেখে নেই। তানক্বীদ বিষয়ে ইমাম মালিক (রাহ) বলেন: كل أحد يؤخذ من قوله ويترك الا صاحب هذا القبر صلى الله عليه وسلم ‘‘প্রত্যেক ব্যক্তিরই কিছু মত গ্রহণ করা হয় এবং কিছু মত বাদ দেওয়া হয়, একমাত্র ব্যতিক্রম এ কবরে যিনি শায়িত আছেন তিনিই, অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)। যাহাবী, সিয়ারে আ’লামিন নুবালাহ ৮/৯৩) এটাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা তাই ইমামগণের নিকট রাসূলুল্লাহ(সাঃ)এর ছাড়া আর কারো কথাই নির্বিচারে বা যাছাই বাছাই ছাড়া গ্রহণ করা হয়না। কুরআন ও সুন্নাহর মানদন্ডে যাচাই করেই সকল কথা গ্রহণ করতে হবে। আল্লামা তাফতাজানী (রঃ) লিখেছেন- الإلهام المفسر بإلقاء معنى في القلب بطريق الفيض ليس من أسباب المعرفة بصحة الشيء عند أهل الحق ‘‘হক্কপন্থীগণের নিকট ইলহাম বা ইলকা কোনো কিছুর সঠিকত্ব জানার কোনো মাধ্যম নয়।’’ (শরহে আকাঈদে নাসাফি পৃ: ২২)
কারো কথা দিয়ে কুরআন বা সুন্নাত বিচার করা যায় না, বরং কুরআন ও সুন্নাহ দিয়ে প্রত্যেকের কথা যাচাই করে গ্রহণ করতে হবে। অমুক বলেছেন কাজেই তা দীনের প্রমাণ বা আক্বীদার দলীল এরূপ চিন্তা করার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। আল্লামা উমর ইবনু মুহাম্মাদ আন-নাসাফী (৫৩৭ হি.) তাঁর ‘‘আল-আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ’’ ও অষ্টম শতকের প্রখ্যাত শাফেয়ী ইমাম আল্লামা সা’দ উদ্দীন মাসঊদ ইবনু উমর আত-তাফতাযানী (৭৯১ হি) তাঁর ‘‘শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ’’ -তে এ কথাই লিখেছেন। (শরহে আকাঈদে নাসাফি পৃ: ২২)
আমাদের কথা সুতরাং মাওলানা মওদুদী (রঃ) সমালোচনা জায়েজ ফতোয়া দিয়েছেন এই অভিয়োগ অমুলক ভিত্তিহীন ই নয় অভিযোগকারীরই অজ্ঞতার বহি প্রকাশ। এখন বিবেকের আদালত ইনসাফের মানদন্ড আর কিতাবের দলীল পর্যালোচনা করে বলেন তানক্বীদের মাসআলায় মাওলানা মওদুদী বা জামায়াতে ইসলামী ই কি এ কথা বলেছেন না এটাই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা?
ওসিলাঃ সহী ও ভ্রান্ত আক্বীদা।
ওসিলার সংজ্ঞা ও মর্ম ‘ওসীলা’ وَسِيْلَةٌ শব্দটি কুরআন কারীমে দুটি স্থানে এসেছে, সূরা আল-মায়েদার ৩৫ নং আয়াত এবং সূরা আল-ইসরার ৫৭ নং আয়াত। আয়াতদ্বয়ে ওসীলার অর্থ হল আল্লাহকে সন্তুষ্টকারী কাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। কোরআনে ব্যবহৃত وَسِيْلَةٌ শব্দটি একবচন, বহু বচনে وَسَائِلُ অর্থ নৈকট্য, নৈকট্যের উপায়। অসীলা এমন ইবাদত যা আল্লাহর নিকট পৌঁছিয়ে দেয়। অর্থাৎ ইবাদতের মাধ্যমে নৈকট্য লাভ করা (লোগাতুল কুরআন)। অসীলা দুই প্রকার (এক) সহী/শুদ্ধ ওসীলা। যেমন- (ক) আল্লাহর নামের মাধ্যমে আল্লাহকে ডাকা (আ‘রাফ ১৮০)। (খ) ঈমান ও নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহকে ডাকা (গ) আল্লাহর সত্তার মাধ্যমে আল্লাহকে ডাকা (ঘ) নিজের দুর্বলতা ও প্রয়োজন প্রকাশ করে আল্লাহকে ডাকা। (ঙ) জীবিত সৎ মানুষের মাধ্যমে আল্লাহকে ডাকা। যেমন ছাহাবীগণ আববাস (রাঃ)-এর মাধ্যমে পানি চেয়েছিলেন (বুখারী, মিশকাত হা/১৫০৯)। (চ) পাপ স্বীকার করে আল্লাহকে ডাকা। (২) দ্বিতীয় প্রকার হ’ল নিষিদ্ধ অসীলা যা ভ্রান্ত আক্বীদার অন্তর্ভুক্ত । যেমন- (ক) মৃত মানুষের নিকট চাওয়া (খ) নবী কিংবা অন্যের ইয্যতের দোহাই দিয়ে চাওয়া (গ) কোন সৃষ্টির মাধ্যমে চাওয়া। তবে জীবিত মানুষ কোন কাজের অসীলা হ’তে পারে।
আল-কোরআনে ওসীলা সুরা মায়েদার ৩৫ নম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ ابْتَغُوْۤا اِلَیْهِ الْوَسِیْلَةَ وَ جَاهِدُوْا فِیْ سَبِیْلِهٖ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ অর্থাৎ ’হে ঈমানদারগণ- তোমরা আল্লাহ কে ভয় কর,এবং ওসিলা বা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা কর এবং আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ কর,আশা করা যায় তোমরা মুক্তি পাবে।’ আয়াতে কেবল মুমিনদের সম্বোধন করা হয়েছে এতে সুস্পষ্ট বুঝা যায় এখানে মুমিনদের তিনটি নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা হলো- (এক) আল্লাহকে ভয় করা (২) ওসীলা ধরা বা পেশ করা (৩) আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করা। সুরা ইসরা বা বনী ইসরাঈলের ৫৭ নম্বার আয়াতে এরশাদ হচ্ছেÑ أُو۟لَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ ٱلْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُۥ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُۥٓ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحْذُورًا অর্থাৎ- তারা যাদেরকে ডাকে, তারা নিজেরাই তো তাদের রবের কাছে নৈকট্যের মাধ্যমে অনুসন্ধান করে যে, তাদের মধ্যে কে তাঁর নিকটতর? আর তারা তাঁর রহমতের আশা করে এবং তাঁর আযাবকে ভয় করে। নিশ্চয় তোমার রবের আযাব ভীতিকর। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) আনহু সুরা ইসরার ৫৭ নম্বার আয়াতটির শানে নুযুল প্রসংগে বলেছেন- আয়াতটি আরবদের কিছুসংখ্যক লোকের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে, যারা কিছুসংখ্যক জিনের উপাসনা করত। অতঃপর জিনেরা ইসলাম গ্রহণ করল, অথচ তাদের উপাসনাকারী মানুষেরা তা টেরই পেল না। (মুসলিম,৩০৩০,বুখারী ৪৭১৪) আয়াতে ব্যবহৃত শব্দগুলোই প্রমাণ দিচ্ছে যে, মুশরিকদের যেসব মাবুদ ও ত্রাণকর্তার কথা এখানে বলা হচ্ছে তারা পাথরের মূর্তি নয় বরং তারা হচ্ছে ফেরেশতা বা অতীত যুগের আল্লাহর প্রীয়বান্দা। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, শির্ককারীরা বলত: আমরা ফেরেশতা, মসীহ ও উযায়ের এর ইবাদাত করি। অথচ যাদের ইবাদত করা হচ্ছে তারাই আল্লাহকে ডাকছে। (ইবন কাসীর) আয়াতের অর্থ পরিষ্কার যে নবী হোন বা অলী আউলিয়া অথবা ফেরেশতা, কারো তোমাদের প্রার্থনা শুনার এবং তোমাদের সাহায্য করার ক্ষমতা নেই। তোমরা নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য তাদেরকে আসিলায় পরিণত করছে কিন্তু তাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তারা নিজেরাই আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশী, তাঁর আযাবের ভয়ে ভীত এবং তাঁর বেশী বেশী নিকটবর্তী হবার জন্য ওাসিলা ও উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে।
তাফসীরে ইবনে জারীর তাবারী ঃ এই আয়াতের তাফসীরে ইবনে জারীর তাবারীতে বলা হয়েছে قال أبو جعفر: يعني جل ثناؤه بذلك: يا أيها الذين صدّقوا الله ورسوله فيما أخبرهم ووعَد من الثواب وأوعدَ من العقاب অর্থাৎ অন্তরে আল্লাহ’কে বিশ্বাস করে সেই বিশ্বাস অনুযায়ী যারা আমল করে আখেরাতে এর সুফল ভোগ করার আশায় তারাই মুমিন। আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ভয় অন্তরে স্থান না দিয়ে আল্লাহর হুকুম রাসুলের সুন্নাহ অনুযায়ী মেনে চলার নাম তাকওয়া। اتقوا الله " يقول: أجيبوا الله فيما أمركم ونهاكم بالطاعة له في ذلك، وحقِّقوا إيمانكم وتصديقكم ربَّكم ونبيَّكم بالصالح من أعمالكم সেই সাথে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসুলের আদর্শ অনুসরণের পথে যত বাধা আসে তা দুর করার প্রানান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া বা جهاد -مجاهداه করা। সেই সাথে আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় নেক আমল পেশ করা বা অসীলা করা। ইবনে জারির বলেছেন وابتغوا إليه الوسيلة "، يقول: واطلبوا القربة إليه بالعمل নেক আমল ই একমাত্র উসিলা হয় কিন্তু মৃত ব্যক্তির অসিলা চাওয়া যায়না।
তফসীরে কুরতুবী ঃ তাফসীরে কুরতুবীতে বলা হয়েছে- أي : يطلب كل واحد من صاحبه ; فالأصل الطلب ; والوسيلة القربة التي ينبغي أن يطلب بها ، والوسيلة درجة في الجنة ، وهي التي جاء الحديث الصحيح بها في قوله عليه الصلاة والسلام : فمن سأل لي الوسيلة حلت له الشفاعة . এর মর্ম হলো আল্লাহর নৈকট্য অনুসন্ধান ই আসল। আর এটা লাভের জন্য নেক আমল করা যা শরীয়তের রীতি নীীত মোতাবেক হবে। হাদীস থেকে জানা যায় জান্নাতের একটি উচ্চতর স্থানের নামও ওসীলা । যে ওসীলার জন্য দোয়া করবে তার জন্য সুপারিশ করা রাসুলের প্রতি কর্তব্য হয়ে যাবে।
তাফসীরে ইবনে কছীর ঃ এই আয়াতের তাফসীরে ইবনে কছীরে বলা হয়েছে- وابتغوا إليه الوسيلة এই বাক্যের তাফসীরে বলেছেনÑ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ، قال سفيان الثوري: حدثنا أبي: عن طلحة، عن عطاء، عن ابن عباسٍ: أي: القُربة.আবু তালহা আতা থেকে তিনি ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে এর অর্থ হলো নৈকট্যতা বা নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা।وكذا قال مجاهد، وأبو وائل، والحسن، وقتادة، وعبدالله بن كثير، والسّدي، وابن زيد، وغير واحدٍ. মুজাহিদ,আবু ওয়াইল,হাসান কাতাদাহ আব্দুল্লাহ ইবনে কছীর,সুদ্দী প্রমুখ একই কথা বলেছেন। এর পর তিনি লিখেছেন هي القُربة إليه بطاعته، هذا محل إجماعٍ من أهل العلم، يعني: دعوا محارم الله، وتقرَّبوا إليه بطاعته -جلَّ وعلا-، فالتقوى: ترك المحارم، والوسيلة: أداء الفرائض. আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে বেঁেচ আল্লাহর হারাম বর্জন করে তাক্বওয়া অর্জন করো এবং নাজাতের ওসিলা হিসাবে বা আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য আল্লঅহর দেয়া সমস্ত ফরজ বিধানাবলী মেনে চল। যেমন সুরা এ নিসার ১ নম্বার আয়াতে বলা হয়েছেÑ يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ হে ঈমানদারগণ তোমাদের রবকে ভয় কর। يعني: اعبدوه واستقيموا على طاعته بأداء فرائضه، وترك محارمه، فإذا أُفردت التَّقوى أُريد بها جميع الدِّين: أداء الفرائض، وترك المحارم، فإذا قُرنت مع غيرها صار المراد بذلك ترك المحارم، وأداء الفرائض. অর্থাৎ আল্লাহর আনুগত্য কর এবং হারাম থেকে দুরে থেকে সমূহ ফরজ আদায় কর। আর وتُطلق التَّقوى على الدِّين كلِّه: দ্বীনের পূর্ণঙ্গতা নির্ভর করে তাক্বওয়ার উপর। وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ يعني: تقرَّبوا إليه بطاعته، والوسائل: هي القُربة بالطاعة بأداء الفرائض. আর ওসিলা হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রষ্টোর উপর যেটা হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য ও ফরজ বিধান পালনের উপর। আবার কারো কারো মতে أيضًا عَلَمٌ على أعلى منزلةٍ في الجنة، وهي منزلة رسول الله ﷺ وداره في الجنة، وهي أقرب أمكنة الجنة إلى العرش.রওসিলা হচ্ছে জান্নাতের একটি উচ্চস্তরের নাম যেটা আল্লাহর রাসুলের জন্য সংরক্ষিত। তাই প্রতি ওয়াক্ত নামাজের আজানের দোয়ায় اللهم ربّ هذه الدَّعوة التَّامة، والصلاة القائمة، آتِ محمدًا الوسيلة والفضيلة، وابعثه مقامًا محمودًا الذي وعدته، আল্লাহর রাসুলের জন্য ওসিলার দোয়া করা হয়। মসনদে আহমদের এক হাদীসেও তাই এসেছে عن أبي هريرة: أنَّ رسول الله ﷺ قال: إذا صلّيتم عليَّ فسلوا لي الوسيلة، قيل: يا رسول الله، وما الوسيلة؟ قال: أعلى درجةٍ في الجنة، لا ينالها إلا رجلٌ واحدٌ، وأرجو أن أكون أنا هو. আবুহুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে রাসুলুলুল্লাহ (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে ওসীলা কি? আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বলেছেন জান্নাতের এক উচ্চস্তরের নাম।
তাফসীরে মা'আরিফুল কোরআন ঃ তাফসীরে মা'আরিফুল কোরআনে মুফতি শফি উসমানী দেওবন্দী রঃ তাফসীরে তাবারী, ইবনে কসীর এর তাফসীর সমর্থন করে বলেছেন ওসীলা অর্থ হলো আল্লাহর আজাব ও গজবের ভয়ে অবাধ্যতা বর্জন করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের সন্ধান করতে সমুহ ফরজ ওয়াজিব সুন্নত আমল পালন করে। তাই ওসিলা অর্থ হলো নেক আমল করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা বা নেক আমলের করা। মুফতি শফিও (রঃ) ওসিলা অর্থ পীর ধরা বা মুরিদ হওয়া অর্থ নেন নি।
তাফসীরে উম্মুল কোরআন ঃ তাফসীরে উম্মুল কোরআনের লেখক (এই গ্রন্থের লেখক) অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল হাই জেহাদী তাফসীরে উম্মুল কোরআনে লিখেছেনÑ الْوَسِيْلَةَ শব্দটি وسل ধাতু থেকে উদ্ভুত। এর অর্থ সংযোগ স্থাপন করা। আসহাবে রাসুল (সাঃ) তাবেয়ীন তবে তাবিয়ীন আকাবীর ও আসলাফগন এ কথাই বলেছেন যে- وسيلة ‘ওসীলা অর্থ নৈকট্য, ঈমান সহ সৎকর্ম বা ফরজ ইবাদতের দ্বারা নৈকট্য ও আনুগত্য বোঝানো হয়েছে’। ইবনে জরীর,আ’তা, মুজাহিদ,হাসান বসরী,ইবনে কছীর, ফতহুল কাদীর ইমাম রাজী,সাদী, রাহিমাহুমুল্লাহ সকলেই এ অর্থই বর্ণনা করেছেন। এ আয়াতের তাফসীরে কাতাদাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন تَقَرَّبُوْا اِلَيْهِ بِطَاعَتِهِ وَالعَمَلِ بِمَا يُرْضِيْهِ অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্য অর্জন কর তাঁর আনুগত্য ও সন্তুষ্টির কাজ করে। (তাবারী, ইবনে কাসীর) আয়াতের সার কথা এই দাড়ায় যে, ঈমান ও সৎকর্মের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অন্বেষণ কর।
মুসলিম এর ৩৮৪ নম্বার হাদীসে আছে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বলেছেনÑ ‘যখন মুয়াজ্জিন আযান দেয়, তখন মুয়াজ্জিন যা বলে, তোমরাও তাই বল। এরপর দুরূদ পাঠ কর এবং আমার জন্য ওসীলার দোয়া কর’।এই হাদীস থেকে এটাও সুস্পষ্ট যে জান্নাতের একটি উচ্চস্থানের নাম হলো ওসীলা।
আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা ঃ
মোদ্দা কথা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা বিশ্বাস হলো যা তাফসীর ও হাদীসের সার সংক্ষেপ যে والوسيلة هي عبادته ودعاؤه والتقرب إليه بكل عمل صالح، فالوسيلة التي يتقرب بها إلى الله هي الوسيلة في عبادته والتقرب إليه بأنواع القربات، وهذا هو عين المشروع بل هو العبادة التي يجب أن نتقرب بها إلى الله عز وجل. ওসীলার অর্থ হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে আমলে সালেহ করা। এবং এটাকেই নাজাতের ওসীলা বানানো। কোন ব্যক্তি বা স্থানকে ওসীলা বানানো যাবেনা আল্লাহ ছাড়া বা আল্লাহর নৈকট্য ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে ইবাদত বন্দেগী করা যাবেনা।
ভ্রান্ত আক্বীদা ঃ হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী (রঃ) বলেন-জ্বিনের পূজাকারী মানব সম্প্রদায় জ্বিন পূজায়বহাল থাকে, অথচ এ সকল জ্বিন তা পছন্দ করতো না,যেহেতু তারা ইসলাম গ্রহণ করে আল্লাহর নিকট অসীলাহ কামনা করতে শুরু করেছে। (ফাতহুল বারী ৮ম খন্ড ৩৯৭ পৃষ্ঠা) উক্ত আয়াতের এটাই হচ্ছে নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা। যেমনটি ইমাম বুখারী (রঃ) ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণনাপূর্বক ছহীহ্ বুখারী গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। ওসীলাহ বলতে ঐ সকল বিষয় বস্তু উদ্দেশ্য যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়, এ ব্যাপারে আয়াতটি অত্যন্ত স্পষ্ট। এজন্য আল্লাহ তায়ালা বলেন,অর্থাৎ তারা সন্ধান করে এমন সৎ আমল যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। দু’টি আয়াতের তাফসীর সম্পর্কে সালাফদের (পূববর্তী মুফাস্সিরদের) থেকে যা সংকলিত হয়েছে তা নির্দেশ করে আরবী ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান (অভিধান) ও সঠিক বোধশক্তি। পক্ষান্তরে,যারা এ আয়াত দু’টি থেকে নবীগণ ও নেককারগণের অবয়ব সত্ত¡া আল্লাহর নিকট তাদের অধিকার ও সম্মানের অসীলাহ গ্রহণ করা বৈধ হওয়ার ব্যাপারে দলীল গ্রহণ করে থাকেন তাদের ব্যাখ্যা বাতিল এবং বাক্যকে নিজের স্থান থেকে বিকৃত করণ,শব্দকে তার প্রকাশ্য নির্দেশনা থেকে পরিবর্তন করণ ও দলীলকে এমন অর্থে ব্যবহার করার শামিল যার সম্ভাবনা রাখে না। তদুপরি এমন অর্থ কোন সালাফ তথা সাহাবাহ্ তাবিঈ ও তাদের অনুসারীগণ বা গ্রহণযোগ্য কোন তাফসীরকারক বলেননি। যখন প্রতিভাত হলো যে, অসীলাহ শব্দের অর্থ- ঐ সকল সৎকর্ম যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। এবার এই সৎকর্মটির শরীয়ত সম্মত কিনা জ্ঞাত হওয়া বাঞ্চনীয়। কারণ-
আল্লাহ এ সকল আমল নির্বাচন করার দায়ীত্ব আমাদের দিকে সোপর্দ করেননি, বা তা চিহিৃত করার ভার আমাদের বিবেক ও রুচির উপর ছাড়াা হয়নি। কেননা এমনটি হলে আমলে বৈপরিত্য ও বিভিন্নতা সৃষ্টি হতো। তাই আল্লাহ আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন আমলের ক্ষেত্রে তার দিকে প্রত্যাবর্তন করতে এবং তার নির্দেশনা ও শিক্ষার অনুসরণ করতে। কেননা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা কোন্ বিষয় তাকে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম। সুতরাং আমাদের কর্তব্য হলো আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার মাধ্যমগুলো জানা। আর তা এভাবে সম্ভব প্রতিটি মাস্আলার বিষয় আল্লাহ ও তদীয় রাসূল (সাঃ) যা প্রবর্তন ও বর্ণনা করেছেন তার দিকে প্রত্যাবর্তন করা। অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।
ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে যে,কোন আমল সৎ হওয়ার জন্য তাকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে খাঁটি হতে হবে এবং আল্লাহর দেয়া নিয়ম অনুযায়ী হতে হবে। এ কথার ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় যে, তাওয়াস্সুল দু’ভাগে বিভক্ত শারঈ (শরীয়ত সম্মত) ও বিদঈ (বিদ’আতী বা শরীয়ত বিরোধী) আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায় ভালো আমলের মধ্য দিয়ে, দোয়ার মধ্য দিয়ে, আল্লাহর আসমা এবং সিফাতের ওসিলা দিয়ে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার মধ্য দিয়ে। ওসিলা অর্জনের এই তিনটি স্বীকৃত পদ্ধতি ইসলামে আছে। যারা এখানে ওসিলার মানে বলছেন কোনো ব্যক্তিকে ধরা বা পীর ধরা, তাঁরা ওসিলার একটি ভুল অর্থ করেছেন যেটি কোনো বিশুদ্ধ তফসিরে আসেনি। ওই সব ব্যক্তি ওসিলার অর্থ করেছেন মাধ্যম, আল্লাহর কাছে মাধ্যম তালাশ করো অর্থাৎ লবিং। তাঁদের মতে এই লবিং বা মাধ্যম হচ্ছেন ওলি-আউলিয়ারা, পীর, বুজুর্গ, নবী, বিশেষ ব্যক্তি। কিন্তু এই ধারণাটি পুরোটাই ভুল। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘যখন তোমার কাছে আমার সম্পর্কে আমার কোনো বান্দা জিজ্ঞাসা করে, তাহলে জেনে রাখ, আমি তাঁদের খুবই কাছাকাছি। আমরা যখন নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, ওমরা করি, হজ করি, কোরবানি করি, সাদকা করি আমাদের কি কোনো মাধ্যম লাগে? এগুলো সবই তো আমরা আল্লাহর জন্য করি। অতএব এর মাঝে কোনো মাধ্যম ইসলাম সমর্থন করে না। আরেকটি বিষয় হলো যেটি নিয়ে এই ধারণাটি ভুল হয়েছে, সেটি হলো, আল্লাহর কাছে শাফায়াত করা। মানুষ মনে করে এই বুজুর্গ ব্যক্তি, আল্লাহর ওলি,আল্লাহর কাছে আমার জন্য শাফায়াত করবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আল্লাহর কাছে শাফায়াত করলেন, এটি আমি কীভাবে বুঝলাম? সুরা আল বাকারার আয়াতুল কুরসির মধ্যে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কে তাঁর কাছে শাফায়াত করবে?’ তার মানে শাফায়াত আমরা নির্ধারণ করতে পারব না, আমি আপনাকে বলতে পারব না যে, কেয়ামতের দিন আপনি আমার জন্য শাফায়াত করুন। এই মধ্যস্বত্ব ভোগীদের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে বক্তব্য রয়েছে, ইহুদিদের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তাঁদের মতো মধ্যস্বত্ব ভোগী হইয়ো না।’ আপনি যদি কোনো বুজুর্গের কাছে কিছু চাইতে চান তাহলে একটি জিনিসই চাইতে পারেন, সেটি হলো, যদি তিনি জীবিত থাকেন তাহলে আপনার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন। কিন্তু সেই বুজুর্গ মৃত হলে আর তাঁর কাছে এটি চাওয়া যাবে না। যারা বুজুর্গ আছেন, জ্ঞানী আছেন, আলেম আছেন, তাঁদের কাছে আমরা দ্বীন শিখব এবং দোয়া চাইব, এর বেশি কিছু নয়, এ ক্ষেত্রে কোনো মধ্যস্বত্ত¡ভোগী থাকবে না। ইসলামী আক্বীদা ও ভ্রান্ত বইএ মৃতদের অসীলা করা জায়েয বলা হয়েছে। এবং ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ) কে এর বিরোধিতা করে বিতর্ক সৃষ্টির জন্য দায়ী করা হয়েছে যা ইনসাফের ও সত্যের পরিপন্থি। আকী¡দা শিক্ষার নামে কি শিক্ষা দিয়ে মগজ ধোলাই করতে তৎপর রয়েছে একটি বিশেষ মহল যারা এখন ইসলামী শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন। জানিনা তাদের দ্বারা এসব করানো হচ্ছে নাকি তারা নিজেদের অজান্তেই এসব করছেন। আল্লাহু তায়ালা এই উম্মাহ কে ফিতনাবাজদের হাত থেকে হেফাজত করুন। অনেকে অসীলা বলতে পীর মুরিদী বুঝিয়ে থাকেন এটাও ঠিক নয়, কোন পীর বা কোন মানুষ কারো ওসীলা হতে পারেন না এটাই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা। ওসিলা একমাত্র নেক আমল। মনে রাখতে হবে কবর কে মাজার নামে রুপান্তরিত মাযারের পাশে ইবাদাত পালন করে আল্লাহকে ডাকা উদ্দেশ্য হলেও উপলক্ষ্য কবর ও কোন মৃত ব্যাক্তি বানানোর কারণে এটাও শিরকের পথ প্রদর্শক। অনুরূপ কবরের উপর সৌধ তৈরী করা,কবরে মোমবাতি বা বিশেষ আলো জ্বালিয়ে রাখা িিগলাফ বা চাদর দেয়া আল্লাহর নৈকট্য অর্জন উদ্দেশ্য হলেও এটা শরীয়তসিদ্ধ না হওয়া এবং শিরকের প্রতি আকৃষ্ট করার কারণে এসব তো ইবাদত নয়ই বরং বিদআত এবং জঘন্য পাপের উপাদান। অনুরূপ কবরে মৃত ব্যাক্তির জন্য কিছু আল্লাহর কাছে না চেয়ে মৃতব্যাক্তির কাছে চাওয়া শিরক। আল্লাহ বা তাঁর রাসূল (সাঃ) থেকে প্রমাণিত নয়-এমন ওসীলাকে অবৈধ অসীলা বলে। যেমনঃ মৃত ব্যক্তিকে অসীলা হিসাবে গ্রহণ করে তার কাছে সাহায্য ও শাফায়াত চাওয়া। আর এই ওসীলা হারাম হওয়ার ব্যাপারে ইমামগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন- যদিও গৃহীত সেই ওসীলা নবী কিংবা অলীই হন।
বৈধ ও অবৈধ অসীলা ঃ কোরআন হাদীসের দলীলে শরীয়ত সম্মত অসীলাহ কুরআন সুন্নাহ অধ্যয়ন করে শরীয়ত সম্মত অসীলাকে তিন ভাগে সীমাবদ্ধ পাওয়া গেছে। (ক) আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর অসীলাহ। (খ) সৎ আমলের অসীলাহ। (গ) সৎ ব্যক্তির দু’আর ওসীলা। ১) মহান আল্লাহর পবিত্র নাম ও গুণাবলির ওসিলা নিয়ে দোয়া করার কথা কুরআনে আছে- যেমন এরশাদ হচ্ছে- وَلِلَّهِ الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا ‘‘এবং আল্লাহর আছে সুন্দরতম নামসমূহ; কাজেই তোমরা তাঁকে সে সকল নামে ডাকবে।’’ (সূরা আ’রাফ : ১৮০) বলা হয়ে থাকে হে আল্লাহ, আপনার রহমান নামের গুণে, বা গাফ্ফার নামের ওসীলায় আমার দোয়া কবুল করুন। এরূপ দোহাই দেয়া বা ওসিলা পেশ করা ওসিলা ধরা কুরআন- হাদীসের দলালে জায়েজ এবং সহীহ আক্বীদা।
হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দোয়া সম্পর্কে বলেছেন - أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ أَوْ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ .... আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি আপনার সকল নাম ধরে বা নামের ওসীলা দিয়ে, যে নামে আপনি নিজেকে ভূষিত করেছেন, অথবা যে নাম আপনি আপনার কিতাবে নাযিল করেছেন, অথবা যে নাম আপনি আপনার কোনো সৃষ্টিকে শিখিয়েছেন, অথবা যে নাম আপনি গাইবী জ্ঞানে আপনার একান্ত নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন (সকল নামের ওসীলায় আমি আপনার কাছে চাচ্ছি) (ইবনে হিববান ৩/২৫৩, মুসতাদরাক আল হাকিম, ১/৬৯০)
নিজের কোনো ভাল কর্মের দোহাই দিয়ে বা ওসিলা পেশ করে দোয়া করা জায়েজ আছে এবং এর পক্ষে হাদীসে দলীল আছেÑ নিজের কোনো ভাল কর্মের দোহাই বা ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করলে কবুল হয় বলে হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে। একটি হাদীসে আছে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, অতীত যুগের তিনজন মানুষ নির্জন পথে চলতে চলতে বৃষ্টির কারণে এক পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করে। প্রবল বর্ষণে একটি বিশাল পাথর গড়িয়ে পড়ে তাদের গুহার মুখ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে গুহাটি তাদের জীবন্ত কবরে পরিণত হয়। এ ভয়ানক বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য তারা দোয়া করতে মনস্থ করেন। তারা একে অপরকে বলেন ادْعُوا اللَّهَ بِأَفْضَلِ عَمَلٍ عَمِلْتُمُوهُ ‘‘জীবনে সর্বশ্রেষ্ট যে আমল করেছ তদ্বারা (তার ওসীলা দিয়ে) আল্লাহর কাছে দোয়া কর বা তার দোহাই দিয়ে আল্লাহকে ডাক।’’ তখন তাদের একজন তার জীবনে সন্তানদের কষ্ট উপেক্ষা করে পিতামাতার খেদমতের একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন- اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا فُرْجَةً نَرَى مِنْهَا السَّمَاءَ ‘‘হে আল্লাহ, আপনি যদি জেনে থাকেন যে, আমি এ কর্মটি আপনার রেজামন্দির জন্যই করেছিলাম, তবে এর ওসিলায় আপনি পাথরটি একটু সরিয়ে দেন যেন আমরা আকাশ দেখতে পাই।’’ মহান আল্লাহ তৎক্ষণাৎ তার দোয়া কবুল করে পাথরটি একটু সরিয়ে দেন। তখন দ্বিতীয় ব্যক্তি তাঁর এক সুন্দরী প্রেমিকার সাথে ব্যভিচারের সুযোগ পাওয়া সত্তে¡বও আল্লাহর ভয়ে পাপ পরিত্যাগ করার একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন- فَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا فُرْجَةً ‘হে আল্লাহ, আপনি যদি জেনে থাকেন যে, আমি এ কর্মটি আপনার রেযামন্দির জন্যই করেছিলাম, তবে এর কারণে (ওসীলায়) আপনি পাথরটি আরেকটু সরিয়ে দিন।’’ মহান আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন এবং পাথরটি দু-তৃতীয়াংশ সরে যায়। তখন তৃতীয় ব্যক্তি নিজের অসুবিধা ও স্বার্থ নষ্ট করে একজন শ্রমিকের বেতন ও আমানত পরিপূর্ণরূপে আদায়ের একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন-اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا ‘‘হে আল্লাহ,আপনি যদি জেনে থাকেন যে, আমি এ কর্মটি আপনার রেযামন্দির জন্যই করেছিলাম, তবে এর কারণে (ওসীলায়) আপনি পাথরটি সরিয়ে দিন।’’ আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেন এবং পাথরটি একেবারে সরে যায়। নিজের ঈমান, মহববত ইত্যাদীর ওসীলা দিয়ে দোয়া চাওয়াও এ প্রকারের ওসীলা প্রদান। উল্লেখ্য এরা ছিলেন আসহাবে কাহফ এই নামে একটি সুরা কুরআনে আছে। (বুখারী,৮২১, সহীহ মুসলিম ২০৯৯)
বুরাইদাহ আসলামী (রাঃ) বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে মসজিদে প্রবেশ করে দেখেন এক ব্যক্তি সালাতরত অবস্থায় দোয়া করছে নিম্নের কথা দিয়ে اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِأَنِّي أَشْهَدُ أَنَّكَ أَنْتَ اللَّهُ لا إِلَهَ إِلا أَنْتَ الأَحَدُ الصَّمَدُ الَّذِي لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ ‘‘হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি,এ ওসীলায় (এদ্বারা) যে, আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি, আপনিই আল্লাহ, আপনি ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই। আপনিই একক, অমুখাপেক্ষী, যিনি জন্মদান করেননি ও জন্মগ্রহণ করেননি এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।’’ তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন-وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَقَدْ سَأَلَ اللَّهَ بِاسْمِهِ الأَعْظَمِ الَّذِي إِذَا دُعِيَ بِهِ أَجَابَ وَإِذَا سُئِلَ بِهِ أَعْطَى ‘‘যার হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ করে বলছি, নিশ্চয় এই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে তাঁর ইসমু আ’যম ধরে প্রার্থনা করেছে, যে নাম ধরে ডাকলে তিনি সাড়া দেন এবং যে নাম ধরে চাইলে তিনি প্রদান করেন।’’ (তিরমিযী,৫১৫; আবূ দাউদ,২/৭৯; ইবনে মাজাহ,২/১২৬৭ সহীহ ইবনু হিববান, ৩/১৭৪)
এখানে স্পষ্ট দেখা দেখা যাচ্ছে যে, ঈমান ও কলিমা শাহাদতের ওসীলা দিয়ে দোয়া চাওয়া হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে বিভিন্ন ভাবে এরূপ দোয়া করা যায়, যে ‘‘হে আল্লাহ, আমি গোনাহগার, আমি অমুক কর্মটি আপনার সন্তুষ্টির জন্য করেছিলাম, সেই ওসীলায় আমার প্রার্থনা কবুল করু। হে আল্লাহ, আমি গোনাহগার, আমার কোনো উল্লেখযোগ্য নেক আমল নেই যে, যার ওসীলা দিয়ে আমি আপনার পবিত্র দরবারে দোয়া চাইব। শুধুমাত্র আপনার হাবীব নবীয়ে মুসতাফা (সাঃ)-এর নামটি ঈমান নিয়ে মুখে নিয়েছি, এর ওসীলায় আমার দোয়া কবুল করুন। হে আল্লাহ, আমার কিছুই নেই, শুধুমাত্র আপনার নবীয়ে আকরাম ( সাঃ) এর সুন্নাতের মহববত টুকু হৃদয়ে আছে, সেই ওসীলায় আমাকে ক্ষমা করুন, আমার দোয়া কবুল করুন। হে আল্লাহ, আমি কিছুই আমল করতে পারিনি, তবে আপনার পথে অগ্রসর ও আমলকারী নেককার বান্দাহদেরকে আপনারই ওয়াস্তে মহববত করি, তাদের পথে চলতে চাই, আপনি সেই ওসীলায় আমার দোয়া কবুল করুন’’ ইত্যাদি। এখানে আল্লাহর নেককার বান্দাহদের আল্লাহর ওয়াস্তে মুহব্বাত করা একটি নেক আমল তাই এটাকে ওসীলা করা যায় এটা কোন ব্যাক্তির বা মানুষের ওসিলা নয়।
হাদীসে আছেأَنَّ رَجُلا ضَرِيرَ الْبَصَرِ أَتَى النَّبِيَّ (ﷺ) فَقَالَ ادْعُ اللَّهَ أَنْ يُعَافِيَنِي قَالَ إِنْ شِئْتَ دَعَوْتُ وَإِنْ شِئْتَ صَبَرْتَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ قَالَ فَادْعُهْ قَالَ فَأَمَرَهُ أَنْ يَتَوَضَّأَ فَيُحْسِنَ وُضُوءَهُ (فيحسن ركعتين) وَيَدْعُوَ بِهَذَا الدُّعَاءِ: اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ وَأَتَوَجَّهُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّكَ مُحَمَّدٍ (ﷺ) نَبِيِّ الرَّحْمَةِ، (يا محمد) إِنِّي تَوَجَّهْتُ بِكَ إِلَى رَبِّي فِي حَاجَتِي هَذِهِ لِتُقْضَى لِيَ (يا محمد إني أَتَوَجَّهُ بِكَ إلى اللهِ أَنْ يَقْضِيَ حَاجَتِيْ) (فَيُجْلِيْ لِيْ عَنْ بَصَرِي) اللَّهُمَّ فَشَفِّعْهُ فِيَّ (وشَفِّعْنِي فِيْهِ) (اللهم شَفِّعْهُ فِيَّ وَشَفِّعْنِيْ فِيْ نَفْسِيْ) ‘‘একজন অন্ধ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট আগমনে করে বলে, আমার জন্য দোয়া করুন, যেন আল্লাহ আমাকে সুস্থতা দান করেন। তিনি বলেন: তুমি যদি চাও আমি দোয়া করব, আর যদি চাও তবে সবর কর, সেটাই তোমার জন্য উত্তম। লোকটি বলে: আপনি দোয়া করুন। তখন তিনি তাকে নির্দেশ দেন, সে যেন সুন্দর করে ওযূ করে (অন্য বর্ণনায়,এবং দু রাকাত সালাত আদায় করে) এবং এই দোয়া করে: ‘‘হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি এবং আপনার দিকে মুখ ফিরাচ্ছি (মনোনিবেশ করছি) আপনার নবী মুহাম্মাদের দ্বারা, যিনি রহমতের নবী, হে মুহাম্মাদ, আমি মুখ ফিরাচ্ছি (মনোনিবেশ করছি) আপনার দ্বারা আমার প্রতিপালকের দিকে আমার এ প্রয়োজনটির বিষয়ে, যেন তা মেটানো হয়। (অন্য বর্ণনায়: যেন তিনি তা মিটিয়ে দেন, যেন তিনি আমার দৃষ্টি প্রদান করেন।) হে আল্লাহ আপনি আমার বিষয়ে তার সুপারিশ কবুল করুন (অন্য বর্ণনায়,আমার বিষয়ে তাঁর সুপারিশ কবুল করুন এবং তাঁর জন্য আমার সুপারিশ কবুল করুন। অন্য বর্ণনায়: আমার বিষয়ে তাঁর সুপারিশ কবুল করুন এবং আমার বিষয়ে আমার নিজের সুপারিশও কবুল করুন।)’’ (তিরমিযী,৫৬৯; মুসতাদরাকে হাকিম ১/৭০০ তিরমিযী বলেন: হাদীসটি হাসান সহীহ গরীব। হাকিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিসীন হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। এ হাদীসে অন্ধ লোকটি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট দোয় চেয়েছেন। তিনি দোয়া করেছেন এবং তাকে শিখিয়ে দিয়েছেন তাঁর দোয়ার ওসীলা দিয়ে মহান আল্লাহর কাছে নিজে দোয়া করতে। লোকটি সেভাবে দোয়া করেছেন। তিরমিযীর বর্ণনায় দোয়ার ফলাফল উল্লেখ করা হয় নি। তবে অন্যান্য সকল বর্ণনায় রাবী বলেন যে, দোয়া আল্লাহ কবুল করেন এবং লোকটি তার দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ ফিরে পান, যেন তিনি কখনোই অন্ধ ছিলেন না।
অন্য এক হাদীসে আছে আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেন: إِنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ كَانَ إِذَا قَحَطُوا اسْتَسْقَى بِالْعَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَقَالَ اللَّهُمَّ إِنَّا كُنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّنَا (ﷺ) فَتَسْقِينَا وَإِنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِعَمِّ نَبِيِّنَا فَاسْقِنَا قَالَ فَيُسْقَوْنَ ‘‘উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) যখন অনাবৃষ্টিতে আক্রান্ত হতেন তখন আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবকে (রাঃ) দিয়ে বৃষ্টির দোয়া করাতেন, অতঃপর বলতেন- হে আল্লাহ আমরা আমাদের নবী (সাঃ) এর ওসীলায় আপনার নিকট প্রার্থনা করতাম ফলে আপনি আমাদের বৃষ্টি দান করতেন। এখন আমরা আপনার নিকট প্রার্থনা করছি আমাদের নবী (সাঃ)-এর চাচার ওসীলায়,অতএব আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন। আনাস (রাঃ) বলেন, তখন বৃষ্টিপাত হতো। (বুখারী,১/৩৪২)।
হযরত আব্বাস (রাঃ) নিম্নের বাক্যগুলি বলে দোয়া করলে আল্লাহ তায়ালা বৃষ্টি দিতেন বলে হাদীসে আছেÑ اللهم إنه لم ينزل بلاء إلا بذنب ولم يكشف إلا بتوبة وقد توجه القوم بي إليك لمكانى من نبيك وهذه أيدينا إليك بالذنوب ونواصينا إليك بالتوبة فاسقنا الغيث ”হে আল্লাহ, পাপের কারণ ছাড়া বালা-মুসিবত নাযিল হয় না এবং তাওবা ছাড়া তা অপসারিত হয় না। আপনার নবীর সাথে আমার সম্পর্কের কারণে মানুষেরা আমার মাধ্যমে আপনার দিকে মুখ ফিরিয়েছে। এ আমাদের পাপময় হাতগুলি আপনার দিকে প্রসারিত এবং আমাদের ললাটগুলি তাওবায় আপনার নিকট সমর্পিত, অতএব আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করু।’’ (ফাতহুল বারী, ২/৪৯৭ইবনে হাজার আসকালানী ) এ হাদীসেও স্পষ্ট যে,হযরত আববাস (রাঃ) বৃষ্টির জন্য দোয়া করেছেন উমার (রাঃ) হযরত আব্বাসের (রাঃ) দোয়ার ওসীলা দিয়ে দোয়া করেছেন।এতে বুঝা যায় যে, যতদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জীবিত ছিলেন, ততদিন খরা বা অনাবৃষ্টি হলে তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে দোয়া চাইতেন এবং সে দোয়ার ওসীলায় আল্লাহ তাদের বৃষ্টি দান করতেন। তাঁর ওফাতের পরে যেহেতু আর তাঁর কাছে দোয়া চাওয়া যাচ্ছে না, সেহেতু তাঁর চাচা আব্বাসের (রাঃ) কাছে দোয়া চাচ্ছেন এবং দোয়ার ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করছেন।
কোনো ব্যক্তি, তাঁর মর্যাদা বা অধিকারের দোহাই দেয়া ঃ আল্লাহর কাছে দোয়া করার ক্ষেত্রে ‘ওসীলা’ বা দোহাই দেওয়ার আরেকটি পর্যায় হলো, কোনো ব্যক্তির, বা তাঁর মর্যাদার বা তাঁর অধিকারের দোহাই দেয়া। যেমন জীবিত বা মৃত কোনো নবী-ওলীর নাম উল্লেখ করে বলা: হে আল্লাহ অমুকের ওসীলায়, বা অমুকের মর্যাদার ওসীলায় বা অমুকের অধিকারের অসীলায় আমার দোয়া কবুল করুন। তবে এরূপ দোয়া করার বৈধতার বিষয়ে আলিমদের মধ্যে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে। অনেক আলিম এরূপ দোয়া করা বৈধ বলেছেন। তাঁরা সাধারণভাবে উপরের দুটি হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করেন। বিশেষত তাবারানী ও বাইহাকী অন্ধ ব্যক্তির হাদীসটির প্রসঙ্গে একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তাদের বর্ণনার সার-সংক্ষেপ যে, খলীফা উসমান (রাঃ)-এর সময়ে এক ব্যক্তি তাঁর দরবারে একটি প্রয়োজনে যায়। কিন্তু খলীফা তার প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না। লোকটি উসমান ইবনু হানীফের (রাঃ) নিকট গমন করে তাকে খলীফা উসমানের নিকট তার জন্য সুপারিশ করতে অনুরোধ করে। তখন উসমান ইবনু হানীফ লোকটিকে অন্ধ লোকটিকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যে দোয়াটি শিখিয়েছিলেন সে দোয়াটি শিখিয়ে দেন। লোকটি এভাবে দোয়া করার পরে খলীফা উসমান (রাঃ) তার প্রয়োজন মিটিয়ে দেন। (তাবারানী, ৯/৩০; আল-মু‘জামুস সাগীর ১/৩০৬; বাইহাকী, দালাইলুন নুবুওয়াত ৬/৩৫৪; এ বর্ণনাটির বিশুদ্ধতার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে আপত্তি ও মতপার্থক্য আছে। যেমন- (ক) এ থেকে বুঝা যায় যে, শুধু রাসূলুল্লাহ (সাঃ)এর দোয়ার ওসীলাই নয়, উপরন্তু তাঁর ইন্তেকালের পরেও তাঁর ওসীলা দিয়ে দোয়া চাওয়া বৈধ। (খ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছাড়া অন্য কোনো ফিরিশতা,নবী, সাহাবী, তাবিয়ী বা ওলী-আল্লাহর ওসীলা দিয়ে দোয়া চাওয়ার কোনো কথা কোনো হাদীসে বা সাহাবী-তাবিয়ীগণের বক্তব্যে পাওয়া যায় না। তবে এ মতের আলিমগণ সকলকেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মত ও তাঁর সাথে তুলনীয় ধরে এরূপ যে কারো নামের ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া চাওয়া জায়েয বলেছেন। (গ) কোনো কোনো আলিম কেবলমাত্র রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ব্যক্তিসত্তার ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করা জায়েয বলেছেন। অন্য কারো ওসীলা দিয়ে দোয়া চাওয়া নাজায়েয বলেছেন। তাঁদের মতে, কারো মৃত্যুর পরেও তাঁর ওসীলা দিয়ে দোয়া করা জায়েয বলার পরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বাদ দিয়ে অন্য কারো ওসীলা দিয়ে দোয়া করা তাঁর সাথে বেয়াদবী ছাড়া কিছুই নয়। (ঘ) পক্ষান্তরে অন্য অনেক আলিম কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির, তাঁর মর্যাদার বা তাঁর অধিকারের দোহাই দিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করা অবৈধ ও নাজায়েয বলে গণ্য করেছেন। তাঁরা বলেন যে, এরূপ কোনো জীবিত বা মৃত কারো ব্যক্তিসত্তার ওসীলা দিয়ে দোয়া চাওয়ার কোনোরূপ নযির কোনো সহীহ ও প্রসিদ্ধ হাদীসে বা সাহাবী-তাবিয়ীগণের মধ্যে পাওয়া যায় না। এছাড়া নবীগণ ও যাদের নাম মহান আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে জানিয়েছেন তাঁরা ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির বিষয়ে সুনিশ্চিতভাবে কখনোই বলা যায় না যে, উক্ত ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয় বা আল্লাহর কাছে তাঁর কোনো বিশেষ মর্যাদা বা অধিকার আছে। সর্বোপরি তাঁরা উপরে উল্লেখিত উমার (রাঃ) কর্তৃক আববাসের ওসীলা প্রদানকে দলীল হিসেবে পেশ করেন। যদি কারো দু‘আর ওসীলা না দিয়ে তাঁর সত্তার ওসীলা দেওয়া জায়েয হতো তবে উমার (রাঃ) ও সাহাবীগণ কখনোই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বাদ দিয়ে আববাস (রাঃ)এর ওসীলা পেশ করতেন না।
(৯) ইমাম আবূ হানীফা (রঃ)ঃ ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) ইমাম আবূ ইউসূফ (রঃ) ও ইমাম মুহাম্মাদ (রঃ) সকলেই একমত যে কারো অধিকার বা মর্যাদার দোহাই দিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া চাওয়া মাকরূহ। আল্লামা ইবনু আবিল ইয্যা হানাফী বলেন-قَالَ أَبُو حَنِيفَةَ وَصَاحِبَاهُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ : يُكْرَهُ أَنْ يَقُولَ الدَّاعِي: أَسْأَلُكَ بِحَقِّ فُلانٍ، أَوْ بِحَقِّ أَنْبِيَائِكَ وَرُسُلِكَ ، وَبِحَقِّ الْبَيْتِ الْحَرَامِ ، وَالْمَشْعَرِ الْحَرَامِ ، وَنَحْوِ ذَلِكَ ‘‘ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ও তাঁর সঙ্গীদ্বয় বলেছেন: ‘আমি অমুকের অধিকার বা আপনার নবী-রাসূলগণের অধিকার, বা বাইতুল হারামের অধিকার বা মাশআ’রুল হারামের অধিকারের দোহাই দিয়ে চাচ্ছি বা প্রার্থনা করছি’ বলে দু‘আ করা মাকরূহ।’’ (ইবনু আবিল ইয্যা, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ,পৃ. ২৩৭।) তিনি আরো বলেছেন- لا ينبغي لأحد أن يدعو الله إلا به والدعاء المأذون فيه المأمور به ما استفيد من قوله تعالى (ولله الأسماء الحسنى فادعوه بها) ... وكره قوله بحق رسلك وأنبيائك وأوليائك ‘‘আল্লাহকে তাঁর নিজের (ওসীলা) দ্বারা ছাড়া অন্য কারো (ওসীলা) দ্বারা ডাকা বা দোয়া করা কারো জন্য বৈধ নয়। (আল ফিক্বহুল আকবর)
আল্লামা আলাউদ্দীন কাসানী (রঃ)
আল্লামা আলাউদ্দীন কাসানী (রঃ) (৫৮৭ হিঃ) বলেন- وَيُكْرَهُ لِلرَّجُلِ أَنْ يَقُولَ فِي دُعَائِهِ أَسْأَلُك بِحَقِّ أَنْبِيَائِك وَرُسُلِك وَبِحَقِّ فُلانٍ لأنَّهُ لا حَقَّ لأحَدٍ عَلَى اللَّهِ...আমি আপনার নবী-রাসূলগণের অধিকারের দোহাই দিয়ে চাচ্ছি এবং অমুকের অধিকারের দোহাই দিয়ে চাচ্ছি বলে দোয়া করা মাকরূহ, কারণ মহান আল্লাহর উপরে কারো কোনো অধিকার নেই।’’(বাদাইউস সানাইয় ৫/১২৬।)
শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (রঃ) শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (রঃ) তাঁর ‘আল-বালাগুল মুবীন’ গ্রন্থে উমার (রাঃ)-এর হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন: ‘‘এই ঘটনায় প্রতীয়মান হয় যে, মৃত ব্যক্তিকে অসিলা করা শরীয়ত বিরোধী। যদি শরীয়ত সিদ্ধ হত তাহলে হযরত ওমর (রাঃ) হুযুর (সাঃ)-কে অসিলা করেই দোয়া করতেন। কারণ, মৃত বা জীবিত যে কোন ব্যক্তির চেয়েই হুযুর (সাঃ)-এর ফযীলত সীমাহীন-অনন্ত। তাই হযরত ওমর (রাঃ) এই কথা বলেন নাই যে, হে আল্লাহ, ইতি পূর্বে তো আমরা তোমার নবীকে অসীলা করিয়া দোয়া করতাম। কিন্তু এখন তিনি আমাদের মধ্যে বিদ্যমান নাই তাই আমরা তাঁহার রূহু মোবারককে অসিলা করিয়া তোমার কাছে আরযী পেশ করতেছি। তাই কোন মৃত ব্যক্তিকে অসিলা করা মোটেই বৈধ নহে।’’ ( আল-বালাগুল মুবীন, পৃষ্ঠা ৩১। আল্লাহকে বাদ দিয়ে ওসীলার কাছেই চাওয়া ওসীলা বিষয়ক চূড়ান্ত শিরক হলো ওসীলার নামে ওসীলার কাছেই দোয়া করা বা ত্রাণ,সাহায্য, বিপদমুক্তি ইত্যাদি প্রার্থনা করা। উপরে ওসীলা বলতে যা কিছু বলা হয়েছে তা হলো কারো ওসীলা দিয়ে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করা। এর বিপরীতে আরেকটি কর্ম হলো, যাকে ওসীলা বলে মনে করা হচ্ছে আল্লাহকে বাদ দিয়ে সরাসরি তাকেই ডাকা। এ বিষয়টি সুস্পষ্ট শিরক।
তাফসীরে উসমানীঃ আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী দেওবন্দী (রঃ) তাফসীরে উসমানীতে লিখেছেন- মানুষ যে ভাবে হিং¯্র প্রাণীর ভয়ে তা থেকে দুরে পালিয়ে যায় এ ভাবে নয় বরং আল্লাহর হুকুম না মানার কারণে আজাব ও গজবের ভয় অন্তরে লালন করে নেক আমলের মাধ্যমৈ তাঁল নৈকট্য, রহমত ও করুণা লাভের চেষ্টা (জেহাদ) কর নেক আমলের মাধ্যমে। আল্লাহর আজাব ও গজব এড়িয়ে নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রানান্তকর প্রচেষ্টার নাম ই হচ্ছে জেহাদ এবং এর মাধ্যমেই সফলতা নিশ্চিত। ওসীলা অর্থ হলো আল্লাহর নৈকট্য ও মিলন সন্ধান করা। তিনি বিখ্যাত মুফাস্সির কাতাদার বরাতে বলেছেনÑ আল্লাহর নৈকট্য হাসিল কর তাঁর আনুগত্য ও পসন্দনীয় আমলের মাধ্যমে। তিনি মুসলিম এর ৩৮৪ নম্বার হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন জান্নাতের একটি উচ্চতর মঞ্জিলের নাম হচ্ছে ওসীলা। কই কোথাও তো তিনি এখানে সফলতার জন্য কোন পীর ফকীর ধরার কথা বলেন নি!
মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ)
মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) তাফহীমুল কোরআনে সুরা মায়েদার ৩৫ নম্বার আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন- ওয়াবতাগু ইলাইহিল ওসীলা অর্থ এমন প্রত্যেকটি উপায় অনুসন্ধান করতে থাকো যার মাধ্যমে তোমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারো।” সুতরাং মাওলানা মওদুদীকে ওসীলা বিতর্কে জড়ানো কতটা অজ্ঞতার বহিপ্রকাশ তা আপনারাই ইনসাফের মানদন্ডে বিবেকের আদালতে বিচার করে বলুন।
শায়খ বিন বাজ (রঃ) সৌদী আরবের গ্রান্ড মুফতি ও আরাফাতের ময়দানের খত্বীব বিশ্ব বরেণ্য ইসলামী স্কলার শায় আব্দুল্লাহ বিন বাজ (রঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ওসীলা সম্পর্কে বলেছেন যে আরবে জাহেলিয়াত যুগে আল্লাহ ছাড়াও আরো অনেককে অনেকের নামে উপাসনা উৎসর্গ করে এর ওসিলায় মুক্তি কামণা করা হতো যা সুস্পষ্ট শিরক। যেমন আকাশের তারকা,গাছ-বৃক্ষ,লতাপাতা,দেব-দেবতা ইত্যাদী। আর এখন কিছু মোসলমানও আছে যারা বিভিন্ন উপায়ে ওসিলা ধরে কখনো শায়খ আব্দুল কাদীরের (আব্দুল কাদীর জিলানী) নামে কখনো কোন কোন পীর বুজুর্গের নামে শিরনী নামাজ কোরবানী উৎসর্গ বা ওসীলা করে। তিনি দীর্ঘ আলোচনার শুরুতেই বলেছেনÑالشرك على اسمه هو تشريك غير الله مع الله في العبادة، كأن يدعو الأصنام يستغيث بهم، ينذر لهم، يصلي لهم، يصوم لهم، يذبح لهم، يذبح للبدوي، يذبح للعيدروس، يذبح لفلان، يصلي لفلان، يطلب المدد من الشيخ عبد القادر، من الرسول অর্থাৎ- আল্লাহর ইবাদতের সাথে অন্যদের শরীক করার নাম ইবাদত বা ওসীলা নয়। আল্লাহ ছাড়া কারো নামে জবাই করা নামাজ আদায় করা রোজা রাখা ইত্যাদী।
আমাদের কথা ঃ বিজ্ঞপাঠকরাই ইনসাফের মানদন্ডে বিবেকের আদালতে বিচার করে বলুন এখানে কোথায় কে ওসীলা শব্দের অর্থ মর্ম পীর মুরিদী নিলেন আর মাওলানা মওদুদী এখানে কোথায় পীর মুরিদী আর তাসাউফের বিরোধিতা করলেন? অথচ আমরা ছোট বেলা থেকে এখনো শুনে আসছি যে ওসীলা অর্থ পীর ধরা মুর্শিদ ধরা যা কোরআনের এই আয়াতের এই শব্দের সম্পুর্ণ পরিপন্থি।
সমাপ্ত